X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঠেকাচ্ছে তুরস্ক-হাঙ্গেরি, লাভ হচ্ছে রাশিয়ার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
০৬ মার্চ ২০২৩, ১৯:৪৬আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৩, ০৯:০৯

গত বছর মে মাসে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল, তখন এটিকে রাশিয়ার প্রতি খোঁচা এবং ইউরোপীয় চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছিল। ঐতিহাসিকভাবে উভয় দেশ মস্কোকে ক্ষেপানোর বদলে ন্যাটোর সঙ্গে জোট নিরপেক্ষ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিল। কিন্তু ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন এই পরিস্থিতি বদলে দেয়।

ফিনল্যান্ড ও সুইডেনসহ ন্যাটো মিত্রদের বেশিরভাগ রাষ্ট্র ১১ জুলাই ন্যাটো সম্মেলনে দেশ দুটির ন্যাটোতে আনুষ্ঠানিক যোগদান দেখতে চায়। তবে এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা রয়েছে এই ইচ্ছা বাস্তবায়নের পথে। দেশ দুটির ন্যাটোতে যোগদানের পরিকল্পনায় তুরস্ক এখনও আনুষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় আশীর্বাদ দেয়নি।

শুধু তুরস্ক-ই বিরোধিতা করছে এমন না। হাঙ্গেরিও নরডিক দেশ দুটির ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়টি অনুস্বাক্ষরে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে তুরস্কের সম্মতির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত, তুরস্ক অবস্থান বদলাবে না বলে ন্যাটোর পশ্চিমা কর্মকর্তারা ক্রমশ হতাশা প্রকাশ করছেন।

প্রকাশ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটো জোটের সদস্যপদ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অজুহাত তুলে ধরছেন। তুরস্কের দাবি, উভয় দেশ, বিশেষ করে সুইডেন, তুরস্কে নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)-এর জঙ্গিদের আশ্রয় দিচ্ছে। শুধু তুরস্ক নয়, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেও এই পিকেকে নিষিদ্ধ। এরদোয়ান বলছেন, তিনি এই জঙ্গিদের তুরস্কে ফিরিয়ে আনতে চান। কিন্তু সুইডেন এই বিষয়ে এখনও সবুজ সংকেত দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেনি।

জুলাইয়ে সম্মেলনের আগে তুরস্ক নিজের অবস্থান পরিবর্তন করবে, এই বিষয়ে ন্যাটো কূটনীতিকরা বিভক্ত। এই বিভাজনের দুই ধারার বক্তব্যের মূলে রয়েছে তুরস্কের চলতি বছরের নির্বাচন। এরদোয়ানের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে পরীক্ষা হতে পারে এই নির্বাচন।

মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের তুরস্ক কর্মসূচির গনুল টল ব্যাখ্যা করে বলেন, তুর্কি জনগণের কাছে কথামতো কাজ করার যে দৃঢ় নেতার ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল এরদোয়ানের এখন তা ম্লান হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে তুরস্কে পশ্চিমাবিরোধী ও কুর্দিবিরোধী মনোভাব বিরাজ করছে। নিজের ঢোল বাজানোর জন্য এটি একটি ভালো বিষয় এবং নাটকীয় ইউ-টার্ন তাকে আরও দুর্বল হিসেবেই হাজির করবে।

গনুল টল মনে করেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে এরদোয়ান অসন্তুষ্ট করতে চান না, এটিও একটি কারণ। সিরিয়ায় কর্মকাণ্ড, রুশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা ও অপর বৈরি কর্মকাণ্ডের জন্য অপর দেশগুলো যখন তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে যখন তুর্কি অর্থনীতি জিইয়ে রাখে রাশিয়া। রাশিয়ার অর্থ ছাড়া এরদোয়ানের পক্ষে মজুরি বৃদ্ধি বা শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান সম্ভব হত না। এখন তিনি ভূমিকম্পের পর বিশাল পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ফলে রাশিয়া এখনও এরদোয়ানের জন্য আকর্ষণীয় অংশীদার।

অনেক পশ্চিমা কর্মকর্তাদের মতো গনুল টলও মনে করেন, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড জঙ্গিদের আশ্রয় দিচ্ছে বলে তোলা দাবি এরদোয়ানের জন্য উপযুক্ত ঢাল। বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে অসুবিধাজনক সময়ে ন্যাটো প্রশ্নে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকতে।

বৃহস্পতিবার ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় হয়ত কোনও ফল আসবে না। এই আলোচনায় প্রাধান্য পেতে পারে এরদোয়ান যদি নির্বাচনে জয়ী হন তাহলে কতটা রাজনৈতিক সুবিধা আদায় সম্ভব।

আশাবাদী গোষ্ঠী

আশাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও কয়েকটি রুশ সীমান্তবর্তী বা সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র। তারা মনে করে, ন্যাটোর সদস্য হওয়ার কারণে তুরস্ক ব্যাপক উপকৃত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তুরস্ক নিজের সর্বোৎকৃষ্ট স্বার্থের পক্ষে যা তা করবে এবং আপত্তি প্রত্যাহার করবে।

এমন কিছুর জন্য কর্মকর্তারা সন্ত্রাসী মনে করা ব্যক্তিদের হস্তান্তর করার চেয়ে বাস্তববাদী দাবির জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। যেমন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বা মার্কিন যুদ্ধবিমান কিনতে তুরস্ককে অনুমোদনের মতো বিষয়। তুর্কি বিমানবাহিনীকে আধুনিকীকরণের জন্য এসব যুদ্ধবিমান প্রয়োজন এরদোয়ানের।

আশাবাদীরা মনে করেন, সমঝোতার একটি ক্ষেত্র রয়েছে যা ন্যাটোর পক্ষে। জোট, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। যেকোনও দেশের জন্য সদস্যপদ উন্মুক্ত থাকার বিষয়টি ঘোষণা করেছে ন্যাটো। সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সদস্যপদ পাওয়ার সব যোগ্যতাই রয়েছে। ফলে তাদের জোটে যোগদান করতে পারা না ন্যাটোকে হাস্যকর করে তুলবে। এক ন্যাটো কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, তারা ধারণা করছেন এরদোয়ান সিদ্ধান্ত পাল্টানোর জন্য সম্মেলনের আগ পর্যন্ত অপেক্ষায় রাখবেন, যাতে করে তিনি পশ্চিমা মিত্রদের প্রশংসা বাগিয়ে নিতে পারেন।

তবে সিএনএন-এর সঙ্গে কথা বেশিরভাগ কর্মকর্তারা হতাশবাদী দলে। তারা মনে করেন, ১১ জুলাইয়ের আগে এরদোয়ানের অবস্থান বদলের সম্ভাবনা শূন্য শতাংশ।

হতাশাবাদী গোষ্ঠী

এক ন্যাটো কূটনীতিক বলেন, আমি ক্রমেই ভাবতে শুরু করেছি সুইডেনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে ফিনল্যান্ড একাই ন্যাটোর সদস্য হয়ে যাবে।

সুইডিশ ও ফিনিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ন্যাটো মহাসচিব। ছবি: রয়টার্স

জোটের অপর সদস্যরা এখনও দুই দেশের ন্যাটোতে যোগদান আটকে যাওয়ার বাস্তবতা দেখছেন। একই সঙ্গে এমন পরিস্থিতি ন্যাটো কীভাবে মোকাবিলা করে বিবেচনা করছেন।

একাধিক ন্যাটো কর্মকর্তা ও কূটনীতিক সিএনএনকে বলেছেন, বিপদ হলো তুরস্কের এই আটকে দেওয়া ক্রেমলিনের ভাষ্যকে সমর্থন করছে। ক্রেমলিন বলে আসছে পশ্চিমারা ও ন্যাটো বিভক্ত। ফলে জোটের কাজ হলো সদস্য না হলেও স্পষ্ট করা যে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন এখন ন্যাটোর ছায়াতলে রয়েছে। হয়ত তারা পূর্ণাঙ্গ সদস্য নয়, কিন্তু তারা যতটা সম্ভব ততটা ঘনিষ্ঠ অংশীদার এবং তারা এখন আর নিরপেক্ষ না।

তুরস্কের সম্মতি পেলেও পৃথক, অবশ্য কম গুরুত্বপূর্ণ বাধা হাঙ্গেরি। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান প্রকাশ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি নরডিক দেশ দুটির জোটে যোগদানের বিরোধী নন। কিন্তু এই সমর্থন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তে যাতে পরিণত না হয় সেজন্য উপায় খুঁজে চলেছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা ওরবানকে পুতিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে মনে করেন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক হাঙ্গেরীয় সদস্য কাতালিন সেহ বলেন, ওরবান যদি সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদান আটকে দেন তাহলে তা পুতিনকে আরেকটি সুবিধা প্রদান করা। পুতিনের বিরুদ্ধে ন্যাটোর যে কোনও জয় ওরবানের শাসনকে বিশৃঙ্খলায় ফেলে দেবে।

ধারণা করা হচ্ছে, ওরবানের যতই এড়ানোর চেষ্টা করেন না কেন তুরস্ক যদি সম্মতি দিয়ে দেয় তাহলে হাঙ্গেরিও ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিরোধিতা করবে না।

এত জটিল রাজনীতি ও কূটনীতির মধ্যে মজার বিষয়টি হারিয়ে যায়নি। ইউক্রেনে আক্রমণের নির্দেশ দেওয়ার সময় কারণ হিসেবে পুতিন বলে ছিলেন ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঠেকানো। বাস্তবতা হলো তার এই আগ্রাসন ঐতিহাসিকভাবে নিরপেক্ষ দেশ দুটিকে ন্যাটোর কাছে নিয়ে গেছে। যা ন্যাটোর জন্য বড় এক জয়।

তুরস্ক ও হাঙ্গেরির সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার আগ পর্যন্ত জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরই ফিনল্যান্ড ও সুইডেন পশ্চিমাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দ্রুত যুদ্ধ থেমে গেলে তারা যে আবার অবস্থান পাল্টে ফেলবে, আবার নিরপেক্ষ হয়ে যাবে, এমনটি হওয়ার সুযোগ কম।

ন্যাটো ও বৃহত্তর পশ্চিমা জোটের ঝুঁকি হলো যদি জোটে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন যোগদান করতে না পারে তাহলে ক্রেমলিন এটিকে নিজের প্রোপাগান্ডায় ব্যবহার করতে পারবে। যদি তা ঘটে, এমনকি যুদ্ধ যদি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বিরোধীরা ঢাক পিটিয়ে বলতে থাকবে, পশ্চিমারা যে বিভক্ত, ন্যাটো যে বিভক্ত।

সিএনএন অবলম্বনে।

/এএ/
সম্পর্কিত
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে ইসরায়েল?
খারকিভে আবাসিক ভবনে রুশ হামলায় আহত ৬
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
সর্বশেষ খবর
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষে বাস উঠে পড়লো রেললাইনে, ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…