X
রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২

যে যায় সে দীর্ঘ যায় | সুহিতা সুলতানা

.
০২ জুলাই ২০২০, ১৩:২৩আপডেট : ০২ জুলাই ২০২০, ১৩:৪১

যে যায় সে দীর্ঘ যায় | সুহিতা সুলতানা

দাউদ আল হাফিজ আমাদের বন্ধু, আমাদের সুহৃদ। ১৯৯৫ সালে দাউদকে প্রথম দেখি আজিজ সুপার মার্কেটে। তখন আজিজ মার্কেটের ভরা যৌবন। কত মহারথিরা যে সেখানে আসতেন নাম বলে শেষ করা যাবে না। বাচ্চু ভাইয়ের বিশাকা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হবে ‘ষাটজন কবির কাব্যচিন্তন’—তা নিয়ে কী মহাব্যস্ততা আমাদের। অনিকেত শামীমের ‘লোক’-এ বসে আমরা দিনরাত্রি সাক্ষাৎকার গ্রহণের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। দাউদ, রণক, শামীম, চঞ্চল আশরাফ, আমি। তুমুল আড্ডার মধ্য দিয়ে আমরা কী নিখুঁতভাবে সম্পাদনার কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম।

পঞ্চাশ থেকে নব্বই দশকের মধ্য থেকে ষাটজন কবিকে নির্বাচন করাও ছিল দুঃসাধ্য। প্রতি সন্ধ্যায় আমাদের আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন হুমায়ুন আজাদ স্যার। স্যারের নির্দেশনাও আমাদের সম্পাদনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ কাফেলায় আরেক জন নিয়মিত আসতেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য এ লেখাটি যখন লিখতে বসেছি, তখন মাথার ওপর থেকে সরে গেছে আর্শীবাদের হাত—চলে গেছেন হুমায়ুন আজাদ স্যার, খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ক’দিন আগে চলে গেলেন আমাদের প্রিয় বন্ধু দাউদ আল হাফিজ।

বুকের পাজর ভেঙে ভেঙে যায়। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। দাউদ এত দ্রুত চলে যাবে এটাও মানতে হবে! এরকম কষ্টের লেখা লিখতাম না হয়ত—সম্পাদকের অনুরোধে লিখতে বসেছি। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কতবার রণককে ফোন করেছি, খলিল মজিদকে। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না দাউদ চলে গেছে না ফেরার দেশে।

আবার ১৯৯৫ সালে ফিরে যাচ্ছি...সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা—কত কবির বাড়িতেই না আমরা গিয়েছি সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য। দাউদ সব সময় থাকতো আমাদের সাথে। কী জোরে প্রাণ খুলেই না দাউদ হাসতো। ওর ভেতরের কষ্টগুলো বুঝতে পারতাম না। কী অদম্য মেধাবী একটা ছেলে এ শহরে একটা ভালো চাকরি পাচ্ছে না। পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকতে পারে না। কখনো কখনো অকপটে কষ্টের কথাগুলো বলে ফেলতো।

দাউদ হাঁটতে পছন্দ করতো ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনের পথ ধরে। টেড হিউজের কবিতা পড়তো হাঁটতে হাঁটতে, মজা করে প্রায়ই বলতো ইংল্যান্ডে থাকলে আপনি সিলভিয়া হয়ে যেতেন। দাউদের কথায় আমরা কেউ রাগ করতাম না। ওর মেধাকে সবাই মূল্যায়ন করতো। ওর হাতের লেখাও ছিল অসাধারণ। একবিংশ পত্রিকার সাথে ও যুক্ত ছিল বরাবরই। খোন্দকার আশরাফ হোসেন ওকে অনেক প্রশ্রয় দিতেন, সেটা আমরা আশরাফ ভাইকে বললে উনি বলতেন, দাউদ তো অন্য রকম। অন্য রকমটা কী তা জানা হয়নি আর।

অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় রণক আর আমার যৌথ সম্পাদনায় ষাটজন কবির কাব্যচিন্তন প্রকাশিত হবে। প্রচ্ছদ করে দিল বিনা পারিশ্রমিকে মাহমুদুর রহমান দীপন। মন দিয়ে প্রুফ দেখতো দাউদ। শামীম ওর লোকের কক্ষটি আমাদের জন্য ছেড়েই দিয়েছিল একরকম। ৯৫-এর বইমেলায় তুমুল আলোচিত হলো গ্রন্থটি। বিশাকার স্টলের সামনে জমে উঠতো আড্ডা। তুষার গায়েন, মোহাম্মদ আলীও মাঝে মাঝে আসতো আড্ডায়।

ছফা ভাই (আহমদ ছফা) তখন আজিজের দু’তলায় বসতেন, আমাদের ব্যস্ততা দেখে রেগে গিয়ে বলতেন, ‘কী হবে সুহিতা এসব করে?’ আমরা কোনো উত্তর দিতাম না। হুমায়ুন আজাদ স্যার ছিলেন আমাদের আশার আলো। সম্পাদনা গ্রন্থটি হাতে নিয়ে স্যার বলেছিলেন, ‘অনেকদিন পর একটা ভালো কাজ করলে তোমরা।’ আজ স্যার থাকলে দাউদের মৃত্যু মানতে পারতেন না।

দাউদের কোথায় যেন একটা হাহাকার ছিল। যেটা বলতে লজ্জা পেত অনেক সময়।

দাউদ রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার লাবণ্য-অমিত চরিত্রের বর্ণনা সুন্দর করে দিত। জীবনানন্দ দাশ ওর প্রিয় কবি ছিল। তবে কবি হবার জন্য ওর খুব অস্থিরতা ছিল এটা আমার মনে হয়নি কখনো। তবে নতুন কোনো কবিতা লিখলে পকেট থেকে বের করে আমাদের শোনাতো। শাদা প্যান্ট-শার্টই পরতো বেশি, মজা করে বলতাম এই স্কুল ড্রেস মার্কা পোশাক এখনো পরেন দাউদ? হেসে উত্তর দিত, অত টাকা নেই যে রঙিন পোশাক কেনার!

