‘ইসলামি বিপ্লব’ সংঘটিত হওয়ার প্রায় চার দশক পর এবার প্রথমবারের মতো নিজ দেশের স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার সুযোগ পেয়েছেন ইরানি নারীরা। এবারই প্রথম ব্রিটিশ নারী ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করতে গিয়ে ইতিহাস গড়েছেন ভিকি স্পার্কস। প্রথম জার্মান নারী ধারাভাষ্যকার হিসেবে এবারই প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করেছেন ক্লদিয়া নিউম্যান। তা সত্ত্বেও এই প্রশ্ন আড়াল করা যায়নি যে বিশ্বকাপ ফুটবল আদতে কেবল পুরুষেরই কিনা। কাতারভিত্তিক আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীদের হয়রানি ও নিপীড়নের কারণে এবারের বিশ্বকাপের কথা বহুদিন মনে থাকবে মানুষের। ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে নারী সাংবাদিকদের নিপীড়িত ও হয়রানির শিকার হওয়ার কথা। দেখা গেছে, কেবল সাংবাদিক নয়, পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার হয়েছেন, নারী ধারাভাষ্যকার থেকে শুরু করে সমর্থকরাও। খেলার বিজ্ঞাপন ও প্রচারণার বার্তায়ও দেখা গেছে ভয়াবহ পুরুষতান্ত্রিকতার ছাপ। টিভি বিজ্ঞাপনের গল্প, ক্যামেরায় ক্রমাগত ভিড়ের মধ্য থেকে আকর্ষণীয় নারীদের মুখ বড় করে দেখানো, স্টেডিয়ামের অভ্যন্তরে নারী টয়লেটের সংখ্যা সবখানেই নারীবিদ্বেষী অবস্থান চোখে পড়েছে। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বকাপে নারীদের অংশগ্রহণ নিষ্ক্রিয় (passive), তারা যেন অলঙ্কারের খানিকটা মতো।
১৯৭৯ সালের পর প্রথমবারের মতো ফুটবল স্টেডিয়ামে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছেন ইরানের নারীরা। রাজধানী তেহরানের স্টেডিয়ামে তারা বড় পর্দায় প্রত্যক্ষ করেছেন ইরান আর স্পেনের মধ্যকার বিশ্বকাপ ফুটবল ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার। সারা বিশ্ব থেকে অনেক নারী সাংবাদিক এবারে প্রথমবারের মতো গিয়েছিলেন এবারের বিশ্বকাপ কাভার করতে। নিজেদের দেশ থেকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ কাভার করতে গিয়ে ইতিহাস গড়েছেন ব্রিটিশ স্পোর্টস সাংবাদিক ভিকি স্পার্কস ও জার্মান ধারাভাষ্যকার ক্লদিয়া নিউম্যান। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক মাস ধরে চলা এই বিশ্বকাপে যত বেশি নারীরা অংশ হয়েছে ততবেশি নারীদের নিগ্রহ ও পুরুষতান্ত্রিক আচরণের শিকার হতে হয়েছে। বৈষম্য প্রতিরোধকারী প্রতিষ্ঠান ফেয়ার নেটওয়ার্ক বলছে, ‘ঘটনা হলো বেশিরভাগ দেশেই ফুটবলকে এখনও শুধু পুরুষের খেলা বলে দেখা হয়।’
নারী সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন
কলম্বিয়ান সাংবাদিক জুলিয়েথ গঞ্জালেস মস্কো থেকে সরাসরি সম্প্রচার করছিলেন। ক্যামেরা চলার সময়ে এক পুরুষ তার ওপর শারীরিক নিপীড়ন চালান। ব্রাজিলিয়ান রিপোর্টার জুলিয়া গুইমারায়েস ইয়াকেটারিনবুর্গ থেকে সরাসরি সম্প্রচারের সময় এক পথিকের রোষানলে পড়েন। ওই ব্যক্তির দিকে মাইক্রোফোন তাক করে তিনি চিৎকার করে ওঠেন, এটা সভ্য আচরণ নয়, এটা ঠিক নয়… আর কখনও এটা করার চেষ্টা করো না, সম্মান করতে শেখো। পরে আবার ক্যামেরার সামনে ফিরে কাজে মনোযোগ দেন তিনি। আরও অনেক নারী