সপ্তাহখানেক পরেই পবিত্র ঈদুল আজহা। কোরবানির জন্য পশু কিনতে অনেক ব্যবসায়ীই রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার হাটগুলোতে ভিড় করছেন। তারা মূলত খামারিদের কাছে গিয়ে সরাসরি দরদাম করে গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যাচ্ছে, এবার রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় খামারিদের কাছে রেকর্ড পরিমাণ কোরবানির উপযোগী পশু রয়েছে। এই বিভাগের চাহিদা মিটিয়েও এ বছর রেকর্ড ৮ লাখ ৩৪ হাজারেও বেশি পশু বিক্রি করা সম্ভব হবে। তবে পশুখাদ্যের মূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ায় লোকসান গুনতে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খামারিরা।
উত্তরবঙ্গের এই উদ্বৃত্ত পশুর ওপর ভর করে প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এ বছর প্রতিবেশী দেশ থেকে চোরাই পথে, কিংবা বৈধভাবে বিদেশ থেকেও পশু আমদানি করার প্রয়োজন নেই। কারণ রংপুর বিভাগসহ অন্যান্য জেলায় যে পরিমাণ পশু রয়েছে, তা কোরবানির জন্য যথেষ্ট, বরং উদ্বৃত্ত থাকতে পারে বলে আশাবাদী তারা।
রংপুর প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর কোরবানির জন্য রংপুর বিভাগে শুধু খামারিদের কাছেই প্রস্তুত রয়েছে ২১ লাখ ৫২ হাজার ৩১৯টি পশু। এসব প্রাণীর মধ্যে গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষ রয়েছে।
অপরদিকে রংপুর বিভাগের ৮ জেলার চাহিদা রয়েছে ১৩ লাখ ১৮ হাজার ১১৭টি পশুর। এছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ে বাড়িতে লালন-পালন করা পশুর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখের বেশি। ফলে উদ্বৃত্ত থাকবে ৯ লাখেরও বেশি পশু। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোরবানির পশুর সংখ্যার দিক থেকে রংপুর বিভাগ এখন পুরোপুরি স্বাবলম্বী। এমনকি নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এই বিভাগে ৯ লাখেরও বেশি পশু দেশের অন্য জেলার চাহিদা মেটাতে সক্ষম।
প্রাণিসম্পদ বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর গাইবান্ধা জেলাতেই কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ২৩ হাজার ৫১টি। এর বিপরীতে প্রস্তুত রয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৪২১টি পশু। কুড়িগ্রাম জেলায় ২ লাখ ১৬ হাজার ৫৩৩টি পশুর চাহিদার বিপরীতে প্রস্তুত আছে ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫১টি। নীলফামারী জেলার চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ১০৯টি, আর প্রস্তুত আছে ১ লাখ ৫২ হাজারেও বেশি পশু। পঞ্চগড় জেলায় ১ লাখ ২২ হাজার ৭৮টির চাহিদা থাকলেও পশু রয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৩১৭টি। রংপুর জেলার চাহিদা রয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার ৩৪৪টি, আর প্রস্তুত রয়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৪৮৫টি। এ সংখ্যা শুধু খামারিদের কাছে থাকা পশুর। এর বাইরে রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় বাসাবাড়িতে পালিত পশুর সংখ্যা ৫ লাখেরও বেশি বলে জানিয়েছে বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