তারপর অনেকদিন আর দাউদের সাথে দেখা নেই, মাঝে মাঝে ফোন করতো। গ্রামই ছিল ওর পছন্দের জায়গা। বারবার গ্রামেই ফিরে যেত ও। ঢাকার জীবন ওকে স্বস্তি দেয়নি একটুও। রবার্ট ফ্রস্ট, টলস্টয়, কার্ল মার্কস, মানিক, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, সুনীল ও বিনয় মজুমদারের লেখা নিয়ে আলোচনা করতে করতে জমিয়ে তুলতো সাহিত্যের আড্ডা। প্রিয় স্যার বলতে কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়লেও প্রায় ৭-৮ টি ভাষা জানতো ও। শৈলকুপার কৃতি সন্তান দাউদ আল হাফিজের নামটি হয়ত একদিন ম্লান হয়ে আসবে, মানুষের চোখ ধূসর হয়ে আসবে। তবে কারো কারো হৃদয়ে এ নামটি থেকে

যাবে হয়ত বা।

‘আনাবাস অথবা দ্বিধার গন্ধম’ এই একটি মাত্র কবিতা গ্রন্থের জনক দাউদ। সব কিছুতেই ওর পরিমিতি বোধ। দাউদ অন্যদের মতো ছিল না, ছিল একটু আলাদা। প্রেম করে বিয়েও করেছিল ছাত্র অবস্থায়। তারপর লেখাপড়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পেলেও মন পড়ে থাকতো শৈলকুপায়। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, পিছুটান অর্থ-সংকট ওকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল।

‘হে রাখাল, হে দুগ্ধবতী গাভী, হে গ্রাম্য কিশোরী, আমি আবার আসবো ফিরে

তোমাদের মোহন ঠিকানায়।’

‘আজ আমার বিশ্বাস নেই অন্য কোনো তীর্থ।’

দাউদের চার স্তবকের কবিতার শরীর জুড়ে তীরবিদ্ধ যন্ত্রণা ছিল—

‘দারিদ্র্যের এক মহান পুরোহিত কবি

বিদ্রোহী মানুষের  অপার দুধ ভাত আর

সমূহ শান্তি সংগ্রহ শত্রু শিবিরে ছুঁড়েছেন

অনলবর্ষী কবিতা-কার্তুজ।’

আনাবাস পর্বের ভেতরে তিন স্তবকে ‘শূন্যে শূন্যে ঘুরছে/ শূন্যভুবন ত্রিভুবনের ত্রিত্ত্বসকল/ খ ও খামার জলেস্থলে…’

দাউদের কাব্য বিশ্লেষণ করবার জন্য এ লেখাটি নয়। সামগ্রিক দিকটাই তুলে আনা। একটা বাউল মন ছিল ওর। ওর অস্তিত্ব ও চিন্তার জগৎ ঘিরে সেটাই উপলদ্ধি করা যায়।

জগৎ সংসারে যা দেখা যায় তার প্রায় সবটা জুড়েই কৃত্রিমতা, স্বার্থের র‌্যাপিন কাগজে মোড়ানো হৃদপিণ্ডহীন জড়বস্তু।

‘সবুর, ছবর, তিতিক্ষা

এই তিনে মানবজীবন।’

চলে যাবার আগে দাউদের চিন্তাজগতের ভাবনা ছিল এরকম।

এই দাউদ আল হাফিজই যশোর বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, অতি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ও একটু একটু করে সামনে আগাতে চেয়েছিল। দারিদ্র্যের কষাঘাত মেধাকেও পিষ্ট করে দেয়। আগাতে পারেনি বেশি দূর। ফিরে গেছে বারবার গ্রামের মেঠো পথ ধরে, জন্মের ঠিকানায়। শহর ওকে ধরে রাখতে পারেনি। ইট কাঠ পাথর ধুলো পেছনে ফেলে চলে গেছে প্রাণপ্রবাহের কাছে।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মব সন্ত্রাস ছেড়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জামায়াতের
মব সন্ত্রাস ছেড়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জামায়াতের
‘মেসি ফুটবল খেলে খুশি’
‘মেসি ফুটবল খেলে খুশি’
রাউজানে প্রকাশ্যে যুবদল কর্মীকে গুলি করে হত্যা
রাউজানে প্রকাশ্যে যুবদল কর্মীকে গুলি করে হত্যা
৯০তম জন্মদিনে আরও ৪০ বছর বাঁচতে চান দালাই লামা
৯০তম জন্মদিনে আরও ৪০ বছর বাঁচতে চান দালাই লামা
সর্বাধিক পঠিত
প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু
প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু
সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় হাত: চাপের মুখে প্রবীণ ও মধ্যবিত্তরা
সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় হাত: চাপের মুখে প্রবীণ ও মধ্যবিত্তরা
আসছে নতুন কারিকুলাম: ফ্রেমওয়ার্ক ডিসেম্বরে, ‘বড় পরিসরে’ থাকবে জুলাই
আসছে নতুন কারিকুলাম: ফ্রেমওয়ার্ক ডিসেম্বরে, ‘বড় পরিসরে’ থাকবে জুলাই
কনস্টেবলকে ‘স্যার’ ডেকে ধরা পড়লেন ভুয়া এসআই
কনস্টেবলকে ‘স্যার’ ডেকে ধরা পড়লেন ভুয়া এসআই
আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে প্রতীকী কফিন মিছিল
আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে প্রতীকী কফিন মিছিল