রিপোর্টার নিজেদের কাজের সময়ে একই ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। আর এতে অধিকার গ্রুপ, মিডিয়া পর্যবেক্ষক আর সাংবাদিকদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরামর্শক গ্রুপ কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের অ্যাডভোকেসি পরিচালক কোর্টনি রাডেচ বলেন, ‘অনেক কিছুই দেখে মনে হতে পারে খেলার একটি মজার অংশ তবে এই ছেলেমানুষি আচরণ আসলে একটি সমস্যাজনিত আচরণ। কারণ, এই পেশাজীবীরা তাদের কাজ করছিলেন আর কয়েকটি ঘটনায় তারা রীতিমত নিপীড়িত আর নিগৃহীত হয়েছেন।’ স্পানিশ ফুটবল রিপোর্টার জেমা সোলার ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপও কাভার করেছেন। তিনি বলেছেন, নিপীড়নের ঘটনা তাকে অবাক করেনি। সোলার আল জাজিরাকে বলেন, এসব ঘটনায় আমি দুঃখ পেয়েছি কিন্তু একই সঙ্গে আমি খুশি এই কারণে যে চিরকাল ধরে চলা এই অগ্রহণযোগ্য আচরণ এখন সংবাদমাধ্যমের অনেক বেশি মনোযোগ পাচ্ছে আর সমাজের অভ্যন্তর থেকেও সাধারণ মানুষের নিন্দাও কুড়াচ্ছে।
যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য
বিশ্বকাপ চলার সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অনেক ভিডিওতে দেখা গেছে নারী সমর্থকদের ঘিরে ধরে বিদেশি ভাষায় যৌন-হয়রানিমূলক ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। টুর্নামেন্টের প্রথম কয়েক দিনে ব্রাজিলিয়ান পুরুষদের একটি দলকে রুশ নারীদের ঘিরে নিজেদের ছবি তুলতে দেখা যায়। ওই পুরুষের দল পর্তুগিজ ভাষায় ‘ঘিরে ধরা নারী’দের নিয়ে হয়রানিমূলক মন্তব্য করতে থাকে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্যারাগুয়ের কয়েকজন সাংবাদিককে এক নারীকে আদিবাসী গুয়ারানি ভাষায় এমন কিছু শব্দ বলতে বলছেন, যা যৌন-হয়রানিমূলক। ফেয়ার নেটওয়ার্কের মিডিয়া কর্মকর্তা মারিয়ানা লিনহাম বলেন, ‘আমার মনে হয় এই ধারার মন্তব্য ভীতি সঞ্চারকারী আর ক্ষতিকর। এসব ঘটনা পরিষ্কারভাবে সেই প্রবণতাকে ইঙ্গিত করছে যা বলে দেয় ফুটবলে নারীরা এখনও তাদের জায়গা খুঁজে ফিরছে।’
ছবির মধ্য দিয়ে যৌন হয়রানি
জার্মানভিত্তিক ফটো সংবাদ সংস্থা গ্যেটে ইমেজ গ্যালারিতে একটি ছবি প্রকাশ করে পরে মুছে দেয়। ওই ছবির শিরোনামে লেখা হয়েছিল, এই বছরের বিশ্বকাপের ‘দ্য হটেস্ট ফ্যান’। ওই গ্যালারির সাবহেডে লেখা হয়েছিল ‘ফুটবল নান্দনিক খেলা হিবেবে পরিচিত আর সমর্থকরাও নন্দনের উৎস। তাদের মধ্যে কয়েকজন যৌন আবেদনময়ীকে দেখে নিন।’ টুইটার ব্যবহারকারীরা মুহূর্তের মধ্যেই গ্যেটে ইমেজ’কে ওই ছবির জন্য ঘৃণা জানাতে শুরু করে। একে ‘চরম পুরুষতান্ত্রিক’ ও ‘জঘন্য কাজ’ আখ্যা দেন তারা। এক ব্যবহারকারী লেখেন, ‘সত্যিই তোমাদের অ্যাকাউন্টের দায়িত্ব কোনও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ফিরে পেয়েছে’। আরেক ব্যবহারকারী লেখেন, ‘১৯৭০’-এর দশক ডাকছে আর তারা নারী বিদ্বেষকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে।’ চরম প্রতিক্রিয়ার একপর্যায়ে ছবিটি নামিয়ে নেওয়া হয়। দুঃখ প্রকাশ করে জানানো হয়, সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় ছবিটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