তবে খামারিরা বলছেন, পশুখাদ্যের মূল্য গত বছরের চেয়ে এবার তিনগুণ বেড়েছে। ফলে এবার অর্থের অভাবে খামারে থাকা পশুদের প্রয়োজনীয় খাবার দিতে পারেননি তারা। এ কারণে গরু মোটা-তাজাকরণ কিংবা রিষ্ট-পুষ্ট সেভাবে করা সম্ভব হয়নি। ফলে বছরজুড়ে যে অর্থ ব্যয় করেছেন, সেভাবে পশুর মূল্য না পাওয়ার শঙ্কা করছেন খামারিরা। এতে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে গরু মোটা-তাজাকরণসহ পশু লালন-পালন করে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোকসানের সম্ভাবনাও দেখছেন তারা।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার জায়গীরহাট গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, সেখানেই দুই শতাধিক গরুর খামার রয়েছে। প্রতিটি খামারে ২৫ থেকে ১০০টি করে গরু-ছাগল রয়েছে। সবগুলোই কোরবানির জন্য মজুত করে রেখেছেন খামারিরা। খামারি রহমান মিয়া জানান, তার খামারে ৩৫টি দেশি ফ্রিজিয়ান জাতের গরু রয়েছে। গড়ে প্রতিটি গরুর দাম এক থেকে দেড় লাখ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু গোখাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার গরু মোটা তাজাকরণ সেভাবে সম্ভব হয়নি। যেভাবে গরু স্বাস্থ্যবান করা দরকার, তা শুধু গোখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে সম্ভব হয়নি। ফলে গরুর দাম যেভাবে আশা করা হয়েছিল, তা পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
একই কথা জানালেন পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা এলাকার খামারি মমতাজুর রহমান। তিনি জানান, গরু মোটা তাজাকরণ এবং পুষ্ট করতে ভুসি, খৈল, চালের গুঁড়াসহ খাদ্য প্রয়োজন। একটা গরুর পেছনে গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ টাকা ব্যয় করতে হয়। এবার গোখাদ্যের দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় প্রয়োজনীয় খাদ্য দেওয়া যায়নি। সে কারণে ভালো দাম পাওয়ার আশা কম বলে জানিয়েছেন তিনি।
রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ এলাকায় প্রায় দুই হাজারেও বেশি গরুর খামার রয়েছে। এখানকার খামারিরা জানালেন, রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে পাইকাররা আসছেন। তারা যে গরুর দাম ২ লাখ টাকা, সেরকম পুষ্ট না হওয়ার কারণে এক লাখ টাকাও বলছেন না।
খামারিরা বলেছেন, অনেক শিক্ষিত বেকার তরুণ গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। ফলে রংপুরে খামারের সংখ্যা বেড়ে এখন ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তারা কোরবানির ঈদ উপলক্ষ করে গরু-ছাগল পালন করেন। আশা করেন, ঈদের সময় তাদের খামারের সব গরু-ছাগল বিক্রি করে যে আয় হবে, তা দিয়ে সারা বছর চলবেন। কিন্তু এবার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে গোখাদ্যের দাম। তাদের অভিযোগ, খাবারের দাম কমাতে সরকারিভাবে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে এবার লাভের মুখও দেখার সম্ভাবনা নেই।
এ ব্যাপারে রংপুর ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লতিফুর রহমান মিলন বলেন, ‘পশুখাদ্যসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় রংপুর বিভাগে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক খামার বন্ধ হওয়ার পথে, আবার অনেকে টিকে আছেন রীতিমতো ধারদেনা করে।’ তিনি জানান, কোরবানি ঈদে মাংস প্রতিকেজি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে হিসাব করে গরুর দাম নির্ধারণ না করা হলে খামারিরা লোকসানের মুখে পড়বেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে রংপুর বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, রংপুর বিভাগে এবার কোরবানির পশুর চাহিদা মিটিয়েও ৮ লাখেরও বেশি পশু উদ্বৃত্ত থাকবে। ফলে কোরবানির জন্য ভারতীয় গরু, কিংবা বিদেশ থেকে গরু আমদানি করার কোনও প্রয়োজন নেই। রংপুর বিভাগ ছাড়াও রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে বিপুল সংখ্যক পশু রয়েছে—যা দিয়ে পুরো দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
এখন মানুষ মোটা-তাজা করা গরু কিনতে চায় না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘এ ধরনের পশুর চাহিদাও কমে গেছে। ফলে মাঝারি ও দেশি জাতের গরুর চাহিদা বাড়ছে।’