X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

লাঠিতে ভর করে শপথ নিতে এসেছেন দুর্ধর্ষ সেই মুক্তিযোদ্ধা

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র, সুনামগঞ্জ
১৮ ডিসেম্বর ২০২১, ২১:২৪আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২১, ২১:২৪

শত শত মানুষের ভিড়ে বাঁশের লাঠিতে ভর করে হেঁটে যাচ্ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মালু মিয়া (৮৬)। চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও এখনও স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় সুনামগঞ্জ স্টেডিয়ামে শপথ অনুষ্ঠানে এসেছেন। উদ্দেশ্য একটাই, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে না দেওয়ার শপথ নেওয়া। শপথ নিয়ে সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির পথ ধরে বাড়ি ফিরছিলেন। তাকে দেখে অবাক হয়েছেন সবাই।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে বিজয় দিবসে সবাইকে শপথ বাক্য পাঠ করান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) বিকাল সাড়ে ৪টায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা থেকে তিনি এই শপথ পাঠ করান। সুনামগঞ্জ স্টেডিয়ামে শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন পাঁচ হাজার মানুষ। সেখানে ছিলেন মালু মিয়াও।

শারীরিক অবস্থা দেখে বোঝা-ই যায় শুধু মনের জোরে শপথ অনুষ্ঠানে এসেছেন। শুনেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা শপথ বাক্য পাঠ করাবেন। বঙ্গবন্ধু ও দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার টানে শপথ অনুষ্ঠানে এসেছেন। শপথ অনুষ্ঠান শেষে যাওয়ার পথে কথা হয় মালু মিয়ার সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘দিন দিন শরীর অচল হয়ে আসছে। কদিন আর বাঁচবো। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা শপথ করাবেন। তাই তার ডাকে সাড়া দিয়েছি। জাতির পিতার ডাকে জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছি আর শেখ হাসিনার ডাকে আজ শপথ নিয়েছি, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে না দেওয়ার। আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই।’

মালু মিয়া বলেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে বদলে যায় আমার জীবনের চিত্র। কারণ আমি ছিলাম দুর্ধর্ষ ডাকাত। ডাকাত থেকে দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। এখন সবাই আমাকে মুক্তিযোদ্ধা মালু মিয়া নামেই চেনেন।’

এর আগে বীর মুক্তিযোদ্ধা মালু মিয়া বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিনিধিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তখন জানালেন, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার রঙ্গারচর গ্রামের এক সময়ের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল মালু মিয়া। মরম ডাকাতের হাতে মালু মিয়ার ডাকাতি পেশার হাতেখড়ি। একসময় মরম ডাকাতের ডানহাতে পরিণত হন। ওই সময়ে তিনি ও তার ডাকাত দল সুনামগঞ্জ শহরের বিভিন্ন দোকান ও বাসাবাড়িতে ডাকাতি করেছেন। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল মানুষ। তখনকার সরকার মালু মিয়ার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে। পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে জীবনযাপন করেছেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় ধরা পড়ে যান স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা হীরা মিয়ার হাতে। হীরা মিয়া তার জল্লাদ হতে চান। মৃত্যুর সব আয়োজন তার চোখের সামনে। মালু মিয়ার শেষ ইচ্ছা জানতে চান মুক্তিযোদ্ধা হীরা মিয়া।

বাঁশের লাঠিতে ভর করে বাড়ি যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মালু মিয়া

তখন মালু মিয়া জানান, আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করে মরতে চাই। এই কথা শুনে হীরা মিয়া হতভম্ব হয়ে যান। একটু ভেবে মালু মিয়াকে জানান, তোমার বাঁচার একটা উপায় আছে। তা হলো ভারতীয় সীমান্তবর্তী কাছার ষোলঘর এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী একটি ঘাঁটিতে গ্রেনেড মেরে ধ্বংস করে দিতে হবে। এ অবস্থায় মালু মিয়া ভাবলেন, এক মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে আরেক মৃত্যুর কছে আত্মসমর্পণ। তিনি রাজি হলেন। 