"@Austynzogs: @Gidi_Traffic Getty Images has deleted a gallery of the 'hottest fans' at the World Cup following criticism on social media #WorldCup pic.twitter.com/ltKZGgFefx
— GIDITRAFFIC (@Gidi_Traffic) June 26, 2018
রোষের কবলে পড়া নারী ভাষ্যকাররা
এবারের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো মার্কিন টেলিভিশনে বিশ্বকাপ ফুটবলের বিশ্লেষকের ভূমিকায় এসেছেন দুই নারী। ফক্স টেলিভিশনে বিশ্লেষণ দেওয়া অ্যালাই ওয়াগনার ও টেলেমুন্ডোর ভিভিয়ানা ভিলাসহ আরও অনেকেই ধারাভাষ্য কিংবা বিশ্লেষণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ফেয়ার নেটওয়ার্ক অন্তত ৪৪ নারী সম্প্রচারকারীর তালিকা প্রকাশ করে লিখেছে, ‘আমরা জানি আরও অনেকেই এ কাজে জড়িত ছিলেন।’ টুর্নামেন্ট কাভারেজে নারীদের অংশগ্রহণ ও অবদান নিয়ে অনেক অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের কাছে প্রশংসিত হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমালোচনা থেকে রেহাই মেলেনি তাদের। ফুটবল ক্লাব চেলসি ও টটেনহামের রক্ষণভাগের সাবেক খেলোয়াড় জেসন কান্ডি এই বিতর্ক উসকে দিয়ে বলেন, ফুটবল দেখার সময়ে তিনি এক পুরুষের কণ্ঠ শুনতেই পছন্দ করেন। তিনি বলেন, নারী ভাষ্যকারের কণ্ঠ অতিমাত্রায় তীক্ষ্ণ। ব্রিটেনের সাংবাদিক সিমন কেলনারও পুরুষের ফুটবলে নারীর ধারাভাষ্য দেওয়ার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘মনে হয় যেন কোনও নেটবল (বাস্কেটবল খেলার পুরনো সংস্করণ) খেলোয়াড় বাস্কেটবলের বড় লীগের খেলা নিয়ে আলোচনা করছেন।’
বিজ্ঞাপন প্রচারণা
ফাস্টফুড চেইন ‘বার্গার কিং’ বিশ্বকাপের সময়ে ৩০ লাখ রাশিয়ান রুবল নগদ ও আজীবন বিনামূল্যে হুপার বার্গার সরবরাহের ঘোষণা দিয়ে এক প্রচারণা চালায়। ‘যেসব রুশ নারী বিশ্বকাপ তারকাদের মাধ্যমে গর্ভধারণ করবেন’; তাদের জন্য এই পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। মার্কিন প্রতিষ্ঠানটির রুশ শাখা বিতর্কের মুখে রাশিয়ার সামাজিক যোগাযোগ প্লাটফর্ম ভিকে-তে চালানো এই প্রচারণা বন্ধ করে দেয় এবং ক্ষমা চায়।
The now deleted promotion pic.twitter.com/mg7xETHfQW
— Jenna Fryer (@JennaFryer) June 20, 2018
আর্জেন্টিনার ভয়াবহ এক প্রকাশনা
বিশ্বকাপ শুরুর এক মাস আগে আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ) এক ম্যানুয়েল প্রকাশ করে। রুশ নারীদের আকর্ষণ করার বিষয়ে ছোট ছোট পরামর্শ থাকা ওই ম্যানুয়েল নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। রাশিয়ায় যাওয়া সাংবাদিক, কর্মকর্তা, খেলোয়াড় ও কোচদের বিনামূল্যে দেওয়া এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিতরণ করা হয় ওই ম্যানুয়েল। কী করে রুশ নারীদের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করা যায়, কেমন পোশাক ও সুগন্ধী ব্যবহার করে তাদের প্ররোচিত করা যায় সেসব নিয়ে ম্যানুয়ালটি রচিত। এ নিয়ে বিতর্কের একপর্যায়ে বিবৃতি দিয়ে ম্যানুয়েলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এএফএ। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ভুলবশত ছাপা’ হয়েছে ম্যানুয়েলের এই অংশটি।