তিন কাহিনিকারের লেখা ফর্মুলানির্ভর, প্রচলিত এক অ্যাকশন ছবি ‘ইনসাফ’। মোশাররফ করিম, শরীফুল রাজ ও তাসনিয়া ফারিনের প্রথম অ্যাকশন ধাঁচের বাণিজ্যিক ছবি ‘ইনসাফ’। আলোচিত আইটেম গান, মারপিট, সমসাময়িক দুর্নীতির বয়ান থাকলেও শেষমেষ তেমন কিছু মনে না হওয়া এক ছবি ‘ইনসাফ’।
পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পাওয়া জিৎ অভিনীত ‘মানুষ’, ওয়েব সিরিজ ‘পয়জন’-এর পর এদেশের সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়া সঞ্জয় সমাদ্দারের প্রথম ছবি ‘ইনসাফ’। শেষদৃশ্যে চঞ্চল চৌধুরীর উপস্থিতি ও চমক দেয়া এক ছবিও ‘ইনসাফ’। কেউ সন্ত্রাসী হয়ে জন্মায় না, সমাজ বা পরিস্থিতি তাকে সন্ত্রাসী বানায়, এমন বক্তব্যের অগনিত ছবির আরেকটি ‘ইনসাফ’।
শীর্ষ সন্ত্রাসী ইউসুফকে নিয়ে এই ছবি। দেশের এককালের আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের মতো সে বেঁচে আছে নাকি নাই, এমন বিতর্ক চলছিল সর্বত্র। পাঁচ বছর আগে সিলেট যাবার পথে সে নিহত হয়েছিল এমনই জানা যায়। পুলিশের এসপি জাহান যার বাবা নিহত হয়েছিলেন বোমা হামলায় সে মনে করে ইউসুফই এই হামলার নেপথ্যে আছে। এর মধ্যে জানা যায় ইউসুফের চেহারার একজন সিলেটে আছে। সেখানে বদলি করা হয় এএসপি জাহানকে। কিন্তু ইউসুফের চেহারার যাকে পাওয়া যায় সে লাবু মাস্টার। বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখায়। তাকে তুলে আনা হয়। প্রচন্ড মারপিটের পরেও সে বলে সে লাবু মাস্টার, ইউসুফ না। তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর পুলিশ অফিসার জাহান লাবু মাস্টারের প্রেমে পড়ে। এরই মাঝে ইউসুফের পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী এসে হাজির হয় লাবু মাস্টারের স্কুলে। শুরু হয় ছবির আসল গল্প। ইউসুফ এবং লাবু মাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ। তার বাবা এএসআই এর চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু, ইউসুফের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সহযোগি আকবরের চরিত্রে মিশা সওদাগর ও হারুনর রশিদ বান্টি,ডন, এবং এএসপি জাহানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাসনিয়া ফারিন।
এই ছবিতে হঠাৎ করেই আগমন বিশ টাকার ডাক্তার খ্যাত শমসের ডাক্তার, যার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম। গল্পের শেষদৃশ্যে আছেন চঞ্চল চৌধুরী। পুলিশ অফিসার চরিত্রে অভিনয় করেছের টাইগার রবি। ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ কিংবা ‘দেয়ালের দেশ’-এ অভিনয় করে আলোচিত হয়েছিলেন শরীফুল রাজ। অ্যাকশন ছবিতেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। তাসনিয়া ফারিনকে মারপিট বা পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের দৃশ্যে ততটা সপ্রতিভ মনে হয়নি। কোপানো বা গুলি করতে করতে পর্দায় আসার দৃশ্যে মোশাররফ করিমকেও মানানসই মনে হয়নি। শরীরের চেয়ে অস্ত্র বড় মনে হয়েছে। অ্যাকশনের চেয়ে অভিনয় দিয়েই তিনি মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন।
বহুদিন পরে হাবীব ওয়াহিদকে পাওয়া গেল ‘ইনসাফ’ ছবির গানে। ‘তোমার খেয়ালে মরি তোমার বেখেয়ালে বাঁচি’ গানটি লিখেছেন তন্ময় পারভেজ। সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন আরাফাত মহসীন নিধি। ‘ইনসাফ’-এর টাইটেল ট্রাক লিখেছেন রবিউল ইসলাম জীবন, কণ্ঠ দিয়েছেন আরিফ আহমেদ জয়,সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন নাভেদ পারভেজ।
