X
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
১৩ বছর পর কলকাতা থেকে ঢাকা

গমগমে আগমন আর নিঃশব্দ প্রস্থানে কবীর সুমন 

সুধাময় সরকার
২১ অক্টোবর ২০২২, ২২:১২আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২২, ১৬:০৪

সুমনের এই সফরটি অনেকভাবেই বিশেষ। একদিকে ১৩ বছর পর ঢাকায় তার ফেরা। অন্যদিকে এতোটা লম্বা সময় ধরে ঢাকার শ্রোতাদের আগে কখনও গান শোনাননি গানওয়ালা। ১৩ অক্টোবর ঢাকায় নেমে ১৫, ১৮ এবং ২১ তারিখে হাউজফুল শো উপহার দিলেন বাংলা গানকবিতার এই কিংবদন্তি।

গতবারের (২০০৯) মতো সুমনের এবারের সফরের শুরুটাও ছিলো তিক্ততায় ভরা, অনুমোদন মেলেনি নির্দিষ্ট ভেন্যুতে গাইবার। পরে সেটি স্থানান্তর হলো ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনের অডিটোরিয়ামে। স্থান বদলালেও কবীরের মন বদলায়নি এতোটুকু। বরং তিনদিনজুড়েই তিনি গানে আর গল্পে মন ভরিয়েছেন উপচেপড়া শ্রোতাদের। তিনটি শোতেই টিকিটের হাহাকার ছিলো ঢাকাজুড়ে। তাই তো সুমন নিজ শহর কলকাতার চেয়েও ঢের ভালোবাসেন ঢাকাকে। গানের ফাঁকে কথার গল্পে সেসব উঠে এসেছে ঘুরে ফিরে।

গমগমে আগমন আর নিঃশব্দ প্রস্থানে কবীর সুমন  ২১ অক্টোবর রাতে সুমনের এই সফরের শেষটা হলো সুমন... সুমন... কলধ্বনিতে। ঘড়ির কাঁটায় রাত ৮টা ছুঁই ছুঁই; পরিবেশন করছিলেন তুমুল জনপ্রিয় ‘তোমাকে চাই’। তার সঙ্গে স্বর মেলালো পুরো অডিটোরিয়াম। গানটি শেষ হতেই হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন সুমন। কিছু না বলেই হাতজোড় করে নিতে চাইলেন নিঃশব্দ বিদায়। দাঁড়িয়ে গেলো উপস্থিত সবাই। এভাবে, এখনই বিদায়ের জন্য উঠে দাঁড়াবেন- গানওয়ালা; সেটা সম্ভবত উপস্থিত কেউই ভাবেননি। সমস্বরে স্লোগান উঠলো, সুমন... সুমন... সুমন...। সঙ্গে করতালি। কথা বাড়ালেন না, হতে পারে এই বিদায়ে দর্শকের চেয়েও কবি নিজে আবেগতাড়িত। তাই অস্ফুট স্বরে এটুকু শুধু বললেন, ‘ভালো থাকবেন সকলে। ইনশাল্লাহ আবার দেখা হবে’। এই বলে আর দাঁড়াননি, চলে গেলেন মঞ্চের পেছনে। অথচ উপস্থিত সবার মনে রয়ে গেছে শোনার ক্ষুধা, বিদায়ের আগে আরও কিছু কথা যদি বলতেন!

গমগমে আগমন আর নিঃশব্দ প্রস্থানে কবীর সুমন  অথচ তার আগেই ‘আমি চাই’ গানটি পরিবেশনের সময় সুমন বলেছিলেন, ‘হতে পারে ঢাকায় এটা আমার শেষ গান। কেউ আমাকে আটকাবে না, শরীর আটকাবে। কারণ, শরীরটা আর টানছে না।’ সুমনের কণ্ঠে একইভাবে বিদায়ের সুর ছিলে ১৫ অক্টোবরের শোতেও। হাতের পাশে রাখা ইনহেলার দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ভয় পাবেন না, মরবো না। আমি এমন ভাগ্য করে জন্মাইনি যে, বাংলাদেশের মাটিতে মরবো।’  

গমগমে আগমন আর নিঃশব্দ প্রস্থানে কবীর সুমন  সুমনের এবারের ঢাকা সফরে গান পরিবেশনা তো ছিলোই, তবে তার চেয়েও দরকারি ছিলো তার নানাবিধ উপলব্ধি প্রকাশ। যেমন শেষ দিনের মঞ্চে বসে সুমন বেশ স্পষ্ট করেই জানালেন নিজ শহরে নিগৃহীত জীবনের কথা। জানালেন, সুমন চট্টোপাধ্যায় থেকে কবীর সুমন হওয়ার পরে তাকে নিজ দেশের মানুষ কীভাবে ঘৃণা করেছে। আমি চাই হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্র বধূ/ আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু- গানটি গাইবার ফাঁকে তিনি বললেন, ‘এই গানটা যখন করি, তখন আমি সুমন চট্টোপাধ্যায়। এরপর কবীর সুমন হই এপিডেভিট করে। মূলত তারপর থেকেই ভারতের মানুষ আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। অথচ চট্টোপাধ্যায় থাকতে কেউ আমাকে একবারও বলেনি, হিন্দু নাম নিয়ে এই গান কেন করো? ধর্মের বাইরে গিয়ে নতুন কোনও নামে গান করো। অথচ কবীর সুমন হওয়ার পর এখন ঠিকই আমাকে ঘৃণা করছে ওরা। কবীর সুমন নামটার মধ্যে কোনও ধর্মীয় টাইটেল নেই, এটা তারা বুঝলো না।’

গমগমে আগমন আর নিঃশব্দ প্রস্থানে কবীর সুমন  এরপর টানা প্রায় ১০টি গান গেয়ে শোনান সুমন। যার মধ্যে রয়েছে ‘পেটকাটি চাঁদিয়াল’, ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’, ‘তোমার জন্য লিখছি প্রেমের গান’, ‘বাঁশরীয় বাজাও তুমি’, ‘খাতা দেখে গান গেওনা’, ‘আমাদের জন্য’, ‘তুমি আসবেই আমি জানি’ এবং ‘তোমাকে চাই’ দিয়ে শেষ করলেন সুমন। এরমধ্যে বেশ গুরুত্ব দিয়ে গাইলেন ঢাকার গীতিকবি এনামুল কবির সুজনের লেখা ‘যাচ্ছে জীবন চলে’ গানটি।

এর আগে ১৮ অক্টোবর খেয়ালের আয়োজনে সুমন এ প্রজন্মের প্রতি বলেছিলেন, ‘গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করুন। এক্সপেরিমেন্ট করতে ভয় পাবেন না। গান নিয়ে ভয় পাবেন না। মনের আনন্দে গান করুন। মনের আনন্দে ভুল করুন। ভুল করে থেমে যাবেন না। আবার ভুল করুন।’

গমগমে আগমন আর নিঃশব্দ প্রস্থানে কবীর সুমন  একই আয়োজনে খেয়ালকে বাঁচাতে সুমন আবেদন জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিও। বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ছাড়া কিন্তু বাংলা খেয়ালের কোনও উপায় নেই। আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, যদ্দিন বেঁচে থাকবো, জানাবো; বাংলা খেয়ালের পাশে থাকবেন।’

খেয়ালের গুরুত্ব বোঝাতে এই শিল্পী মজা করতেও ছাড়েননি ঢাকার শ্রোতাদের সঙ্গে। বলেছিলেন, ‘ধরুন আপনারা আমার কাছে গল্প শুনতে চাইলেন, আমার তৃতীয় বিয়ের গল্প। আমি যদি সেটা সংক্ষেপে বলে ফেলি, যেমন অপর্ণার কাছে গিয়ে সোজাসুজি বললাম, চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি। আপনারা কিন্তু থামিয়ে দিয়ে বলবেন, থাক গল্প বলা লাগবে না। কারণ গল্প তো একটু রসিয়ে বলতে হবে। গল্পের ভেতরেও তো গল্প থাকে। গল্পটাকে নানানভাবে বলাই মূলত খেয়ালের কাজ।’

গমগমে আগমন আর নিঃশব্দ প্রস্থানে কবীর সুমন  এই সফরে এসে সুমনের কণ্ঠে ঘুরেফিরে উঠে এসেছে কলকাতায় তার অসহায় জীবনের সুর। সঙ্গে ঢাকার শ্রোতাদের কাছে এমন ভালোবাসার প্রতিধ্বনিও মিলেছে গানওয়ালার কণ্ঠে। সুমন বলেছেন, ‘আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে পেনশন পাই। এছাড়া কয়েকজনকে আধুনিক বাংলা গান শেখাই, তারা কিছু দেন। তাতেই আমার সংসার চলে। আমাকে এখন কেউ ডাকে না। বিনোদন শিল্পে বুড়োদের জায়গা নেই। বুড়োদের জায়গা আছে ডাক্তারি ও ওকালতিতে। তাছাড়া অনেকে আমায় পছন্দ করেন না নানা কারণে। আমি কথা দিচ্ছি, এই মঞ্চেই যদি সুযোগ হয়, আমি আবার গাইবো বিনামূল্যে।’

গমগমে আগমন আর নিঃশব্দ প্রস্থানে কবীর সুমন  এই সফরে সুমনের বিদায়ক্ষণটা যতোটা নিঃশব্দের হলো, ততোটাই মুহুর্মুহু ছিলো তার গান আর জীবনের গল্প। যে গল্পের পরতে পরতে সুমন জানিয়ে গেছেন নিজের অসহায়ত্ব, অপারগতা, প্রেম, রসিকতা আর বাঁচা-মরার গল্প। সুমনের এই গমগমে আগমন আর নিঃশব্দ প্রস্থান- ঢাকাই শ্রোতাদের মনে দাগ কেটে রবে ততোদিন, যতোদিন না তিনি ফের এসে এভাবে গান শোনাবেন- গানওয়ালার বেশে।    

প্রসঙ্গত, ১৩ বছর আগে শেষবার ঢাকায় গান শুনিয়েছিলেন সুমন। গমগমে আগমন আর নিঃশব্দ প্রস্থানে কবীর সুমন 

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

আরও: একান্ত আলাপে কবীর সুমন (এক্সক্লুসিভ)

/এমএম/
সম্পর্কিত
সুমনের গানের রেশ ধরে...
সুমনের গানের রেশ ধরে...
হাসপাতাল থেকে কবীর সুমন: চিন্তা করবেন না
হাসপাতাল থেকে কবীর সুমন: চিন্তা করবেন না
স্মৃতিকাতর গোলাম আলি, সুমনের খেয়াল
স্মরণে ওস্তাদ রশিদ খান স্মৃতিকাতর গোলাম আলি, সুমনের খেয়াল
জন্মদিনে কবীর সুমন: রাস্তায় গান গাইবো
জন্মদিনে কবীর সুমন: রাস্তায় গান গাইবো
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
মনামী: সবচেয়ে সহজ মানুষ চঞ্চলদা
মনামী: সবচেয়ে সহজ মানুষ চঞ্চলদা
এবারের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র
এবারের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র
আমি চাচ্ছিলাম না, দৃশ্যটা শেষ হোক: মেরিল স্ট্রিপ
আমি চাচ্ছিলাম না, দৃশ্যটা শেষ হোক: মেরিল স্ট্রিপ
ফুল দিয়ে বরণ, রিট দিয়ে শুরু কোন্দল!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিফুল দিয়ে বরণ, রিট দিয়ে শুরু কোন্দল!
ছয় মিনিটের অভিবাদন, নিয়ম ভাঙলেন এই নায়ক
কান উৎসব ২০২৪ছয় মিনিটের অভিবাদন, নিয়ম ভাঙলেন এই নায়ক