ভাষা দিবসে কার্যত শূন্য পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার জেলার বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক সীমান্তের পেট্রাপোল-বেনাপোল নো-ম্যান্স ল্যান্ড। দীর্ঘদিন ধরেই দুদেশের আমন্ত্রণে ভাষাপ্রেমী, জনপ্রতিনিধি, বিশেষ অতিথিদের উপস্থিতিতে অস্থায়ী শহীদ বেদীতে মাল্যদান করে এই দিনটিকে যৌথভাবে উদযাপন করা হয়ে আসছিল। ভাষার টানে দুই দেশের মানুষ মিলিত হন। তবে এবারের ছবিটা একেবারেই আলাদা।
বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতির আঁচ পড়েছে সীমান্তে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে অনুষ্ঠানে। সীমান্তের উভয় পাড়ে আলাদাভাবে ভাষা দিবস পালন হলেও তা হলো নো-ম্যান্স ল্যান্ডের বেশ কিছুটা দূরত্বে। ভারতীয় দিকে পেট্রাপোল স্থলসীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় স্থানীয় ছয়ঘড়িয়া পঞ্চায়েত এবং বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির তরফে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান করা হয়। অস্থায়ী শহীদ বেদী নির্মাণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি মঞ্চ করে ভাষা দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরেন উপস্থিত ব্যক্তিরা। তবে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান না হওয়ায় মন খারাপ এপার বাংলার (পশ্চিমবঙ্গ) ভাষাপ্রেমী মানুষের।
তৃণমূলের রাজ্যসভার সংসদ সদস্য মমতা বালা ঠাকুর বলেন, প্রতিবছর নো-ম্যান্স ল্যান্ডে উপস্থিত থেকে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকি, একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়। কিন্তু এবার হলো না। তবে আমার মনে হয় দুই দেশের সম্পর্ক আবার ঠিক হবে, আবার আমরা ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যেতে পারব।
বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ প্রসেনজিৎ ঘোষ জানান, আমরা যারা বাঙালি, আমরা যারা ভাষাপ্রেমী মানুষ- তারা সবাই হতাশ। তবুও বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের আবেগকে সম্মান জানিয়ে ভারতীয় দিকে ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা অচিরেই সমস্যার সমাধান হবে।
এদিকে প্রতিবছর যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে দিনটি পালন করা হয়ে থাকে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে। কিন্তু এবছর ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে কোনোরকম আড়ম্ভর ছিল না। শুক্রবার সকালে উপ-হাইকমিশন প্রাঙ্গণে শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন দূতালয় প্রধান সিকদার মোহাম্মদ আশরাফুর রহমান, কাউন্সেলর (শিক্ষা ও ক্রীড়া) রিয়াজুল ইসলাম, কাউন্সেলর (কনস্যুলার) এএসএম আলমাস হোসেন, কাউন্সিলর (রাজনৈতিক) তুষিতা চাকমাসহ মিশনের কর্মকর্তারা।
কিন্তু অতীতে কলকাতার সোহরাওয়ার্দী এভিনিউতে অবস্থিত বাংলাদেশ গ্রন্থাগার ও তথ্যকেন্দ্রর সামনে থেকে প্রতিবছর যে সুদৃশ্য প্রভাতফেরী বের হয়ে হতো, এবার তা ছিল না। এমনকি দিনভর যে বিভিন্ন কর্মসূচি থাকতো সেগুলোকেও এবার বাদ দেওয়া হয়েছে। কার্যত খুব সংক্ষিপ্ত আকারে ভাষা দিবস পালন করা হচ্ছে। মিশন সূত্রে খবর, বর্তমান পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তাজনিত কারণেই এবারের আয়োজন কিছুটা কাঁটছাট করা হয়েছে।
শান্তিনিকেতনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানেও কিছুটা রদবদল ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশ ভবনের বদলে এবছর মাতৃভাষা দিবসের স্থান পরিবর্তন করে করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় সংহতিকেন্দ্রে। চিরাচরিত প্রথা অনুয়ায়ী ঐতিহ্য মেনে এদিন সকালে আন্তর্জাতিক অতিথিশালার সামনে থেকে জাতীয় সংহতি ভবন পর্যন্ত পদযাত্রা আয়োজিত হলো আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গান গেয়ে। পরবর্তীতে জাতীয় সংহতি ভবনে এসে বেদীতে পুষ্প দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বিনয় কুমার সোরেন, বাংলাদেশ ভবনের সমন্বয়ক অধ্যাপক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ভারপ্রাপ্ত জনসংযোগ কর্মকর্তা অতিগ ঘোষসহ বাকি অধ্যাপকরা। ‘অমর একুশে’ গানে গানে অংশ নিলেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাও। যদিও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে বাতিল করা হয়েছে সন্ধ্যানুষ্ঠান।
বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাংলাদেশ ভবন সংস্কারের কাজ চলছে, তাই স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। ওপার বাংলায় পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, এপার বাংলায় বন্ধন অটুট। অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে বিশ্বভারতীর বাংলাদেশ ভবনের সমন্বয়ক অধ্যাপক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান বড় বিষয়। এটা আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস। এপার বা ওপার বাংলা বলে নয়, সব ভাষাভাষী দিবস আজ। সংস্কারের কাজ চলার জন্য বাংলাদেশ ভবনে অনুষ্ঠান হয়নি। পরে আবার অনুষ্ঠান হলে তা হবে।
গত দুই বছর ধরে একটু অভিনব উদ্যোগে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অনুষ্ঠান পালন করে আসছে কলকাতার ইন্দো বাংলা প্রেস ক্লাব। অস্থায়ী শহীদ বেদী নির্মাণ করে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি রক্তদান শিবির, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য শিবির করে আসছিল ক্লাব কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এবারে তা স্থগিত রাখা হয়েছে। অন্যদিকে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সারা রাতব্যাপী অনুষ্ঠান করেছে ‘ভাষা ও চেতনা সমিতি’ নামে একটি সংগঠন। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকেই কলকাতার রবীন্দ্রসদন লাগোয়া অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর সামনে রাণুছায়া মঞ্চে শুরু হওয়া সারা রাত বাংলা ভাষা উৎসবে নাচ, গান, কবিতা, নাটক, যাদু, বাউল, লোক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। শুক্রবার সকালে প্রভাত ফেরির মধ্য দিয়ে সেই অনুষ্ঠানের শেষ হয়।
সকালে কলকাতার থিয়েটার রোড সংলগ্ন পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, তৃণমূল বিধায়ক দেবাশীষ কুমার দলের সাংসদ মালা রায় প্রমূখ। পরে মেয়র জানান বাঙালি লড়াই করতে জানে। বাঙালি জাতি মাথা তুলে বাঁচতে জানে। তাই কেউ ইচ্ছা করলেই আমাদের মাথা নত করতে পারবে না। বাংলা ভাষার জন্য বাংলাদেশের পাশাপাশি আসামের শিলচরে ও এই একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে বহু যুবক প্রাণ দিয়েছেন। তাই আমরা মাথা নত করব না।
বিকালে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা হয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের উদ্যোগে। যেখানে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়কসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।