ভোটদান পাকিস্তানের সব প্রাপ্তবয়স্কদের সাংবিধানিক অধিকার। তারপরও সামাজিকভাবে রক্ষণশীল দেশটির প্রত্যন্ত এলাকাগুলো পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজালে আটকে আছে এখনও। অনেক এলাকায় নারীদের পুরুষের অনুমতি ছাড়া ভোট দেওয়ার অধিকার নেই, হোক না সেই নারী উচ্চশিক্ষিত।
এমনই একটি এলাকা পাঞ্জাবের ধুরনাল গ্রাম। দেশটির সবচেয়ে উন্নত প্রদেশ হিসেবে পরিচিত পাঞ্জাব। অথচ ধুরনাল গ্রামে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে নারীদের ভোটদানে নিষেধাজ্ঞার ইতিহাস রয়েছে। এ নিয়ে এক প্রতিবেদন তৈরি করেছে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি। পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম ডন মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
ধুরনাল গ্রামেরই ৬০ বছর বয়সী এক নারী নাঈম কাউসির, যিনি কিনা সেখানকার এক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকাও ছিলেন। তিনি এবং তার সাত মেয়ে–যাদের ছয়জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছেন। তারা সবাই পাকিস্তানের আসন্ন নির্বাচনে ভোট দিতে চান, যদি তার পরিবারের পুরুষরা অনুমতি দেন। তার মতো এই গ্রামের বহু নারীকেই তাদের ভোটদানের অধিকার দেওয়ার মতো সাহস পুরুষদের নেই বলে জানিয়েছেন কাউসির।
আর যাদের ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তাদেরকে প্রায়ই পুরুষের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়।
এখানে ১৯৬২ সাল থেকেই এমনটাই ঘটছে। পাকিস্তানের পুরুষরা অনেকেই মনে করেন, তাদের সম্মানের সঙ্গে নারীদের রক্ষা করার বিষয় জড়িয়ে আছে। ওই বছর ভোটের দিন এ নিয়ে একটা গোলমাল হয়। পুরুষরা অপমানিত বোধ করে নারীদের ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করে। অর্ধ শতাব্দীর বেশি পার হয়ে গেলেও এখনও সেই নিষেধাজ্ঞা রয়ে গেছে।
স্থানীয় গ্রাম পরিষদের এক সদস্য মালিক মুহাম্মদ বলেছেন, ‘এছাড়া বেশ কয়েকবছর আগে, যখন এখানে সাক্ষরতার হার কম ছিল, তখন একজন কাউন্সিল চেয়ারম্যান প্রশ্ন তুলেছিলেন, পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও ভোট দিতে গেলে, গৃহস্থালি কে সামলাবে?’ নারীদের ভোটদানকে এখানে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হয় বলেও জানিয়েছেন তিনি।
যদিও একজন দোকানদার মুহম্মদ আসলামের দাবি, বহু আগে গ্রামের একটা ভোটকেন্দ্রে ঝামেলা শুরু হলে, নারীদের স্থানীয় শত্রুতা থেকে রক্ষা করার জন্যই তাদেরকে ভোট দিতে বারণ করা হয়, যা এখন এক নিয়মে পরিণত হয়েছে।
অথচ পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) জোর দিয়ে বলেছে, যেকোনও নির্বাচনি এলাকায় নারীদের ভোটদানে বাধা দেওয়া হলে, ওই কেন্দ্রে ভোট বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণার ক্ষমতা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। অথচ বাস্তবতা হলো, এমন বহু এলাকা রয়েছে যেখানে নারীরা ভোটার তালিকাতেই নেই।
খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের কোহিস্তানের পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ৮ লাখ লোকের বাসস্থান। এখানে গত মাসে নারীদের নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নেওয়াকে অনৈসলামিক বলে ঘোষণা করেছেন ধর্মীয় আলেমরা।
আইন বিশেষজ্ঞ ও নারী অধিকার কর্মী ফাতিমা বাট বলেছেন, ইসলামে নারীদের ভোট দেওয়ার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে শোষণই করা হয় শুধু।
১৯৮৮ সালে সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া উল-হককে হারিয়ে পাকিস্তানে বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারী নেত্রী নির্বাচিত হন বেনজির ভুট্টো। নারীদের শিক্ষা ও আয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার ৩০ বছরেরও বেশি সময় পর, ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ৬ হাজার ৯৪ জন পুরুষ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মাত্র ৩৫৫ জন নারী।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে জাতীয় পরিষদের ৩৪২টি আসনের মধ্যে নারীদের জন্য ৬০টি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ১০টি আসন সংরক্ষিত। কিন্তু এই কোটার বাইরে খুব কমই নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেয় রাজনৈতিক দলগুলো।
তবে পরিবর্তন আসছে বলে জানিয়েছেন ধুরনালের এক স্বাস্থ্যসেবাকর্মী রবিনা কাউসির। ইমরান খান যখন ২০১৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন, রবিনা তখন নারীদের স্থানীয় ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি মিনিবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। এবার তিনি তার স্বামীর সমর্থনে একই রকম ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত।