X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
তৃতীয় চোখ

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া: হাওরের অনবদ্য জীবনগাঁথা

আহসান কবির
০৭ নভেম্বর ২০২২, ০৯:৩২আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২২, ১২:১৩

শত বছর পরেও যদি কেউ জানতে চায় কেমন ছিল ভাটি বা হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবনগাঁথা, তার জন্য নির্ধারিত এক নান্দনিক ছবি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’। বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে বৈষম্য ও বঞ্চনার মাঝে বাঁচতে চাওয়া মানুষের সম্মিলিত লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি এটি।হাওরের জল-কাদায় মানুষের যে কান্না জমে থাকে, সেই কান্নার লোকজ ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের গল্প নিয়ে এই সিনেমা।

মাতৃহারা এক ছেলে যার জীবনে সৎ-মায়ের অত্যাচার ছাড়া আর কিছু নেই তার নাম সুলতান! কাজের সন্ধানে সে একদল কৃষি শ্রমিকের সাথে হাওরে পাড়ি দেয়। দু’বেলা পেটে-ভাতে খাবার পাবার বিনিময়ে সে এক বৃদ্ধের থমকে যাওয়া সংসারে ধান চাষ, গরু চরানো, দুধ দোয়ানো, মাছ ধরাসহ গেরস্থালী কাজে নিয়োজিত হয়। এই বৃদ্ধ হাওরের জলে তার পুত্রকে হারিয়েছে। মাছ ধরতে যেয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে সে মারা যায়। থেকে যায় পুত্রের স্ত্রী ও দুই সন্তান। সেই বৃদ্ধের ছেলের জায়গাটা ক্রমশ নিয়ে ফেলে সুলতান।

কিন্তু প্রকৃতির রুদ্ররূপ তখনও সুলতানের দেখার বাকি। ধানকাটা আর ঘ্রাণ পুরোপুরি পাবার আগেই পাহাড় থেকে নেমে আসা জলে ডুবে যায় সুলতানের ধানক্ষেত। নিদানের কালে খাবার মেলে না বৃদ্ধের পরিবারে। এর মাঝে একদিন বৃদ্ধের ছোট নাতিটা তার বাবার মতো পানিতে পড়ে মারা যায়। সুলতান নিদানের কালে নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করে চলে যেতে চাইলে বড় মেয়েটা তার কাপড়-চোপড় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেই হাওরে হারিয়ে যেতে চায়। সুলতান ও বৃদ্ধের পুত্রবধূ বড় মেয়েকে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু এক সিনেমাটিক ঘটনা ঘটে। সুলতান বৃদ্ধের পুত্রবধূর হাত ছাড়ে না। সুলতান বিয়ে করে বৃদ্ধের পুত্রবধূকে।

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া নতুন স্বপ্ন দেখে তারা। ঋণ নিয়ে বেশি জমিতে ধান চাষ করে সুলতান। কিন্তু কপাল তার স্বপ্নের সমান হয় না। ধান পাকার আগেই ডুবে যায়। পুরো হাওরজুড়ে নেমে আসে কান্না আর কবর নীরবতা। এরপর বেঁচে থাকার প্রয়োজনে একই সাথে ঋণের ভয় আর নতুন কাজের সন্ধানে হাওর ছাড়ে সুলতান, সঙ্গে তার স্ত্রী ও কন্যা রুকু। জীবনযুদ্ধে জড়াতে কিংবা সৎ-মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য সুলতান এসেছিল হাওরে। হাওরের ঘ্রাণ পুরোপুরি নেয়ার আগেই তাকে চলে যেতে হয় নতুন জীবিকার সন্ধানে!

