X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আফগানিস্তানে ব্যর্থ মার্কিননীতি, যুদ্ধের তথ্য গোপন করছে পেন্টাগন

মাহাদী হাসান
৩০ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:১৭আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:২২

রক্তাক্ত ও নৃশংস হামলায় বারবার কেঁপে উঠছে আফগানিস্তান। গত কয়েকদিনের মধ্যে ভয়াবহ তিনটি হামলার পর দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে, তালেবানদের উৎখাতে মার্কিন জোটের যুদ্ধের সমাপ্তির পরও দেশটিতে হামলা বন্ধ না হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ছে মার্কিন আফগাননীতি। এর মধ্যেই দেশটিতে সেনা বাড়ানো ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। সমালোচকরা বলছেন, তিক্ত সত্য হলেও হামলাগুলোকে সেনা বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, আফগান যুদ্ধের তথ্য গোপন করার চেষ্টা করছে মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন।

আফগানিস্তানে মার্কিন নীতি ব্যর্থ

শনিবার কাবুলে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়। তার আগের দিন শুক্রবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টালে হামলা চালায় জঙ্গিরা। আর সোমবার কাবুলে একটি সামরিক একাডেমিতে চালানো হয় হামলা। কানাডাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল রিসার্চের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে ১ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও ২০১৬ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ১২ হাজার। ফলে দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জন এখনও অনেক দূরের লক্ষ্য। যদিও আফগানিস্তানে দায়িত্বপালন করা শীর্ষ মার্কিন জেনারেল আগামী নভেম্বরের মধ্যে তালেবান উৎখাতের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। দুই বছরের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ এলাকা নিজেদের দখলে রাখতে চান তারা। 

সোমবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, আফগানিস্তানে মার্কিন কৌশল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক হামলাগুলো প্রমাণ করে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ট্রাম্প প্রশাসন যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা বাস্তবায়নে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের সাবেক কমান্ডার কশ সাদাত ও স্ট্যানলি ম্যাকক্রিস্টাল দেশটির পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিকে জানিয়েছেন, এখনও আফগানিস্তান লড়ছে এবং ২০০১ সালে ক্ষমতা হারানো তালেবান তাদের সর্বোচ্চ শক্তি অর্জন করেছে।

আরেক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে আফগানিস্তানে মার্কিন নীতি ব্যর্থ হয়েছে সরাসরি দাবি করা হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট অবস্থান করলেও তালেবান ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আবারও শক্তিশালী হয়ে ওঠছে। যে বাস্তবতা হতাশার।

একের পর এক হামলা চালাচ্ছে তালেবানরা

এতে আরও বলা হয়েছে, ২০০১ সালে তালেবানকে উৎখাতের পরও মার্কিন ও আফগান সেনারা জঙ্গি গোষ্ঠীটির আফগান ও পাকিস্তান নেটওয়ার্ককে দমনে হিমশিম খেয়েছে। বর্তমানে তালেবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে। বাবাজি ও মাজরাহ এর মতো শক্তিশালী ঘাঁটি রয়েছে তালেবানের যেখানে তাদের পরাজিত করা জোট সেনাদের পক্ষে কঠিন। বড় বড় শহরগুলোতে হামলা চালিয়ে তালেবান ঘোষণা করছে, দেশটিতে কেউই নিরাপদ নয়।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান যুদ্ধের তথ্য গোপন করার চেষ্টা করছে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন। আফগানিস্তানে কাজ করা শীর্ষ মার্কিন পর্যবেক্ষক সংস্থাকে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর প্রতিবন্ধকতাকে গোপন করতে বলেছে পেন্টাগন। ফলে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোটের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশন বা সিগার নামের ওই সংস্থাটি আফগানিস্তানে অনেক দিন ধরেই কাজ করে আসছিল। তালেবান ও আফগান সরকারের দখলে কতটুকু এলাকা আছে সেটা নিয়ে তিনমাসের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি।

সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে সিগার জানায়, তাদেরকে তথ্য প্রকাশে নিষেধ করা হয়েছিল। ২০০৯ সালের পর প্রথমবারের মতো সামরিক বাহিনী তাদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। আফগান ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ফোর্সের প্রকৃত সেনাসংখ্যা বলতেও নিষেধ করা হয় তাদের। 

তালেবানের দখলে আফগানিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা

সংস্থাটির প্রধান জন এফ সোপকো পেন্টাগনের এমন সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের প্রতিবেদন পড়ে সাধারণ জনগণের বোঝা সম্ভব নয় যে তাদের অর্থ কিভাবে আফগানিস্তানে ব্যয় করা হচ্ছে।’

আফগানিস্তানে চলা ১৬ বছরের এই যুদ্ধের তথ্য গোপন করার সিদ্ধান্ত মূলত পেন্টাগনেরই। প্রতিরক্ষা দফতর থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, তারা সিগারকে কোনও তথ্য গোপন করতে বলেনি। বরং ন্যাটো জোট এই অনুরোধ জানিয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ন্যাটোর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার ক্ষমতা পেন্টাগনের নেই। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাইকেল অ্যান্ড্রু বলেন, আগে যা প্রকাশের যোগ্য ছিল সেটা গোপন করার নির্দেশনায় যে জটিলতা তৈরি হয়েছে সেটা সমাধানে সিগার, ন্যাটো ও আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছে প্রতিরক্ষা দফতর।’

সাবেক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলেন,  এই তথ্য গোপনের নির্দেশ যেখান থেকেই আসুক না কেন এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। কারণ এতে করে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান কর্মকর্তার এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি সবার মাঝে তৈরি করেছে যা দূর করা কঠিন হবে। 

সোপকো বলেন, মার্কিন জনগণ ধারণা করবেন যে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতি নেই বলেই তথ্য গোপন করা হচ্ছে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও এমন অভিযোগ উঠেছিল যা পরবর্তীতে তা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। সোপকো বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, আপনি আমাকে যাই জিজ্ঞাসা করুন না কেন আমাকে বলতে হবে এটা গোপন বা এটা বলা যাবে না। মানে সবকিছুরই যেন একই জবাব।’  তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা দফতর এই নির্দেশনার জন্য তাকে কোন কারণ দেখায়নি। 

প্রতিরক্ষা দফতরের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, আফগানিস্তানে ৬০ শতাংশ এলাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১০ শতাংশ।

আফগানিস্তানে সেনা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প

গত নভেম্বরে জেনারেল জন নিকলসন বলেছিলেন, আফগান সরকার ২০১৬ সালের মতোই নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। ৬৪ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে, তালেবানের দখলে ১২ শতাংশ ও বাকি ২৪ শতাংশ এলাকায় বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি চলছে। তবে তিনি কোনও জেলার নাম বা সংখ্যা প্রকাশ করেননি।

সোপকো বলেন, সরকারের নিয়ন্ত্রণ কমতে শুরু করেছে। আর বিদ্রোহীরা বেশি জেলা দখল করতে ‍শুরু করেছে। জনগণের কাছে এই তথ্য লুকানোর চেয়ে এই বিষয়টি নিয়ে বেশি চিন্তা করা উচিত।

আল-জাজিরা জানায়, আফগান যুদ্ধের ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। গত বছর আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী বেশ কিছু তথ্য গোপন করে। তাদের শক্তি ও নিহতের সংখ্যা অনেক কিছুই এড়িয়ে যায় তারা। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছিল, তথ্যগুলো আফগান সরকারের কাছে আছে ও সরকারই তা প্রকাশ করতে চায় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, সামরিক বাহিনী চাপে ছিল। তাদের অর্জন সবাই না জানলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা তথ্য গোপন করে এমন এক পথে যাচ্ছি যেখানে লক্ষ্য অর্জনের চাপ আরও বেশি হবে।’

ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলেও হামলা চালায় তালেবানরা
কিউথ্রি ফক্স জানায়, আফগান যুদ্ধের বিষয়টি প্রায় মার্কিন জনগণ ভুলে গেছেন। ২০০২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। সোপকো বলেন, তার প্রতিবেদনেও পেন্টাগন অনেক তথ্য গোপন করতে বলেছে। অনেক সময় হতাহতদের সংখ্যাও গোপন করেছেন তারা।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম কিউথ্রি ফক্সের এক প্রতিবেদন বলা হয়, আফগান যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নতুন কৌশল ঘোষণার পর এমন অবস্থানে আসলো পেন্টাগন। ১৬ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে তালেবানসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মোকাবিলায় নতুন কৌশলের কথা জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। নাকচ করে দিয়েছেন কোনও আলোচনার সম্ভাবনাও।

আফগানিস্তানে আরও তিন হাজার সেনা পাঠানোরও ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সেনার সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪ হাজার।

 

/এএ/
সম্পর্কিত
এ বছর পুলিৎজার পেলো ৩ সংবাদমাধ্যম
পুতিনের পঞ্চম মেয়াদের শপথ অনুষ্ঠান বয়কট করলেন পশ্চিমা নেতারা
ইসরায়েলকে অস্ত্রের চালান দেওয়া স্থগিত করলো যুক্তরাষ্ট্র?
সর্বশেষ খবর
সব হজযাত্রী ভিসা নিয়ে সঠিক সময়েই হজে যাবেন: ধর্মমন্ত্রী
সব হজযাত্রী ভিসা নিয়ে সঠিক সময়েই হজে যাবেন: ধর্মমন্ত্রী
শোরুম উদ্বোধন করতে যাওয়া সাকিবকে দেখতে গিয়ে স্কুলছাত্র বিদ্যুৎস্পৃষ্ট
শোরুম উদ্বোধন করতে যাওয়া সাকিবকে দেখতে গিয়ে স্কুলছাত্র বিদ্যুৎস্পৃষ্ট
সাবেক এসপি সুব্রত কুমার হালদারসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট
সাবেক এসপি সুব্রত কুমার হালদারসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট
জেলেনস্কিকে হত্যার ষড়যন্ত্র, ২ ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা আটক
জেলেনস্কিকে হত্যার ষড়যন্ত্র, ২ ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা আটক
সর্বাধিক পঠিত
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
ছাত্রলীগ সহসভাপতি সাদ্দামের বছরে আয় ২২ লাখ, ব্যাংকে ৩২ লাখ, উপহারের স্বর্ণ ৩০ ভরি
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাচনছাত্রলীগ সহসভাপতি সাদ্দামের বছরে আয় ২২ লাখ, ব্যাংকে ৩২ লাখ, উপহারের স্বর্ণ ৩০ ভরি
বৃষ্টি ও বন্যার কী পূর্বাভাস পাওয়া গেলো?
বৃষ্টি ও বন্যার কী পূর্বাভাস পাওয়া গেলো?
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হামাস, অগ্রহণযোগ্য বলছে ইসরায়েল
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হামাস, অগ্রহণযোগ্য বলছে ইসরায়েল