নববর্ষ বরণে কলকাতা শহরজুড়ে শিকড়ের সন্ধান। বাংলার মনীষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পাশাপাশি বাংলার বাণিজ্যের গৌরবময় অতীতকেও ফিরে দেখার প্রয়াস এবারের বর্ষবরণে। ভারতের বাংলা পঞ্জিকা মতে নববর্ষের দিন শনিবার বিকেলে বঙ্গীয় সনাতনী সংস্কৃতি পরিষদ ও বাংলা আবার সামাজিক সংগঠন আয়োজন করেছে মঙ্গল শোভাযাত্রার।
সংগঠনের তরফে প্রবীর ভট্টাচার্য বলেন, ‘মহারাজ শশাঙ্ক বাংলা নববর্ষের সূচনা করেছিলেন। আমরা তাঁর প্রতিকৃতি নিয়ে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা করব। শোভাযাত্রায় থাকবে বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির প্রতীক লজ্জা গৌরী, শঙ্খ, আম্রপল্লব, কলাগাছ, চামর, কুলো, ঢাক- ঢোল, গৌড়ীয় নৃত্য, কীর্তনের দল। শোভাযাত্রায় সমুখে থাকবে মহারাজা শশাঙ্কের সময়ের ধ্বজ। শোভাযাত্রাটি রবীন্দ্রসদন, বিড়লা তারামণ্ডল, ভিক্টোরিয়া হয়ে অ্যাকাডেমি চত্বরে এসে শোভাযাত্রা শেষ হবে। এরপর রাণুছায়া মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় বছরের শশাঙ্ক সম্মান পাবেন গবেষক কাঞ্চন বন্দ্যোপাধ্যায়। তার উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো- শৈব, বৈষ্ণবীয় পুঁথি অনুসন্ধান করে ত্রিবেণীতে কুম্ভমেলার সূচনা করেছিলেন।’
একইভাবে বাংলার চিরন্তণী লোকসংস্কৃতি তুলে ধরেছে সংস্কার ভারতী (দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত)। চৈত্রের শেষ দিনে পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতিকেন্দ্রের পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহে উন্মোচিত হয় ‘বাংলার আলপনা’ শীর্ষক দেওয়ালপঞ্জী। উন্মোচন করেন পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতিকেন্দ্রের অধিকর্তা আশিস গিরি। সংস্কার ভারতীর কেন্দ্রীয় সম্পাদিকা নীলাঞ্জনা রায় বলেন, ‘দীর্ঘ ২০ বছর ধরে সংস্কার ভারতী এই সাংস্কৃতিক দেওয়ালপঞ্জী প্রকাশ করে আসছে। ইতোমধ্যে এই বিষয়ের ওপর গবেষণা করছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। প্রথম বছর দেওয়ালপঞ্জীর বিষয় ছিল ‘বাংলার পালাপার্বণ’। সংস্কার ভারতীর শিল্পী সদস্যরা গবেষণামূলক এই দেওয়ালপঞ্জী প্রকাশের পরম্পরাটি বর্তমানেও অব্যাহত রেখেছেন। বিগত বিভিন্ন বছরে ভারতের সংস্কৃতিভিত্তিক যে বিষয়গুলো নিয়ে দেওয়ালপঞ্জী প্রকাশিত হয়েছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ভারতের উৎসব’, ‘ভারতের লোককলা’, ‘বাংলার দেবদেউল’, ‘নমন ১৮৫৭’, ‘ডাকঘর নাটকের শতবর্ষ’, ‘ভারতের নদনদী’, ‘ভারতের মহীয়সী নারী’, ‘ভারতের প্রাচীন নগরী’, ‘ভারতের গুহাশিল্প’ ও ‘বিবেকানন্দ শিলা স্মারক- কন্যাকুমারী’।
১২ টি মাসের ১২ টি আলপনা চিত্রাঙ্কন করে দেওয়ালপঞ্জীকে আকর্ষণীয় করে তোলেন শিল্পী অধ্যাপক সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, জয়দেব বণিক, দীপক দাস, অরিত্র ঘোষ দস্তিদার, কনাদ দাস, জয়দীপ ভকত, অরূপ দাস, ঋদ্ধি বণিক, সোমা হাজরা ও দেবপর্ণা চক্রবর্তী। প্রকাশনায় সহায়তা করে পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতিকেন্দ্র।
শুধু সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতি নয়, বাণিজ্যেও বাংলা যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী ছিল। সেই অতীত ঐতিহ্য স্মরণে বাংলাপক্ষ নববর্ষের দিন সকালে ‘টাকা মিছিল’ করবে। বিষয়টা ঠিক কী? সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক কৌশিক মাইতি বলেন, “এই নামকরণটি প্রতীকী। আমরা আসলে বাঙালির বাণিজ্যের অতীত সমৃদ্ধির ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। বাঙালি ব্যবসা করতে পারে না, এই ধারণা ঠিক নয়। আমাদের নয়া শ্লোগান তাই ‘বাংলার টাকা, বাংলার আশা/ বাংলার কাজ, বাংলার ভাষা/ বাঙালির হোক, বাঙালির হোক, /বাঙালির হোক, হে ভগবান’।”
নববর্ষের সকালে গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর পর্যন্ত এক বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো দ্বারা ‘অধরা বিশ্ব ঐতিহ্য’ স্বীকৃতি পাওয়ার পরের বছর থেকেই প্রতি বছর এই আয়োজন করেছেন তারা।
ইতিমধ্যে গত এক মাস ধরে চলছে এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার প্রস্তুতি। ওয়ার্কশপ চলছে শিল্পীদের। বানানো হচ্ছে নানা ম্যাসকট- পশ্চিম বঙ্গের জাতীয় প্রাণি মেছো বেড়াল, তৈরি হচ্ছে বাউল, বুলবুলি পাখি, নৌকা, দক্ষিণ দিনাজপুরের বিখ্যাত কুশ্মাণ্ডির মুখোশ। বিভিন্ন শিল্পীরা তাদের শ্রম দান করছেন বাংলার কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে।
সাজো সাজো রবে মুর্শিদাবাদ থেকে আসছেন জারি গানের দল, বীরভূম থেকে আসছেন হাপু ও বোলান গানের দল। সবাই অংশ গ্রহণ করবেন এই সাংস্কৃতিক শোভাযাত্রায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন পবিত্র সরকার, চন্দন সেন, দেবেশ চট্টোপাধ্যায় ও বর্ষীয়ান প্রতুল মুখোপাধ্যায়।শোভাযাত্রার মূল ভাবনা, যা নিখাদ বঙ্গ সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করা, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই, উদ্বোধন করবেন গ্রামীণ মাটির বেহালা বাদক রহমত।