X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১
বুসান ডায়েরি-১

আড়াই ঘণ্টার ট্রেনের টিকিট ৬০ হাজার!

জনি হক, বুসান (দক্ষিণ কোরিয়া) থেকে
জনি হক, বুসান (দক্ষিণ কোরিয়া) থেকে
০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১০:১৬আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৪৮

কান চলচ্চিত্র উৎসব ছাড়া দেশের বাইরে সিনেমা নিয়ে দুনিয়ার আর কোনও আয়োজন দেখার অভিজ্ঞতা নেই আমার। সেক্ষেত্রে বুসান যাত্রা পুরোপুরি নতুন মাত্রার হবে জানা ছিল। কিন্তু পয়লা দিনেই যে বিদেশে আমার বিগত সব অভিজ্ঞতা ছাড়িয়ে যাবে বুঝতে পারিনি! সেই বিচিত্র গল্পে যাওয়ার আগে যাত্রার সূত্রপাত লেখা দরকার।

বুসান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ২৮তম আসর বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতিযোগিতামূলক দুই বিভাগ জিসোক এবং নিউ কারেন্টসে বাংলাদেশের তিনটি সিনেমা নির্বাচিত হয়েছে। এমনটি কবে আর কোন উৎসবে দেখা গেছে আমার জানা নেই। সেজন্য বুসান সফরের ইচ্ছে হলো খুব। কিন্তু টাকা-পয়সার কথা ভাবলে আগ্রহ দমে যায়। সংবাদকর্মী পার্থ সনজয় তুমুল উৎসাহ দিলেন। মূলত তার পীড়াপীড়িতে শেষমেষ মনে মনে প্রস্তুত থাকলাম। তবুও মনে হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত যাওয়া হবে না। কিন্তু পার্থদা যেন নাছোড়বান্দা! ওদিকে চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বুসানের স্বাদ নিতে উদ্বুদ্ধ করলেন। তার উদ্দীপনা দেখে পার্থদা একরকম অপ্রতিরোধ্যই হয়ে উঠলেন। আমাকে তিনি সফরসঙ্গী করবেনই! আমাদের সঙ্গে আছে পার্থদার ক্যামেরাসঙ্গী নজরুল ইসলাম রনি।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসে শুক্রবার (৭ অক্টোবর) দিবাগত রাত ১২টা ৫০ মিনিটে ফ্লাইট। একই উড়োজাহাজের বিজনেস ক্লাসে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, নুসরাত ইমরোজ তিশা ও তাদের মেয়ে ইলহাম। বিনোদন অঙ্গনের আরেকজনের সঙ্গে এয়ারবাসের ভেতরেই দেখা। তিনি অভিনেতা মাজনুন মিজান। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে যাচ্ছেন। চীনের গুয়াংজুতে তাদের ট্রানজিট। চীনের এই বিমানবন্দরে আমাদের তিন সংবাদকর্মীর জন্য অপেক্ষা করছিল অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা।

ট্রেনের ভেতরে স্টেশনের দিকনির্দেশনা চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসের সব কেবিন ক্রু’র মুখে মাস্ক দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছিল, চীনারা এখনও কতটা সাবধানী। তিন ঘণ্টা ৪০ মিনিট আকাশপথে উড়ে গুয়াংজু বায়ুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর মনে হলো করোনা মহামারি এখনও চলছে! বিমানবন্দরে একটি মেশিনে পাসপোর্টের পরিচিতি অংশ স্ক্যান করে বাঁ-হাতের চার আঙুল, তারপর ডান হাতের চার আঙুল এবং এরপর দুই বুড়ো আঙুল চেপে ধরতে হলো। সবশেষে পাসপোর্ট নম্বরসহ ফিঙ্গারপ্রিন্ট ভাউচার প্রিন্ট হয়ে বেরিয়ে এলো।

কাহিনি আরও আছে‍! একটু এগিয়ে আরেকটি মেশিনে নিজের নাম, জন্ম তারিখ, পাসপোর্ট নম্বর, জাতীয়তাসহ মোটামুটি একখানা জীবন বৃত্তান্ত উল্লেখ করতে হলো। সেই সঙ্গে চীনের স্থানীয় একটি মোবাইল ফোন নম্বর জানাতে হবে। কী মুশকিল! বিমানবন্দরে কর্মরত একজন নিজের তরফ থেকে একটি নম্বর দেখিয়ে দিলেন। সবশেষে একটি পাজল মেলানোর পর পর্দায় ভেসে উঠলো হেলথ ডিক্লারেশন। এর বারকোডের ছবি মোবাইল ফোনে তুলে রাখা আবশ্যকীয়। এটি ইমিগ্রেশনের ফটকে দেখানোর পরেই দরজা খুলেছে। ফ্রি ওয়াইফাই পুরো বিমানবন্দরেই আছে। কিন্তু ফেসবুক-গুগল-ইউটিউব কাজ করে না। বাকি সব ওয়েবসাইটে যাওয়া যায়।

গুয়াংজু বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দরের মধ্যে অন্যতম। এখানকার নিরাপত্তা চেকিংয়ে জুতা, বেল্ট, ঘড়ি ও চশমা খুলতে হয়নি। এর আগে দেশের বাইরে যত জায়গায় গিয়েছিলাম, কোথাও ট্রানজিটে এসব বস্তু খোলার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দর কেবল ব্যতিক্রম। ঢাকায় শার্ট-প্যান্ট ছাড়া মোটামুটি সবকিছুই চেকিংয়ের ট্রেতে তুলে দিতে হয়। একেক দেশের নিয়ম-কানুন একেক রকম আর কী!

গুয়াংজু থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার ইনচন বিমানবন্দরে পৌঁছাতে লাগলো ৩ ঘণ্টা ২০ মিনিট। ঢাকা থেকে বুসানে সরাসরি যাওয়ার টিকিট অনেক চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। ফলে এবার ট্রেনে চড়তে হবে। ইনচনে আগে থেকে অপেক্ষমাণ প্রবাসী বাংলাদেশি ইমরান। তিনি পার্থদার সাবেক ছাত্র। তার পরামর্শ অনুযায়ী ইন্টারনেট সেবা নিতে ইনচন বিমানবন্দর থেকেই একটি সিম কার্ড কেনা হলো। দাম ৩ হাজার ৮৫০ ওন (কোরিয়ান মুদ্রা)। তবে এই সিম কার্ড দিয়ে কোথাও ফোন করা যাবে না! ইন্টারনেটের মাধ্যমেই যা যা কাজ সেরে নিতে হবে। ইনচন থেকে মেট্রোরেলে সিউল যেতে হবে। প্রত্যেকের টিকিটের মূল্য ৪ হাজার ৫০০ ওন। যদিও সিউলে নেমে নির্দিষ্ট মেশিনে সেই টিকিট প্রবেশ করালে ৫০০ ওনের কয়েন ফেরত পেলাম। স্বাভাবিকভাবেই এই বুদ্ধি ইমরান ভাই ছাড়া কেউ দেওয়ার কথা না!

বিমানবন্দর বিটিএস ও ব্ল্যাকপিঙ্কের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় আমাদের মতো বাংলাদেশিদের জন্য দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক, ভাষা। দুই, হালাল খাবার। কোরিয়ান ভাষা বোঝার চেয়ে পাহাড় ডিঙানো বোধহয় সহজ! কান চলচ্চিত্র উৎসবের সাতবার যাওয়ার সুবাদে ফরাসি ভাষা মোটামুটি বুঝি। কোরিয়ান ভাষা শুনে মনে হচ্ছে, ফরাসি ভাষা ঢের সহজ!

কোরিয়ায় হালাল খাবার পাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। সিউলে এ ব্যাপারে মোটামুটি একটা ক্লাস করিয়ে ফেললেন ইমরান ভাই। এখানে ম্যাকডোনাল্ডস-কেএফসির মতো জনপ্রিয় ফুড চেইন লটেরিয়া। সিউল ট্রেন স্টেশনেও তাদের শাখা আছে। এখান থেকে চিংড়ির বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও কোমল পানীয় কেনা হলো। চার জনের খাবারের দাম ২৭ হাজার ৬০০ ওন। এরপর ইমরান ভাই আইসক্রিম উপহার দিলেন।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে ফ্রান্স আর বুসান যাত্রার মধ্যে দুটি বিষয়ে নিজেকে বড়লোক মনে হলো! একটা হলো টাকা-পয়সা। কান কিংবা প্যারিসে যখন ১ ইউরো খরচ করতাম, তখন মনে পড়ে যেত বাংলাদেশ থেকে আনা ১০০ টাকা চলে যাচ্ছে! তবে কোরিয়ান মুদ্রার মান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। ১ টাকার সমান ১৩ ওন। সিউল থেকে বুসান যাওয়ার ট্রেনের টিকিটের মূল্য একেকজনের পড়লো ৫৯ হাজার ৮০০ ওন। পার্থদা, আমার ও রনির তিনটি টিকিটের সম্মিলিত মূল্য ১ লাখ ৭৯ হাজার ৪০০ ওন! এখানে ১ হাজারের নিচে নোট নাই। ৫০০ ওন পর্যন্ত কয়েনের চল আছে।

সিউল থেকে ট্রেনে আড়াই ঘণ্টার বুসান যাত্রা শুরুর সময় মনে পড়লো কোরিয়ান একটি সিনেমার কথা। ২০১৬ সালে কান উৎসবের মিডনাইট স্ক্রিনিংস বিভাগে প্রদর্শিত ‘ট্রেন টু বুসান’। উচ্চগতির একটি ট্রেনে জম্বিদের হানার টানটান উত্তেজনার মোড়কে বাবা-মেয়ের হৃদয়ছোঁয়া গল্প নিয়ে তৈরি হয় ছবিটি। সেই গল্প ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম কে জানে! ঘুম ভাঙলো বুসান পৌঁছানোর মিনিট পাঁচেক আগে।

বুসান স্টেশন থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিলাম। চালক কোরিয়ান, চীনা নয়তো জাপানিজ। সত্যি বলতে, এই তিন দেশের নাগরিকদের মুখাবয়ব এত কাছাকাছি যে ঠাওর করা মুশকিল কে কোন দেশের! ৩০ মিনিট ট্যাক্সিতে চড়ে হোটেলে পৌঁছে ভাড়া গুনতে হলো ১৭ হাজার ওন। আমরা উঠেছি বুসানের সমুদ্রতীরবর্তী হিয়ুন্দের জেবি ডিজাইন হোটেলে। এখানে পানি, কফি ও বরফ ফ্রি। রুমে ছোট ফ্রিজে তিনটি পানির বোতল সাজানো। সাত দিন একটি কক্ষের ভাড়া ৬০০ ডলার।

সিউল স্টেশন বুসানে প্রথম রাতে হালাল খাবারের হদিস পেলাম না অনেক ঘুরে। এখানে ইমরান ভাই নেই। তিনি সিউলেই বিদায় নিয়েছেন। আমরা তিন আগন্তুক শেষমেষ সুপারশপে ঢুকে হাফ ডজন সাগর কলা, তিনটি বাটার বন ও এক বোতল কোমল পানীয় কিনলাম। এবার গুনতে হলো ১৩ হাজার ৮০০ ওন। সব মিলিয়ে গুনে দেখলাম উড়োজাহাজ আর হোটেল ভাড়া ছাড়াই চলে গেলো আড়াই লাখ ওন। বাংলাদেশি মুদ্রায় হিসাব করলে ২০ হাজার টাকা। আমাদের তিন জনের ভাগে পড়েছে ৭ হাজার টাকারও কম। এ আর এমন কী!

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত দেড়টা। তবে বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৩০ মিনিট। বুসানে এসে টাকা-পয়সার পর সময়ের দিক দিয়ে নিজেকে বড়লোক ভাবতে লাগলাম! কান শহর বাংলাদেশের চেয়ে চার ঘণ্টা পিছিয়ে থাকে। এ কারণে উৎসব চলাকালে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে নাভিশ্বাস বেরিয়ে যেত! বুসানে অন্তত লেখা কিংবা খবর পাঠানোর ক্ষেত্রে সময় নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকছে না!

/এমএম/
সম্পর্কিত
থমথমে ঢালিউডে দম দিতে এলো ‘ভাইরাল বেবি’!
থমথমে ঢালিউডে দম দিতে এলো ‘ভাইরাল বেবি’!
ইউরোপীয় হাওয়ায় শুরু হলো টোকিও উৎসব, ফোকাসে বেগম রোকেয়া
ইউরোপীয় হাওয়ায় শুরু হলো টোকিও উৎসব, ফোকাসে বেগম রোকেয়া
শেষবেলায় সাগরপাড়ে, সিউলে চাটগাঁইয়া খাবারের পসরা
বুসান ডায়েরি-৬শেষবেলায় সাগরপাড়ে, সিউলে চাটগাঁইয়া খাবারের পসরা
গিনেস রেকর্ডধারী ডিপার্টমেন্ট স্টোর এবং ‘এশিয়ার কান’
বুসান ডায়েরি-৫গিনেস রেকর্ডধারী ডিপার্টমেন্ট স্টোর এবং ‘এশিয়ার কান’
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে
সাংবাদিক হতে চেয়ে অভিনেত্রী!
সাংবাদিক হতে চেয়ে অভিনেত্রী!
মুবিতে মুক্তি দেশি মুভি
মুবিতে মুক্তি দেশি মুভি
মে দিবসে ফুঁসে উঠলেন সিনেমা শ্রমিকরা
মে দিবসে ফুঁসে উঠলেন সিনেমা শ্রমিকরা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা