X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আপনার চোখকে ভালোবাসুন

নীনা নাহার
১৩ অক্টোবর ২০২২, ১৬:১৬আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২২, ১৬:১৬

বিশ্ব দৃষ্টি দিবস আজ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ দিবসটি পালন করা হচ্ছে। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার দিবসটি পালন করা হয়। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে। বিশ্বব্যাপী চোখের যত্ন নেওয়ার জন্য গণসচেতনতা তৈরি, চোখের রোগ নির্মূলে প্রভাবিত করা, চোখের যত্ন নেওয়ার তথ্য জনগণের কাছে তুলে আনাই হলো বিশ্ব দৃষ্টি দিবসের মূল লক্ষ্য। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, ‘আপনার চোখকে ভালোবাসুন।’

চোখ মানব দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত উদাসীন। কী কারণে মানুষ অন্ধত্ব বরণ করে সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকলে দেশে অন্ধত্বের হার অনেকাংশেই হ্রাস পেত। অন্ধত্ব এবং চোখের বিকলতা সম্পর্কে বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য ২১ বছর আগে ২০০০ সালের ১২ অক্টোবর এই দিবসটি প্রথম পালন করা হয়।

প্রতি বছর এই দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার অন্ধত্ব এবং চোখের বিকলতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সরকার-মন্ত্রণালয়কে অংশগ্রহণে প্রভাবিতকরণ, জাতীয় অন্ধতা প্রতিরোধ কর্মসূচির জন্য তহবিল তৈরিকরণ এবং অন্ধতা প্রতিরোধ সম্পর্কে অবহিত করার বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে সরকার নানা কর্মসূচির আয়োজন করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে সারা বিশ্বে প্রায় ৪ কোটি মানুষ নিবারণযোগ্য অন্ধত্বের শিকার। এছাড়া দৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি মিনিটে ১২ জন মানুষ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে একজন শিশু। বাংলাদেশে ৭৫ লাখের বেশি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার শিশু। বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতার প্রধান কারণ ছানিজনিত। মানুষ সচেতন হলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও অন্ধত্ব কমানো সম্ভব। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সালে দেশে অন্ধত্ব ও ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়ে পরিচালিত অন্য এক জরিপে অন্ধত্বের প্রধান কারণ হিসেবে ছানিপড়া রোগকে দায়ী করা হয়। দেশে বছরে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ অন্ধত্বজনিত ছানির রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন

সমগ্র বিশ্বে পুষ্টিহীনতা এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বয়স্ক ব্যক্তিরা ট্রাকোমা এবং চোখের ছানিজনিত সমস্যায় ভোগেন। বিভিন্ন ধরনের রোগ কিংবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে বিভিন্ন বয়সের মানুষও অন্ধত্বে আক্রান্ত হন। কখনও কখনও নবজাতকও অন্ধত্বে আক্রান্ত হয়ে দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। কিছু লোক পদার্থের রঙজনিত সমস্যায় ভোগেন যা বর্ণান্ধতা  নামে পরিচিত। অর্থাৎ ব্যক্তি জিনিসকে দেখেন ঠিকই, কিন্তু সঠিকভাবে রঙের নাম বলতে পারেন না বা রঙের পার্থক্য বুঝতে অক্ষম বা তারা কোনও রঙই দেখতে পান না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ বর্ণান্ধতাকে রঙ দর্শনজনিত পার্থক্য নামে অভিহিত করে থাকেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের মাধ্যমে স্বল্প দৃষ্টি ও অন্ধত্বে আক্রান্ত হওয়ার সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। যেমন চোখের যত্নকে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চোখের যত্ন বিষয়ক কার্যক্রম গ্রহণ-বাস্তবায়ন সমন্বিত ও জনবান্ধব করা, কার্যকর চোখের যত্নের পদক্ষেপের জন্য উন্নতমানের সেবা প্রদান, চোখের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সেবা বিষয়ক গবেষণা ও প্রচার, সমন্বিত ও জনবান্ধব চোখের যত্ন বিষয়ক কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রবণতা নিরীক্ষণ এবং অগ্রগতি মূল্যায়ন, চোখের যত্নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে চাহিদা তৈরি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি চারটি কৌশলসহ গ্রহণ করা যেতে পারে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মানুষকে চোখের যত্ন বিষয়ক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করা এবং ক্ষমতায়িত করা, চোখের যত্নকে গুরুত্ব দিয়ে শরীরের প্রাথমিক যত্নের সাথে পুনর্বিন্যাস করা, স্বাস্থ্য খাতের সাথে চোখের যত্নের সেবাকে সমন্বয় করা। এছাড়া চোখের যত্ন বিষয়ক একটি সহনশীল পরিবেশ তৈরি করা, জাতীয় স্বাস্থ্য কৌশলগত পরিকল্পনায় চোখের যত্নের অন্তর্ভুক্তি, স্বাস্থ্য তথ্য সিস্টেমের মধ্যে প্রাসঙ্গিক চোখের যত্ন সম্পর্কিত তথ্য একীকরণ, জনসংখ্যার চাহিদা অনুযায়ী চক্ষু পরিচর্যা কর্মীদের বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।

অন্ধত্ব হ্রাসে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে উন্নতি সাধিত হয়েছে ( ২০২০ সালে ছিল ১.০৩%, যা ২০০০ সালে হয় ১.৫৩%)। শিশুদের (১৫ বছরের নিচে)। অন্ধত্ব হ্রাসে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ হয়েছে যেখানে শৈশব অন্ধত্বের প্রাদুর্ভাব কমেছে (২০০৩ সালে প্রতি ১০০০ জনে ০.৮ যা ২০১৭ সালে দাঁড়ায় ০.৬)। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটস (সিএসআর) কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। 

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দৃষ্টি সেবার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য চোখের সেবা বিকেন্দ্রীভূতকরণ জরুরি। সর্বজনীন চক্ষু স্বাস্থ্য কভারেজ মোকাবিলার জন্য জাতীয় স্তরের ইউনিভার্সাল আই হেলথ টাস্ক ফোর্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চোখের সেবা অর্জনে জেলা পর্যায়ের কমিটি সক্রিয়করণ, পরিবীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ আরও দক্ষ হতে পারে। জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে মনিটরিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা বিদ্যমান পরিস্থিতি শক্তিশালী করা, চোখের যত্নে সঠিক পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দৃষ্টিসেবার সাধারণ সেবাকেন্দ্র থেকে অধিকতর চোখের যত্ন পরিষেবার জন্য শক্তিশালী হাসপাতাল তৈরি করতে জেলা স্তরের হাসপাতালগুলোকে শক্তিশালী করা অপরিহার্য। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং সহযোগিতা নিশ্চিত করতে এনজিও, বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিকের সরকারি নীতি এবং আইন সংশোধনের প্রয়োজন।

চোখের স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য জাতীয় মানবসম্পদ পরিকল্পনা আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনসংখ্যার চোখের যত্নের প্রয়োজনের সঙ্গে আনুপাতিক আকার এবং গঠনসহ (স্বীকৃত চক্ষু ক্যাডার) একটি চক্ষু স্বাস্থ্যকর্মী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ এবং তৈরি করা প্রয়োজন। জেলা হাসপাতালে চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এবং ধরে রাখা, এনজিও/সিভিল সোসাইটি সংস্থার সাথে আন্তঃক্ষেত্রীয় সমন্বয় এবং সহযোগিতার মাধ্যমে চোখের স্বাস্থ্যের প্রচার এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিমূলক চক্ষু পরিচর্যা পরিষেবাকে শক্তিশালী করা, ইনক্লুসিভ চক্ষুস্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুমোদন, লিঙ্গ এবং অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলোর ওপর ফোকাস রেখে ডিজিবল পিপলস ওরগানিজেসন (ওপিডি) এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে সমন্বয় করে ব্যাপকহারে জেলা চক্ষু যত্ন পরিকল্পনা করা হয়েছে।

বিশেষ করে নিম্ন আয়ের গোষ্ঠী এবং অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর জন্য সংশ্লিষ্ট নীতি সংশোধন ও সংস্কার করা প্রয়োজন। চোখের অবস্থার উন্নতি এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দ্রুত উপকারে আসার জন্য দুটি সূচক নিরীক্ষণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে ইফেক্টিভ কভারেজ অব ক্যাটারাক্ট সার্জারির (ছানি অপারেশন) এবং ইফেক্টিভ কভারেজ অব রিফ্র্যাক্টিভ এরর (দৃষ্টি সংশোধন)।

চক্ষু পরিচর্যার বিষয়টি স্কুলের কার্যক্রমের সাথে সমন্বয় করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের চোখের যত্ন কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করতে শিক্ষক, বয়স্ক শিশুসহ সব সম্প্রদায়কে নিযুক্ত, ক্ষমতায়ন এবং নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে । নবজাতক, প্রাক-স্কুল এবং স্কুল বয়সী শিশুদের সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আন্তঃ সেক্টরাল সহযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে। আন্তঃক্ষেত্রীয় সহযোগিতা এবং সমন্বয় যেমন পরিবহন, চা বাগান এবং গার্মেন্টস সেক্টরগুলো বিশেষভাবে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এনজিও এবং বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের আওতাধীন সব জেলায় সেবা পৌঁছানোর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সেবা তরান্বিত করা যেতে পারে।

দেশে চশমা এবং কাচের সরবরাহের ঘাটতি মেটানোর মাধ্যমে এনজিওসহ বেসরকারি খাতে চোখের যত্ন পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য কর ছাড় দেওয়া প্রয়োজন। দৃষ্টি সেবা কার্যক্রমের সাথে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ঝুঁকির বিষয়টি কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে।

জাতীয় গবেষণা এজেন্ডায় অবদান রাখার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নীতি গবেষণা এবং চোখের যত্নের জন্য প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সহজতর করার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তিসহ প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সাধন, কার্যকর কর্মপরিকল্পনা জোরদার করা এবং বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

লেখক: উন্নয়নকর্মী, ভিশন স্প্রিং বাংলাদেশ

/এনএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
চিকিৎসক ছাড়াই রক্ত ট্রান্সফিউশনের সময় হাজির ম্যাজিস্ট্রেট
চিকিৎসক ছাড়াই রক্ত ট্রান্সফিউশনের সময় হাজির ম্যাজিস্ট্রেট
অশ্রু ঝরিয়ে বৃষ্টির প্রার্থনা
অশ্রু ঝরিয়ে বৃষ্টির প্রার্থনা
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না