‘আকাশেতে লক্ষ তারা’-এই গানের সাথে নতুন কথা সংযোজন করেছেন সুদীপ কুমার দ্বীপ। কণ্ঠ দিয়েছেন মিলা। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন শওকত আলি ইমন।
‘ইনসাফ’ ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন নাজিম উদ দৌলা। কাহিনী লিখেছেন যৌথভাবে নাজিম উদ দৌলা, স্বরূপ দে এবং সঞ্জয় সমাদ্দার। চিত্রগ্রহণে প্রসেনজিৎ চৌধুরী। প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু এবং আবুল কালাম। পরিবেশক টাইগার মিডিয়া, নির্মিত হয়েছে অনুপমের ব্যানারে। এবার ছবির ভিন্ন কিছু দিক...তাসরিয়া ফারিনকে নিয়ে পোস্টার প্রকাশের সাথে সাথে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নকলের অভিযোগ ওঠে। কেউ কেউ কোরিয়ান ছবি ‘কিল বক্সুন’ ছবির পোস্টারও পাশাপাশি তুলে ধরেন।
মোশাররফ করিমের আগমন এই ছবিতে হঠাৎ করেই। ছবির শেষে যখন নায়ক ও ভিলেনের মারামারিই উপজীব্য, সেখানে তার আগমন ছবির গতিকে ক্ষুন্ন করেছে।
ছবির চমক অথবা সিক্যুয়েলের জন্য চঞ্চল চৌধুরীর আগমন চাপাতি দিয়ে বেহালা টাইপ বাজনা বাজানো এবং ইউসুফের সাগরেদকে মেরে ফেলার দৃশ্যও নতুন কিছু নয়। তামিল বা হিন্দি ছবিতে কয়েক বছর ধরে প্রেম ও প্রতিশোধের সাথে সাথে সমসাময়িক কিছু আলোচিত ঘটনাও জুড়ে দেয়া হয়।
‘ইনসাফ’ ছবিতে দুর্নীতি, সরকারি চাকরিতে ঘুষ বা পিওনকে টাকা দিয়ে নিয়োগ দেওয়া, সরকারি ওষুধ বাইরে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা আছে। মাথার ভেতরে তামিল বা হিন্দি ছবির গল্প ঘুরঘুর করলে বাংলাদেশি ছবিও এর বাইরে যেতে পারবে না।
তবু জয় হোক বাংলা ছবির।
ইনসাফ: ৫/১০
পরচিালক: সঞ্জয় সমাদ্দার
অভিনয়ে: শরিফুল রাজ, তাসনিয়া ফারিণ, মোশাররফ করিম
প্রযোজনা: তিতাস কথাচিত্র ও টিওটি ফিল্মস
পরিবেশক: টাইগার মিডিয়া
মুক্তি: ৭ জুন ২০২৫
সমালোচক: রম্যলেখক, সাংবাদিক ও কবি
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
আরও সমালোচনা:
‘জংলি’ ৫/১০: জন্ম না দিয়েও আদর্শ বাবা হতে পারার ছবি
‘চক্কর ৩০২’ ৭/১০: গল্পের চক্করে ভরা এক ছবি
‘দাগি’ ৭/১০: প্রায়শ্চিত্তের গ্লানি মাখা এক ছবি
‘বরবাদ’ ৫/১০: শিশুদের নিয়ে না দেখার মতো ছবি
৮৪০: রহস্যময়তার আড়ালে মজাদার এক রাজনৈতিক স্যাটায়ার
দরদ: দরদহীন নির্মাণের এক প্রশ্নবিদ্ধ ছবি!
৩৬-২৪-৩৬: সিনেমার পর্দায় ‘ওটিটি কনটেন্ট’
তুফান: সন্ত্রাসকে গ্ল্যামারাইজ করতে চাওয়া এক ছবি
ফাতিমা: সাধারণ এক নারীর ‘অসাধারণ’ সংগ্রামের ছবি
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
রাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
হুব্বা: সামথিং লাইক আ ক্রিমিনাল’স অটোবায়োগ্রাফি!
খুফিয়া: বাংলাদেশ নিয়ে ‘শঙ্কা ও ভাবনার’ ভারতীয় ছবি!
অন্তর্জাল: সাইবার থ্রিলার নিয়ে স্মার্ট ছবি
এমআর-৯: ‘মাসুদ রানা’ আছে ‘মাসুদ রানা’ নেই!
১৯৭১ সেই সব দিন: ৫৩ বছর আগের বাস্তবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা
আম কাঁঠালের ছুটি: দুরন্ত শৈশব মনে করিয়ে দেয়া এক ছবি
প্রিয়তমা: পরিচিত গল্প আর ‘তাড়াহুড়ো’য় নির্মিত ছবি!
প্রহেলিকা: ছবিটি দেখলে কিছু প্রশ্ন উঠবেই
‘পরাণ’-এর আরেক ভার্সন ‘সুড়ঙ্গ’!
সুলতানপুর: ফর্মুলায় আক্রান্ত ধারাবাহিকতাহীন ছবি
আদিম: ‘বস্তি ঘনিষ্ঠ’ এক অপরূপ ছবি!
পাপ: শেষ না হওয়া এক থ্রিলার গল্পের ছবি
কিল হিম: বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন অনন্ত, কিন্তু সেটা নড়ে না!
লিডার: স্বস্তি আর অস্বস্তির পাঁচ-ছয়
লোকাল: রাজনীতির ব্যানারে প্রেম ও প্রতিশোধের ছবি!
জ্বীন: ‘জিন ছাড়ানো’র কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছবি!