X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাহিনীর ‘ইমেজ রক্ষায়’ বাবুলকে ছাড় দিয়েছিলেন তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তারা!

নুরুজ্জামান লাবু
১৫ মে ২০২১, ২১:৫০আপডেট : ১৫ মে ২০২১, ২২:৩৮

স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার সঙ্গে তার স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গিয়েছিল পাঁচ বছর আগেই। কিন্তু বাহিনীর ইমেজ রক্ষা করতে তৎকালীন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাবুলকে ‘বিশেষ ছাড়’ দিয়েছিলেন। এজন্য বাবুলকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ঢাকার গোয়েন্দা কার্যালয়ে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর দুটি ‘অপশন’ দেওয়া হয়েছিল। ‘অপশন’ দুটি ছিল হয় তাকে স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়তে হবে, তা না হলে মামলার আসামি করা হবে। এর আগে বাবুলের সামনে স্ত্রী হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সব তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়। বাবুল সে সময় স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার অপশনটি বেছে নেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুনের মতো একটি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়ার পরও কাউকে ছাড় দেওয়াটা আইনের প্রতি চরম অবমাননাকর। ব্যক্তির দায় কোনোভাবেই তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাহিনীর দায় হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন না। বাবুলকে সে সময় ছাড় না দেওয়া হলে এতদিনে বিচার শেষ করে তাকে সাজার মুখোমুখি দাঁড় করানো যেতো।

আলোচিত এ ঘটনার পাঁচ বছর পর নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই গত ১১ মে বাবুল আক্তারকে গ্রেফতার করে। বাবুল আক্তার ওই মামলার বাদী হওয়ায় আগের মামলাটির আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পরে নিহত মাহমুদা খানম মিতুর বাবা মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে বাবুলকে এক নম্বর আসামি করে একই ঘটনায় চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় নতুন একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় বাবুলকে গ্রেফতারের পর পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পিবিআই।

পিবিআই’র প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত-তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বাবুলের দিকেই সন্দেহের তীর যায়। পরে বাবুলকে গ্রেফতার করা হয়। এক্ষেত্রে কোনও ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘তদন্ত করতে গিয়ে আমরা বাবুলের সম্পৃক্ত থাকার অনেকগুলো লিড পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করার পর সব তথ্য-প্রমাণ হাতে নিয়েই বাবুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ 

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যেসব তথ্য সূত্রের বরাতে বাবুল আক্তারকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই, পাঁচ বছর আগেই তা জানতেন তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তারা। সব তথ্য-প্রমাণ হাতে নিয়েই ২০১৬ সালের ২৫ জুন খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ায় শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে ঢাকার গোয়েন্দা কার্যালয়ে এনে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল আক্তার প্রথমে খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেন। পরে তার সামনে সব তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়। এ সময় কিছুটা ভেঙে পড়েন বাবুল। পরে বাহিনীর ইমেজ রক্ষা করতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তাকে স্বেচ্ছায় অবসর নিতে আবেদন করতে বলা হয়। বাবুল আক্তার তাতে রাজি হয়ে পুলিশ বাহিনী থেকে অবসর নিতে একটি আবেদন করেন। যদিও পরবর্তীতে বাবুল আক্তার নিজেই পুলিশ বাহিনীতে ফিরতে সেই আবেদন প্রত্যাহারের জন্য আরেকটি আবেদন করেন।

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘সে সময় ধারাবাহিক জঙ্গি হামলা ও টার্গেট কিলিং নিয়ে অস্বস্তির মধ্যে ছিল পুলিশ বাহিনী। জঙ্গি দমনে বাবুল আক্তারের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়। এরমধ্যেই বাবুল আক্তারের মতো একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে স্ত্রী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হলে বাহিনীর ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এ কারণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে দুটি অপশন দিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০১৬ সালের ২৬ জুন চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওয়াসিম ও আনোয়ার নামে দুই ব্যক্তি খুনের কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। আদালতে তারা মুসার নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। ওই সূত্র জানায়, ওয়াসিম ও আনোয়ারকে আদালতে সোপর্দ করার আগেই ২০১৬ সালের ২২ জুন চট্টগ্রামের রাউজান থেকে কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসাকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায়। মুসার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ওয়াসিম ও আনোয়ারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

