২০১১ সালের ভূমিকম্প ও ভয়াবহ সুনামির পাঁচ বছর পর জাপানে আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পে এরইমধ্যে ৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় নয়শ মানুষ। আর ধসে পড়া ভবনের নিচে বহু মানুষের চাপা পড়ে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা সম্পর্কে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, শক্তিশালী ভূমিকম্পে বহু ঘড়বাড়ি ধসে পড়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। তবে ঘটনায় জাপানের পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এ ঘটনায় কোনও সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়নি। তবে জাপানের আবহাওয়া দফতর ও ভূমিকম্প বিশারদরা আরও ‘আফটার শক’-এর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কাছাকাছি আগ্নেয়গিরিগুলোতে অগ্নুৎপাতের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা তাও পর্যবেক্ষণ করছেন কর্মকর্তারা। আর আফটার শকের ভীতিতে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার তৎপরতা।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ দপ্তর ইউএসজিএস এর তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৯টার দিকে দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুমামতো ও কিয়েশু প্রদেশে প্রথম দফা ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৪। কিয়েশু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল দেশটির ইউকি শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে, ভূ-পৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। এর ৪০ মিনিটের মাথায় ৫ দশমিক ৭ এবং মধ্যরাতের পর ৬ মাত্রার আরও দুটি ভূমিকম্প ওই অঞ্চলকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। এতে প্রাথমিকভাবে ৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, আর আহতদের মধ্যে ৮ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানায় হাসপাতাল সূত্র। এ ছাড়াও ৮৫০ জনেরও বেশি হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন: জাপানে ভূমিকম্পে অন্তত ৯জন নিহত
কুমামতো ও কিয়েশু অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক বাড়ি-ঘর ধসে পড়ে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাস্তাঘাট। ভূমিকম্পের পর ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন তারা। সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার রাত থেকে মোট ৪৪ হাজার মানুষকে মাসিকি শহর থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরা সবাই আরও আফটার শক কিংবা অগ্নুৎপাতের ভীতিতে রয়েছেন।
কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ না হলেও সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুর্গত এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস বন্ধ হয়ে যায়। কুমামতোর পুলিশ কর্মকর্তা হিরোনাকি কোসাকি জানান, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত তারা নয়জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন। এদের মধ্যে চারজন পুরুষ ও পাঁচজন নারী। কুমামতোর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান তাকাউকি মাসুশিতা জানান, ওই শহরের প্রায় ৪৪ হাজার বাসিন্দাকে শুক্রবার ভোরের মধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে আইএস-এর নতুন ফ্রন্ট, পরিচালনায় আবু ইব্রাহিম
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুমামতো ও কিয়েশু প্রদেশের এই ভূমিকম্পের আগে বেশ কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় ভূমিধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ওই অঞ্চলে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতেরও আশঙ্কা রয়েছে। কাইয়ুশু দ্বীপে বেশ কিছু জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে সে সব আগ্নেয়গিরির প্রসঙ্গে গত বছরের নভেম্বর থেকেই ২ নম্বর সতর্ক সংকেত দিয়ে রাখা হয়েছে।
ওয়েস্ট হিরোইয়াসু এলিমেন্টারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক সোসুকি তানাকা প্রায় ৩০০ মানুষকে তার বিদ্যালয়ে আশ্রয় দিয়েছেন। অস্থায়ীভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হওয়া এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমরা সন্ধ্যা থেকেই ভূমিকম্পের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করছি। অনেকেই নির্ঘুম রাত পার করেছেন।’ মাসিকি শহরের ব্যায়ামাগারে রাতের বেলা আশ্রয় নিয়েছিলেন অন্তত ২০০ মানুষ। ব্যায়ামাগারের রক্ষণাবেক্ষণকারী ইয়োকো মারুমি জানান, ‘রাতে ২০০ মানুষ অবস্থান করলেও এখন আশ্রয় গ্রহণকারীর সংখ্যা প্রায় ৫০০ এবং শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখনো মানুষ আশ্রয় নিতে এখানে আসছেন।’
শক্তিশালী ওই ভূমিকম্পের পর আশঙ্কা করা হচ্ছে আরও ‘আফটার শক’-এর। ২০১৩ সালের মার্চ থেকে ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে মাটির কাঠিন্য (ইনটেনসিটি) পরীক্ষা করতে শুরু করে জাপানের আবহাওয়া দফতর, যেখান থেকে তারা ভূমিকম্প থেকে ধারণা নিয়ে থাকেন। এবারের ভূমিকম্পের পর সেখান থেকে নেওয়া ধারণার ভিত্তিতে জাপানের কোব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-কম্পন বিদ্যার অধ্যাপক কাটসুহিকো ইসিবাসি বলেন, ‘অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না যদি আবারও একইভাবে অন্য কোনও স্থানে আবারও ভূমিকম্প আঘাত হানে।‘ তিনি বলেন, ‘এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই যে পরবর্তী ভূমিকম্প আগেরটির চেয়ে শক্তিশালী হবে না’।
ভূমিকম্পে যেসব স্থাপনা ধসে পড়েছে, সেইসব স্থাপনার নিচে বহু মানুষ চাপা পড়ে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে আফটার শকের শঙ্কায় উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। জাপানের সেলফ ডিফেন্স ফোর্স হিরোইয়াশু কুমামোতো অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করছে। তারা জানায় কাঠের তৈরি ঘরবাড়িগুলো বড় রকমের ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। ভূমিকম্পে নিরাশ্রয় হয়ে পড়া মানুষের মধ্যে রুটি ও পানি বিতরণ করা হয়েছে। ব্যায়ামাগার সহ অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রেও পৌঁছেছে লাঞ্চবক্স।
রাজধানী টোকিওতে সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে জাপানের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়াশিদে সুগা বলেছেন, '২০১১ সালের সুনামির পর এটি বড় ধরনের ভূমিকম্প। ১৯টি বাড়ি ধসে কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। আমরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছি।' . . বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (এসডিএফ) এর সাড়ে ৩ হাজার সদস্য রাত থেকেই উদ্ধার কাজে নিয়োজিত বলে জাপানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গেন নাকাতানি জানিয়েছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইতোমধ্যে নয় শতাধিক আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। আরও অনেকে আসছেন চিকিৎসা সহায়তা নিতে।
টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায়, ভূমিকম্পে রাস্তায় ফাটল ধরেছে, বেশ কিছু মঠ ও পুরনো একটি প্রাসাদ ধসে পড়েছে। কয়েকটি স্থানে আগুন লাগারও খবর পাওয়া গেছে। সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, গার্ডিয়ান, এশিয়ান রিভিউ
/ইউআর/বিএ/