X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

সগিরা হত্যা মামলার তদন্ত বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারবার

রাফসান জানি
১৬ জানুয়ারি ২০২০, ২২:৩৩আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ১৯:২১

সগিরা মোর্শেদ

ঢাকার সিদ্বেশ্বরীতে ১৯৮৯ সালে গুলি করে হত্যা করা হয় বিআইডিএস-এর গবেষক সগিরা মোর্শেদকে। এরপর কেটে গেছে ৩০ বছর। একের পর এক দায়িত্ব পাওয়া ২৫ কর্মকর্তা তদন্তে অগ্রগতি করতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। আসামিরা সগিরা মোর্শেদকে হত্যার পর পরিকল্পিতভাবে এর সাক্ষী-প্রমাণ ও আলামত ধ্বংস করেছে। উড়োচিঠির মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে হুমকি। কিন্তু কোনও বাধাই সত্য প্রকাশে পথ বন্ধ করতে পারেনি। ঘটনার ত্রিশ বছর পর ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই মামলার তদন্তভার পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তারা তদন্ত শুরুর ১৮০ দিনের মধ্যে প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে।

বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) চার জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছেন পিবিআই’র তদন্ত কর্মকর্তারা। গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তরা হলো, নিহত সগিরার স্বামীর বড় ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০), হাসান আলীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহিন (৬৪), শাহিনের ভাই আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান (৫৯) ও হত্যার কন্ট্রাক্ট নেওয়া মারুফ রেজা। তারা প্রত্যেকে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন, যেখানে তারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে।

বাদীকে উড়োচিঠি

পিবিআইয়ের তদন্তে বিগত সময়ে এই মামলাটিকে ঘিরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার প্রকাশ পেয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম আসামি মামলার বাদী আবুদস ছালাম চৌধুরীকে তার বাসায় বিভিন্ন সময়ে উড়োচিঠি পাঠিয়েছিল। চিঠিতে এই মামলা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছিল। যেগুলো বাদীর বড় ভাই, বড় ভাইয়ের স্ত্রী, বড় ভাইয়ের শ্যালক ও ভাড়াটে খুনির পরিকল্পনায় হয়েছে।

সগিরা মোর্শেদকে হত্যার পর বাদীর বড় ভাই আসামি হাসান আলী বিভিন্নভাবে বাদীকে মামলা নিয়ে নিরুৎসাহিত করেছে। বাদী আ. ছালাম চৌধুরী বলেন, ‘আমি তো তখন জানতাম না আপন ভাই আমার স্ত্রীর হত্যাকারী। সে সান্ত্বনা দেওয়ার ছলে এই মামলা নিয়ে বেশি কিছু করতে নিরুৎসাহিত করে। বারবার এটা বোঝানোর চেষ্টা করেছে, যারা এটা করেছে তারা ভয়ঙ্কর। এদের নিয়ে নড়াচড়া করলে আরও ক্ষতি করতে পারে।

অস্ত্রসহ আটক মন্টু যেভাবে সগিরা মামলায় গ্রেফতার

পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৯০ সালে সবুজবাগ এলাকা থেকে অস্ত্রসহ আটক হন মিন্টু ওরফে মন্টু। তাকে পরবর্তীতের সগিরা হত্যা মামলায় শ্যেন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। আর উদ্ধার হওয়া অস্ত্রটি সগিরা হত্যা মামলার আলামত হিসেবে উপস্থাপন করেন তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক এবি এম সুলতান আহম্মেদ। অস্ত্রটি বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়। কিন্তু, সিআইডি সুস্পষ্ট কোনও মতামত না দিলেও অস্ত্রটিকে সগিরা হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। গ্রেফতার মন্টুর বিরুদ্ধে শক্ত সাক্ষী ছাড়াই আদালতে তাকে আসামি করে চার্জশিট দাখিল করা হয়।

পরবর্তীতে মামলার বিচার নিয়ে স্থগিতাদেশ দেওয়ায় জেল থেকে মন্টু জামিন পান জানিয়ে পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমরা তদন্তভার পাওয়ার পর মন্টুকে ডেকেছিলাম। কিন্তু সে আসেনি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার কোনও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তাকে আমাদের অভিযোগপত্রে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’

সাক্ষীদের বক্তব্যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নের নাম আসায় আটকে যায় বিচার

সগিরা মোর্শেদ হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার মন্টুকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়ার পর মামলার অন্যতম আসামি মারুফ রেজার নাম উঠে আসে। মারুফ রেজা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে বলে জানা যায়।  মামলায় মারুফ রেজার নাম উঠে আসায় এপিপি মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করেন। আবেদন মঞ্জুরও করে আদালত। এই পরিপ্রেক্ষিতে মারুফ রেজা উচ্চ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।

