ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলের ব্যবসা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা সাংবাদিকের ফোনেও নজরদারি চালানো হয়েছে। ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের তৈরি করা সফটওয়্যার পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে তার ফোনে আড়ি পাতা হয়।
১৮ জুলাই এক প্রতিবেদনে ভারতে তিন শতাধিক ব্যক্তির ফোনে নজরদারির তথ্য প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়্যার’। ঘটনাচক্রে, রোহিনী সিংহ নামের ওই সাংবাদিক ‘দ্য ওয়্যার’-এরই কর্মী। রোহিনী ছাড়াও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সুশান্ত সিংহ নামে এক সাংবাদিকের ফোনেও পেগাসাসের অস্তিত্ব মিলেছে।
ফাঁস হওয়া একটি ডেটাবেজে এই ফোন নম্বরগুলো প্রথমে পায় প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। পরে তারা বিভিন্ন দেশের ডজনখানেকেরও বেশি সংবাদমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’-এর কাছে এটি সরবরাহ করে। ভারতে ওই তথ্য পেয়েছে ‘দ্য ওয়্যার’।
তাদের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ তিন শতাধিক মানুষের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে। যদিও সব ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা এখনও সম্পন্ন হয়নি।
জানা গেছে, দ্য ওয়্যার ছাড়াও হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, নেটওয়ার্ক ১৮, দ্য হিন্দু এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর সাংবাদিকদের ফোনও হ্যাক করা হয়েছে।
অমিত শাহের ছেলে জয় শাহের পাশাপাশি ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির-ঘনিষ্ঠ’ ব্যবসায়ী নিখিল মার্চেন্টের কারবার এবং ব্যবসায়ী অজয় পিরামলের সঙ্গে মোদি-মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পীযূষ গয়ালের লেনদেন নিয়েও তদন্ত চালিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন রোহিনী।
দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ সালে ঠিক যে সময়ে রাফাল যুদ্ধবিমান নিয়ে ভারতজুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, ঠিক সেই সময়েই ফাঁস হওয়া তালিকায় নাম উঠেছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সুশান্তের। গত বছরই ফরেনসিক পরীক্ষায় তার ফোনে পেগাসাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। ঘটনাচক্রে, সুশান্তও রাফাল নিয়েই তদন্ত করছিলেন।
ম্যালওয়্যারটির বিক্রেতা ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও-র দাবি, এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে তারা যুক্ত নয়। বরং মানবাধিকার রেকর্ড ভালো এমন দেশের সামরিক বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা বিভাগের কাছে তারা এই সফটওয়্যার বিক্রি করেছে।
যেভাবে কাজ করে পেগাসাস স্পাইওয়্যার
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, পেগাসাস সম্ভবত কোনও বেসরকারি কোম্পানির তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী স্পাইওয়্যার। আইওএস বা অ্যান্ড্রয়েড-চালিত ফোনের ওপর গোপনে নজরদারি চালানোর ক্ষমতা এই ম্যালওয়্যারটির রয়েছে। পেগাসাস যদি কোনোভাবে একবার ফোনে ঢুকে যেতে পারে, তাহলে এটি আপনার ফোনকে সার্বক্ষণিক এক নজরদারির যন্ত্রে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে। ফোন থেকে আপনি যত মেসেজ বা ছবি পাঠান, কিংবা রিসিভ করুন, পেগাসাস তা কপি করে গোপনে পাচার করে। পাঠিয়ে দেয় নির্দিষ্ট জায়গায়।
এই স্পাইওয়্যারটি আপনার অগোচরে ফোনের কথাবার্তা রেকর্ড করতে পারে, এমনকি ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে গোপনে আপনার ভিডিও রেকর্ড করতে পারে। আপনি কোথায় আছেন, কোথায় গিয়েছিলেন, অথবা কার কার সঙ্গে দেখা করেছেন, পেগাসাস সে সম্পর্কেও জানতে পারে বলে মনে করা হয়। ২০১৬ সালে গবেষকরা পেগাসাসের প্রথম ভার্সনটির কথা জানতে পারেন। সে সময় কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির ফোনে টেক্সট মেসেজ বা মেইল পাঠানো হতো, যাতে থাকতো একটি লিংক। সেই লিংকে ক্লিক করলেই পেগাসাস ফোনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতো। অবশ্য এরপর এনএসও গ্রুপ এই স্পাইওয়্যারের ক্ষমতাকে আরও বহুগুণ শক্তিশালী করেছে।
২০১৯ সালে ভারতে আরেক পেগাসাস কেলেঙ্কারির পর জানা যায়, ভিডিও কলের মাধ্যমেই স্পাইওয়্যারটি মোবাইল ফোনে ইন্সটল হয়ে যায়। যদি সেই ফোন রিসিভও না করা হয়, তবুও সফটওয়্যারটি ফোনে ইন্সটল হয়ে যায়। অর্থাৎ যার ফোনে নজরদারি চালানো হবে বলে টার্গেট করা হয়, তার বিশেষ কিছু করার থাকে না। সূত্র: বিবিসি।