X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
একান্ত আলাপে মেজবাউর রহমান সুমন

‘মায়া বা করুণা দিয়ে কোনও শিল্প টিকে থাকে না’

কামরুল ইসলাম
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৪৭আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:১২

উত্তাল সমুদ্রে ভেসে-ডুবে ‘হাওয়া’ বানিয়েছেন মেজবাউর রহমান সুমন। প্রচলিত বাণিজ্যিক রেসিপি নয়, প্রান্তিক এক জনগোষ্ঠীর গল্প বেছে নিয়েছেন বড় পর্দায় নিজের অভিষেকের জন্য। গত ২৯ জুলাই মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি এখনও দেশজুড়ে প্রায় অর্ধশত পর্দায় প্রদর্শিত হচ্ছে। এমন অবিশ্বাস্য সাফল্যের সঙ্গে নেতিবাচক ঝড়ও মোকাবিলা করতে হয়েছে ‘হাওয়া’ টিমকে। সিনেমাটির বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ তোলা হয়েছে, বন্যপ্রাণী আইন টেনে ঠোকা হয়েছে মামলা। তবে শেষ পর্যন্ত মামলা-বিতর্ক সবকিছুর ইতি ঘটেছে। 

‘হাওয়া’র সাফল্য, বিতর্ক এবং আগামী নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের মুখোমুখি মেজবাউর রহমান সুমন-

বাংলা ট্রিবিউন: ‘হাওয়া’ দিয়ে ঝড় তোলার জন্য প্রথমত অভিনন্দন। এতটা সফলকাম হবেন সেটা কি ভেবেছিলেন? 

মেজবাউর রহমান সুমন: কোনও কাজ সাফল্য পাবে কিনা, গণমানুষের কাছে যাবে কিনা, এটা আগে থেকে কেউ জানে না। হ্যাঁ, একটা প্রত্যাশা সবারই থাকে। কিন্তু সাফল্যের ব্যাপারটা কাজের মানের ওপরই নির্ভর করে। আমি আসলে সিনেমাটি বানিয়েছি। এটা গণমানুষের কাছে পৌঁছাবে কিনা, সেই দায়িত্ব মানুষের কাছেই ছেড়ে দিয়েছি। পছন্দ করতেই হবে, এরকম কোনও দায়িত্ব নিয়ে আমি সিনেমা বানাইনি। দর্শক সিনেমাটি দেখেছে, এতে তো আমি বিস্মিত! কারণ, আমি কমার্শিয়াল ফর্মুলার বাইরে গিয়ে সিনেমা বানিয়েছি। দর্শকের পছন্দ হবে, এই ভাবনা থেকে অতিরিক্ত কিছুই যুক্ত করিনি। আমি এবং আমার টিম কেবল সততার সঙ্গে গল্পটা বলার চেষ্টা করেছি। আরেকটা কথা বলতে পারি, দর্শক পছন্দ করাতে আমি সাহস পেয়েছি যে এরকম গল্পও বলা যায়। আমার পরবর্তী সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে এটা আমাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে।  

বাংলা ট্রিবিউন: ছবির বাণিজ্যিক সফলতা আর নির্মাতার আত্মতৃপ্তি; দুটো সম্ভবত এক নয়। যদি তা-ই হয়, নির্মাতা হিসেবে আপনি কতোটা তৃপ্ত?

মেজবাউর রহমান সুমন: না, তৃপ্ত নই। কারণ, আমার স্বপ্ন তো শিল্পকর্মের ভেতরে। পরিষ্কারভাবে এক কথায় যদি বলি, সিনেমার সফলতার ভেতর দিয়ে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সফল-ব্যর্থ ব্যাপারগুলো অলৌকিক অংক। ‘হাওয়া’ যিনি পছন্দ করেছেন, তার কাছে সফল; আবার অন্য কারও কাছে এটা তো ব্যর্থ মনে হতে পারে। আমার কাছে মনে হয়েছে, ‘হাওয়া’র মাধ্যমে আমি আসলে সিনেমা বানানো শিখেছি; পরবর্তী কাজে আমি এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর চেষ্টা করবো। 

বাংলা ট্রিবিউন: ‘হাওয়া’র মূলভাব বা দর্শন কি দর্শক ধরতে পেরেছে বলে মনে করেন? 

