কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানে ভারতের হামলাকে লজ্জাজনক বলে আখ্যায়িত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দুদেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানান। শুক্রবার মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এক বক্তব্যে বলেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে জড়ানোর কোনও আগ্রহ নেই যুক্তরাষ্ট্রের।
অথচ, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাতেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় পারমাণবিক শক্তিধর এশিয়ার দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র।
৮ মে দুদেশ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পর প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্র এসব থেকে নিজেকে দূরেই রাখবে। তবে শেষতক ট্রাম্পের জড়িয়ে পড়াটা খুব বেশি অস্বাভাবিক ছিল না। বরং, এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশীয় নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবনার খোরাক জোগায়।
ট্রাম্প সবসময় বেশ বড়াই করে বলেন, তার প্রথম মেয়াদে বিশ্বে কোনও যুদ্ধ হয়নি। ইউক্রেন থেকে শুরু করে সিরিয়া, সব সংঘাতের জন্য তিনি রাখঢাক ছাড়াই সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট ওবামা ও বাইডেনকে দোষারোপ করে আসছেন।
ট্রাম্প নিজেকে এমন একজন শান্তির দূত বলে বিশ্বাস করেন, যিনি বৈশ্বিক যেকোনও সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম। ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই তিনি বলে আসছেন, এক চুটকিতে ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন এবং গাজা সংকটের সমাধান করবেন। তার প্রতিজ্ঞা অনুসারে ২৪ ঘণ্টায় সমাধান না হলেও ১১ মে কিছুটা নমনীয় সুরে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার জন্য প্রস্তুত।
এদিকে, গাজা সংকট সমাধানে তিনি ফিলিস্তিনিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের বিষয়টি বিবেচনা করছেন বলে অসমর্থিত কিছু সূত্রে দাবি করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটানোর মধ্য দিয়ে তাদের খনিজ সম্পদের বিশাল অংশের বখরা বুঝে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া, গাজাবাসীদের উৎখাত করে সেখানে রিভিয়েরা বানানোর মতো পরিকল্পনা পেশ করে মোটামুটি বিশ্বব্যাপী শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। তার গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা থাকলেও নিজের শান্তি প্রতিষ্ঠার দক্ষতা নিয়ে ট্রাম্পের আত্মবিশ্বাস কিন্তু ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এসবের মধ্যেই সংঘাতে জড়িয়ে যায় ভারত ও পাকিস্তান। এ দুদেশের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কায় সবাই যখন প্রমাদ গুনছেন, তখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সারা রাত আলোচনার পর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে দিল্লি ও ইসলামাবাদ। এর কিছুক্ষণ পর দুদেশের শীর্ষ কর্মকর্তারা তার এই বক্তব্যের সমর্থনে বিবৃতি প্রদান করেন।
এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রদ্বয়ের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের নেপথ্যে কেবল ট্রাম্পের শান্তির দূত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল বলে মনে করেন না বিশ্লেষকরা। ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে প্রতিহত করার জন্য ভারতকে অন্যতম কৌশলগত সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করে হোয়াইট হাউজ।
এর আগে একাধিক মার্কিন প্রশাসন তাদের কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে চীনকে ঘেরাও করার নীতি গ্রহণ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ভারত পর্যন্ত মিত্রদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা হচ্ছে তাদের এই পরিকল্পনা কার্যকর করার ভিত্তি। এছাড়া, ভারতের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার পাশাপাশি বাইডেন আমলে নেওয়া হয়েছিল 'ফ্রেন্ড শোরিং' নীতি। এই নীতির আওতায়, চীনা উৎপাদকদের ওপর মার্কিন নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে ভারতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক নিয়ে ভারতের সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। তবে, এরপরও কিন্তু দেশটির সঙ্গে সামরিক ও বাণিজ্য খাতে সহায়তা চুক্তি করেছে হোয়াইট হাউজ।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সংঘাতকে ঘিরে পাকিস্তানের সমর্থনে এসে গিয়েছিল চীন। ওয়াশিংটনের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ইরান যৌথভাবে পাকিস্তানের পাশে থাকলে এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব হ্রাস পেতে পারে এবং অন্যতম মার্কিন মিত্র ভারতের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে পারে- হোয়াইট হাউজ এই আশঙ্কার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়।
এসব কিছু মিলিয়েই ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ খুব একটা বিস্ময়কর ছিল না। তবে, ইউক্রেন ও গাজা সংকট সমাধান করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে নিজেদের আখের গোছানোর চেষ্টায় আছে, তাতে দক্ষিণ এশিয়ায় পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি প্রশমনে ট্রাম্পের সর্বশেষ হস্তক্ষেপে চূড়ান্ত ফায়দা কার হবে, সেটা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স