X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

যুগযন্ত্রণার নিরিখে কামাল চৌধুরীর কবিতা

রিপন আহসান ঋতু
০১ মে ২০২১, ২৩:০৩আপডেট : ০১ মে ২০২১, ২৩:০৩

একজন নিমগ্ন কবি হিসেবে বাংলা কবিতায় কামাল চৌধুরীর অবস্থান বিশেষ ও ব্যক্তিত্বখচিত। জীবন, জগৎ ও মানব-সম্পর্কের বিচিত্র বিষয়কে কবিতায় ধারণ করে কবিতা ও জীবনের সম্পর্ক নিরূপণে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর কবিতায় জীবনদর্শন ও শিল্পভাবনার মৌল প্রবণতার উন্মোচন উল্লেখ করার মতো। তাই আমি তাঁকে ডাকি জীবনদৃষ্টির অনন্য শিল্পী বলে। এই প্রবন্ধে কবিতা বিষয়ে কামাল চৌধুরীর অভিব্যক্তি অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে’ কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত অংশে আলোক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে মানবস্বভাব ও সম্পর্কের গতিবিধি বিষয়ে কবির পর্যবেক্ষণ সূত্রাবদ্ধ করার প্রয়াসও এই প্রবন্ধে লক্ষ করা যাবে।

কবি কামাল চৌধুরী জীবনের ঘটনাকে সবসময়ই কবিত্বের অভিজ্ঞতা দিয়ে বর্ধিত, শোধিত ও সংযত করে নিতে পারেন। যা একজন শিল্পীর মহৎ গুণ। এই বিষয়টি নিয়ে ‘লেখার ইশকুল’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসু বলেন : ‘সমস্ত জীবনই লেখকের কাঁচামাল, কিন্তু জীবন বিশৃঙ্খল ও স্বেচ্ছাচারী, সেই উত্তাল আবর্ত থেকে কোন সময়ে কতটুকু তিনি নেবেন, এবং কীভাবে সেটা ব্যবহার করবেন, তার জন্যে নিজের রুচি ও বিচারবুদ্ধি তাছাড়া স্বোপার্জিত শিক্ষার উপরেই তাঁকে নির্ভর করতে হবে। ভাষা ও কলাকৌশলের উপর মোটামুটি দখল না জন্মালে লেখক হওয়া যাবে না; কিন্তু জীবনকে কে কত ব্যাপক ও গভীরভাবে দেখতে পেরেছেন এবং তার প্রকাশই বা কতটা সত্য হয়েছে, লেখকদের আপেক্ষিক মূল্যের এ-ই হয়তো মানদণ্ড’। প্রসঙ্গত, বুদ্ধদেব বসুর এই স্বাগত অনুভব, সৃষ্টিশীল প্রতিটি লেখকের জন্যই আদর্শ হতে পারে।

এবার মূল বিষয়ে আসা যাক ‘স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে’ কবি কামাল চৌধুরীর তিরিশতম গ্রন্থ। মৃত্যুচিন্তার সরল বোধ আর স্বজন হারানোর ব্যথাতুর বক্তব্য দিয়ে কাব্যগ্রন্থের শুরু। এখানে মৃত্যুকে কবি এতটা সহজ নিঃশঙ্কচিত্তে বরণ করেছেন যেখানে তাঁর পরিণতিবোধ ও নিষ্পাপ আত্মাকে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা মানুষ মূলত প্রতিনিয়ত একটা কিছুর অপেক্ষায় থাকি। কখনো কখনো সে অপেক্ষা আমাদের অস্থির করে তোলে, আর সমস্ত অস্থিরতা মিলিয়ে আমাদের নিয়ে যায় এক চূড়ান্ত গন্তব্যের কাছে, যেখানে পৌঁছাতে মানুষকে ধ্যানী হয়ে উঠতে হয়। ‘স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে’ কাব্যগ্রন্থে আমরা এমনই একজন ধ্যানীসত্তাকে খুঁজে পাব।

এ কাব্যগ্রন্থের শুরুতেই ‘মোহসীন, ভাই আমার’ কবিতায় কবিকে আমরা বলতে শুনি—‘আমরা অপেক্ষা করবো না কারণ আমাদের জন্ম হয়নি/কারণ আমরা মৃত্যুতে কাতর নই।’ মৃত্যু নিয়ে কবির এই ভয়-ডরহীন অপেক্ষা ঈর্ষা করার মতোই। মৃত্যু নিয়ে কবির মধ্যে কোনো শঙ্কা নেই, অস্বস্তি নেই। তবে তাঁর কবিতায় উঁকি মারে ভিন্ন এক জিজ্ঞাসা—‘তার জন্য আমরা শোক করছি না/ তবু কেন হাহাকার? তবু কেন ডুবে যাচ্ছি কান্নায়?’ এখানে জীবনের প্রতি মায়া এবং মর্ত্যজীবনের প্রতিবেশ আর অন্তর্লোকের গভীরতা এত মিতবাক বাক্যে প্রকাশ করার মধ্যদিয়ে কামাল চৌধুরী তাঁর কবিত্বের জাদুশক্তিকেই মনে করিয়ে দিয়েছেন আমাদের।

এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা স্পষ্টত দৃশ্যময়—যা আমাদের চারপাশের অতি পরিচিত মর্ত্যজীবনের ছবি। সে ছবির বিশেষত্ব, প্রকৃতির অঢেল সঞ্চয় থেকে নেয়া হয়েছে অঙ্কনের উপকরণ। প্রকরণের বিশিষ্টতা আর উপকরণের প্রসাদগুণে রক্ত মাংসের বিষয়ও হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক। প্রকৃতিনির্ভর এসব কবিতায় বাহারি রঙের ব্যবহারও আমাদের চোখে পড়ে। যে রঙগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে এমন এক অর্ধস্ফুট ও কোমলতা থেকে—যেখানে সকালের শিশিরের ওপর চুঁইয়ে পড়া কাঁচা রোদের সাতরঙ তৈরি করেছে ভিন্ন এক মিশ্রণ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কামাল চৌধুরীর কবিতার অবয়বে সাতরঙের মিশ্রণে যা কিছু ছবি হিসাবে প্রতিভাত হয় তার চেয়ে গভীর ব্যঞ্জনাময় হয় সেই ছবির পটভূমি। অর্থাৎ, তাঁর কবিতাকে নির্ভুলভাবে আবিষ্কার করতে গেলে সতর্কভাবে লক্ষ করতে হবে কবিতার প্রেক্ষাপটের দিকে। ‘ভাঙচুর’ কবিতায় লক্ষ করলে দেখব, কবি লিখছেন—‘জানালার পাশে ঘুমিয়ে থাকা কিছু রোদ ছুড়ে ফেলে দিয়েছি/টুকরো কাগজ ভেবে।’

এ তো গেল কবিতায় প্রেক্ষাপটের কথা, এবার আসি কবিতায় সময়ের ব্যবহার যে একটি অনন্য বিষয় হতে পারে তা কিন্তু কামাল চৌধুরীর প্রতিটি কবিতায় প্রকটভাবে লক্ষণীয়। ‘স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে’ গ্রন্থেও তাঁর কিছু প্রিয় সময়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। কবিতায় তিনি উষাকাল, দ্বিপ্রহর, সন্ধ্যা ও জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রিকালের কথা লিখেছেন বেশ নিমগ্নতার সাথে। আমরা প্রত্যেকেই জানি, প্রকৃতির এই সময়গুলি মূলত আমাদের জাগরণ, বিশ্রাম, শ্রান্তিমোচন এবং সুষুপ্তির নির্দেশ করে। কবি কামাল চৌধুরী তাঁর কবিতায় এই সময়গুলোর আশ্রয় নিয়ে পাঠকের জাগতিক জাগরণ, বিশ্রাম এবং শ্রান্তিমোচনেরই চেষ্টা করেছেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, কবিতায় ব্যবহৃত সময়ের এই অবস্থাগুলি মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ের আত্মমগ্নতার। অতএব, সময়কে ধারণ করে তৈরি হওয়া কবিতায় আমরা একজন আত্মমগ্ন কবিকে আবিষ্কার করতে পারি সহজেই।

যেকোনো লেখক উৎকৃষ্ট রচনার জন্য ভাষা ও ভঙ্গি নিয়ে বেশ ভাবিত থাকেন এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। কেননা বিষয় যেমনই হোক ভাষা ও ভঙ্গির চমৎকারিত্বই একজনকে বড়ো লেখক করে তোলে—এই কথাটা ফেলনা নয়। তবে কবিতায় ভাষাভঙ্গির পাশাপাশি সময়কে ধারণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। ‘স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে’ কাব্যগ্রন্থে সময়কে ধারণ করে বিচিত্র কথনরীতির মাধ্যমে কবি যুগযন্ত্রণা প্রকাশ করেছেন ধ্রুপদী সৃজনশীলতায়।

একজন কবির সৃজনপ্রতিভার স্বভাব-স্বাতন্ত্র্য-প্রভাব বিচারে কবিতায় বিম্বিত বিষয়ের গুরুত্ব কতটুকু তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে, কিন্তু ভাষার প্রকাশ প্রবণতার অপরিসীম সম্ভাবনা নির্দেশে কবিতার বিষয়বস্তুর অবদান সম্পর্কে উদাসীন থাকার সুযোগ নেই। এই কাব্যগ্রন্থের ‘দর্শক’ শিরোনামের কবিতাংশের কথায় ধরা যাক—‘পৃথিবীটা বাতাসের অমিতাচারে চুপসে যাচ্ছে/ তুমি কড়িকাঠে যা দেখছ, সেখানে একটা সমুদ্র ঝুলে আছে’। এই যে কবিতায় নিজের অনুভূতি এবং শিল্পের মধ্যে যে লুকোচুরিটা তিনি করলেন সেটাও বেশ ভাবসংযমী এবং অর্থবহ। কবির এমন অনুভব ও উপলব্ধির গভীরতা কবিতায় যেমন লাবণ্য সঞ্চার করে তেমনি অনাঘ্রাত এবং অর্থময় একটি সম্ভাবনাকেও কল্পনাপ্রবণ পাঠকের সামনে মেলে ধরে।

কামাল চৌধুরীর কবিতায় আমরা দেখি দুঃখ, কষ্ট, বিষাদে আচ্ছন্ন। প্রতিটা কবিতার মধ্যে একটি করে গল্প থাকে, সে গল্পে কাহিনিও থাকে। তবে কাব্যময় সেই কাহিনি বর্ণনায় কবিতার বিষয়বস্তু কোথাও ঢাকা পড়ে না। এখানেই কবি কামাল চৌধুরী অনন্য। লেখালেখিতে যে তিনি কঠোর পরিশ্রমী তা তাঁর কবিতার পরতে পরতে প্রমাণ রেখেছেন। তাঁর ক্ষুরধার মেধা আর কল্পনাশক্তি দিয়ে নির্মিত কবিতাগুলো পড়ে পাঠকের মনে হবে তিনি আমাদের আজকালকার জীবনের সমস্ত বিকার, বিক্ষোভ ও ক্লান্তি প্রকাশের শ্রেষ্ঠ কবি।

২০২১ বইমেলায় পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘স্তব্ধতা যারা শিখে গেছে’ কাব্যগ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব রাজু। ৪৮ পৃষ্ঠার এই বইটির ক্রয়মূল্য ১৭৩ টাকা।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইয়েমেনে হুথিদের তিনটি লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালালো ইসরায়েল
ইয়েমেনে হুথিদের তিনটি লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালালো ইসরায়েল
বৈষ্যমবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হাসিবের পরিবারের অনুদান না পাওয়ার অভিযোগ
বৈষ্যমবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হাসিবের পরিবারের অনুদান না পাওয়ার অভিযোগ
কুষ্টিয়াসহ তিন জেলায় যৌথবাহিনীর অভিযান, অস্ত্র-মাথার খুলিসহ গ্রেফতার ৪
কুষ্টিয়াসহ তিন জেলায় যৌথবাহিনীর অভিযান, অস্ত্র-মাথার খুলিসহ গ্রেফতার ৪
শেখ হাসিনাকে ‘বাংলার ইয়াজিদ’ বললেন এনসিপি নেত্রী সামান্তা
শেখ হাসিনাকে ‘বাংলার ইয়াজিদ’ বললেন এনসিপি নেত্রী সামান্তা
সর্বাধিক পঠিত
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক 
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক 
লোহিত সাগরে জাহাজে হামলায় আগুন, ডুবে যাওয়ার শঙ্কা
লোহিত সাগরে জাহাজে হামলায় আগুন, ডুবে যাওয়ার শঙ্কা
ফার্মেসিতে ওষুধের আড়ালে ‘ট্যাপেন্টাডল’ বিক্রির অভিযোগ, আটক ৫
ফার্মেসিতে ওষুধের আড়ালে ‘ট্যাপেন্টাডল’ বিক্রির অভিযোগ, আটক ৫
বিশেষ বিমানে গুজরাট থেকে দুই শতাধিক ‘বাংলাদেশি’কে সীমান্তে পাঠালো ভারত 
বিশেষ বিমানে গুজরাট থেকে দুই শতাধিক ‘বাংলাদেশি’কে সীমান্তে পাঠালো ভারত 
সেই ব্যাংক কর্মকর্তার খোঁজ মিলেছে
সেই ব্যাংক কর্মকর্তার খোঁজ মিলেছে