X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধের ঝুঁকি ‘ভঙ্গুর’ বিশ্ব অর্থনীতির নতুন হুমকি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:০৬আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:২৬

করোনাভাইরাস মহামারি ও ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ধাক্কা পার করতে না করতেই মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয়েছে ইসরোয়েলি আগ্রাসন। এই আগ্রাসন একটি আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত হতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন অনেকে। এমনটি হলে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি হতে পারে আকাশছোঁয়া। ফলে আবারও একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক ধাক্কা খাবে বিশ্ব। আশঙ্কা রয়েছে, এবারের ধাক্কাটা আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হতে পারে, যা সামাল দিতে হিমশিম খাবে বিশ্ববাসী। কেননা, এর আগে পর পর এমন দুবার বিশ্বে জ্বালানি শক্তির সংকট দেখা দেয়নি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে এমন পরিস্থিতির কথা উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট টানা তিন বছরের অর্থনৈতিক ধাক্কা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বিশ্ব। ইতোমধ্যে মুদ্রাস্ফীতি কমেছে, স্থিতিশীল হয়েছে তেলের দাম। ভবিষ্যৎ মন্দার আশঙ্কাও এড়ানো সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব যখন একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার কথা তখন দুঃসংবাদ দিলো কিছু নেতৃস্থানীয় আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারী। তারা সতর্ক করে বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ‘ভঙ্গুর’ অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার করা আরও কঠিন হতে পারে।

মূল্য বৃদ্ধি শুধু পরিবার এবং কোম্পানিগুলোর ক্রয় ক্ষমতাকেই কমিয়ে দেয় না বরং খাদ্য উৎপাদনের খরচও বাড়িয়ে দেয়। ফলে চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মুখে পড়ে মিসর, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো।

ঋণের উচ্চ মাত্রা, বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়া পাঁচ দশকের মধ্যে মন্থর পুনরুদ্ধারের কারণে বিভিন্ন দেশ হিমশিম খাচ্ছে। এসব পরিস্থিতি সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায়কে আরও কঠিন করে তুলছে। উচ্চ সুদহার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের ফলাফল সরকার ও বেসরকারি কোম্পানির ঋণ পাওয়া এবং ঋণ খেলাপি হওয়া এড়ানো আরও কঠিন করেছে।

নাইজেরিয়ার একটি বাজার। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস

তেল ও গ্যাসের দামের ওপর ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইন্দারমিট গিল বলেন, ‘এই প্রথম আমরা একই সময়ের মধ্যে দুইবার জ্বালানি শক্তি সংকটে পড়েছি। আমরা বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে ভঙ্গুর সময়টাতে রয়েছি।’

এই পর্যালোচনার সঙ্গে একমত আরও বেশ কয়েকজন বিশ্লেষক। জেপিমরগান চেজ-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জ্যামি ডিমন গত মাসে বলেছিলেন, ‘গত কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্ব হয়ত সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় পার করছে’। গাজায় সংকটকে তিনি পশ্চিমা বিশ্বের জন্য ‘সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

একাধিক মহাদেশে ভূরাজনৈতিক সংঘাতের কারণে সম্প্রতি অর্থনৈতিক সংকটের তীব্রতা বেড়েছে। প্রযুক্তি হস্তান্তর ও নিরাপত্তা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার উত্তেজনা জলবায়ু পরিবর্তন, ঋণ সহযোগিতা বা সহিংস আঞ্চলিক সংঘাত নিরসনে একসঙ্গে কাজের উদ্যোগকে জটিলতায় ফেলেছে।

একের পর এক রাজনৈতিক অস্থিরতার অর্থ হলো সুদের হার বা সরকারের ব্যয়ের মতো প্রচলিত আর্থিক ও রাজস্ব হাতিয়ার কম কার্যকর হতে পারে। 

হামাস ও ইসরায়েলের নির্মম লড়াইয়ে ইতোমধ্যে কয়েক হাজার বেসামরিকের প্রাণহানি হয়েছে। উভয় দেশে সংঘাতের দুর্ভোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বেশিরভাগ বিশ্লেষকরা একমত যে, সংঘাত যদি ছড়িয়ে না পড়ে তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব হবে সীমিত।

বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ার জেরোম এইচ. পাওয়েল বলেছেন, এই মুহূর্তে এটি স্পষ্ট নয় যে, মধ্যপ্রাচ্যের সংকট যুক্তরাষ্ট্রে বড় ধরনের আর্থিক প্রভাব রাখবে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারীরা ১৯৭০ দশকের মতো তেলের বাজার এখন আর নিয়ন্ত্রণ করে না। ওই সময় ইসরায়েলে আক্রমণ করেছিল মিসর ও সিরিয়া। তখন আরব দেশগুলো তেলের উৎপাদন কমিয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া বিকল্প নবায়নযোগ্য জ্বালানির কারণে বিশ্বের জ্বালানি চাহিদা শুধু তেল নির্ভর নয়।

