X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১
বিজয় দিবস বিশেষ

কণ্ঠযোদ্ধার কণ্ঠে বিজয়ের সুখস্মৃতি আর আক্ষেপের বাস্তবতা

আবিদ হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:০৭আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:১৪

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হঠাৎ করেই ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হামলে পড়ে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের উচিত জবাব দেওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায় আপামর বাঙালি। রণাঙ্গনে যুদ্ধের পাশাপাশি চলে কূটনৈতিক আর সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। রণক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মনে তথ্য, সাহস ও শক্তি সঞ্চার করতে কলকাতা থেকে পরিচালিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। যাকে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি সেক্টর হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। সেখানে বাংলাদেশের অসংখ্য শিল্পী-কুশলীর মাধ্যমে তৈরি ও প্রচার হয় নাটক, গান, সংবাদ। যে কণ্ঠগুলো রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সাহস জোগাতো, পথ দেখাতো। সেই ঐতিহাসিক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি সংবাদ পাঠ করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ।

মহান বিজয় দিবসে (১৬ ডিসেম্বর) বাংলা ট্রিবিউন মুখোমুখি হয় এই কণ্ঠযোদ্ধার। জানার চেষ্টা হয় ১৯৭১ সালের এই দিনের অমূল্য স্মৃতিটুকু। কথা প্রসঙ্গে স্মৃতিকাতর ড. নাসরীন আহমাদ মন খুলে বলেন আরও অনেক কথা। জানান বিজয়ের স্মৃতি আর আক্ষেপের বাস্তবতা।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ খানিক পেছনে যান। বলেন, ‘‘১৪-১৫ ডিসেম্বর থেকে আমরা বুঝতে পারছিলাম যুদ্ধটা আমাদের দিকে চলে এসেছে। মানে পাকিস্তানিরা হেরে যাচ্ছে, আমরা জিতে যাচ্ছি। আর সে বিষয়টাকে নিয়ে আমাদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রোজকার প্রোগ্রাম রোজই পরিকল্পনা ও রেকর্ডিং হতো। সে অনুযায়ী ১৪-১৫ তারিখ থেকে আমরা বেতারের মাধ্যমে জেনারেল নিয়াজিকে বলছিলাম, ‘তুমি সারেন্ডার করো’, ‘তোমার কোনও উপায় নেই। চারপাশ দিয়ে আমরা তোমাদের ঘিরে রেখেছি’। নিউজের মধ্যে আমরা এ জাতীয় কথাগুলো তাদের বলছিলাম। আমরা শুধু নিউজেই বলছিলাম না, অনলাইনে যে লাইনারের মাধ্যমে কথা বলা হতো, সেটির মাধ্যমেও আমরা তাদের কথাগুলো বলছিলাম, যেন তারা আমাদের শক্ত অবস্থানটা টের পায়। একইভাবে এই বার্তার মাধ্যমে রণাঙ্গনের যোদ্ধারাও উৎসাহ পান। এটা ১৪ ডিসেম্বর থেকেই করছিলাম আমরা। তবে তখন তো আর এটা জানতাম না, ১৬ ডিসেম্বর অন্যরকম একটা দিন আসবে আমাদের জীবনে।’’

অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ অবশেষে এলো সেই বিজয়ের দিন। ১৬ ডিসেম্বর বিকালে ঢাকায় বিজয়ের হাওয়া বইলেও, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিল অন্যরকম উত্তেজনা। কারণ আগের রেকর্ডকৃত ও পরিকল্পনার প্রায় সব প্রোগ্রাম বাদ দিয়ে নতুন অনুষ্ঠান প্রচারের তাড়া ছিল বেতারযোদ্ধাদের ভেতর। সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্মৃতিকাতর এই সংবাদযোদ্ধা বলেন, ‘‘১৬ তারিখ সকাল ১০টার দিকে আমরা স্বাভাবিক নিয়মের দিনের সকল প্রোগ্রামের শিডিউল ঠিক করে ফেলেছিলাম। তারপর দুপুর দুইটা-আড়াইটার দিকে আমরা জানলাম আজ সারেন্ডার হবে! কখন হবে ঠিক জানি না, তবে আমরা জানতে পারলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়াজি সারেন্ডার করবে। তখন আমাদের যে আগের শিডিউল প্রোগ্রাম, সেগুলো সব বাদ হয়ে গেল। বিকালের জন্য নতুন প্রোগ্রাম রেকর্ড করতে হলো। মনে পড়ে, যখন সারেন্ডারের খবর পেলাম এবং অনুষ্ঠান সব বদলাতে হবে শুনলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে সবাই বসে গেলাম। বসেই আমাদের শহিদুল ইসলাম একটা গান লিখলেন, সঙ্গে সঙ্গে সুজেয় শ্যাম সুর করলেন এবং অজিত রায় সেটি কণ্ঠে তুলে নিলেন। সেই ঐতিহাসিক গানটি ছিল, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই, বাংলার ঘরে ঘরে’। এই গানটি সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় প্রচার হয়েছিল। সেদিনের বড় ঘটনার মধ্যে এটুকু স্পষ্ট মনে আছে।’’

