X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

পেটার হান্ডকের অন্তর্জগত ও নোবেল বিতর্ক

ইরা সামন্ত
১২ অক্টোবর ২০১৯, ০০:৪৫আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০১৯, ০১:০৬
উপন্যাস ও নাটকের জন্য এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন অস্ট্রিয়ায় লেখক পেটার হান্ডকে। তাকে বলা হয় চিন্তা-উদ্দীপক লেখক। লেখালেখির জন্য তিনি বেশ সমালোচিতও। তাই তার নোবেল প্রাপ্তির সংবাদে অনেকেই খুশি নন।
পেটার হান্ডকের অন্তর্জগত ও নোবেল বিতর্ক

ইংরেজি ভাষার পাঠকরা পেটার হান্ডকের সম্পর্কে বলেন, তিনি পাঠকের নজরে এসেছেন তার চিন্তা-উদ্দীপক রচনার মাধ্যমে, যাকে বলে থট-প্রভোকিং।

তিনি কি চিন্তা-উদ্দীপক লেখক? নাকি পাঠককে উত্যক্ত করতে বেশি পছন্দ করেন—এই প্রসঙ্গে কথা উঠলে কথা ঘুরে যায় গ্রুপ ফোর্টি সেভেনের [দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সে সময়ের তরুণ জার্মান লেখকরা নাৎসি প্রভাবমুক্ত একটি লেখক সংগঠন দাঁড় করান, জার্মানে তার নাম ‘গ্রুপে জিবেন উন্ড ফিয়ারজিগ’, ইংরেজিতে ‘গ্রুপ ফোর্টি সেভেন’।] দিকে। লেখক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর এই সংগঠনের একটি বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন পেটার হান্ডকে। শ্রোতাদের উদ্দেশে তিনি কথা শুরু করেছিলেন বেশ কিছু খারাপ শব্দ ব্যবহার করে। এরপর থেকে তাকে এক প্রকার বর্জন করে লেখকদের ঐ সংগঠনটি।

তার লেখায়ও একই ব্যাপার ঘটতে দেখি। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত পুবলিকুমস-বেশিমফুং (ইংরেজিতে অনূদিত হয় ১৯৭১ সালে) বা ‘অফেনডিং দ্য অডিয়েন্স’ বা ‘ইনসাল্টিং দ্য অডিয়েন্স’ নাটকে দেখা যায় চরিত্ররা নাটকের কোনো ব্যাকরণ মানছে না, এমনকি নির্মাণের দিক থেকেও পেটার তার চরিত্রদের দিয়ে কদর্যভাবে তির্যক কথা বলাচ্ছেন, বেশিরভাগ সময়ে যা গালাগালিতে পর্যবসিত হয়েছে। নাটকটির কোনো প্লট নেই, কোনো গল্প নেই। থিয়েটারের সকল রীতিনীতিকে পাশ কাটিয়ে এমন একটি রচনার জন্য প্রশংসিতও হয়েছিলেন পেটার। বিশেষ করে ১৯৭০ সালে ইজরাইলি নাট্য-পরিচালক নাফতালি ইয়াভিনের পরিচালনায় লন্ডনে প্রদর্শীত হওয়ার পর থেকে এই নাটকটি অনেক জনপ্রিয়তা পায়।

নাটকটি সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে পেটার বলেছিলেন, ‘অন্য কোনো জগতের নয়, নাটকের পৃথিবী সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার পরিকল্পনা থেকে এই ধরনের নাটক লিখেছি। পরিকল্পনা ছিল দর্শকদের তাদের নিজের দিকে ঠেলে দেয়ার। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বা আমি গুরুত্বপূর্ণভাবে এই নাটকের মাধ্যমে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি সবসময় দর্শকরা সমস্ত নাটক আরো সচেতনভাবে এবং ভিন্ন চেতনা দিয়ে যেন দেখে। আমি প্রথমে থিয়েটারের বিপক্ষে পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার মনে হয়েছে পেপার ব্যাকের কয়েকটা কাগজের ভেতরে কিছু লেখার থেকে থিয়েটার বিরোধী বিবৃতিকে থিয়েটার হিসেবেই প্রকাশ সবচেয়ে বেশি যৌক্তিক। আর শেষমেষ নাটকটি আপনাদের অন্যরকম লাগছে।’

তবে পেটারের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক ‘দ্য আওয়ার্স উই নিউ নাথিং অব ইচ আদার’। এই নাটকটিও থিয়েটারের প্রচলিত ফর্ম থেকে আলাদা। নাটকটি শুধুমাত্র প্লটকে কেন্দ্র করে লেখা, নির্দিষ্ট কোনো ডায়লগ নেই।

