X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
শামসুর রাহমান

প্রান্তরে জীবনের বীজ

ফারুখ সিদ্ধার্থ
১৭ আগস্ট ২০২২, ০০:০৪আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২২, ০০:০৪

অফিসে ঢুকে ডেস্কে বসতেই রিসিপশন থেকে ইরা ইন্টারকমে জানায়, ভাইয়া, শ্যামলী থেকে আপনার ফোন এসেছিল। 
তাই! কখন?
হ্যাঁ, এই তো, কিছুক্ষণ আগে—।
কী বলেছেন?
আপনার সাথে না-কি জরুরি কথা আছে।
আচ্ছা, কলব্যাক করো।
তিনি বরাবরই টেলিফোনে কথা বলতে ভালোবাসেন, কিন্তু আজ শুধু সে-জন্যে ফোন করেননি। তিনি তিরিশোত্তর আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রধান পুরুষ, সমকালীন বাঙলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি এবং দেশবরেণ্য আলোকিত মানুষ—এই বিবেচনায় আমাদের পত্রিকার, বিশেষ করে, বিশেষ সংখ্যাগুলোর, প্রথমদিকেই তাঁর নামে একটি স্পেস বরাদ্দ থাকে। এবারও আছে। সে-হিসেবে আগেভাগেই তাঁর কাছে একটি লেখা চেয়েছিলাম। তিনিও কথা দিয়েছিলেন। একটু দেরি হচ্ছিল প্রতিশ্রুত লেখাটি পেতে। তবে এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কাউকে পাঠিয়ে শুধু নিয়ে এলেই হয়। কিন্তু কাকে পাঠাই? অফিসের প্রতিটি স্টাফ এখন ব্যস্ত—মহাব্যস্ত। ওদিকে তাঁর বাসায় কোনও ফ্যাক্স বা ইন্টারনেট সুবিধা নেই; এদিকে ঈদ সমাগত; ঈদ সংখ্যার কাজও প্রায় শেষপর্যায়ে। পত্রিকার অন্যফর্মাগুলো ইতোমধ্যে প্রেসে চ’লে গেছে।... উপায়হীন আমি তাই নিজেই বেরিয়ে পড়ি।
পান্থপথ সিগন্যাল থেকে, রিকশা নিয়ে, ফার্মগেটের কাছে আসতেই রেড সিগন্যাল। না, কোনও ট্রাফিক সিগন্যাল নয়, সামনেই হাত তুলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে সুজন—কই যাইতাছেন বস? 
এই তো, সামনে। 
তুফান বেগে যাইতাছেন যে!
একটু তাড়া আছে কি না—।
সাংবাদিক হইলেই বুঝি তাড়াহুড়া করণ লাগে? তাও শুক্কুরবার? 
সাংবাদিকের আবার শুক্র-শনি কী? কাজ পড়ে গেলে—ছুটতেই হয়। 
আরে থন আপনার ছোডাছুডি। কামডা কী তাই কন।
আছে। চাইলে তুমিও আসতে পারো।
আপনার লগে!—কই যামু?
রাহমান ভাইর বাসায়।
রাহমান ভাই! মানে শামসুর রাহমান!! আগে কইবেন না?
হু-র-রে... বলেই লাফিয়ে ওঠে সুজন।
ফার্মগেট থেকে গাবতলির বাস ধরি আমরা। শ্যামলী নেমে, আইল্যান্ড পার হয়ে, একটি রিকশা নেই। যেতে যেতে সুজন বলে, বস্ কবিরে কি বাসায় পামু? দ্যাখা হইব তাঁর লগে? 
খুব উত্তেজিত মনে হয় ওকে। আমি ওর কাঁধে মৃদু চাপড় দিয়ে ওকে আশ্বস্ত করি—হবে, হবে। 
কথায়-কথায় ‘পঙ্খীরাজ’ নামের রিকশাটি আমাদের পৌঁছে দেয় কবির ছিমছাম রুপালি বাড়িটির সামনে; যেখানে, মেইন গেটের দু-পাশে দুটি ফুলগাছ—শিউলি ও কামিনি। কামিনিরা থোকা ধ’রে ফুটে আছে গাছময়; আর রাতে-ফোটা শিউলির নরম ফুলগুলো কমলার গাঢ়-রঙ বোঁটা নিয়ে উপুড় ছড়িয়ে আছে ঘাসে। বাড়ির ভেতরেও—সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে, সার বেঁধে আছে রঙ্গন-দোপাটি-গোলাপ...। গাড়িবারান্দার ছাদ থেকে একটি ঝোপালো বাগান বিলাস আর একটি মধুমঞ্জরি তাদের আভিজাত্য নিয়ে উঠে গেছে দোতলার ছাদে। আকাশমুখি, অথচ শেকড় মাটিতেই পোঁতা। কবির নিরাপত্তা প্রহরীসহ এইসব সুন্দর আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানায়। 
এ-বাড়ির সীমানায় পা রাখলেই কোনও-না-কোনও ফুলের গন্ধ আমাকে জাপটে ধরে। আর ওমনি আমার মনে পড়ে একটি বিশেষ ফুলের কথা। গত বসন্তে, একটি বিনোদন-ম্যাগাজিনের বিশেষ অনুরোধে, কবির একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেদিন কথা হয়েছিল কবির ‘প্রথম প্রেম’ নিয়ে। সাক্ষাতে জানিয়েছিলেন, তখনও কৈশোর পেরোননি; এক আশ্চর্য সুন্দর কিশোরীর প্রেমে পড়েছিলেন। বনফুলের মালাবদল করে তাঁদের প্রেম হয়েছিল। কবির সেই প্রথম-প্রেমিকা আজও আছেন; এবং এই ঢাকাতেই।... সেদিন মালাবদল আর বনফুলের প্রসঙ্গেই কবি জানান তাঁর প্রিয়ফুলের কথাও; আর পাল্টা প্রশ্ন করেন আমাকে। আমি বলি, পথের ঘাসফুল থেকে চালের কুমড়োফুল... সবই আমার প্রিয়। তবে আমাকে সবচে বেশি টানে কচুরিফুল। 
কচুরিফুল!! 
অবাক হচ্ছেন?
থতমত খেয়ে কবি বলেন, আসলে, আমি না... কচুরিফুল দেখিনি। 
কী! আপনি কচুরিফুল দ্যাখেননি!!
কবি হাসেন, একটু ভ্যাবাচেকা হাসি; যেন এক ব্যর্থ মানুষ। আমিও হাসি, তবে অবিশ্বাসের; বলি, না রাহমান ভাই, অসংখ্য বিলঝিল ভরা নদী-বিধৌত এই দেশে আপনি কচুরিফুল দ্যাখেননি—এ হতে পারে না। নিশ্চয়ই দেখেছেন, হয়তো মনে করতে পারছেন না। 
সত্যি দেখিনি। তুমি আমাকে দেখাবে?—কেমন দেখতে?
আমার চোখে তো অসাধারণ। সাধারণত গ্রাম-বাঙলার খাল-বিল, ছোট নদী বা মজাপুকুরে, দলে-দলে কিংবা গাদাগাদি অবস্থায় ভেসে থাকে যে-সব সবুজ কচুরি, হেমন্তেই ফুটতে শুরু করে তাদের ফুল। প্রতিটি কচুরিপানায় একটি-দুটি বা তিনটি, হালকা সবুজাভ, দণ্ড বেরোয়। রজনিগন্ধার মতো নাতিদীর্ঘ প্রতিটি দণ্ডের চারপাশ জুড়ে একসাথে ফোটে মনোরম নয়-দশ থেকে পনেরো বা বিশটি ফুল; যার প্রতিটি বোঁটায় থাকে হালকা বেগুনি রঙের ছয়টি করে হাসিখুশি পাপড়ি। ঠিক ওপরদিকের পাপড়িটি আবার অন্যরকম : মাঝামাঝি নীলচে প্রায় শিরা-উপশিরায় বিন্যস্ত গাঢ়-বেগুনি-রঙ ভালোবাসার এক মায়াবী প্রতীক...।
বলো কি! আমার তো এখনই দেখতে ইচ্ছে করছে।
শুধু কি তাই? সুমিষ্ট পিঠের মধ্যে যেভাবে সযত্নে বসানো থাকে নারকেলের নরম তক্তি, তেমনই সেই প্রতীকটির ভেতরেও হলদে ঘন চ্যাপ্টামতো চারকোনা একটি সুদৃশ্য তিলক আঁকা। এ-ছাড়াও আছে আরও কিছু আকর্ষণীয় বর্ণিল সূক্ষ্ম কারুকাজ। সবমিলিয়ে ঊর্ধ্বমুখি এক প্রাকৃতিক ঝাড়লণ্ঠন...।
বলো কি!!
হ্যাঁ। সব কচুরি যখন একসাথে ফোটে, তখন দশদিক কেমন ঝলমল করে ওঠে; খলখল করে হেসে ওঠে পুকুর মাঠ বিল...; মনে হয়, একঝাঁক ভায়োলেট পাখি—এখনই বুঝি উড়াল দেবে; তখন সত্যি চোখ ফেরানো যায় না।
আমার কথা শুনে তাঁর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আমিও, টিয়েরঙ-পাতাসহ হালকা-বেগুনি রঙের একগোছা কচুরিফুল তাঁকে অচিরেই দেখাব, কথা দেই। 
দোতলায়, সিঁড়ির ডানপাশেই, কবির নিজস্ব ঘর। সিঁড়ি ভেঙেই দেখি, দরজা খোলা। কাঠের হাতাঅলা ত্রিকোনা চেয়ারে বসে লেখার টেবিলে মগ্ন কবি। কালো ফ্রেমের পুরু চশমা-চোখে, নিবিষ্ট মনে, কী যেন পড়ছেন। গায়ে ফ্যাশন্যাবল তকতকে ফতুয়া, আর জংলি প্রিন্ট লুঙ্গি পরনে। মাথায় শরতের কাশফুল—শাদা দীর্ঘশ্বাস ভরা। টেবিলের একপাশে কতগুলো পত্রিকা। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আস্তে করে ডাক দেই। তিনি খেয়াল করেন না। দরজার পাল্লায় নক করে আমি আবার ডাক পাড়ি, রাহমান ভাই, আমি মুক্তি...।
এবার মুখ তোলেন কবি, ও তুমি এসে গেছ। এসো, বসো। 
কবির বাঁ-পাশের চেয়ারে আমি। টেবিলের কোনায়, আমার মুখোমুখি, সুজন। তার পেছন-ঘেঁষে নীলাভ শাদা দেয়াল। দেয়ালে কাঠের ফ্রেমের একটি বড় ঘড়ি; ছোট্ট পাখিবসা পেন্ডুলামটি অবিরাম দুলছে। ঘড়ির ডানপাশে, সম্প্রতি বাঁধানো, কবির একটি বড় ফটোগ্রাফ; তরুণ আলোকচিত্রী জাহাঙ্গীরের তোলা। 
এ-বাসায় আজই প্রথম এসেছে সুজন। অবাক বিস্ময়ে সে দেখছে—কত বিপুল বিচিত্র বই ঘরজুড়ে। আলমিরার ওপরেও প্রায় ছাদ ছুঁয়ে আছে বই আর বই। লেখার টেবিলে তো সদ্যপাওয়া নতুন বইয়ের গাদা; সুগন্ধে ভরপুর। এছাড়া ধবধবে বিছানায়, ফুলতোলা বালিশের পাশে, ভাঁজখোলা আরও কিছু পত্রিকা; আর সামনের দেয়ালে, কবি-জীবনের বিশেষ ও বিরল মুহূর্তকে ধরে আছে আরও কয়েকটি ফটোগ্রাফ।... সবকিছুই ধোপদুরস্ত, পরিপাটি। যথারীতি আন্তরিক কবি বলেন, কী খাবে তোমরা?
নো থ্যাঙ্কস্: আপনি ব্যস্ত হবেন না, প্লিজ।
কেন, রোজা রেখেছ?
না, রাহমান ভাই, বেশিক্ষণ হয়নি নাশতা করেছি।
তাহলে শুধু চা হোক—বলেই সদ্যলেখা স্ক্রিপটি বাড়িয়ে দেন। আমি হাতে নিয়ে ঝটপট পাতা উল্টাই। কবি বলেন, তোমার কি খুব তাড়া?
আমি সিরিয়াস হয়ে উঠি—কেন রাহমান ভাই? 
লেখাটা যদি একটু পড়তে... 
ও, এই কথা! ঠিক আছে পড়ছি : বহুক্ষণ হেঁটে, হেঁটে, হেঁটে/ কোথায় এসেছি/ গায়ে কাঁটা দেয়া এই জন্মান্ধ সন্ধ্যায়?/ মনে হচ্ছে পশ্চিম আকাশ/ কখনো বিস্কুটের মতো আর/ চাঁদ কোনও বুড়োর ধরনে কতিপয়/ ফোঁকলা দাঁতের আহামরি সৌন্দর্যের/ বিদঘুটে বাজারু প্রচারে কী অশ্লীল!...
বিদঘুটে, হিংসুটে এক বৃক্ষতলে ক’জন জুয়াড়ি/ মেতেছে খেলায় আর কখনো কখনো/ তাদের হুল্লোড়ে কেঁপে ওঠে/ জমি, যেন গিলে খাবে সেই/ ফতুরে জুয়াড়িদের। আচানক নারীর কান্নার/ ধ্বনি ভেসে আসে ক্ষণে ক্ষণে ঘোর কৃষ্ণ/ দিগন্তের বুক চিরে। কে এই নিঃসঙ্গ অনামিকা?
কখনো নিজেকে দেখতে পাই এক/ হ্রদের কিনারে/ বড় বেশি অন্ধকার চারদিক থেকে/ দাঁত, নখ খিঁচিয়ে আসছে মুখ ঢেকে/ মুখ ঢেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা ক’রে ব্যর্থ হই।/ আমি তো ভেবেছিলাম হ্রদ থেকে উঠে...। এটুকু পড়তেই কবির দু-নাতনি—নয়না ও দীপিতা, কাঁধে ইস্কুলব্যাগ, বাইরে থেকে হুড়মুড় ছুটে আসে। তারা দাদুর দু-পাশ থেকে দুগালে একসাথে দুটি চুমু খায়। কবিও আদর ক’রে তাদের কপালে সশব্দে দুটি চুমু এঁকে দেন। সুজন দ্যাখে আর মুগ্ধ হয়, কবির সবকিছু তার ভালো লাগে। আমি আবার শুরু করি; কিন্তু কবি ঠিকমতো শুনতে পান না। আমি কণ্ঠের ভলিউম আরেকটু বাড়িয়ে দেই। তিনি তন্ময় হয়ে থাকেন। এর মধ্যেই বড় ট্রে-তে করে চা আসে, সাথে মচমচে টোস্ট। চা-এ চুমুক দিতে গিয়ে খেয়াল করি, খুব চুপচাপ বসে আছে সুজন, যা তার স্বভাবের সাথে কিছুতেই যায় না। তাই হঠাৎ মনে-পড়ার মতো বলি, রাহমান ভাই, ওর নাম সুজন—ফিরোজ সুজন। 
ফিরোজ সুজন! নামটা চেনাচেনা লাগছে—কী করেন আপনি?
আমি একটি কলেজে পড়াই।
আমি বলি, লেখালিখিও করে। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রায়ই লেখা আসে ওর। হয়তো সে-কারণেই...।
ঠোঁটের কোনায় লেগে-থাকা সূর্যোদয়ের আভাটুকু আরেকটু ছড়িয়ে কবি বলেন, হ্যাঁ, তা-ই হবে। আমি তরুণদের লেখা সবসময় পড়ি। 
এবার ন’ড়েচ’ড়ে বসে সুজন। বেশ জ’মে ওঠে আড্ডা। কথায়-কথায় দুপুর গড়িয়ে যায়। কথায় কি আজ পেয়ে বসেছে কবিকে? এত কথা তো কোনওদিন বলতে শুনিনি?—এমনটি যখন ভাবছি, ঠিক তখনই, ঘড়িপরা হাতটি চোখের কাছে নিয়ে আঁতকে ওঠেন কবি; আর বালকের মতো হাঁক ছাড়েন, টিয়া, টি—য়া...। পাশের রুম থেকে চমৎকার সাড়া দেন টিয়াও— আসছি বাবা...।
ও-ঘরে যেতে, দরজার পাশেই, ক্যালেন্ডারে কবির বিশেষ কর্মসূচিগুলো লালবৃত্তে মার্ক করা। সে-দিকে তাকিয়ে কবি জানতে চান, আজ আমার কী প্রোগ্রাম? 
চৌকাঠ ধরে দাঁড়ানো টিয়াও সেদিকে তাকিয়ে বলেন, বাবা, আজ চারটায় কবি জালালউদ্দিন রুমির ওপর একটা অনুষ্ঠান আছে।
কোথায় যেন?
টেবিল থেকে দ্রুত একটি নোটবই তুলে নেন টিয়া, আর তখনই ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে ওঠে কবির ল্যান্ডফোন। তিনি খপ করে ধরেন—হ্যালো... ওয়ালাইকুম আস-সালাম;... জি, ভালো;... হ্যাঁ মনে আছে; ...আচ্ছা আচ্ছা...। 
রিসিভার রেখে বলেন, ওঁরাই করেছেন। একটি শাদা মাইক্রোবাস এসে নিয়ে যাবে। আমাকে তৈরি থাকতে হবে।
রাহমান ভাই, প্রোগ্রামটা কারা করছে? 
একটি ইসলামি সংস্থা।
কবির মুখে আয়োজকদের কথা শুনেও ঠিক আঁচ করতে পারি না—কারা। তিনি বলেন, কবি জালালউদ্দিন রুমির ওপর একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে ওঁরা। টেবিলের ওপর, দেয়ালঘেঁষে রাখা কিছু বই থেকে একটি তুলে নেন কবি, এবং আমার সামনে মেলে ধরে বলেন, আমাকে এর মোড়ক উন্মোচন করতে হবে। গোলাপি আন্ডারলাইনে চি‎হ্নিত কয়েকটি বাক্য আমাকে পড়েও শোনান। তবু আমার উৎকণ্ঠ প্রশ্ন : আপনি যাবেনই ওদের অনুষ্ঠানে?
কেন, ভয় পাচ্ছ? আমাকে ওরা মেরে ফেলবে? 
আমি চুপ করে থাকি। কিছুক্ষণ পর, নীরবতা ভেঙে কবি বলেন, ওঁদের সঙ্গে কথা বলে এবং বইটি পড়ে তো ‘তেমন কিছু’ মনে হচ্ছে না। 
তিনি পুনরায় স্মারক বইটি খুলে কয়েকটি বিশেষ জায়গায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন; যেখানে ধর্ম প্রসঙ্গে রুমির বক্তব্য আমাকে ছুঁয়ে যায়। তবু দ্বিধা নিয়ে বলি, ঠিক আছে, আপনি যদি ভালো বোঝেন, তো ভালো। আর কে যাচ্ছে?
আমার সঙ্গে?—জাহাঙ্গীর যাবে। 
জাহাঙ্গীর! আমার পেছনেই, একটি চেয়ারে, কখন এসে বসে আছে, টের পাইনি। তাকিয়ে দেখি মিটিমিটি হাসছে—আরে জাহাঙ্গীর, তুমি—কতক্ষণ?
এই তো এলাম।
কেমন চলছে তোমার ফটোগ্রাফি?
জি, ভালোই।
শোনো ভাই, তুমি তো সঙ্গে যাচ্ছ—খুব খেয়াল রেখো; আর মুঠোফোনটা সবসময় অন রেখো, কেমন?
আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। আমি আছি।
ওকে—থ্যাঙ্কস্। তো রাহমান ভাই, আজ আমরা উঠি তাহলে?
হ্যাঁ, আবার এসো।
আমি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াই; সুজন পা ছুঁয়ে কবিকে সালাম করে।

২.
অফিসে মেকআপ রুমে বসে আছি। কাজ দেখছি। রিসিভশন থেকে ইরা জানায়—ভাইয়া, আপনার ফোন; কবি শামসুর রাহমান, দিলাম...।
খুব আফসোস হয়—ইস্ আগেই একটা রিং করা উচিত ছিল... হ্যাঁ, রাহমান ভাই, মুক্তি বলছি।
মুক্তি, কেমন আছো?
ভালো, ভালো, আপনি? 
কবি ভেঙে-ভেঙে বলেন, খুব ভালো বোধ হচ্ছে না।
গ্লুকোমা সমস্যা কি বেড়েছে? 
সে তো আছেই। পড়তে পারি না—কষ্ট হয়। তার ওপর এখন বুকের ভেতরেও কী যেন বাসা বেঁধেছে। যাহোক, ডাক্তারকে ইনফর্ম করেছি। দেখি কী হয়। তোমার কথা বলো। গতকাল অফিসে কোনো সমস্যা হয়েছে?
না তো! কেন রাহমান ভাই?
আমার কাছে এসে তোমার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।
কী যে বলেন, আপনার কাছে গেলে কারও সময় নষ্ট হয়! এরপর তো আমি আরও সময় নিয়ে আসব। 
তাই! কবে নাগাদ? 
শিগগিরই। ঈদ তো এসে গেল। এ-সুযোগে একবার বাড়ি যেতে হবে। মা পথ চেয়ে আছেন। বাড়ি থেকে ফিরেই...
মনটা আগেই চলে গেছে, না?—এবার ফেরার পথে আমার জন্যে কচুরিফুল আনবে?
এই সেরেছে।... আমি থমকে যাই। ও-প্রান্তে কবি কান পেতে আছেন, হ্যালো, মুক্তি? 
এখন কী বলব? আমি কি বোঝাতে পারিনি—এক স্পর্শকাতর ফুলের নাম কচুরিফুল? তুলে হাতে নিলে, কিছুক্ষণ পর, এমনিতেই মিইয়ে আসে; তারওপর নাড়াচাড়া পেলে তো কথাই নেই। সেক্ষেত্রে দূর থেকে দূরে বহন করা তো আরও সমস্যা। তাতে তার প্রকৃত শোভা ও মোহন সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান হয়ে যায়। এ-কথা আগেও বলেছি। তাই সে প্রসঙ্গে আর যাই না। শুধু বলি, হ্যাঁ, রাহমান ভাই, কচুরিফুলের কথা আপনার মনে আছে? আপনি না আজকাল ভুলে যান সব? 
সত্যি, কিচ্ছু মনে থাকে না। কী যে হয়েছে—মাঝে মাঝে কাউকে চিনতেও পারি না। 
আমাকেও?
টের পাই, কবি হাসছেন। আমি বলি, সব ভুল হয়, বিবর্ণ হয়, শুধু ছেলেবেলার কথাই কিছু ভুল হয় না, তাই না? 
বিস্ময়ভরা কণ্ঠে কবি বলেন, আশ্চর্য! তুমি কী করে বুঝলে?
নিজেকে দেখেই, তাছাড়া আপনাকে পাঠ ও পর্যবেক্ষণ করেও...।
তুমি আমাকে এত খেয়াল করো?
তেমনটি আর পারি কই? তবে আপনাকে আমি ভালোবাসি রাহমান ভাই, খুব ভালোবাসি। 
মুহূর্তে নস্টালজিক হয়ে-ওঠা কবি বলেন, জানো, পায়ে-পায়ে যতই মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছি, ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ছেলেবেলা; তার সব রঙ; মাহুৎটুলি, পাড়াতলি... সব। 
তাহলে কচুরিফুলও নিশ্চয় দেখেছেন কোথাও, না-হলে এতকিছুর ভিড়েও একটি ফুলের কথা এত মনে থাকে কীভাবে? 
তোমার অমন বর্ণনা শুনেই হয়তো...।
আমি তো প্ল্যান করেছি, এবার জন্মদিনে আপনাকে কচুরিফুল দিয়েই শুভেচ্ছা জানাব।
তাই! তবে তো ওটাই হবে আমার জন্যে সবচে ভালো উপহার। আমি অধীর আগ্রহে দিনটির অপেক্ষায় থাকব...। 
আমার আইডিয়ায় মুগ্ধ ও চমৎকৃত কবি বলেই যাচ্ছেন—হ্যালো—হ্যালো? 
আমি বুঝিয়ে বলি, রাহমান ভাই, সম্পাদক সাহেব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
ঠিক আছে, আমি এখন রাখছি, তুমি এসো কিন্তু।
আচ্ছা, আসব, নিশ্চয়ই আসব।

৩.
শিল্পী শাহাবুদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক শক্তিশালী প্রচ্ছদ নিয়ে ‘অন্যদিন ঈদ-সংখ্যা’ এখন বাজারে। প্রায় ছয়শো পৃষ্ঠার ঢাউশ ম্যাগাজিনটি পত্রিকার স্টলগুলোতে শোভা পাচ্ছে। সৌজন্য কপি বিতরণের কাজও শেষ প্রায়।
এমনিতে কাজের চাপ নেই, তারওপর আজ ডে-অফ। বেশ ভারমুক্ত আমি পিজি-র কোয়ার্টারে, নিজের আস্তানায়, শুয়ে ভাবছি—বাড়ি যাওয়ার আগে রাহমান ভাই-র সাথে একবার দেখা করলে কেমন হয়। এত করে বলেছেন। তার ওপর শরীরটাও না-কি ভালো যাচ্ছে না। বিকেলে বাড়ির জন্যে কিছু কেনাকাটা আছে, কাল অফিস গুছিয়ে পরশুই বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা।... শ্যামলী গেলে তাই এ-বেলাই যাওয়া উচিত। 
ঝটপট বেরিয়ে পড়ি। হোটেল শেরাটনের উল্টোদিক থেকে উঠে পড়ি গাবতলিগামী বাসে। ভিড় সামলে গন্তব্যে পৌঁছতে বেশ সময় লেগে যায়।
আজও দরজাটা খোলা। বিছানায় শুয়ে আছেন কবি, কী যেন ভাবছেন। আমাকে দেখেই উঠে বসতে চান। আমি উঠতে দেই না, বরং খাটেই, তাঁর ডানপাশে, সাবধানে বসি—কুশলাদি নেই। কথায়-কথায় চ’লে আসে অনেকদিন আগের কথা : ৯ অক্টোবর ১৯৮৭। মস্কোতে জননেতা মোহাম্মদ ফরহাদ-এর জীবনাবসান হয়। তাঁর অকালপ্রয়াণে তখন, তাৎক্ষণিকভাবে, আপনার শোকার্ত কলমে এসেছিল একটি কালজয়ী মহৎ কবিতা; যেমন এসেছে, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে, শহীদ আসাদ, বঙ্গবন্ধু, নূর হোসেন, রাজুসহ অনেকের বেলায়; এবং উত্তরকালে যে-সব পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছে বিপুল। কমরেড ফরহাদ-কে নিয়ে লেখা সেই দীর্ঘ মনোগ্রাহী কবিতাটি ছাপা হয়েছিল সিপিবি’র মুখপত্র সাপ্তাহিক একতা-য়। আপনার মনে পড়ে?
না তো, মনে করতে পারছি না।
আপনার পাশে সৈয়দ হকেরও একটি কবিতা ছিল। আমি তখন ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। ইস্কুল ছুটি থাকায় সেদিন আমি ছিলাম আমার জন্মগ্রামে...। 
তোমার—গ্রামের—নামটা যেন কী?
আসফরদী। 
ও হ্যাঁ, বলেছিলে, মনে পড়েছে। 
তবে গ্রামে থাকলেও, অগ্রজদের কল্যাণে, একতা’র সেই বিশেষ সংখ্যাটি তখন ঠিকই আমার হাতে পৌঁছেছিল, যা আমি বারবার পড়েছি। কখনও ছাগল চরাতে গিয়ে, মাঠে—খেতের আলে পা ছড়িয়ে বসে, কখনও-বা অনেক আকাশের নিচে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছি : অকস্মাৎ এ কেমন নিস্তব্ধতা এলো ব্যেপে দেশে?/ এ কেমন সূর্যাস্তের ছটা/ বিলাপের মতো/ আকাশে ছড়িয়ে পড়ে? বেদনার্ত পাখি নীড়ে ফেরা/ ভুলে যায়, ফুল/ উন্মীলনে পায় না উৎসাহ,/ নদীতে জোয়ার-ভাটা থেমে যায়; মনে হয়, পঞ্চান্ন হাজার/ বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি কী ভীষণ বাষ্পাকুল!/ না তোমাকে মানায় না এরকম কাফনের শাদা/ মোড়কে শুয়ে-থাকা/ মাটির গভীরে, না তোমাকে মানায় না;/ এ গহন স্তব্ধতায় মিশে-থাকা সাজে না তোমাকে।...
আরেকটু পড়ো না—।
এভাবে বলছেন কেন, আপনি যত শুনবেন, আমি পড়ব: ‘... রেডিও সংবাদপত্র বলে, তুমি নেই।/ গাছপালা, নদীনালা, মাঝিমাল্লা, ক্ষেতমজুররা/ বলে, তুমি নেই; গ্রাম্য পথ, শহুরে সড়ক দ্বীপ/ বলে, তুমি নেই/ প্রতিটি নদীর বাঁক, পদ্মার রূপালি ইলিশের/ ঝাঁক বলে, তুমি নেই, গোলাপ বাগান, পাহাড়ের/ পাকদণ্ডী, উদার গৈরিক মাঠ বলে, তুমি নেই/ বাউলের একতারা বলে, তুমি নেই,/ তোমার নিজস্ব ঘর গেরস্থালি বলে নেই, তুমি নেই/ পাখিদের ক্লান্ত ডানা বলে, তুমি নেই, তুমি নেই/ তুমি থাকবে না/ শহর কাঁপানো মিছিলের পুরোভাগে/ তুমি থাকবে না/ শ্রমিকের, কৃষকের, ছাত্রদের বিপুল উজ্জ্বল সমাবেশে/ তুমি থাকবে না/ পার্টির ব্যাপক সম্মেলনে,/ ক্ষুধার্তের সারিতে তোমাকে দেখবো না...’ গভীর আবেগে সেদিন সত্যি নিজেকে ধরে রাখতে পারি নি। শোকস্তব্ধ আমি তখন চোখ মুছে ওই লেখার ভেতরেই ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি খুঁজে পেয়েছি; কিন্তু বড় হয়ে, আপনার সব বই ঘেঁটেও, কোথাও লেখাটি আর পাই নি।
হাতের তালুতে মাথা রেখে কাত-হয়ে-শুয়ে-থাকা কবি এবার উঠে বসেন। বালিশে ঠেস দিয়ে বলেন, একতা’র সেই কপিটি...?
সেটি আমাদের শহরের বাসায় সংরক্ষিত ছিল, কিন্তু ৮৮-র বন্যায়, ঘরের ভেতর যখন হাঁটুপানি, আরও অনেক কিছুর সাথে, বানের তোড়ে, কোথায় ভেসে গেছে। তারপর অনেক খুঁজেও, কোথাও, কারও কাছেই লেখাটির কোনও কপি আর পাইনি। শেষমেশ—কিছুদিন আগে, পল্টনের সাহিত্যপ্রকাশ-এ, মতিউর রহমান সম্পাদিত মোহাম্মদ ফরহাদ স্মারকগ্রন্থ-এ সম্পূর্ণ অক্ষতই পেয়েছি। কিংবদন্তি হয়ে শীর্ষক ৬৮ পঙক্তির দীর্ঘ কবিতাটির কোথাও আপনি নেতার নামটি উচ্চারণ করেন নি; অথচ কী আশ্চর্য, প্রতিটি শব্দেই তাঁকে নিবিড়ভাবে পাওয়া যায়! যতবার পড়ি, আমার সব ইন্দ্রিয়—সারাদেশ, নেতার অসীম শূন্যতাকে অনুভব করে। আজও। লেখাটির শেষদিকে আপনি দ্রষ্টার মতো ভবিষদ্বাণী করেছেন: ‘...যদিও এখন তুমি মেঘে ভাসমান,/একগুচ্ছ ফুল,/ বিরান প্রান্তরে জীবনের বীজ, অথচ এও তো জানি মৃত্যুর জঠর/ ফুঁড়ে লোকগাথার মতন/ কিংবদন্তি হয়ে তুমি/ থাকবে বাংলায় আমাদের পাশে অগণিত হৃদয়ে হৃদয়ে।’ সত্যি, আপনার কথাই ঠিক। আজও, সমগ্র উত্তর-বাংলায়, প্রতিটি জনপদে, অগণিত মানুষের মনে তিনি কিংবদন্তি হয়েই আছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন : আপনার নির্বাচিত কাব্যগ্রন্থে অমন একটি মর্মস্পর্শী, আবেদনময়ী, কবিতার ঠাঁই হলো না কেন! 
কবি যথারীতি তাঁর ভুলের দোহাই দিয়ে বলেন, একদিন নিয়ে আসবে লেখাটি? দেখব।
আমি নিয়েই এসেছি। 
কই দেখি তো! 
এই যে দেখুন, বলে কাঁধের ব্যাগ থেকে ফটোকপিটি বের করে কবিকে দেখাই। তিনি হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলতে-খুলতে জোরগলায় ছেলেমানুষের মতো ডেকে ওঠেন, টিয়া—টিয়া, আমার চশমা?
কবির বালিশের পাশেই ছিল চশমা। আমি দ্রুত তুলে নিয়ে বলি, এই তো চশমা। তিনি কবিতাটি চোখের কাছে নিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দ্যাখেন। কিন্তু বেশিদূর পড়ে উঠতে পারেন না। কী মনে করে পাশেই রেখে দেন—আর কী এনেছ? 
আর কী আনব? আমি তো আপনার জন্যে কিছুই আনতে পারি না; শুধু আসি আর মুঠো ভরে নিয়ে যাই।
একটু লাজুক হেসে কবি বলেন, তোমাকে, প্রায়ই, একটি কথা বলব-বলব করি, কিন্তু বলা হয় না। তুমি সামনে এলেই কেমন দিব্যি ভুলে বসে থাকি।
এমন কী কথা, রাহমান ভাই, যে এরকম ভূমিকা—?
তেমন কিছু না, তোমার ‘মুক্তি’ নামটা কে রেখেছেন? 
আমার মেজো ভাই। 
তোমার সেই কমিউনিস্ট ভাইটা?
জি। এর একটি চমৎকার প্রেক্ষাপটও আছে—।
কী রকম? একটু বলা যাবে? 
খুব কৌতূহলী হয়ে ওঠেন কবি। শরীরটা যে ভালো নেই, তা যেন ভুলে বসে আছেন। আমিও খুশি হয়ে বলি : একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর—ভোরবেলা; যখন সবুজের বিক্ষত পটভূমিতে স্বাধীনতার রক্তাক্ত সূর্যটি উঠি উঠি করছে। শোষণের নাগপাশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবার সেই বিরল মুহূর্তে আমার জন্ম; যে-কারণে আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের কাছে সেদিন এ-নামটি অনিবার্য হয়ে উঠেছিল...
বাহ্! চমৎকার—ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট! 
খুব উচ্ছ্বসিত কবি সব শুনে বলেন, তুমি তো রীতিমতো গর্ব করতে পারো। একটি দেশের জন্মের সাথে তোমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা—কেমন হাত ধরাধরি ক’রে আছে! আর তাকে আরও অর্থবহ করেছে তোমার এই আপাত ছোট্ট নামটি। 
আমার মাথায় পাল্টা প্রশ্ন খেলা করে; সত্যি কি অর্থবহ করেছে? আমরা স্বাধীন হয়েছি ঠিকই, আমাদের আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি কি এসেছে? সেই সময় আমাদের সব ধরনের পশ্চাৎপদতা ও ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে শোষণহীন সমাজ গড়ার যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা তো আজও বাস্তবায়িত হয় নি। আমি সুদূর পরাহত সেই স্বপ্নের কথা তুলে ক্লান্ত—অসুস্থ কবিকে আর বিব্রত করতে চাই না; তাই নিঃশব্দ হাসি আর দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে চেপে যাই সব।
কথায়-কথায় বাসি হয় দুপুর। কবির অনুরোধে তাঁর সামনে বসে খেতে হয় দুপুরের খাবার: বেগুন-ভর্তা, বাতাসি মাছের চচ্চড়ি আর লাউ-শিংমাছসহ ধোঁয়াওঠা গরম ভাত। খেতে-খেতেও প্রান্তিক মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে টুকটাক কথা হয় আমাদের। অতঃপর বিদায়।

৪.
ঈদের ছুটি-শেষ। যথারীতি ব্যস্ততায় পেয়ে বসে আবার। তবু চোখ রাখি, যখন যেখানে যাই; খুঁজে ফিরি—কোথায় পাওয়া যায় একগুচ্ছ কচুরিফুল। সময় বয়ে যায়। গ্রীষ্ম-বর্ষা হয়ে ফের চলে আসে শরৎ। তবু যাওয়া হয় না আর, কবিকে দেখতে। কেননা, এ-শহরে সময় পেলেও কচুরিফুল পাওয়া যায় না। 
আমাদের পত্রিকার একটি নিয়মিত বিভাগ ‘শেকড়ের সন্ধানে’; যার প্রতিসংখ্যায়, একটি অনুসন্ধানী ফিচার থাকে। এ-কাজে প্রতিমাসেই আমাকে ঘুরে আসতে হয় দেশের এক-বা একাধিক জেলা; কোনও-না-কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চল। সেই ধারাবাহিতায় এবার ময়নামতি ঘুরে, সপ্তাহান্তে, আজ ঢাকায় ফিরছি। সাঁই-সাঁই করে ছুটছে চেয়ারকোচ। মুঠোফোনের ব্যাটারিতে পর্যাপ্ত চার্জ না-থাকায় কারও সাথেই ভালো যোগাযোগ হচ্ছে না। তবু চেষ্টা করছি। হঠাৎ সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার দীপংকর গৌতমের কল—হ্যালো, মুক্তি, তোমরা কোথায় এখন?
দাদা, আমরা তো এখন গোমতি পার হচ্ছি। ও-দিকের খবর কী? 
খবর তো একটাই—রাহমান ভাইর অবস্থা ভালো না?
তাই-না-কি! কীরকম—কবে থেকে এ অবস্থা?
এই তো, তুমি যাওয়ার পর থেকেই... কেন, শোনো নি কিছু? 
শুনেছি—তবে ডিটেইল না। যাহোক, সর্বশেষ অবস্থা কী?
সর্বষেশ অবস্থা...।
হ্যালো...হ্যালো...দাদা... ধুত্ লাইনটা কেটে গেল! আমি আবার চেষ্টা করি; কাজ হয় না। একটু পর দাদা-ই কলব্যাক করেন—হ্যাঁ, মুক্তি, ঢাকায় পৌঁছেই আমাকে ফোন করো। আমরা তাঁকে দেখতে যাব, কেমন? 
আমার শরীর ঘেমে উঠছে। আমি জানালার গ্লাস সরিয়ে দিই। বাতাসে রোদের ঘ্রাণ। চারপাশে ছড়ানো জীবনের কত উপাদান। ক্লান্তি আর অবসাদ সত্ত্বেও দৃষ্টি বারবার ছুঁয়ে আসছে দিগন্ত। কত শাদা-ছেঁড়া-মেঘের বহর নীলগোলা আকাশে; নিচে অপার কাশবন। শাপলা-ফোটা ধূ-ধূ বিলের মধ্যেও কচুরিতে সবুজ হয়ে উঠেছে ভাদরের কাঁচা-রোদ। হেমন্তেই ফুটতে থাকবে রাশি রাশি কচুরি; অজস্ত্র ফুলে ফুলে ভরে উঠবে বাঙলার কতশত খাল-বিল-ডোবা; অথচ কী দুর্ভাগ্য আমার, প্রিয় মানুষের করপুটে তার একটি ফুলও উঠবে না...! তবে কি এভাবেই থেকে যায় অপূরণ এক-একজন কবির স্বপ্ন? এতটুকু চাওয়া? 
আমার সফরসঙ্গী বিশ্বজিৎ সরকার আজকের দৈনিকটা পড়ছিলেন। তার মুখেই শুনেছি, রাহমান ভাইকে নিয়ে কী-সব আশংকার কথা লিখেছে। আমার এ-মুহূর্তের ভাবনার কথা তার জানবার কথা না; তবে আমি-যে সুযোগ পেলেই কচুরিফুল খুঁজে ফিরি, তা ভালো করেই জানেন। একজন পেশাদার আলোকচিত্রী হিশেবে প্রয়োজনীয় কোনও দৃশ্যই তার দৃষ্টি এড়ায় না। এমন-কি দ্রুতগতির মধ্যেও যে-কোনও দুর্লভ দৃশ্য তিনি অনায়াসে তার ক্যামেরায় তুলে আনতে পারেন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে যা সুদূরপ্রসারী আবেদন সৃষ্টি করে। 
সড়কের পাশেই থই-থই জলে আগাম ফুটে আছে জারুল রঙের একগুচ্ছ ফুল। কচুরিফুল! বেশ হাসিখুশি ফুলগুলো দেখামাত্র ক্লিক ক’রে তুলে নিল বিশ্বজিৎ দা-র ডিজিটাল ক্যামেরা। আমার পাশে বসেই তিনি দৃশ্যটি আবিষ্কার করেছেন। শুধু ক্যামেরাবন্দি নয়, একেবারে হাতেধরা বাস্তব দৃশ্য। প্রথমে সুপারভাইজারকে ব’লে চলন্ত কোচটি থামান; কিন্তু অমন স্পর্শকাতর যে ফুল তা শুধু ডাঁটি ভেঙে নিয়ে গেলে ঢাকা পর্যন্ত টিকবে কেন? তাই ছেবড়িসহ আস্ত পানাটিই তুলে আনেন তিনি। শুধু কি তাই? ফুলগুলো যাতে সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত এবং সতেজ থাকে তারও ব্যবস্থা নেন। ভবের-চর স্টেশনে এসেই ঝটপট পাশের বাজার থেকে লাল রঙের একটি বালতি কেনেন এবং সড়কের বুকঘেঁষা ছোট-ছোট ঢেউখেলা জল ভেঙে তুলে আনেন আধাবালতি টলটলে জল। এ-সবই করছেন তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে। বাসের অন্যযাত্রীরা কে কী মনে করছে, সে-দিকে তাঁর কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।
ঢাকায় পৌঁছেই বোঝা যায় প্রকৃত পরিস্থিতি। পাওয়া যায় শেষ-সংবাদ। বাঙলা কবিতার জীবন্ত কিংবদন্তি কবি শামসুর রাহমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আইসিইউতে সাক্ষাৎ মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। ডাক্তাররা বলেছেন—তাঁর ফুসফুস, কিডনি, যকৃত—সবই প্রায় বিকল। 
অফিসে রিপোর্ট বুঝিয়ে দিয়ে, বিকেলেই, ছুটি হাসপাতালে—সঙ্গে দীপংকর দা ও বিশ্বজিৎ দা।
সিকিউরিটিতে মারাত্মক কড়াকড়ি। তবু ওখানকার একজন পরিচিত ডাক্তারের রেফারেন্সে আমরা ঠিকই পৌঁছে যাই কবির শয্যাপাশে। হাতে কচুরিফুল, চোখে জল; কিন্তু যাঁর জন্যে এই আয়োজন, তাঁর ক্ষমতা নেই সাড়া দেবার। তিনি সম্পূর্ণ কোমায় চলে গেছেন। তবু আমি তাঁর নাকে-মুখে পরানো যন্ত্রের ফাঁক গ’লে, আলতো ছুঁইয়ে, বুকের কাছেই, রেখে দিই ফুলগুলো। 
ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে অচিরেই পৃথিবী জেনে যায়, বাঙলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান আর নেই। তাঁর শরীর থেকে যাবতীয় যন্ত্রপাতি খুলে নেওয়া হয়েছে।
নীরব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় দেশব্যাপী বইছে শোকের শৈত্যপ্রবাহ। 
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় না হলেও, দেশের আপামর মানুষের পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ফুলে-ফুলে সিক্ত হন কবি; কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে মানুষের ঢল পেরিয়ে বনানী গোরস্থানে—মায়ের বুকেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন আমাদের প্রিয় কবি। 
ধূসর সমাধির পাশে, প্রিয় ফুল হাতে, শ্রদ্ধাবনত আমি, নীরবে কাঁদছি শুধু। কত প্রত্যাশিত এই ফুল—যা আমি শেষ পর্যন্ত পেলাম ঠিকই, কিন্তু তাঁর হাতে তুলে দিতে পারলাম না। তিনিও দেখে যেতে পারলেন না—ঠিক কেমন দেখতে আমার প্রিয় ফুল—কচুরিফুল।
এখন কীভাবে ক্ষমা করব নিজেকে? জীবনে—যখন—যেখানেই দেখা হবে কোনও কচুরিফুলের সাথে, একটি গাঢ় চাপা দীর্ঘশ্বাস কি এভাবেই বেরিয়ে আসবে না, আমার ভেতর থেকে? তখন বাঙলার সব ফুল নিয়ে এখানে এলেও কি পাওয়া যাবে কোনও সান্ত্বনা? কে ব’লে দেবে? 

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!