ফিলিস্তিনের আবাসিক এলাকাগুলোতে যখন আজান শুরু হয় তখন মুসলিমদের কাছে তা সুমধুর কণ্ঠ ও মহিমান্বিত। দিনজুড়ে প্রতিদিন পাঁচবার এই আজান আলোড়িত করে ফিলিস্তিনিদের। এই আজানের মধ্য দিয়ে তাদের আবেগও প্রকাশিত হয়। কিন্তু সীমান্তের ওপারে আরব ইহুদিদের কাছে মুসলিমদের এই প্রার্থনার আহ্বান ভিন্নতা নিয়ে হাজির হয়। তারা এটাকে শব্দদূষণ হিসেবেই মনে করেন। কখনও কখনও আরও খারাপভাবে আজানকে তারা গ্রহণ করে। যখন ফিলিস্তিনি মুসলিম ও ইসরায়েলের ইহুদিদের মধ্যে সহিংসতা চলমান থাকে তখন মসজিদের মাইকে ফিলিস্তিনিদের আল্লাহু আকবার (আল্লাহ মহান) ধ্বনি উচ্চারণের পর ইহুদিরা আল্লাহর কথা ভাবে না, তারা এটাকে হুমকি বলেই মনে করে।
এ হুমকি মোকাবেলায় ইসরায়েলের এক আইনপ্রণেতারা উদ্যোগী হয়েছেন। তিনি একটি আইন প্রস্তাব করেছেন যাতে ইসরায়েল ও পূর্ব জেরুজালেমে আজান দিতে মাইক নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে ফজরের আজান, যা ভোর ৪টার দিকে দেওয়া হয়। আইনটি নিয়ে ইসরায়েলে আলোচনা চলছে। প্রস্তাবকারী আইনপ্রণেতা আশাবাদী আগামী সপ্তাহে আইনটি পাস হতে পারে।
প্রস্তাবক ইসরায়েলি আইনপ্রণেতারা আইনটির নামটির দিয়েছেন ‘মুয়াজ্জিন আইন’। তারা এটাকে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে খর্ব করা হিসেবে বিবেচনা করতে রাজি নন। এটাকে তারা শব্দ দূষণ কমানোর পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। প্রস্তাবকারীদের মতে, এর মধ্য দিয়ে ‘উন্নতমানের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত’ করা হবে।
প্রত্যাশিতভাবেই মাইকে আজান দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা ফিলিস্তিনিদের মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ফিলিস্তিনি মুসলিমরা মনে করেন, তাদের দীর্ঘদিনের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আচারকে কোনও উচ্ছৃঙ্খল হই-হুল্লোড় পাটির সঙ্গে তুলনা করা যায় না। যা পুলিশ এসে বন্ধ করে দেবে।
পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদি বসতি পিসগাত জিভ-এ সাজানো অ্যাপার্টমেন্টে বাস করেন ইয়ালে আনতেবি। তিনি এখন জেরুজালেম সিটি কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র। তার বাসা থেকে সামনে থাকালে নদীর তীরে শুকনো মরুভূমি দেখা যায়। যেখান থেকে একটু দূরত্বে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির শুয়াফাত অবস্থিত। এখন এটা শরণার্থী শিবির হলেও কয়েক প্রজন্ম আগে সেখানে ছিলো বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, বাজার ও ছোট ছোট রাস্তা মিলিয়ে একটি শহর।
আনতেবি বলেন, উত্তেজনার সময় আজানের শব্দ শুনলেই তাদের মনে আতঙ্ক জাগে। তিনি জানান, তার বাসায় বেড়াতে আসা নাতি-নাতনিরা ভয় পায়। কারণ তারা আরব গ্রামে কখনও বাস করেনি।
আনতেবি আরও অভিযোগ করেন, উত্তেজনার সময় মসজিদের মাইকের ভলিউম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে গাজা যুদ্ধের আজানের শব্দ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, আজান শুনে মনে হয় তারা আমাদের মাথার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছে।
ফিলিস্তিনে অবৈধ বসতি স্থাপনের সমর্থক ইহুদি হোম পার্টির সংসদ সদস্য মোট্টি ইয়োগেভ বিতর্কিত এই আইনটি প্রস্তাব করেছেন। তার দাবি, আরব ও ইহুদিদের মিশ্র বাস এলাকার অঞ্চল লোদ, আকরে, হাইফা, রামলি ও জেরুজালেমের মানুষেরা আজান শুনে ভীত হয়ে পড়েন বলে তার কাছে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে সারাদিন; বিশেষ করে ভোরে আজান শুনে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। মুসলিমরা মসজিদের মাইক ইহুদিদে আবাসের দিকে মুখ করে রাখে এবং তাদের জাগিয়ে তুলে।
এ ইহুদি সংসদ সদস্যের দাবি, কয়েক বছর আগে যখন বিদ্যুৎ ও মাইক ছিল না তখন মুসলিমরা দরজায় কড়া নেড়ে প্রার্থনার আহ্বান জানাতো অথবা মসজিদের মিনারে মাইক ছাড়া আজান দিত। ফলে মাইক নিষিদ্ধ করলে কোনও সমস্যা হবে না। তারা ফোনে বা অ্যালার্ম ঘড়ি দিয়ে নামাজের সময় ঠিক জানতে পারবে। এজন্য মাইকে আজান দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
ফিলিস্তিনের শুয়াফাতের স্থানীয়রা মুয়াজ্জিন বিলকে শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতি ছাড়া কিছু ভাবতে পারছে না। তাদের কাছে এটা দুর্বলের প্রতি সবলে ক্ষমতা জাহির করা। এক সময়ের মুষ্ঠিযোদ্ধা কামাল আবদুল কাদের বলেন, আজান কারও ক্ষতি করে না। আজানের অর্থ হলো আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে আসো। ইহুদিরা এটা শুনতে চায় না কেন?
এ সময় তাকে বলা হয়, আজানের শব্দে মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। তখন হেসে ওঠেন। রাস্তার ও আশপাশের প্রচণ্ড শব্দ ও উচ্চস্বরে পপ সংগীত বাজার দিকে ইঙ্গিত করেন। বলেন, দেখুন এটা হচ্ছে জেরুজালেম। খ্রিস্টানরা যখন চার্চে ঘণ্টা বাজায় আমরা মুসলিমরা তো অভিযোগ করি না। ইহুদিরা যখন তাদের শৃঙ্ঘা বাজায় তখনও করি না। এটা হচ্ছে ধর্মীয় বিষয়। এখানে কারও হস্তক্ষেপ করা উচিত না।
শুয়াফাতের মসজিদে আসা মুসল্লিরাও কামালের সঙ্গে একমত। একজন জানালেন, তথাকথিত মুয়াজ্জিন আইন মূলত ইহুদিদের রীতি রক্ষার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। ইসরায়েলের ইহুদিরা শুক্রবার সন্ধ্যায় সাব্বাতের শুরু হিসেবে সাইরেন বাজায়, কখনও হর্ন বাজায়। আইনটি প্রস্তাবের পর কিছু ইহুদি আইনজীবীও এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের এ আশঙ্কা এটা তাদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হতে পারে। আইনটির প্রস্তাবকরাও স্বীকার করেছেন, সাব্বাত সাইরেনকে রক্ষার জন্য মুয়াজ্জিন বিলটি প্রস্তাবের বিষয়ে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের সমর্থন রয়েছে প্রস্তাবিত আইনটির প্রতি। সম্প্রতি নেতানিয়াহু বলেছেন, আমি বলে শেষ করতে পারব না বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরা এটার মধ্য দিয়ে বিরক্ত করেছে। ইসরায়েল সব ধর্মের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কিন্তু তাকে অবশ্যই নাগরিকদের শব্দ দূষণ থেকেও রক্ষা করতে হবে। সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট।
/এএ/