মেজবাউর রহমান সুমন: আমি নিজেই গল্পের মধ্যে অনেক ফাঁক রেখে দিয়েছি। সিনেমাটি যেখানে শেষ হয়, সেখানে কিন্তু নির্দিষ্ট সমাপ্তি নেই। পুরো ‘হাওয়া’র মধ্যেই একটা অস্পষ্ট ভঙ্গিমা আছে। চরিত্রগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বিভেদ, সিনেমার চলন সবেতেই অস্পষ্টতা আছে। এরপরও সিনেমাটি দর্শক পছন্দ করেছে, এটা আশ্চর্যের বিষয়! আমি আসলে চেয়েছিলাম দর্শকের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হোক। আমি যে দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পটা বলেছি, সেটাই দর্শক দেখবে-বুঝবে, এটা চাইনি। তাদের ভাবনার দরজাগুলো খুলে দিতে চেয়েছি। যেমন কোনও কবি যে ভাবনা থেকে কবিতা লেখেন, নির্দিষ্ট করে সেই ভাবনা কি আমরা ভাবি? না, বরং নিজের মতো করেই একটা ভাবি। আমিও সেটাই করেছি। সিনেমাটি যদি একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবির মতো হয়, যা দেখছেন তা-ই, এর বাইরে কিছু নেই, তাহলে সেটা আমার কাছে চলচ্চিত্র না। তবে হ্যাঁ, আমি যে ভাবনা থেকে গল্পটা বলেছি, সেটা অনেকেই ধরতে পেরেছেন। বিভিন্ন লেখালেখি-পোস্টে তা বুঝতে পারছি। 

শুটিংয়ে টিম ‘হাওয়া’, ডানে মেজবাউর রহমান সুমন বাংলা ট্রিবিউন: অনেক বাধা-সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। এগুলো নিয়ে আগে থেকে কোনও শঙ্কা বা প্রস্তুতি ছিল?

মেজবাউর রহমান সুমন: আমি তো আসলে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির মানুষ না। একেবারে বাইরের লোক বলা চলে। একটা সময় কিছু টেলিভিশন ফিকশন বানিয়েছি, এখন বিজ্ঞাপন বানাই। তাছাড়া আমি সোশাল মিডিয়াতেও সক্রিয় না। তো সিনেমা অঙ্গনের এসব ব্যাপার আমার একদমই জানা ছিল না। প্রথম প্রথম বিষয়টা নিয়ে খুব অস্বস্তিতে ছিলাম। পরে ভাবলাম, যে ‘হাওয়া’ নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে, সেটা নিয়ে কিছু সমালোচনা, ঝামেলা তো আসবেই। 

বাংলা ট্রিবিউন: এই যে দেশের দর্শকরা ‘হাওয়া’র সাফল্যে ভাসছে, এর মূল কারণ কী হতে পারে বলে মনে করেন?

মেজবাউর রহমান সুমন: প্রথমেই বলবো, দর্শকের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। দর্শক এখন ফর্মুলা সিনেমা দেখতে চায় না। যে ধরনের সিনেমা বছরের পর বছর হয়ে আসছে, সেগুলোর প্রতি তাদের আগ্রহ কমে গেছে। তারা এখন নতুনত্ব চায়। আর ‘হাওয়া’র সাফল্যের ক্ষেত্রে তারুণ্যের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তারুণ্য বলতে শুধু বয়সে তরুণ, এমন না। মানসিক তারুণ্যের কথাও বলছি। নতুন কিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা সবার থাকে না। তরুণদের থাকে। তারাই ‘হাওয়া’কে প্রথমে গ্রহণ করে ফেলে। পোস্টার, ট্রেলার, গান প্রকাশের সময় থেকেই এটা টের পাচ্ছিলাম। এরপর যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি, তখন আরও প্রবলভাবে বুঝতে পেরেছি। মুক্তির পরও তরুণরাই প্রথমে সিনেমা দেখতে ছুটে এসেছে। এরপর অন্যরাও এসেছে। 

শুটিংয়ে নাজিফা তুষি, মেজবাউর রহমান সুমন, চঞ্চল চৌধুরী, শরিফুল রাজ প্রমুখ বাংলা ট্রিবিউন: হলবিমুখ দর্শকদের ফেরাতে কোন টেকনিক লাগে, সেটা নিশ্চয়ই এতদিনে জেনেছেন। কী লাগে আসলে? 

মেজবাউর রহমান সুমন: সিনেমা দিয়েই দর্শকদের হলে আনা সম্ভব। শুধু শুধু ‘বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান’- এরকম কথা বলে তাদের আসলে হলে আনা যাবে না। যেমন, একটা গান করার পর কিন্তু গায়ক বলেন না গানের পাশে দাঁড়ান; কোনও লেখক বই লেখার পর বলেন না সাহিত্যের পাশে দাঁড়ান। গানটা শোনার মতো হলে মানুষ শুনবে, বই পড়ার মতো হলে পড়বেই। সব শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। মায়া বা করুণা দিয়ে কোনও শিল্প টিকে থাকে না। 

বাংলা ট্রিবিউন: ‘হাওয়া’ মুক্তির পর পাওয়া একটা ব্যতিক্রম প্রতিক্রিয়ার কথা শুনতে চাই...