এভাবে মামলার তদন্তে বার বার বাধা এসেছে জানিয়ে তদন্ত কর্তাকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৯০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর আদালত অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে বিচারকার্য শুরু করে। বিচারকার্য চলাকালে ছয় জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। সাক্ষীদের জবানবন্দিতে সন্দিগ্ধ আসামি মারুফ রেজার নাম আসায় এপিপি মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করেন। আদালত অধিকতর তদন্তের আবেদন মঞ্জুর করেন। বিজ্ঞ আদালতের এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে সন্দিগ্ধ আসামি মারুফ রেজা হাইকোর্ট বিভাগে ক্রিমিনাল রিভিশন মামলা দায়ের করেন। এরপর ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মামলাটি তদন্তে আটকে ছিল।

চার আসামি মামলার আলামত গায়েব

মামলার আলামতের মধ্যে সগিরা মোর্শেদের গায়ে থাকা পোশাক, ব্যাগ ও ব্যাগের মধ্যে থাকা কিছু টাকা সাইদুর রহমান নামে একজন মালখানা থেকে ১৯৯২ সালে নিয়ে যান। আর সাইদুর রহমানকে শনাক্ত করেন শহিদ উদ্দিন নামের একজন অ্যাডভোকেট। এই সাইদুর রহমান বাদীর পরিবারের কেউ নন বলে জানিয়ে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, আমরা তদন্তভার পাওয়ার পর সাইদুর রহমানের সন্ধান করি। কিন্তু তার কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। আর তাকে শনাক্তকারী অ্যাডভোকেট শহিদ উদ্দিনের খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পেরেছি, উনি মারা গেছেন। তারা মালখানা থেকে ১৯৯২ সালের ৯ জুন আলামতগুলো নিয়ে যায়।

কিশোর হিসেবে ফায়দা নিতে মারুফ রেজার জন্মতারিখ পরিবর্তন

সাক্ষীদের বক্তব্যে নিজের নাম আসার পর মারুফ রেজা তার জন্মসাল পরিবর্তন করে। তার কাছে পাওয়া এনআইডিতে রয়েছে, ১৯৭২ সালের ২৯ আগস্টে জন্ম। এই জন্মতারিখ অনুযায়ী সগিরা মোর্শেদ হত্যার সময় মারুফ রেজার বয়স হয় ১৬ বছর ১০ মাস ২৬ দিন।

মারুফ রেজা আদালতে ফায়দা নেওয়ার জন্য বয়স কমিয়েছে এমন সন্দেহে প্রকৃত বয়স অনুসন্ধান শুরু করে পিবিআই। খুঁজতে খুঁজতে পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তারা পৌঁছে যায় মারুফ রেজার স্কুল উইল্স লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে। যেখানকার ভর্তি রেজিস্ট্রার অনুযায়ী তার জন্ম হয় ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ। আর এই রেজিস্ট্রার মতে, সগিরা মোর্শেদ হত্যার সময় তার বয়স ছিল ১৮ বৎসর ৪ মাস ১৫ দিন। 

এ বিষয়ে বনজ কুমার বলেন, ‘মারুফ রেজা যখন বুঝতে পারে আসামি হিসেবে তার নাম আসতে পারে, তখনই এনআইডি কার্ডে নিজের বয়স গোপন করে কমিয়ে নেয়। আমরা তদন্ত করে তা প্রকৃত বয়স পেয়েছি। ফলে এখন বিচারে সে কিশোর অপরাধী হিসেবে সুবিধা নিতে পারবে না।’

আরও পড়ুন: সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাণ্ডের স্কেচ প্রকাশ

 

 

/এনআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঐকমত্য কমিশনের সপ্তম দিনের বৈঠক: যেসব বিষয়ে হবে আলোচনা
ঐকমত্য কমিশনের সপ্তম দিনের বৈঠক: যেসব বিষয়ে হবে আলোচনা
ওয়ারীতে আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পাওয়ার কারণ জানালো ফায়ার সার্ভিস
ওয়ারীতে আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পাওয়ার কারণ জানালো ফায়ার সার্ভিস
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনে ৮ কিলোমিটার যানবাহনের ধীরগতি
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনে ৮ কিলোমিটার যানবাহনের ধীরগতি
গোয়ালন্দে লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব, আতঙ্কিত কৃষক-খামারিরা
গোয়ালন্দে লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব, আতঙ্কিত কৃষক-খামারিরা
সর্বাধিক পঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
অবশেষে রিজার্ভে আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ হলো
অবশেষে রিজার্ভে আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ হলো
ইলিশের দাম নির্ধারণের প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন
ইলিশের দাম নির্ধারণের প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন
ক্যাম্পাসে নতুন সভাপতির প্রবেশ ঠেকাতে দুদিন পাঠদান বন্ধ!
ঢাকা সিটি কলেজক্যাম্পাসে নতুন সভাপতির প্রবেশ ঠেকাতে দুদিন পাঠদান বন্ধ!