স্থানীয় জনগণের নেতৃত্বে পরিচালিত এবং একীভূত পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিধি কর্মসূচি গর্ভবতী নারী, কিশোরী ও দুই বছরের কম বয়সি শিশুদের স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে বলে আইসিডিআর,বির গবেষণায় জানা গেছে।
সোমবার (৭ জুলাই) আইসিডিডিআর,বির সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত এক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে ‘নগরের নিম্নবিত্ত অন্তঃসত্ত্বা নারী-কিশোরী ও দুই বছরের কম বয়সি শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে করা নিউট্রি-ক্যাপ’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল তুলে ধরা হয়। অ্যাডভান্সিং সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রডাক্টিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস (অ্যাডসার্চ) প্রকল্পের আওতায় এই গবেষণাটি ঢাকার মিরপুরের বাউনিয়াবাদ বস্তিতে বসবাস করা মানুষের ওপর করা হয়।
আইসিডিডিআর,বি জানায়, গত দুই দশকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও দ্রুত নগরায়নের ফলে ক্রমশ নতুন নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। ১৯৭৩ সালে দেশে নগরায়নের মাত্রা ৮ শতাংশ হলেও ২০২২ সালে তা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়। বর্তমানে ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ শহরে বাস করছে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে। সামগ্রিকভাবে নগরের স্বাস্থ্য সূচক গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ভালো হলেও শহরে বাস করা মানুষদের মধ্যে আয়ের তারতম্য ব্যাপক এবং এ ক্ষেত্রে বিপুল বৈষম্য বিদ্যমান। বস্তিতে বাস করা অর্ধেকের বেশি পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের শিশুদের প্রায় ৫০ শতাংশ খর্বাকৃতির। যেখানে শহরের ৫৩ শতাংশ নারী প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে গর্ভকালীন চার বা ততোধিকবার সেবা পান, সেখানে বস্তিতে এ হার মাত্র ৪০ শতাংশ। এছাড়া বস্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসীর বয়স ১৫ বছরের নিচে। ফলে বস্তিতে বাস করা অন্তঃসত্ত্বা নারী, কিশোরী এবং শিশুদের খাদ্য ও পুষ্টির জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
গবেষকরা জানান, মিরপুরের বাউনিয়াবাদ যেন নগরে বাস করা নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের বাস্তব সংকটগুলোরই এক জীবন্ত চিত্র। এই এলাকায় বাস করা ১৫ হাজার বিবাহিত নারীর মধ্যে গবেষণার সময়কালে ৭২১ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী শনাক্ত হন। এই গবেষণা কর্মসূচিতে আরও ৪ হাজার ২০০ কিশোরী এবং প্রায় ২ হাজার ৫০০ দুই বছরের নিচের শিশু অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১৬ হাজার ৫৩২টি পরিবারের মধ্যে ২ হাজার ৮২৬টি নিয়ে ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গভীর বিশ্লেষণ চালানো হয়। এসব পরিবারে যদিও কিছু সূচকে স্থিতিশীলতা দেখা গেছে, দারিদ্র্য ও অসুবিধা ছিল প্রকট। প্রতিটি পরিবারের গড় আয় ছিল ২১ হাজার টাকা, তবু প্রতি চারটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার খাদ্য সংকটে ভুগেছে, খাদ্য সংকটে ভোগা পরিবারের মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ কোনও না কোনোভাবে ঋণগ্রস্ত ছিল। ৩৯ শতাংশ পরিবারে প্রতি ঘরে তিন জনের বেশি সদস্য ঘুমাতেন। ৪২ শতাংশ পরিবারের নারীরা সংসারের আয়ে অবদান রাখতেন। এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি পরিবার প্রধান প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন।
গবেষকরা জানান, নিউট্রি-ক্যাপ কর্মসূচি তিনটি নগরের বস্তিতে বাস করা তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী– অন্তঃসত্ত্বা নারী, কিশোরী ও দুই বছরের নিচের শিশুদের লক্ষ্য করে একীভূত সেবা প্যাকেজ চালু করে। অন্তঃসত্ত্বারা প্রতি মাসে বাড়িতে গিয়ে পুষ্টিবিষয়ক পরামর্শ, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডির মতো পুষ্টি উপাদান এবং ওজন, রক্তচাপ, হিমোগ্লোবিন ও রক্তে শর্করার পর্যবেক্ষণ পায়। তাদের নিয়মিত প্রসবপূর্ব চেকআপ ও যথাযথ বিশ্রামে উৎসাহ দেওয়া হয়। ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। কর্মসূচিভুক্ত নারীদের গড় ওজন বৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৯ কেজি, যেখানে তুলনামূলক গ্রুপে তা ছিল ৭ দশমিক ৫ কেজি। এছাড়াও নিরাপদ প্রসব, হাসপাতালে সন্তান জন্মদানের হার বৃদ্ধি পায়, কমে যায় গর্ভপাত, মৃতভ্রুণ ও নবজাতকের মৃত্যুহার। গর্ভকালীন বয়সের তুলনায় কম ওজনের সন্তান জন্মের ঝুঁকি কমে ১৬ শতাংশ।
এছাড়া গবেষণার তথ্য বলছে, কর্মসূচিভুক্ত কিশোরীদের হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ গড়ে ১২ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২ দশমিক ৮ গ্রাম/ডেসিলিটারে। খাদ্য-বৈচিত্র্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পাওয়া না গেলেও স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। এই কিশোরীদের মধ্যে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ ছিল অপুষ্টির কারণে ক্ষীণকায়, আর ১২ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল অতিরিক্ত ওজনের, যা দেশের শহরাঞ্চলের গড় পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রয়েছে।
গবেষণায় শিশুদের স্বাস্থ্যেও দেখা যায় সুস্পষ্ট অগ্রগতি। উচ্চতা ও ওজন উভয় ক্ষেত্রে দেখা গেছে কর্মসূচিভুক্ত শিশুদের অবনতির হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া কিশোরীদের ক্ষেত্রে হজম প্রক্রিয়া ও অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে বলে জানা গেছে। জৈবিক পরীক্ষায় দেখা গেছে কর্মসূচিভুক্ত কিশোরীদের মাঝে অন্ত্রের প্রদাহ কমেছে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এই কর্মসূচির সফলতা উল্লেখযোগ্য। এই কর্মসূচির ফলে চিকিৎসায় পারিবারিক খরচ কমে এসেছে। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ কমেছে। সেবার পেছনে সময় বেশি দিতে হলেও সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য ব্যয় কম ছিল। মানবসম্পদের খরচ ছিল সবচেয়ে বেশি, তবে গবেষণা বলছে, এই মডেল ব্যবস্থায়িত হলে খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
গবেষক দলের প্রধান ড. মোস্তফা মাহফুজ বলেন, এই মডেলের সফলতার পেছনে রয়েছে স্থানীয় জনগণের অবদান। মডেলটি কাজ করেছে, কারণ তা স্থানীয় জনগণের কথা শুনেছে, স্থানীয় নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং একাধিক বাধাকে একসঙ্গে মোকাবিলা করেছে। একদিকে মানুষের সহমর্মিতা অন্যদিকে তথ্যপ্রমাণভিত্তিক কর্মসূচি– এই দুয়ে মিল হলে সম্ভাবনা অসীম বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, বস্তিবাসীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত। নিউট্রি-ক্যাপের মতো অভিযোজিত মডেলগুলো শুধু কার্যকরই নয় বরং দেশের অন্য বস্তি ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও প্রসারণযোগ্য।
অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্য দেন আইসিডিডিআর,বি-র নিউট্রিশন রিসার্চ ডিভিশনের সিনিয়র ডিরেক্টর ড. থাডিয়াস ডেভিড মে। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন অ্যাডসার্চ বাই আইসিডিডিআর,বির প্রকল্প পরিচালক ও আইসিডিডিআর,বির প্রফেসর ইমিরেটাস ড. শামস এল আরিফিন, যিনি এই মডেলটি বৃহৎ পরিসরে সম্প্রসারণ ও অংশীদারিত্বের সুযোগ তুলে ধরেন।
সেমিনারে সরকারি কর্মকর্তা, উন্নয়ন সহযোগী, এনজিও প্রতিনিধি ও গবেষকসহ বিভিন্ন খাতের অংশীজন অংশ নেন।