বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেই শুধু বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার নেই, রয়েছে অভিনয়েও। মঞ্চ-টিভি নাটক হয়ে সিনেমা আর ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যিনি অভিনয়ের দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন তিন দশক ধরে। বিশ্বকাপ সামনে রেখে তার অভিনয় জীবনের গল্প ছাপিয়ে বাংলা ট্রিবিউন-এর বিশেষ আয়োজনে কথা হলো ক্রিকেটজীবন নিয়ে।
প্রিয় খেলা
অবশ্যই ক্রিকেট। তবে গ্রামের ছেলে হিসেবে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, ডাংগুলিসহ যা যা খেলা আছে কম-বেশি সবই খেলেছি। তবে এখন ক্রিকেটটা সবচেয়ে বেশি দেখা হয়। যদিও কাজের ব্যস্ততার কারণে সব ম্যাচ সব সিরিজ দেখা হয় না। বাট খোঁজ খবরটা সবসময় রাখি। এখন সুবিধা হচ্ছে আমার ছেলে আবার ক্রিকেট পাগল। ও সব ম্যাচ দেখে। এবং আমাকে টাইম টু টাইম সব তথ্য জানায়। বলা যায়, এই ব্যস্ত সময়েও আমি পুত্রের সুবাদে খেলার আপডেটগুলো পাই নিয়মিত। যেমন এশিয়া কাপের বেশিরভাগ খেলাই দেখতে পারিনি। কিন্তু সব তথ্য পুত্রের কাছ থেকে পেয়েছি।
ক্রিকেট দেখা
খেলা তো খেলাই। এটা দেখার কারণ তো বিনোদন। তবে ক্রিকেট খেলায় অনেক একসাইটমেন্ট আছে। টেস্ট ক্রিকেট আমার দেখা হয় না। এটা অনেক ধৈর্যের বিষয়। তবে ওয়ানডে ও টি টোয়েন্টি দেখি মজা করে। আমার সবচেয়ে ভালো লাগে ৫০ ওভারের ওয়ানডে ম্যাচগুলো। আমার মনে হয়, এই খেলার প্রতি বলে বলে উত্তেজনা আছে। আমার কাছে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার খেলা। এজন্যই এই খেলাটা দেখে উপভোগ করি।
খেলার অভিজ্ঞতা
খেলেছি। সবই খেলেছি। ছোটবেলায় তো অতো জনপ্রিয়তা ছিলো না ক্রিকেট। তখন ফুটবলটাই বেশি খেলা হতো। আর ক্রিকেট খেলতাম টেনিস বল নিয়ে, নারকেলের গোদা (ডালের মোটা অংশ) দিয়ে ব্যাট বানিয়ে। এখন প্রশ্ন আসে আমি বোলার না ব্যাটার। আমরা আসলে দুইটাই করতাম। তখন তো ক্রিকেটার মানে সবাই সব। আর এতো জানতামও না খেলাটা সম্পর্কে। অনেক পরে জানতে পারলাম ক্রিকেটে বোলার আলাদা ব্যাটার আলাদা। আবার সাকিবের মতো কেউ কেউ থাকেন অলরাউন্ডার। তবে আমি মনে হয় মিডিয়াম পেস বোলিংটা ভালো করতাম। এটা পরে বুঝেছি অবশ্য। বলছি ৮০ থেকে ৯০ দশকের কথা। যখন স্কুলে পড়তাম। তখন বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হতো না। তবে ফুটবল খেলছি অনেক, হায়ারে গিয়ে।
বাংলাদেশের বাইরে
দেশের বাইরে এখন আমার প্রথম পছন্দের দল ইন্ডিয়া। আগে ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্রায়ান লারার আমলে। তখন অবশ্য শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান- সব দলই পছন্দ করতাম। আমি আসলে খেলাটা এনজয় করতাম। যারা ভালো খেলতো সবাইকেই পছন্দ করতাম। বাংলাদেশ তখন অতোটা এগোয়নি ক্রিকেটে। এখন তো আমাদের দলেই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার আছে।