এই ছবির সবচেয়ে বড় দিক জীবন ঘনিষ্ঠতা। এদেশের আর কোনও ছবিতে এত বিশাল ক্যানভাসে চিত্রধারণের কাজ হয়নি বলা যায়। হাওরের জীবনের সবটা যেমন ছবিতে আছে, তেমনি জল, ঋতুচক্র, ঝড়, জলের মাতম, বাঁধ ভাঙন, বিয়ের আনন্দ, অভাব আর জীবনের অনিশ্চয়তা যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তাতে এটা বাংলাদেশের একটা মাইলফলক ছবি হিসেবেই থেকে যাবে।

প্রায় অপরিচিত এই ছবির পরিচালক। যার নাম মুহাম্মদ কাইউম। জীবনে প্রিয়তম মানুষকে হারিয়ে একবার বাসা ছেড়েছিলেন, অজানাতে যাবেন অভিপ্রায়ে বাসে চেপে বসেছিলেন। বাস নিয়ে গিয়েছিল সুনামগঞ্জ। টাঙ্গুয়ার হাওর মন কেড়েছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হাওরের জীবনগাঁথা নিয়ে ছবি বানাবেন। এরপর অসংখ্যবার হাওরে গিয়েছেন, আবহাওয়া, ঋতুচক্র আর মানুষের জীবনযাপন মিলিয়ে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। যেখানে সিনেমা আছে, জীবন আছে কিন্তু কোনও মেদ নেই। রচনা ও পরিচালনার মতো এই ছবির প্রযোজকও তিনি। সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য হয়তো বাণিজ্য নয়, তাই মুক্তি দিতে যেয়ে হল জটিলতায় পড়েছেন প্রথমেই। তাও যে একটিমাত্র হলে মুক্তি পেয়েছে, গল্পের বিরূপ পরিবেশের মতো শোটাইমও বিরূপ সময়ে মিলেছে। জানি না এই ছবি দর্শক পাবে কিনা। 

কাইউম সাহেবের মতো স্যালুট পেতে পারেন এই ছবির চিত্রগ্রাহক মাজাহারুল রাজু। বিশাল ক্যানভাসে তার ক্যামেরা জীবনের গল্প বুনেছে।
 
ভালো অভিনয় করেছেন এই ছবির শিল্পীরা। জয়িতা মহলানবিশ, উজ্জ্বল কবির হিমু, সুমি ইসলাম, সামিয়া আক্তার বৃষ্টি, বাদল শহীদ, মাহমুদ আলম ও আবুল কালাম আজাদ নিজ নিজ চরিত্রে ছিলেন উজ্জ্বল। পুত্রবধূ জয়িতা, সুলতান চরিত্রে হিমু আর রুকু চরিত্রে বৃষ্টি ছিলেন অনবদ্য।

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া লোকজ ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সুরও আছে এই ছবিতে। সংগীত পরিচালক ছিলেন সাত্যকী ব্যানার্জি। সিলেট অঞ্চলের গান ও সুর ব্যবহার করা হয়েছে সুন্দরভাবে। স্বামী হারা জয়িতার কান্নার সাথে জলের মাতম আর পরিচিত গান- ‘আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি’ হৃদয়কে নাড়া দেয়। জয়িতা ও হিমুর বিয়ের দৃশ্যে রাধারমনের গানটাও দারুণ মুন্সিয়ানায় ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রকৃতির বৈরিতার বিপরীতে হাওরের মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের নান্দনিক এক ছবি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’। যা বাংলাদেশকেই উপস্থাপন করবে বড় বড় ছবির আসরে।

জয় হোক বাংলা ছবির।

লেখক: সাংবাদিক, সমালোচক ও রম্যলেখক

/এমএম/
সম্পর্কিত
ওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
সিনেমা সমালোচনাওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
রাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
সিনেমা সমালোচনারাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
সিনেমা সমালোচনাকাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
হুব্বা: সামথিং লাইক আ ক্রিমিনাল’স অটোবায়োগ্রাফি!
সিনেমা সমালোচনাহুব্বা: সামথিং লাইক আ ক্রিমিনাল’স অটোবায়োগ্রাফি!
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
১৬ বছর পর জেনস সুমনের ফেরা (ভিডিও)
১৬ বছর পর জেনস সুমনের ফেরা (ভিডিও)
মা হারালেন বেবী নাজনীন
মা হারালেন বেবী নাজনীন