যা হোক, পাঠক বা শ্রোতাকে উত্তেজিত করে আলোচিত হতে পেটার হান্ডকে পছন্দ করেন কিনা আমরা সে প্রসঙ্গে না গিয়ে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘দি এংস্ট দেস টর্টবের্টস ফর্ম এলফমেটার’, ইংরেজিতে ‘দ্য ফেয়ার অব দ্য কিপার’ শিরোনামের এই ক্রাইম নভেলের দিকে দৃষ্টিক্ষেপন করলে দেখতে পাই, উপন্যাসের মূল চরিত্র প্রতি পদে পদে একেক জনকে খুন করে। এক পর্যায়ে সে তার মাকেও খুন করে। পেটার এভাবেই এমনকিছু এমনভাবে বলছেন যেন পাঠক উত্তেজিত হতে বাধ্য হন।

গতকাল নোবেল কমিটি তাকে ২০১৯ সালের নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক হিসেবে ঘোষণা করেছে। নোবেল পাওয়ার আগে থেকেই পেটারের সাহিত্যকর্ম একইসঙ্গে জনপ্রিয় এবং সমালোচিত। বেশ আগে থেকেই ব্যক্তি পেটার এবং তার রাজনৈতিক দর্শন সমালোচিত। বিশেষ করে ৯০-এর দশকে যুগোস্লাভ যুদ্ধের পর সার্বিয়ার পক্ষ নেওয়া এবং সার্বিয়ার গণহত্যাকে সমর্থন পেটারের রাজনৈতিক দর্শনকে যতটা না প্রশ্নবিদ্ধ করে, তারচেয়ে পরবর্তীকালে সার্বিয়ার অন্যতম প্রধান নেতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোবোডান মিলোসেভিকের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা এবং বিশেষ করে তার মৃত্যুর পর শোক অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় সার্বিয়ার প্রতি মমত্ববোধ প্রদর্শন পেটারকে অনেক সমালোচনার মুখে ফেলে।

প্রসঙ্গক্রমে দুটি কথা বলে রাখা ভালো যে, পেটারের মা সার্বিয়ান এবং পেটারের রাজনৈতিক দর্শন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার মূল পটভূমি যুগোস্লাভ যুদ্ধ।

পেটারকে বিজয়ী ঘোষণা করে কমিটি বলেছে, ‘মানুষের অভিজ্ঞতাকে সুনির্দিষ্ট করে নতুন ধরনের ভাষা তৈরির মধ্য দিয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সাহিত্যকর্মের জন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হল।’ কিন্তু নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, ‘আশ্চর্যের ব্যাপার। এটা নিশ্চয়ই সুইডিশ একাডেমির জন্য একটি সাহসী সিদ্ধান্ত।’

আসলেই আশ্চর্যের, কারণ ২০১৪ সালে অস্ট্রিয়ান সংবাদমাধ্যম ‘দি প্রেসে’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পেটার হান্ডকে বলেছিলেন, ‘নোবেল পুরস্কারের আর মূল্য নেই। এই পুরস্কার বন্ধ করে দেয়া উচিত।’ সেই তিনিই যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন তো মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, পেটার কি নোবেল প্রত্যাখ্যান করবেন?

পেটার নোবেল পেয়েছেন এই ঘোষণা হওয়ার পরপরই সুইডিশ একাডেমির বিরুদ্ধে বিশ্বের বাঘা বাঘা সাহিত্য-সমালোচকরা নিন্দার ঝড় তুলেছেন পেটারের রাজনৈতিক দর্শনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে।

সালমান রুশদি বলেছেন, ‘আমি তার বিপক্ষে বহু আগেই লিখেছি, এখনো তার বিপক্ষেই অটল আছি।’

কসোভর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এই ঘোষণাটি অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে ক্ষত তৈরি করলো।’

গার্ডিয়ানকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে গতকাল স্লোভেনিয়ান দার্শনিক স্লাভিয়ো জিজেক বলেছেন, ‘যিনি ২০১৪ সালে বলেছেন নোবেল পুরস্কার বন্ধ করা দরকার, তাকেই নোবেল দিয়ে প্রমাণিত হলো নোবেল কেনো বন্ধ হওয়া উচিত। এক যুদ্ধাপরাধীকে কীভাবে নোবেল পুরস্কার দেয়া যেতে পারে? তাকে সাহিত্যে নোবেল দেয়া বন্ধ করে বরং আমাদের সময়ের হিরো জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে শান্তিতে নোবেল দেয়া হোক।’

এক প্রেস বার্তায় পেন আমেরিকা পেটারের নোবেল প্রাপ্তিকে তিরস্কার করে দুঃখপ্রকাশ করে বলেছে, ‘যিনি ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করেন তেমন একজন লেখক সাহিত্যে নোবেল পাওয়ায় আমরা হতবাক।’

সব মিলিয়ে পেটার হান্ডকের নোবেল প্রাপ্তি এক বিশাল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

শেষ করি পেটারের একটি কথা দিয়ে। এক সাক্ষাৎকারে পেটারকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সফলতা কী? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সফলতা শব্দটি রূপকথার একটি উপাদান—কখনো যা সত্য হয় না।’

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে