দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের পরেই পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছিল। সোমবার (২৪ জুন) পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদিকে চিঠি লিখে ‘ফারাক্কা-গঙ্গা জলবণ্টন চুক্তি’ নবায়ন এবং তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অংশগ্রহণ ছাড়া তিস্তা এবং ফারাক্কার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও চুক্তিতে আমার তীব্র আপত্তি রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থ নিয়ে কোনও আপস করব না।’ কলকাতাভিত্তিক ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা এ খবর জানিয়েছে।
চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে মমতা লিখেছেন, ‘গঙ্গা ও তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে হয়ত আপনার কিছু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোনও মতামত না নিয়ে এমন একতরফা আলোচনা কাঙ্ক্ষিত বা গ্রহণযোগ্য নয়।’
বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের সঙ্গে যে তিনি সুসম্পর্ক রাখতে চান, সেই বার্তা দিয়ে মমতা জানিয়েছেন, ছিটমহল বিনিময়, রেল ও বাস যোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিবিড় হয়েছে। কিন্তু এর পরেই তার মন্তব্য, ‘কিন্তু পানি অত্যন্ত মূল্যবান। প্রাণধারণের রসদ নিয়ে কোনও সমঝোতা করতে আমরা প্রস্তুত নই।’
পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে পানি বণ্টনের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন তিনি। বস্তুত, সোমবার বিকেলে নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে পানি বণ্টন নিয়ে নয়াদিল্লি-ঢাকা দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মমতা। সেই সঙ্গে তার অভিযোগ, ‘চীনকে দিয়ে ড্যাম (জলাধার) বানিয়েছে বাংলাদেশ।’
প্রসঙ্গত, গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। এই আবহে শনিবার নয়াদিল্লিতে নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মধ্যে একটি বৈঠক হয়। সেখানে ‘ফারাক্কা-গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি’ নবায়নের জন্য ‘যৌথ কারিগরি কমিটি’ তৈরি করা হয়েছে। কার্যত এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হলো। রবিবারই তৃণমূলের তরফে মোদি সরকারের ওই পদক্ষেপের সমালোচনা করা হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে যখন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ বছরের জন্য গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছিল, ওই সময় বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। দিল্লিতে ক্ষমতাসীন ছিল এইচডি দেবগৌড়ার যুক্তফ্রন্ট সরকার। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ওই সময় গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিতে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালের চুক্তি মোতাবেক, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিদিন ৪০ হাজার কিউসেক করে পানি পায় ভারত। ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে ফিডার ক্যানাল হয়ে কলকাতা বন্দরে যায় সেই পানি। অবশিষ্ট পানি মূল ব্যারেজ হয়ে যায় বাংলাদেশে। তবে মার্চ-এপ্রিলে নদীতে জল কমতে শুরু করলে সমস্যা বাড়ে। চুক্তি অনুযায়ী, মার্চ মাসে ২০ দিন বাংলাদেশে ৩৫ হাজার কিউসেক করে পানি যায়। পরবর্তী ১০ দিন ভারত পায় একই পরিমাণ পানি। এপ্রিলে উল্টো। ওই মাসে ভারত ২০ দিন পায় ৩৫ হাজার কিউসেক পানি। বাংলাদেশ শেষ ১০ দিন পাবে একই পরিমাণ পানি। বাকি সময় নদীতে যে জলপ্রবাহ থাকবে, তা সমানভাবে পাবে দু’দেশ।
মোদিকে পাঠানো চিঠিতে মমতা লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে গঙ্গার পানির গুরুত্বের পাশাপাশি ফারাক্কা থেকে পাওয়া পানি কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখার ক্ষেত্রেও বড় ভরসা।’ সেই সঙ্গে চিঠিতে মমতা বলেছেন, ‘ফারাক্কা ফিডার ক্যানালের মাধ্যমে অন্তত ৪০ হাজার কিউসেক পানি পেলে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা সম্ভব।’ তা না হলে গঙ্গায় পলি পড়ে কলকাতা বন্দর জাহাজ চলাচলের উপযোগী নাব্যতা হারাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
প্রায় আট বছর আগে ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে ঠিক ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণে পাংশায় পদ্মা নদীর ওপর হাসিনা সরকার বাঁধ নির্মাণে উদ্যোগী হওয়ায় আপত্তি তুলেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দু’দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত জলঙ্গি এবং মাথাভাঙা নদী ইতোমধ্যে পদ্মার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন মমতা। তিনি লিখেছেন, ‘এর ফলে সুন্দরবনে মিঠা পানির প্রবাহ ব্যাহত হয়েছে।’
মোদিকে পাঠানো চিঠিতে তিস্তার পানি বণ্টন প্রসঙ্গেরও উল্লেখ করেছেন মমতা। তিনি লিখেছেন, ‘সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে তিস্তার গুরুতর স্বাস্থ্যহানি হয়েছে। পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে।’ এর পরেই কেন্দ্রকে নিশানা করে চিঠিতে তার মন্তব্য, ‘দেখে আশ্চর্য হচ্ছি, তিস্তার ভারতীয় অংশের স্বাস্থ্য ফেরাতে পানিশক্তি মন্ত্রণালয়ের কোনও উদ্যোগই নেই!’ সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে তিস্তায় জলপ্রবাহ কমেছে এবং তাতে উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৩ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি অস্থায়ী চুক্তি হয়। ২০১১ সালে আরও একটি তিস্তা চুক্তির খসড়া তৈরি করে দুই দেশ, যেখানে শুকনো মৌসুমে ভারতের ৩৭.৫ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ৪২.৫ শতাংশ পানি পাওয়ার কথা হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চুক্তির বিরোধিতা করেন পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থহানির যুক্তি দেখিয়ে।
উল্লেখ্য, ভারতের সংবিধান অনুযায়ী পানির ওপর রাজ্যের অধিকার স্বীকৃত। তাই মমতার আপত্তি উপেক্ষা করে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন কার্যত সম্ভব নয় ভারতের কেন্দ্র সরকারের পক্ষে।