মেজবাউর রহমান সুমন: এরকম অনেক প্রতিক্রিয়া আছে। কিছু দিন আগে আমি একটা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। সেখানে একজন বয়স্ক মানুষ, আমার বাবার বয়সী হবেন, কাছে এসে জানান, তিনি ৩০-৩৫ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেন। এতদিন পর তিনি প্রেক্ষাগৃহে গেছেন এবং ‘হাওয়া’ দুইবার দেখেছেন। তাকে হলে নিয়ে গিয়েছিলেন তার মেয়ে। তিনি আমার কাছে অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন, সিনেমাটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই ব্যাপারটা আমাকে হঠাৎ মুগ্ধ করেছে। 

‘হাওয়া’ মুক্তির আগে চঞ্চল-সুমনের বৈঠক বাংলা ট্রিবিউন: হলে বসে ‘হাওয়া’ পুরোটা দেখেছেন একবারও! হলে গেলে তো হয় অতিথি সামলাতে হয়েছে, নয় তো দর্শক সেলফি!

মেজবাউর রহমান সুমন: না, এটা আমার জীবনের একটি বড় আক্ষেপ। ইচ্ছে ছিল প্রথম দিনই দর্শক সারিতে বসে ‘হাওয়া’ দেখবো। কিন্তু মুক্তির তিন দিন আগেই সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। এ কারণে প্রথম দিন দর্শকের সঙ্গে বসে পুরো সিনেমাটি দেখার সুযোগ হয়নি। এরপরে আর সেভাবে হলেই যাইনি আমি। দু’একবার গিয়েছিলাম বিশেষ কারণে। কিন্তু ১৫-২০ মিনিটের বেশি থাকা হয়নি। তবে শিগগিরই দেখার ইচ্ছে আছে। 

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার দ্বিতীয় সিনেমা নিয়ে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। সেটার নাম কী হচ্ছে? কবে নাগাদ শুরু করছেন? 

মেজবাউর রহমান সুমন: সিনেমার নাম ‘রৈদ’। এর গল্পটা আরও সহজ-সরল এবং আমার খুব কাছের। এই সিনেমা যদি মানুষ দেখে, তাহলে আমি মুগ্ধ হবো। ‘হাওয়া’ নিয়ে সারপ্রাইজড হয়েছি, পরেরবার মুগ্ধ হবো। সিনেমাটির কাস্টিং এখনও করিনি। কিছু লোকেশন ঠিক করেছি। চিত্রনাট্য প্রায় চূড়ান্ত। আগামী বছর করার চিন্তা আছে। তবে ‘হাওয়া’ থেকে বের হয়ে আরেকটা কাজে হাত দিতে একটু সময় তো লাগবে। তাছাড়া নতুন সিনেমাটির শুটিং বছরব্যাপী করা লাগবে। কারণ, এখানে আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয় আছে। 

বাংলা ট্রিবিউন: প্রথম সিনেমা মুক্তির পর যে নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো হয়েছে, যেমন নকলের অভিযোগ কিংবা শালিক মামলা। এসব অনুসারে দ্বিতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে নতুন কী পদক্ষেপ বা কৌশল নেবেন?

মেজবাউর রহমান সুমন: আমি আসলে কৌশলী মানুষ না। আর সমস্যা নিয়েও ভাবতে চাই না। আমি শুধু মন দিয়ে সিনেমাটা বানাতে চাই। প্রথম সিনেমায় যেসব ঘাটতি আমার চোখে পড়েছে, সেগুলো দ্বিতীয় সিনেমায় যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবো। ছবির প্রচারণায় টিম ‘হাওয়া’

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
কুয়াশায় ঢাকলো জয়ার ‘রইদ’, যা বললেন নির্মাতা
কুয়াশায় ঢাকলো জয়ার ‘রইদ’, যা বললেন নির্মাতা
তুষির একান্ত ফটোগ্রাফার কে এই নিরাকার
তুষির একান্ত ফটোগ্রাফার কে এই নিরাকার
পথচলার ২০ বছর উদযাপনে ‘মেঘদল’র একক কনসার্ট
পথচলার ২০ বছর উদযাপনে ‘মেঘদল’র একক কনসার্ট
‘অ্যালুমিনিয়ামের ডানা’ উন্মুক্ত করলো মেঘদল
‘অ্যালুমিনিয়ামের ডানা’ উন্মুক্ত করলো মেঘদল
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী
‘জংলি’ মিশনে সিয়ামের সঙ্গী বুবলী
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!