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই যোদ্ধা কথায় কথায় আরেকটি তথ্য দেন। জানান, ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দ শুধু বাংলাদেশেই নামেনি, তারই প্রতিচ্ছবি হিসেবে এদিন সন্ধ্যায় আলোয় ভেসেছিল শহর কলকাতাও। তার ভাষায়, ‘কলকাতা ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট ছিল। কিন্তু সেদিন (১৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা বাজতে না বাজতেই পুরো শহর আলোয় ঝলমল করে উঠলো! চেয়ে দেখলাম, চারদিকে আর কোনও অন্ধকার নেই, সব আলোকিত। সেখানে আমরা যারা বাংলাদেশি ছিলাম, তাদের মধ্যে উত্তেজনা তো ছিলই। কলকাতার স্থানীয়রাও একে অপরকে অভিনন্দন জানাচ্ছিল। সবার মুখে স্লোগান ছিল- জয় বাংলা। একটা হই-হই উৎসবের ব্যাপার ছিল সেই রাতে।’

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ-পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সদস্যদের নানা ব্যস্ততার মধ্যে কাটতো! কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরদিন থেকে পুরো পরিস্থিতি বদলে গেল। সেই পরিস্থিতিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে অভিমত জানালেন অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ।

এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘স্বাধীনতার পরের দিন একটা অ্যাবনরমাল ভাব চলে আসে। এতদিন যে পরিস্থিতি যে পরিবেশে চলছিলাম, পরদিন (১৭ ডিসেম্বর) সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো- যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলো! এটা মনে রাখতে হবে, নয় মাসের যুদ্ধ খুব অল্প সময়ের একটা যুদ্ধ। আমরা বছরের পর বছর নিজেদের একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর আমাদের অনেকের কাছেই মনে হয়েছিল, কী ব্যাপার স্বাধীন হয়ে গেলাম! যুদ্ধ শেষ! আমরা স্বাধীন!’

স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে এই যোদ্ধার মনে তৈরি হলো কিছু আক্ষেপ। তিনি মনে করেন, ‘‘যে উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম সেটি প্রথম হোঁচট খেয়েছে ১৯৭৫ সালে, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার মধ্য দিয়ে। আমাদের তখন মনে হয়েছে, যার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, তাকেই তো হারিয়ে ফেললাম। তারপর যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বলে আমরা যুদ্ধ করতাম, যেটি ছিল আমাদের রণধ্বনি; সেটি উচ্চারণ করতে পারিনি ২১ বছর। বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত আমরা উচ্চারণ করতে পারিনি, একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলাম তখন।’’

‘তারপরও আমরা ৫২ বছরে এগিয়েছি। গত ১৫ বছর আমরা কিছুটা থিতু হয়েছি। তারপরও আমরা সেভাবে এগোইনি। চারদিকে এত অবকাঠামো উন্নয়ন, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ইত্যাদি অনেক উন্নয়ন। কিন্তু আমরা যেই বাঙালিয়ানার জন্য যুদ্ধ করেছি, সেই বাঙালি এখন দেখছি না। এগুলো সত্যিই আমাকে অনেক কষ্ট দেয়।’ হতাশা নিয়ে যোগ করলেন এই কণ্ঠযোদ্ধা।

অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ এই শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের ব্যর্থ প্রজন্ম বলে দাবি করেন। মনে করেন, পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখাতে পারেননি তারা। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। ড. নাসরীন আহমাদ বলেন, ‘একাত্তরের প্রজন্মের গর্ব করার বিষয় হলো- তারা একাত্তরের প্রজন্ম। কিন্তু কথা হলো, তারাও কি তাদের ঠিকমতো চালাতে পেরেছে এ পর্যন্ত? কারণ, এখনও আমরা নানাভাবে সুবিধা নেওয়ার চিন্তা করি। কিন্তু আমাদেরও যে একটা দায়িত্ব রয়েছে সেটা নিয়ে ভাবি না। এবং এখানটায় আমার কথা হচ্ছে, আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, তারা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা আমাদের প্রজন্মকে ঠিকমতো গড়ে তুলতে পারিনি, পথটা দেখাতে পারিনি। যার জন্য এত বছর ধরে এখনও আমরা ঠিক সোজা পথে চলছি না।’

/এমএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
১৬ ডিসেম্বর সকালেও আত্মসমর্পণের বিষয়ে গড়িমসি ছিল!
১৬ ডিসেম্বর সকালেও আত্মসমর্পণের বিষয়ে গড়িমসি ছিল!
বিজয় দিবস উদযাপনে রাজধানী সেজেছে রঙিন আলোয়
বিজয় দিবস উদযাপনে রাজধানী সেজেছে রঙিন আলোয়
বিচার অস্বীকার করে খুনি মুঈনউদ্দিনের ধৃষ্টতা
বিচার অস্বীকার করে খুনি মুঈনউদ্দিনের ধৃষ্টতা
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র’, এক অজানা ইতিহাস
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র’, এক অজানা ইতিহাস
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!