অস্কারে প্রথম ব্রাজিলিয়ান ছবি হিসেবে সেরা আন্তর্জাতিক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগের পুরস্কার জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ‘আই অ্যাম স্টিল হিয়ার’। ব্রাজিলের ওয়াল্টার সালেস পরিচালিত ছবিটির গল্প একটি সত্যি ঘটনা। এতে দেখানো হয়েছে, সত্তর দশকে লাতিন আমেরিকার দেশটিতে সামরিক স্বৈরশাসনের পটভূমিতে স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার পর পাঁচ সন্তানের এক মায়ের সংগ্রাম। এবারই প্রথম কোনও ব্রাজিলিয়ান পরিচালকের পর্তুগিজ ভাষার ছবি অস্কার পেলো।
রবিবার (বাংলাদেশ সময় সোমবার সকাল) যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে হলিউডের ডলবি থিয়েটারে ওয়াল্টার সালেসের হাতে অস্কারের সোনালি ট্রফি তুলে দেন স্প্যানিশ অভিনেত্রী পেনেলোপি ক্রুজ। আমেরিকান টিভি ব্যক্তিত্ব কোনান ও’ব্রায়েন প্রথমবার অস্কার সঞ্চালনা করেছেন। এবিসি টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশে ও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম হুলু’তে সরাসরি দেখানো হয়েছে অনুষ্ঠানটি।
‘আই অ্যাম স্টিল হিয়ার’ ছবিতে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে ব্রাজিলের সামরিক একনায়কতন্ত্রের সময় স্বামীকে জোরপূর্বক নিখোঁজ করার ঘটনায় পাঁচ সন্তান নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েন ইউনিস পাইবা নামের এক নারী। স্বামীর অন্তর্ধানের সত্য উন্মোচন ও জীবনকে নতুনভাবে গড়তে সংগ্রাম করেন তিনি।
ইউনিস পাইবা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এবারের অস্কারে সেরা অভিনেত্রী বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছেন ব্রাজিলিয়ান অভিনেত্রী ফার্নান্দা তোরেস। এছাড়া সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনীত হয়েছে ‘আই অ্যাম স্টিল হিয়ার’। এবারই প্রথম পর্তুগিজ ভাষার সংলাপ নিয়ে নির্মিত ব্রাজিলিয়ান ছবি অস্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার সেরা চলচ্চিত্রের জন্য মনোনীত হয়েছে। তবে সেরা চলচ্চিত্র ও সেরা অভিনেত্রী পুরস্কার পায়নি ‘আই অ্যাম স্টিল হিয়ার’।
ইউনিস পাইবার ছেলে মার্সেলো রুবেন্স পাইবার মর্মস্পর্শী স্মৃতিগ্রন্থ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ‘আই অ্যাম স্টিল হিয়ার’ ছবির চিত্রনাট্য। নিপীড়নের মুখে একটি পরিবারের দুঃসময়ের হৃদয়বিদারক গল্প বলা হয়েছে এতে। ছবিটির জন্য গত বছর ৮১তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার পান ব্রাজিলের মুরিলো হাউজার ও এইতর লরেগা।
অস্কার মঞ্চে দাঁড়িয়ে পরিচালক ওয়াল্টার সালেস এই পুরস্কার ইউনিস পাইবা ও তার চরিত্রে অভিনয় করা দুই অভিনেত্রী ফার্নান্দা তোরেস ও ফার্নান্দা মন্টেনেগ্রোকে উৎসর্গ করেন। মঞ্চের পেছনে সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় কোনও চলচ্চিত্র নয়, একটি সংস্কৃতি এই স্বীকৃতি পেয়েছে। ব্রাজিলে আমরা যেভাবে সিনেমা নির্মাণ করি সেটি স্বীকৃত হচ্ছে।’
ব্রাজিলে ১৯৬৪ সালে সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর ২১ বছর ধরে সামরিক শাসন চলাকালীন অনেক ভুক্তভোগীর মধ্যে ছিল পাইবা পরিবার। দুই দশকেরও বেশি সময়ে হাজার হাজার মানুষকে আটক করে নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এছাড়া শত শত লোককে গুম করা হয়। অনেকে নির্বাসিত ও নির্যাতনের শিকার হয়। ওয়াল্টার সালেস মনে করেন, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র আরও হুমকির মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে তার মন্তব্য, ‘কখনও ভাবিনি এই দেশে এত নড়বড়ে অবস্থা হবে। অতীতে ব্রাজিলে যা ঘটেছিল সেগুলো বর্তমান সময়ের খুব কাছাকাছি মনে হয়।’
সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগে অস্কার জেতার ঘটনায় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘এই পুরস্কার এমন একটি কাজের স্বীকৃতি, যা কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুত্ব তুলে ধরে। আজ ব্রাজিলিয়ান হিসেবে আমাদের গর্ব করার দিন। আমাদের সিনেমা, আমাদের শিল্পীদের ও সর্বোপরি আমাদের দেশের গণতন্ত্রের জন্য গর্বিত।’
৯৭তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসে সেরা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগে আরও মনোনীত হয়েছে ডেনমার্কের ‘দ্য গার্ল উইথ দ্য নিডেল’, ফ্রান্সের ‘এমিলিয়া পেরেজ’, জার্মানির ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’, লাটভিয়ার অ্যানিমেটেড ছবি ‘ফ্লো’।
সর্বশেষ ২৬ বছর আগে (১৯৯৯ সালে) ওয়াল্টার সালেস পরিচালিত ‘সেন্ট্রাল স্টেশন’ ছবির সুবাদে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনীত হয় ব্রাজিল। তার হাত ধরেই দেশটিতে এই বিভাগের অস্কার এলো। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, ফার্নান্দা তোরেসের মা ফার্নান্দা মন্টেনেগ্রো ১৯৯৯ সালে অস্কারের সেরা অভিনেত্রী বিভাগে ‘সেন্ট্রাল স্টেশন’ ছবির জন্য ব্রাজিলের প্রথম অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পান।
অস্কারের আন্তর্জাতিক কাহিনিচিত্র, পরিচালনা ও তথ্যচিত্র বিভাগগুলোতে বেশ কয়েকটি ব্রাজিলিয়ান ছবি মনোনীত হলেও কোনোটি জিততে পারেনি। যদিও ফ্রান্স, ইতালি ও ব্রাজিলিয়ান প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ‘ব্ল্যাক অরফিয়াস’ ১৯৬০ সালে সেরা বিদেশি ভাষার ছবি বিভাগে অস্কার পেয়েছে। এটি পরিচালনা করেন ফ্রান্সের মার্সেল কামু। ফলে সেই অস্কার গেছে ফ্রান্সে।