সে সময়ে ছিল প্রচণ্ড শীত। শীতে মানুষের জবুথবু অবস্থা। তীব্র শীত উপেক্ষা করে একদিন রাত ৯টার দিকে হাজামজা জলাশয়ের কচুরিপানা মাথায় দিয়ে লুঙ্গি কাচা মেরে নেমে পড়লেন ঠান্ডা পানিতে। পানিতে নামার আগ মুহূর্তে তার দুই হাতে হীরা মিয়া তুলে দেন চারটি গ্রেনেড। দুই হাত চারটি গ্রেনেড নিয়ে ওপরে হাত তুলে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটির কাছাকাছি গিয়ে ঘাঁটি লক্ষ্য করে ছুড়ে মারেন। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ। ওই ঘাঁটির সবাই শেষ। 

তবে এই কাজটি সহজ ছিল না। মালু মিয়ার জন্য এটি ছিল মৃত্যুর পথে যাত্রা। একে তো তীব্র শীত। তার ওপর এদিক-সেদিক হলেই গ্রেনেডের বিস্ফোরণ। হাত থেকে পানিতে পড়ে গ্রেনেড অকার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। 

রাত ৯টার দিকে অপারেশন শুরু হলেও শেষ হয় রাত ২টায়। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য পুকুরের পানিতে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয় সারারাত। দীর্ঘক্ষণ পানিতে থাকায় সাপ, জোঁক ও পোকামাকড় তার সারা শরীরে আঁকড়ে ধরে। শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা কমে গিয়েছিল। বিষাক্ত পোকার কামড়ে সারা শরীর ফুলে যায়। 

ফিরে এসে ডাক্তার দেখানোর পর শরীর ভালো হয়। এরপর ষোলঘরের আরেকটি যুদ্ধ। এটি ছিল সম্মুখযুদ্ধ। এই যুদ্ধে মারাত্মক আহত হন মালু মিয়া। যুদ্ধে এক পাকিস্তানি সেনাকে গুলি করে হত্যা করেন। এভাবে তিনি বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন চালান। যুদ্ধ শেষ হলে ফিরে আসেন বাড়িতে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে সেদিন দেশের টানে একজন পেশাদার ডাকাত জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। এভাবে শুরু হয়েছিল তার নতুন জীবনের জয়যাত্রা। অতীত পেছনে ফেলে নতুন করে বাঁচতে শুরু করেন। দেশ স্বাধীনের পর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের স্বীকৃতি পান মালু মিয়া।

/এএম/
সম্পর্কিত
রাষ্ট্রপতি পেলেন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ লেখা স্মার্ট এনআইডি
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সফলতায় কিছুটা দায়মুক্ত হয়েছি: মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী
চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে মুক্তিযোদ্ধাকে গাছে বেঁধে বিচারের হুমকি
সর্বশেষ খবর
তোমার গানের ওপারে
তোমার গানের ওপারে
বার্নাব্যুতে আরেকটি জাদুকরী রাতের অপেক্ষায় রিয়াল মাদ্রিদ 
চ্যাম্পিয়নস লিগবার্নাব্যুতে আরেকটি জাদুকরী রাতের অপেক্ষায় রিয়াল মাদ্রিদ 
বিএসএফের গুলিতে ২ বাংলাদেশি নিহত, নিয়ে গেছে লাশ
বিএসএফের গুলিতে ২ বাংলাদেশি নিহত, নিয়ে গেছে লাশ
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ৭ উপায়
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ৭ উপায়
সর্বাধিক পঠিত
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
ছুড়ে দেওয়া সব তির সাদরে গ্রহণ করলাম: ভাবনা
ছুড়ে দেওয়া সব তির সাদরে গ্রহণ করলাম: ভাবনা
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