পছন্দের খেলোয়াড়
ব্রায়ান লারা, শচীন টেন্ডুলকার, জয় সুরিয়া, ডি সিলভা, কোর্টনি ওয়ালস, মুরালি ধরন, ওয়াকার ইউনুস, ওয়াসিম আকরাম, সেন ওয়ার্ন, গ্ল্যান ম্যাগ্রা, শোয়েব আক্তার, শহিদ আফ্রিদি। আহা কতো তারকা প্লেয়ার ছিলো তখন। সেই উত্তেজনা এখন আর আছে বলে মনে হয় না। তখন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানে তো পুরো বিশ্ব কাঁপতো। পুরো শহর থেমে যেতো।
মাঠে দেখা
মাঠে গিয়ে প্রথম দেখেছি ভারত-অস্ট্রেলিয়ার একটি ম্যাচ। সৌরভ গাঙ্গুলি ক্যাপ্টেন ছিলো। শচীন ও গাঙ্গুলী নামতো একসঙ্গে। মিনি বিশ্বকাপ সম্ভবত। ঢাকা মিরপুরে। কত সালে মনে নাই এখন।
ক্যাপ্টেন সাকিব
সত্যি বলতে এখন খেলা আমি দেখতে পারি না। শুধুমাত্র বাংলাদেশের জেতা ও হারার খবরটা রাখি। বা ছেলের কাছে যখন শুনি বাংলাদেশ জিতবে এই ম্যাচটা, তখন দেখার চেষ্টা করি। আমি একটা জিনিস মনে করি, সাকিব আল হাসান একজন যোগ্য খেলোয়াড় ও ক্যাপ্টেন। এতে কোনও সন্দেহ নাই। তার নেতৃত্বে এবার আমরা ভালো করবো, সেই বিশ্বাস আমি রাখতে চাই। তবে কথা আছে। আমি চাই না দলনেতার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেন সাকিব তার অলরাউন্ডার পারফরমেন্সে ঘাটতি ঘটনায়। এটা আগেও অনেক ক্যাপ্টেনের বেলায় দেখেছি, দলকে গুছাতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। তাই সাকিবের প্রতি আমার অনুরোধ, ক্যাপটেন্সি করার সঙ্গে যেন মাথা ঠাণ্ডা করে নিজের সেরা খেলাটাও সে খেলে। কারণ এটা অনেক বড় দায়িত্ব। এর বাইরে দলের মধ্যে বাকি যারা আছেন, তাদের প্রতিও আমার আস্থা আছে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গায় যদি পারফর্ম করে তাহলে অনেক ভালো ফলাফল আসবে এবার।
বাংলাদেশ টিম
এখন বাংলাদেশের যে অবস্থান, হয়তো কনটিনিউ জয় থাকে না। বা আমরা যে প্রত্যাশা করি, সেটা পূরণ হয় না। সবচেয়ে বড় বিষয়, আমরা জেতা ম্যাচ হেরে যাই সহজে। আর হারা ম্যাচও জিতে যাই! এর মানে হলো, ধারাবাহিকতাটা আমরা কেন জানি এখনও রক্ষা করতে পারছিনা। আমি জানি, খেলায় হার-জিৎ থাকবেই। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হারার মধ্যেও তো একটা স্বস্তি থাকে। সেটা পাই না এখন। আমার মনে হয় আমাদের কনফিডেন্স লেভেলটা বাড়ানো দরকার। অন্তত এশিয়া কাপের পারফরমেন্স দেখে আমার তাই মনে হলো।
বিশ্বকাপ কার
প্রথমত যারা সবচেয়ে ভালো খেলবে, তাদের ঘরেই যাবে। তবে শেষ এশিয়া কাপ দেখে যা মনে হলো, পাকিস্তান বেশ ভালো দল। ভারত খুবই ফর্মে আছে। আসলে এখনও অনেক সময় বাকি আছে। সব দলই তাদের সেরা প্রস্তুতির মধ্যে আছে। এরমধ্যে সবাই গুছিয়ে নেবে। তবে অবশ্যই চাই বাংলাদেশ ভালো কিছু করুক। কারণ আগেই বলেছি, মিরাকলি বাংলাদেশ যে কোনও কিছু করতে পারে। ফলে কাপটা বাংলাদেশের ঘরেও আসতে পারে, এই স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি!
তারকার পার্থক্য
আমরা হচ্ছি শুধু বাংলাদেশের তারকা। আমাদের চেনা-জানা সব বাংলাদেশের মানুষের ভেতর। আর ক্রিকেটাররা ইন্টারন্যাশনাল তারকা। ওরা আসলে গ্লোবাল স্টার। আমরা হয়তো জাতীয়ভাবে আছি। যেমন একজন অভিনেতা যদি ৮০/৯০ বছর পর্যন্ত অভিনয় করতে পারেন ঠিকঠাক, তাহলে তিনি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। কিন্তু ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে সেটা খুবই কঠিন। তারা খুব অল্প সময় পায় নিজেদের প্রমাণ করার জন্য। দল থেকে বাদ পড়লে আমরা তাদের ভুলে যাই। তবে গ্লোবালি খেলোয়াড়দের প্রাপ্তিটা বেশি। প্রফেশনালিও যদি চিন্তা করি- অর্থনৈতিক হিসাবেও তারা অনেক এগিয়ে থাকে। তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বাসেডর হলে বা বিজ্ঞাপন করলে যে পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারেন, সেটা আমরা পাই না। আসলে দুটো মাধ্যমেই কিছু পার্থক্য বা সুবিধা-অসুবিধা আছে।
তবে দিনশেষে আমরা ওদের জন্য ওরাও আমাদের জন্য। আমার ‘আয়নাবাজি’ ছবি ক্রিকেটাররা দলবেঁধে দেখেছে। আবার আমি মাশরাফি, মুশফিক, তামিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদদের অসম্ভব ফ্যান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওদের সঙ্গে দেখা হলে যে আন্তরিকতা পাই বা আড্ডাবাজি করি, সেটা অনেক আন্তরিক।
অম্লমধুর ঘটনা
ক্রিকেট নিয়ে আমার জীবনে মজার ও কষ্টের দুটো ঘটনা আছে। দুটোই একসঙ্গে বলি। খেলা দেখতে দেখতে একটা সময় আমি ও আমার আশেপাশের মানুষরা আবিষ্কার করলো, টিভির সামনে বসে আমি যে দলকে সাপোর্ট করি সেটাই হারে! এটা মোটামুটি প্রমাণিত। এজন্য আমি সাধারণত পছন্দের দলের খেলা হলে টেলিভিশনের সামনে বসি না। এমনটা আমার ইউনিভার্সিটি লাইফে অসংখ্যবার হয়েছে। দেখা গেলো ক্লাস মিস করে সারাদিন বসে আছি টিভির সামনে, বিকালে দেখি আমার পক্ষের দল হারছে! তখন খুব আফসোস হতো, ক্লাস বাদ দিয়ে কেন খেলা দেখলাম। তাই আমি কখনোই পছন্দের টিমের পুরা খেলা দেখি না। তবে সারাক্ষণ এদিক ওদিক থেকে খবরটা নেই, কী অবস্থা। বাংলাদেশের খেলা হলে এখন তাই করি। তবে যখন জয়টা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারি, তখন টিভি খুলে আরাম করে বসি। তো এটা আমার জীবনে একটা অম্লমধুর ঘটনা।
ক্রিকেটার বন্ধু
আমার ক্রিকেটার বন্ধু কে? সেভাবে ভাবিনি কখনও। তবে এই প্রশ্নটা শুনেই আমার মাথায় এলো মাশরাফির নাম। আমার মনে হয়েছে ক্রিকেটারদের মধ্যে মাশরাফিই আমার সবচেয়ে কাছের। দেখা হলেই জড়িয়ে ধরে। ভাই ভাই বলে ছুটে আসে। যতবার ওর সঙ্গে দেখা হয় আমার বুকটা ভরে ওঠে ওর আচরণে। একেবারে দিলখোলা একজন মানুষ। শেষ ওর সঙ্গে হুট করেই দেখা হয়েছিলো কয়েকদিন আগে এয়ারপোর্টে। সেদিনও ভাই ভাই বলে ছুটে আসলো। অনেক মজার একজন মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা মাশরাফি মানুষকে ভালোবাসতে জানে, সম্মান দিতে জানে। আর বাংলাদেশের দলের হয়ে তার লিডারশিপ বা পারফরমেন্সের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই।