ইসরায়েলের ধারাবাহিক বিমান হামলায় মঙ্গলবার গাজা উপত্যকায় অন্তত ৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। আন্তর্জাতিক চাপ ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহ্বান উপেক্ষা করেই এই অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
গাজার বিভিন্ন স্থানে চালানো হামলায় নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার চিকিৎসকেরা। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরের বাসিন্দাদের সোমবার উপকূলীয় এলাকায় সরে যেতে বলেছিল ইসরায়েল। তবে ওই অভিযানের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।
একটি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোর ওপর চালানো হামলায় ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে থাকা পোড়া কাপড়, একটি লাল খেলনা ভালুকসহ ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের দৃশ্য উঠে এসেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে। আল-আহলি হাসপাতালে দেখা গেছে, সাদা কাফনে মোড়া মরদেহের ওপর প্রার্থনা করছেন শোকাহত স্বজনেরা।
স্কুলে আশ্রয় নেওয়া ওমর আহেল বলেন, আমাদের দোষ কী? শিশুদের কী দোষ? আমরা সিঁড়িতে পোড়া চুল ও ছেঁড়া কাপড়সহ যে নারীদের লাশ পেয়েছি, তাদের অপরাধ কী? আল্লাহর কসম, এটা চরম অন্যায়।
গত আট দিনে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিনি। গাজায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গাজা উপত্যকার প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দার সবাই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা সীমান্ত দিয়ে ইসরায়েলি জনপদে হামলায় ১২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় হামাস। এরপরই গাজায় শুরু হয় ইসরায়েলের এই ব্যাপক সামরিক অভিযান। এতে এখন পর্যন্ত ৫৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
গত ২ মার্চ থেকে গাজায় খাবারসহ জরুরি পণ্য প্রবেশে অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল। এতে সেখানে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি চরমে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ-সমর্থিত খাদ্য নিরাপত্তা মনিটর।
সোমবার ইসরায়েল ৯টি সহায়তা ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিলেও, মঙ্গলবার জাতিসংঘ জানিয়েছে—১০০টি ট্রাক প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে তারা। অথচ, জাতিসংঘ বলছে, প্রতিদিন অন্তত ৫০০টি ট্রাক প্রয়োজন গাজার জন্য।
জর্ডানে অবস্থিত জাতিসংঘের গুদামঘরে দাঁড়িয়ে সংস্থাটির মুখপাত্র লুইস ওয়াটারিজ বলেন, সব কিছু ফাঁকা। গুদাম, বিতরণ কেন্দ্র—সবই বহুদিন ধরে খালি।
সোমবার ব্রিটেন, ফ্রান্স ও কানাডার নেতারা ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দেন, গাজায় সেনা অভিযান বন্ধ না করলে তারা ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নিতে পারে।
মঙ্গলবার ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ-নোয়েল বারো এক রেডিও সাক্ষাৎকারে বলেন, সহায়তা হতে হবে তাৎক্ষণিক, ব্যাপক ও কোনও বাধা ছাড়াই। তিনি জানান, ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সহযোগিতা চুক্তি পুনর্বিবেচনার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশ।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ইঙ্গিত নিয়ে ইসরায়েল-ফ্রান্স সম্পর্কে টানাপোড়েন বেড়েছে। ফরাসি প্রস্তাবে চরম আপত্তি জানিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
নেতানিয়াহু বলেন, আমরা বর্বরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। ন্যায়সঙ্গতভাবে আত্মরক্ষা করতে থাকব যতক্ষণ না চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। তার লক্ষ্য গাজা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সাবেক উপপ্রধান ও বিরোধী ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতা ইয়ায়ের গোলান স্থানীয় এক রেডিওতে বলেন, একটি সুস্থ রাষ্ট্র বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না, শিশু হত্যা করে না এবং জনগণকে বিতাড়িত করার নীতি অনুসরণ করে না।
তার এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান নেতানিয়াহু। তিনি গোলানের বক্তব্যকে ‘ইহুদিবিরোধী ঘৃণ্য অপবাদ’ আখ্যা দেন। ইসরায়েলি সেনাপ্রধান আইয়াল জামিরও এক বিবৃতিতে সেনাদের মূল্যবোধ নিয়ে সন্দেহ তোলার সমালোচনা করেন।
ইসরায়েল বলছে, হামাসকে নির্মূল এবং জিম্মিদের মুক্ত করতেই তারা এই অভিযান চালাচ্ছে। হামাস পাল্টা দাবিতে বলেছে, যুদ্ধ বন্ধ হলে এবং বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দিলে তারা জিম্মিদের ছাড়তে রাজি।
সূত্র: রয়টার্স, আলজাজিরা, এনডিটিভি