জ্ঞানকাণ্ডও যে নিরপেক্ষ বাস্তবতায় বিকশিত হয় না, হাল আমলের সমাজ বিজ্ঞান তা ফাঁস করেছে বহু আগেই। প্রখ্যাত ফরাসি বুদ্ধিজীবী মিশেল ফুকোর সুবাদে আমরা জেনেছি, জ্ঞান হলো এক ধরনের ক্ষমতা, যা মানুষের ওপর আরোপিত হয়। শাস্ত্র হিসেবে নৃবিজ্ঞানও এর বাইরে নয়। এবার সেই নৃবিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হচ্ছে আগ্রাসনের অজুহাত হিসেবে। নৃবিজ্ঞানের এক গবেষণার প্রেক্ষিতে বলা হচ্ছে, ‘আধুনিক’ বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হলে আদিবাসীরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়বে। তবে এ কথা মানছেন না আদিবাসী সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। তারা বলছেন, এটা তাদেরকে গণহত্যার ষড়যন্ত্র।
আমাজনের দুর্গম অঞ্চলের আদিবাসীদের নিয়ে গত দুই বছর ধরে গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দুই নৃবিজ্ঞানী। এরা হলেন প্রফেসর কিম হিল ও রবার্ট ওয়াকার। ওই দুই নৃবিজ্ঞানীর মতে, আদিবাসীদের আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য জোর না করে এভাবে থাকতে দিলে তারা আরও বেশি প্রান্তিক হয়ে পড়বেন। অধ্যাপক কিম হিল ও রবার্ট ওয়াকারের প্রস্তাব, আদিবাসীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা ও শিক্ষিত করে গড়ে তোলা দরকার। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জঙ্গলে প্রবেশ করার আগেই এটা করতে হবে। তারা মনে করেন অবৈধ পাচারকারী ও রোগবালাই থেকে রক্ষা করার জন্য নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। আদিবাসীদের নিজেদের মতো থাকতে দেওয়াই তাদের আধুনিক সভ্যতা থেকে রক্ষা করার উপায়- এই ধারণাকে নিতান্তই একটি বিভ্রম বলে মত দিয়েছেন তারা।
এদিকে, এ প্রসঙ্গে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও প্রকাশ করছে ভিন্নমত। অনেকেরই মতে, আমাজন জঙ্গলের গভীরে বসবাসরত আদিবাসীদের সঙ্গে জোর করে সম্পর্ক তৈরির প্রচেষ্টা হবে গণহত্যার শামিল। সম্প্রতি আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা সংগঠনের পক্ষ ওই বনের একটি আদিবাসীদের একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। এতে আমাজনের গভীরে বসবাসকারী গুয়াজাজারা আদিবাসী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এ আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সারভাইবাল ইন্টারন্যাশনাল নামের ওই দাতব্য সংস্থা দুই নৃবিজ্ঞানীর মতামতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি তারা একটি ভিডিও প্রকাশ করে আদিবাসীদের বক্তব্য তুলে ধরেছে। গুয়াজাজারা নামের ওই আদিবাসীরা মনে করেন, জোর করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বা সম্পর্ক স্থাপন গণহত্যার শামিল।
সারভাইবাল ইন্টারন্যাশনাল এর প্রচারণা পরিচালক ফিয়োনা ওয়াটসন বলেন, ‘গুয়াজাজারা গোত্রের সদস্যরা রাষ্ট্রের অগোচরে নিজেদের হাতে অনেক দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে।’ এই প্রতিষ্ঠানটি প্রফেসর হিল ও ওয়াকারের বরাবর একটি খোলা চিঠিও প্রকাশ করেন। তাতে তারা দাবি করেন, জোর করে এই অরণ্যবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা নতুন ধরনের রোগশোক ও সহিংসতার শিকার হতে পারেন। তিনি আরও বলেন, ‘ওদের সঙ্গে জোরপূর্বক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা হবে ঈশ্বরের সঙ্গে খেলা করা।’ ফিওনা ওয়াটসন জানান, রাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টি নিজেরাই দেখছে আদিবাসী গোষ্ঠীটি। এর আগেও এরকম জোর করে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। ওই সব ক্ষেত্রেও গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।
এর আগে ১৯৮৭ সালে ব্রাজিল সরকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক নীতি নির্ধারণ করে যাতে এই গভীর অরন্যের বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
আরও পড়ুন: যেন সম্রাট আকবরের দীন এ এলাহী ধর্ম ফিরিয়ে এনেছেন রাজা
এদিকে প্রফেসর হিল তার অবস্থানে অনড়। সবকিছুর পরও তার দাবি, ‘এমন কোন গোষ্ঠী নেই যারা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে নিজেরা খুব ভালো আছে।’ তিনি আরও মনে করেন, বেশিরভাগ আদিবাসীরাই আসলে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভীষণ আগ্রহী। সূত্র: ইন্ডিপেনডেন্ট
/এএ/ইউআর/বিএ/