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সেন্টার অন গ্লোবাল এনার্জি পলিসি-এর পরিচালক জ্যাসন বর্ডফ বলেন, এটি চরম ভঙ্গুর, অনিশ্চিত ও ভীতিকর পরিস্থিতি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, ইরান ও অপর উপসাগরীয় দেশগুলো একমত যে, চলমান সংকটের গাজা ও ইসরায়েল ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়ে যাওয়া কারও স্বার্থের পক্ষে যাবে না।

তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ভুল পদক্ষেপ, দুর্বল যোগাযোগ ও ভুল বোঝাবুঝির কারণে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো না চাইলেও সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

আর যেকোনও কারণেই হোক না কেন তেলের বৈশ্বিক সরবরাহ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে গেলে তা একসঙ্গে প্রবৃদ্ধি মন্থর ও মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে। এই অভিশপ্ত পরিস্থিতিকে স্থবিরতা বলা হয়ে থাকে।

ইওয়াই-পার্থেনন-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ গ্রেগরি ডাকো বলেছেন, সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে প্রতি ব্যারেল তেলের মূল্য এখনকার ৮৫ ডলার থেকে ১৫০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। এই পরিস্থিতির বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে ভয়াবহ।

তিনি সতর্ক করে বলেছেন, মৃদু মন্দায় শেয়ারের দরপতন হতে পারে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে লোকসান হতে পারে ২ ট্রিলিয়ন ডলার।

ইসরায়েলের একটি পাইপলাইন। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস

অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নিতে সংশয়ে আছেন। ফলে উদীয়মান বাজারগুলোতে ব্যবসার সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঋণের ব্যয় বেড়েছে, ব্রাজিল থেকে চীন বিভিন্ন দেশের কোম্পানিগুলো ঋণ পরিশোধে পুনরায় অর্থায়নে জটিলতায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কনসালটিং প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের মতে, একই সময়ে মিসর, নাইজেরিয়া ও হাঙ্গেরির মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো মহামারিতে খুব ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। ফলে পূর্বাভাসের চেয়ে প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। 

সংঘাত ও অর্থনৈতিক চাপের কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা থেকে ইউরোপে অভিবাসীদের গমন বাড়তে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিসরের সঙ্গে একটি আলোচনায় লিপ্ত। অভিবাসী নিয়ন্ত্রণের জন্য আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করছে তারা।

উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে অর্ধেক তেল আমদানি করে চীন। দেশটি আবাসন ব্যবসায় বিপর্যয় ও গত তিন দশকের মধ্যে দুর্বল প্রবৃদ্ধির কারণে জটিলতায় রয়েছে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধির আভাস রয়েছে। মন্থর মুদ্রাস্ফীতি, মজুদকৃত সঞ্চয় এবং ব্যাপক নিয়োগের কারণে  জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশটির প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ শতাংশের একটু কর্ম। 

বড় ভোক্তা বাজারের দেশ ভারতেরও অর্থনীতির পূর্বাভাসও ইতিবাচক। চলতি অর্থবছরে দেশটিতে ৬.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস প্রতিবেদন দেখভালের দায়িত্বে থাকা আয়হান কোসে বলেছেন, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির শিকার হতে পারে সাব-সাহারান আফ্রিকা। গাজা ও ইসরায়েলের সংঘাত শুরুর আগে থেকেই অঞ্চলটি ধুঁকছিল। পুরো অঞ্চলটির প্রবৃদ্ধি চলতি বছরে ৩.৩ শতাংশ কমে যেতে পারে। ২০১৪ সালে তেলের মূল্য কমে যাওয়ার পর অঞ্চলটির আয় আর বাড়েনি।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ইতোমধ্যে একটি ভয়াবহ দশক অতিক্রম করেছে সাব-সাহারান আফ্রিকা। এখন আরেকটি বিপর্যয়কর দশকের কথা ভাবতে হচ্ছে। তেলের বাজারের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে কিছু ঘটলে তা শুধু এই অঞ্চলেই প্রভাব বিস্তার করে না, এর বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে।

/এএকে/এএ/
সম্পর্কিত
এপি'র সাংবাদিককে গ্রেফতার করলো রাশিয়া
সোমবার যুদ্ধবিরতির আলোচনায় মিসর যাচ্ছেন হামাস প্রতিনিধি
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহত বেড়ে প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার
সর্বশেষ খবর
ম্যানসিটিকে আরও পেছনে ফেললো আর্সেনাল
ম্যানসিটিকে আরও পেছনে ফেললো আর্সেনাল
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
পাকিস্তানে বৃষ্টিতে নিহত ২২
‘গরমে’ শ্রেণিকক্ষে অজ্ঞান দুই শিক্ষার্থী
‘গরমে’ শ্রেণিকক্ষে অজ্ঞান দুই শিক্ষার্থী
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে