X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

চর্যার পুনর্জাগরণ কী?

সাকার মুস্তাফা
১৭ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:০১আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০১৮, ১০:২৩

চর্যার পুনর্জাগরণ কী?

চর্যাপদ যে আদতে সংগীত রূপেই চর্চিত হতো, সে বিষয়ে পণ্ডিত মহলে মত পার্থক্য নাই। কিন্তু আজ থেকে হাজার বছর বা তারও বেশি সময় আগে চর্যাপদ কী রূপে গীত হতো, তা জানার কোনো উপায় আজ আর নাই। তবে প্রতিটি চর্যাপদের সামনে রাগের নাম উল্লেখ আছে। ২৫ সংখ্যক পদ ছাড়া বাকি ৪৯টি পদের  সামনে, পটমঞ্জরী, গবড়া/গউড়া, অরু, গুঞ্জরী, গুর্জরী, দেবক্রী, দেশাখ, ভৈরবী, কামোদ, ধনসীসহ মোট ১৮টি রাগের নাম আর অনাহত ডমরু, ঘণ্টা, নূপুর ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের নাম দেখে গবেষকগণ চর্যার সুর নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। এছাড়া, চর্যাসংস্কৃতির জীবন্তপ্রবাহ রয়েছে নেপালে। সেখানে চর্যাগান গীতবাদ্যনৃত্যসহ পরিবেশিত হয়। যা বর্তমানে চাচা গান বা চচা গান নামে পরিচিত।

আজ থেকে শতবছর আগে প্রকাশিত একটি গ্রন্থ, যা সংগৃহীত হয়েছিল দূরদেশ নেপালের রাজপুথিশালা থেকে। স্বর্গীয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অন্তত চারবার নেপালে গমনের পর ১৯০৭ সালে চারটি পুথি উদ্ধার করে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা নামে প্রকাশ  করেন ১৯১৬ সালে। এর মধ্যে একটি পুথির নাম চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়, যার ভাষা বাংলা কিনা তা নিয়ে ছিল চরম বিতর্ক। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতো অনেক গবেষণার মধ্যদিয়ে পণ্ডিতরা প্রমাণ করতে সক্ষম হন চর্যার ভাষা বাংলা। এই চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়ই পরসময়ে চর্যাপদ বা চর্যাগীতিকা নামে পরিচিত লাভ করে।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত চর্যাপদে গান ছিল সাড়ে ৪৬টি। প্রবোধচন্দ্র বাগচী তিব্বতি-মহাগ্রন্থ তানজুর থেকে চর্যার তিব্বতি/ভূটিয়া অনুবাদ খুঁজে বের করে হারানো সাড়ে ৩টি পদের অনূদিত পাঠ প্রকাশ করেন। চর্যাপদ আবিষ্কারের পর থেকেই এর ভাষা, সাহিত্যমূল্য, ধর্মসাধন পদ্ধতিই ছিল গবেষকদের আগ্রহের বিষয়।

১৯৫০ এর দশক থেকে চর্যার সাংগীতিক পরিবেশনার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে থাকে। লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড স্টাডিজের সংস্কৃতের অধ্যাপক ড. আর্নল্ড এ্যাড্রিয়ান বাকে (১৮৯৯-১৯৬৩), ১৯৫৪-৫৫ সালে নেপালের এক বজ্রাচার্যের কণ্ঠ থেকে কিছু চচা বা চাচা গান রেকর্ডে ধারণ করে আনেন এবং পরে শশিভূষণ দাশগুপ্তকে শোনান। গান শুনে শশিভূষণ নিশ্চিত হন এই চচা বা চাচা গান আসলে চর্যাগান (চর্যা-চর্চা-চচা-চাচা)। দেশে ফিরে তিনি নেপালে যান এবং ২০ টি গান রেকর্ড ও ২০০টির বেশি চর্যাগান সংগ্রহ করে ফেরেন। ৭ সেপ্টেমবর ১৯৬৩ সালে  বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে একটি সভায়  নবচর্যাপদ এর ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, এখন আমি মৎসংগৃহীত নূতন একটি পদ এবং প্রাচীনতর চর্যা সংকলনভুক্ত একটি পদের গান, যা বর্তমান কালে বজ্রাচার্য পুরোহিত গায়কেরা গান করে থাকেন এবং যার ২০টি আমি tape record করে এনেছি তা আপনাদের শোনাচ্ছি। তালমান সহযোগে ধীরোদাত্ত কণ্ঠে এই গান আজও বজ্রাচার্যরা গেয়ে থাকেন। ১৯৭৬ সালে শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগে প্রথম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সুখময় মুখোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্য : কালে কালে শিরোনামে যে গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন তাতে রাগ-তাল সমন্বিত সুর সহযোগে চর্যাগান হয়েছিল। সম্প্রতি অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের সম্পাদনায় নতুন নতুন চর্যাপদ নিয়ে বিশালায়তনের ‘নবচর্যাপদ’ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশে চর্যার সাংগীতিক উপস্থাপনার বিচ্ছিন্ন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় ১৯৬০ এর দশক থেকে, কিছু ব্যক্তি উদ্যোগে, কিছু প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে। এদের মধ্যে কয়েকজন হলেন—আতিকুল ইসলাম, নরেন বিশ্বাস, নীলুফার ইয়াসমিন, কফিল আহমেদ, শিমূল ইউসুফ, সাইম রানা, আলীম মাহমুদ প্রমুখ। তারা চর্যার পদসমূহে সুরারোপ ও উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে তারা কখনো শাস্ত্রীয় সংগীতের সুরারোপের চেষ্টা করেছেন, আবার কখনো নেপালে চর্চিত সুরের অনুকরণের চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে বৃহৎ পরিসরে চর্যাগানের ডিভিডি প্রকাশ করেন আলীম মাহমুদ। নাট্যসংগঠন স্বপ্নদল এর আয়োজনে চর্যাগান শিরোনামে ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে-এর প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদিত সাড়ে ৪৬টি পদের সাংগীতিকরূপ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে তিনি মূল রাগের অনুসরণে সুরারোপের চেষ্টা করেছেন বলে—তার দাবি।

২১ মে ২০১৬ সালে, বৌদ্ধপূর্ণিমাতিথিতে, ভাবনগর ফাউন্ডেশনের ১৬ জন সাধুশিল্পীর পরিবেশনায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর উদ্ধারকৃত সম্পূর্ণ চর্যাপদ অর্থাৎ ৫০টি পদের সাংগীতিক উপস্থাপনার যৌথ আয়োজন করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও ভাবনগর ফাউন্ডেশন। চর্যার আদি ভাষায় উপস্থাপিত কয়েকটি গানের পাশাপাশি আধুনিক বাংলায় রূপান্তরিত চর্যাগান দিয়ে সাজানো হয় অনুষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয় চর্যাগবেষক সাইমন জাকারিয়া কর্তৃক চর্যাপদের আধুনিক বাংলায় অনূদিত অবনাগমন গ্রন্থটি। অবশ্য, ভাবনগর ফাউন্ডেশনের এই পূর্ণাঙ্গ পরিবেশনা প্রথম প্রচেষ্টা নয়। বরং গত দুই বছর ধরে ভাবনগর সাধুসঙ্গের শিল্পীরা চর্যার রাগ-সুর-পরিবেশনা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সাধুসঙ্গ চত্বরে প্রতি বুধবার দেশি-বিদেশি গবেষক-শিল্পী আর সাধারণ মানুষের সামনে নিরীক্ষামূলকভাবে পরিবেশন করেছেন চর্যাগান। প্রয়োজনানুসারে অভিমত-প্রেরণা গ্রহণ করেছেন।

২৬ নভেম্বর ২০১৫, বৃহস্পতিবারে ভাবনগরের সাধুশিল্পীরা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারে চর্যাগানের আয়োজন করেন। সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭.৩০ টা পর্যন্ত চলে চর্যাগানের পরিবেশনা। এতে ভাবনগর শিল্পীদের পাশাপাশি স্থানীয় সাধকশিল্পী—হাবিবুর রহমান, নান্নু সরকার, বাবুল আক্তার বাচ্চু লালনগীতি পরিবেশন করেন। স্থানীয় দর্শক-শ্রোতা ছাড়াও এই পরিবেশনা পর্যবেক্ষণের জন্যে উপস্থিত ছিলেন, জাপানের হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-লালন গবেষক মাসাহিকো তোগওয়া ও তাঁর একদল শিক্ষার্থী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক মাসউদ ইমরান মান্নু। হাজার বছর আগের চর্যাগানকে মুহূর্তেই আপন করে নেয় পাহাড়পুরের জনগণ। সেই থেকে ভাবনগর ফাউন্ডেশন সমগ্র চর্যাগানকে পরিবেশনার টার্গেট নিয়ে সুরসংযোজন করতে থাকেন।  বর্তমানে পাহাড়পুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জ, ঢাকাসহ বাংলাদেশেরে বিভিন্ন সাধক-শিল্পীগণ চর্যাগান পরিবেশন করে চলেছেন, ভাবনগর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে যেসব শিল্পীরা চর্যাগান পরিবেশন করেন, তারা মূলত লোকগানের সুরকে আশ্রয় করেন।

ভাবনগর বাউল-ফকিরগণ চর্যাগানের যে সুর-সংযোজন ও গীত উপস্থাপন করেন তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো : সুর-সংযোজনে তাঁরা চর্যার নির্দেশিত রাগ-রাগিনীকে আশ্রয় করলেও সেই সঙ্গে ভূখণ্ডগত কারণে লোকসুরকে আশ্রয় করেছেন, সমসাময়িক কালে শ্রোতাদের বোধগম্যতার কথা বিবেচনা করে তাঁরা প্রাচীন চর্যাপদসমূহের সমকালীন রূপান্তরিত গীতবাণীকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং বাদ্যের ব্যবহারে তাঁরা চর্যার নির্দেশিত বাদ্যযন্ত্রসমূহকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

চর্যার গান কোন সুরে গাওয়া হবে তা নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এ নিয়ে বহু বিতর্ক চলতে পারে, আর সেই বিতর্কই চর্যাচর্চাকে আবারও জীবন্ত সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত করতে পারে। তাই চর্যাকে নিয়ে কোনো গোঁড়ামি সিদ্ধান্ত এখনই গ্রহণ করা উচিৎ নয়, বরং নিরীক্ষামূলকভাবে যে যেভাবে পারুক চর্চা করতে থাকুক। আর কালের প্রবাহ কোনটিকে গ্রহণ করবে, সে সিদ্ধান্তের  জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামীর প্রত্যাশায়।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিকেএসপি কাপ ভলিবলে লাল দল চ্যাম্পিয়ন
বিকেএসপি কাপ ভলিবলে লাল দল চ্যাম্পিয়ন
যে দর্শনে পাকিস্তানকে কোচিং করাতে চান গিলেস্পি
যে দর্শনে পাকিস্তানকে কোচিং করাতে চান গিলেস্পি
‘কবরস্থানের উন্নয়নে’ কেটে ফেলা হলো অর্ধশতাধিক গাছ
‘কবরস্থানের উন্নয়নে’ কেটে ফেলা হলো অর্ধশতাধিক গাছ
টপ অর্ডার ব্যাটারদের ব্যর্থতায় চিন্তিত টিম ম্যানেজমেন্ট
বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলটপ অর্ডার ব্যাটারদের ব্যর্থতায় চিন্তিত টিম ম্যানেজমেন্ট
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?