হঠাৎ করেই যেন একজনের হাতে থাকা চুড়িতে চোখ আটকে গেল। তাজা ফুলের পাপড়ি ঝলমল করছে চুড়ির ভেতর। আবার অনেক সময় দেখা যায় বেডরুমে বিয়ের মালার ফুলগুলো অবিকল একই রকমভাবে ফ্রেমে বন্দি করে রাখা আছে বিয়ের ছবির সাথে। এই জিনিসগুলো আসলে রেজিন দিয়ে তৈরি করা।
কথা হলো রেজিন আর্টিস্ট শারমিন মাহজাবীনের সঙ্গে। শখের বসেই রেজিন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। এরপর দুবাইয়ের বিখ্যাত আর্টিস্ট মারিয়ার কাছ থেকে হাতেকলমে শিখেছেন রেজিনের টেকনিকগুলো। শারমিন জানান, রেজিন মূলত এক ধরনের কেমিক্যাল। এই লিকুইড কেমিক্যাল দুইভাবে থাকে- রেজিন এবং হার্ডেনার। এদের একটা নির্দিষ্ট অনুপাত মেশাতে হয় কাজ করার জন্য। বাংলাদেশে মূলত ৩:১ এবং ২:১ রেজিন পাওয়া যায়। ২:১ হলে আপনি মেইন রেজিন কেমিক্যালটা ১০০ গ্রাম নিলে হার্ডেনার অনুপাত নেবেন পঞ্চাশ গ্রাম এবং পুরো মিশ্রণের পরিমাণ হবে দেড়শ গ্রাম। কিচেনে আমরা যে ওজন মাপার স্কেলগুলো ব্যবহার করি, সেটা দিয়ে পেপার কাপে এই মিশ্রণগুলো ঢেলে নিয়ে আইসক্রিমের কাঠি দিয়ে মিনিমাম তিন মিনিট ধরে মেশালে ভালো একটা মিশ্রণ তৈরি হবে কাজ করার জন্য। রেজিনের অনুপাত যত কম হবে, রেজিন তত ঘন হবে। যেমন ২:১ রেজিন আসলে ৩:১ এর চেয়ে অনেক ঘন।
রেজিন দিয়ে কী কী করতে পারবেন
রেজিন দিয়ে যে শুধু গয়না তৈরি করতে পারবেন এমন নয়। এটি নানাভাবে কাজে লাগাতে পারেন। যেমন আসবাব মেরামত করতে রেজিনের সাহায্য নিতে পারেন। রেজিন আর্টের সবচেয়ে উপকারী বিষয়ই এটি। রেজিন আর্ট শুধু সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য নয়, এটা আপনার জীবনযাত্রার একটা অংশ হতে পারে। 'ধরুন আপনার প্রিয় আসবাবের এক পাশ ফাটল ধরেছে। অথবা আপনার বাসার একটা দেয়ালের চুন খসে পড়ছে। এসব ক্ষেত্রে একটা বোর্ড নেবেন। রেজিন দিয়ে একটা বোর্ডের উপরে সুন্দর একটি আর্ট করে সেটা পেস্টিং করে দিলে যেমন বাসার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হবে, তেমনি ঢাকা সম্ভব হবে দৃষ্টিকটু দেয়াল। রেজিনের মিশ্রণ দিয়ে আসবাবের ফাটলও মেরামত করতে পারেন খুব সহজে। আজীবন সেই আসবাবকে রক্ষা করবে রেজিন'- বলেন শারমিন।
রেজিন নিয়ে নিরীক্ষামূলক কাজ করার সুযোগ রয়েছে অনেক
সৃজনশীল নানা উপায়ে রেজিন ব্যবহার করতে পারেন। যেকোনো স্মৃতিকে সারাজীবনের জন্য ধরে রাখতে চাইলে রেজিন হতে পারে দারুণ উপায়। যেমন শিশুর প্রথম দুধদাঁত রেজিনের মধ্যে ঢেলে বানিয়ে ফেলতে পারেন লকেট। প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পাওয়া উপহারও এভাবে আজীবনের জন্য আটকে ফেলতে পারেন রেজিনের ফ্রেমে। ফ্রুট সারভিং ট্রে, খাওয়ার বাটি চামচ, ন্যাপকিন হোল্ডার, টিস্যু হোল্ডার সবকিছু একই কালার থিমের উপর রেজিন দিয়ে বানানো যায়। সমুদ্র বানিয়ে ফেলতে পারেন রেজিন দিয়ে, সেটা বানিয়ে ফেলতে পারেন টি টেবিল। আবার আর্ট পিস হিসেবে টাঙ্গিয়ে দিতে পারেন বাসার দেয়ালে।
রেজিন কি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?
রেজিন এক ধরনের কেমিক্যাল এবং এটি দিয়ে কাজ করতে হলে অবশ্যই কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। শারমিন জানালেন রেজিন সম্পর্কে কিছু সচেতনতার কথা। রেজিনের কাজ করার সময় অবশ্যই গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে। রেজিন ত্বকে লেগে গেলে স্কিন অ্যালার্জি হতে পারে। রেজিনের কাজ করার সময় বড় এবং আলো বাতাস চলাচল করে এমন রুম বেছে নিতে হবে। রুমে যদি পর্যাপ্ত আলো বাতাস না থাকে, তাহলে কাজ করার সময় ব্যবহার করতে হবে মাস্কও। রেজিন শিশুদের থেকে অবশ্যই দূরে রাখতে হবে। রেজিনের তৈরি ট্রে, খাবারের বাটি, প্লেটে খুব গরম খাবার পরিবেশন করা উচিত নয়। রেজিনের জিনিসগুলো কখনও মাইক্রোওয়েভে দেবেন না।
রেজিনের কাজ শেখার সুযোগ কি আছে দেশে?
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যারা রেজিন নিয়ে কাজ করেছেন, তারা সবাই মোটামুটি নিজের উদ্যোগে ইউটিউবের ভিডিও দেখে শিখেছেন। কারণ বড় পরিসরে রেজিনের কাজ শেখার সুযোগ এখনও সেভাবে নেই দেশে। শারমিন মনে করেন, এর অন্যতম কারণ হচ্ছে রেজিনের কাজের জন্য যে উপকরণগুলো দরকার, সেগুলো বাংলাদেশে খুব একটা সহজলভ্য না। এগুলোর বেশিরভাগই আনতে হয় বিদেশ থেকে। এছাড়া রেজিন, তার রঙ , সিলিকন মোল্ড সবকিছুই কিছুটা ব্যয়বহুল। রেজিনের জিনিসেরও তাই অনেক দাম হয়ে থাকে। রেজিন আর্ট শেখার সুযোগ খুব একটা না থাকলেও এর ভবিষ্যৎ কিন্তু বেশ উজ্জ্বল। রেজিন দিয়ে নানা পণ্য বানিয়ে খুব সহজেই উপার্জন করা সম্ভব। কারণ দিন দিন বাড়ছে রেজিনের পণ্যের চাহিদা। শারমিন জানান, তিনি নিজেই উদ্যোগ নিয়ে রেজিনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিগ রেজিন ক্লাব নামের একটি পেইজের মাধ্যমে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। রেজিনের বিভিন্ন টেকনিক যেমন রেজিন গ্যালাক্সি, ওসেন আইল্যান্ড, ওপাল, টারকুইজ, ইঙ্ক টেকনিক, থ্রিডি ফ্লাওয়ার, মিক্সড মিডিয়া ইত্যাদি বিষয়ে হাতেকলমে শেখাচ্ছেন আগ্রহীদের।