ওই সূত্র জানায়, ‘ইমেজ রক্ষা’য় বাবুল আক্তারকে ছাড় দেওয়ার জন্যও পুলিশের তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মুসাকে প্রকাশ্যে আদালতে সোপর্দ করেননি। তবে ওই ঘটনার পর থেকে মুসাকে আর কোথাও দেখা যায়নি। পিবিআই’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মুসাকে তারা খুঁজছেন। কারণ, মুসা হলো এই মামলার অন্যতম আসামি। মুসাকে পেলে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি ‘শতভাগ’ ক্লিয়ার হওয়া যেতো।

তবে পিবিআইর দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা বলেন, মুসাকে না পেলেও বাবুল আক্তার যে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সে বিষয়ে তারা তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারবেন। বিশেষ করে ঘটনার আগে পরে কিছু কথোপকথন এবং বাবুল আক্তার তার একজন ব্যবসায়ী বন্ধুর মাধ্যমে মুসাকে তিন লাখ টাকা দেওয়ার বিষয়ে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও অনেক তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে এসেছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি যখন ঘটে সে সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ছিলেন একেএম শহীদুল হক। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি অবসরে যান। যোগাযোগ করা হলে সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, ‘বাবুল আক্তার তখনও সন্দেহভাজন ছিলেন। কিন্তু একজন দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তাকে তো শুধু সন্দেহভাজন হিসেবেই গ্রেফতার করা যায় না। আমি তদন্ত সংশ্লিষ্টদের মুসাকে গ্রেফতার করতে নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা সে সময় মুসাকে গ্রেফতার করেছিল কিনা আমাকে কিছু জানায়নি।’

পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় বাবুল আক্তারকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘খুনের দায় প্রমাণ হলে কাউকে ছাড় দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে মুসা নামে যাকে দেখা গিয়েছিল সে বাবুলের সোর্স বলে পরিচিত ছিল। আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম, কিন্তু সে অস্বীকার করেছে। সে যেহেতু বিচক্ষণ অফিসার ছিল, তাই তাকে ধরাটা কঠিন ছিল। কিন্তু কোনও ছাড় দেওয়া হয়নি।’

আলোচিত এই ঘটনা তদন্তে সরাসরি তদারকি করেছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন কমিশনার ইকবাল বাহার। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর থেকে তিনি অবসরোত্তর ছুটিতে রয়েছেন। ঢাকার মিন্টো রোডে যখন বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় সে সময় তদন্ত দলের প্রধান হিসেবে তিনি উপস্থিত ছিলেন। সদ্য অবসরে যাওয়া পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বক্তব্য জানতে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল ও খুদেবার্তা দিলেও তিনি সাড়া দেননি। যোগাযোগ করা হলে তৎকালীন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ও বর্তমানে রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, প্রথম বিষয় হচ্ছে বাবুল আক্তারের বিষয়ে এক ধরনের নাটকীয়তা আমরা লক্ষ করেছি। আজ থেকে পাঁচ বছর আগেই কিন্তু বিভিন্ন জায়গা থেকে, এমনকি পুলিশের তরফ থেকেই বাবুল আক্তার সন্দেহভাজন ছিল। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, আমরা দেখলাম এক ধরনের সমঝোতার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। যেটার কারণে সম্ভবত বাবুল আক্তারকে পদত্যাগের সুযোগ দেওয়া হলো। পাঁচ বছর আগে যে সূত্রগুলো প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করেছিল, তখন তাকে গ্রেফতার না করে, মামলায় আসামি না করে এই পাঁচটি বছর নানারকম সময়ক্ষেপণ করে পুলিশের এক ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। যে সময়ে তার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রাথমিক তথ্য পেয়ে সন্দেহ করা হয়েছিল সেই সময়েই গ্রেফতার বা মামলার আসামি করা আরও বেশি যুক্তিসঙ্গত হতো। পাঁচ বছর সময় নেওয়ায় মামলার মেরিট দুর্বল হতে পারে। যেই ভাবমূর্তি বা ইমেজ রক্ষার কারণে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে, তাতে বরং উল্টো আরও বেশি ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে মাহমুদা খানম মিতুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি প্রথমে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানা পুলিশ ও চট্টগ্রামের গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার পিবিআইকে দেওয়া হয়।

 

/এমআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
মিতু হত্যা: বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রাম থেকে পাঠানো হলো ফেনী কারাগারে
বাবুলের নির্দেশে মিতুকে হত্যা, আদালতকে নিখোঁজ মুছার স্ত্রী
এক মামলায় সাবেক পুলিশ সুপার বাবুলের জামিন
সর্বশেষ খবর
‘খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা দ্রুত নেতৃত্ব দিতে সক্ষম’
‘খেলাধুলার মাধ্যমে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিরা দ্রুত নেতৃত্ব দিতে সক্ষম’
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