X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্টালিনের শক্তি

আবু আফজাল সালেহ
২২ নভেম্বর ২০২২, ১০:২৪আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২২, ১২:৪৫

কবিতার গুণ বিচার করতে গেলে আমাদের দুটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়। প্রথমত কবিতার মাধ্যমে কবির মানসলোকের আলোচনা; দ্বিতীয়ত কবিতার আঙ্গিক ও প্রকরণগত আলোচনা। আজকের আলোচনায় কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের মানসলোকের আলোচনা বেশি করব; কম করে হলেও প্রকরণগত আলোচনা করারও চেষ্টা করব। কবি স্টালিন পথ-চলাতে স্বাধীন। কবিতা বা সাহিত্যের উঠোনে তিনি নিজের মতো করেই ঘোরাঘুরি করতে চান। তার কবিতা পাঠে সত্যতাও পাই। স্বাধীনচেতা মানসলোক বৃদ্ধি করতে চান তিনি। বিভিন্ন কবিতায় তা বলেছেনও। স্টালিনের শক্তভাষার আকাঙ্ক্ষা :

‘এ পথে আপনি স্বাধীন;

আপনার সবকিছু আপনি স্বেচ্ছায় নির্বাচন করুন।

কোনো পথপ্রদর্শক নেই। আপনিই আপনার নিয়ন্তা;

এগুবার কিংবা ফেরার দায়িত্ব আপনার নিজের।’

(পথের নির্বাচন)

অনেকসময় কবি বিজ্ঞানের কাছে গেছেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র তুলে ধরে কবিতায় গতিশীলতা আনতে চেয়েছেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে খুব কমই লেখা হয়েছে। আবার বিভিন্ন ইতিহাসে ফিরে গিয়ে কবিতার উপাদান জোগাড় করেছেন। বিশ্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন উপাদান এনে ইতিহাস সচেতন করতে চেয়েছেন। বিজ্ঞান ও ইতিহাস নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে কবিতা বা সাহিত্যে এমন সুনিপুণভাবে ব্যবহার করা যায় না। তত্ত্বীয়-জ্ঞানকে প্রয়োগ করে এক্ষেত্রে কবি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। যা মোটেও সহজ কাজ নন। কবি কিন্তু বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র হচ্ছে, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীতমুখী ক্রিয়া রয়েছে’। আবার সক্রেটিসের মূলবাণী হচ্ছে, নিজেকে জানা। রেজাউদ্দিনের অনেক কবিতার মর্মবাণী কিন্তু এমনই।

‘আত্মা কি, ঈশ্বর কোথায়?

ভাবতে-ভাবতে উই ধরেছে জঙ্ঘায়।

পৃথিবী কবে থেকে সূর্যের চারদিকে

ঘুরতে শুরু করলো তা স্রষ্টা ছাড়া কেউ জানে না।’

(এক দার্শনিকের মুখোমুখি, সংক্ষেপিত)

আমরা অনেকেই বলি, বাংলা ভাষার অনেক কবির কবিতায় অনেক শক্তি রয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে পারছি না। অনুবাদে অদক্ষ বা বাংলা কবিতার অনুবাদ কম হওয়ায় বিশ্বপাঠকের কাছে আমরা অনেক পিছিয়ে। কিন্তু রেজাউদ্দিন স্টালিন চুপি চুপি এ কাজটিই করে যাচ্ছেন। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা অনূদিত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়। কবি স্টালিন কবিতায় পুরাণ, প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ইত্যাদির মিথ ব্যবহার করেছেন। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে বাঙালির পরিবেশ ও সমসাময়িক অবস্থার সাথে মিশেল করে কবিতা লিখেছেন। উপমা-উৎপ্রেক্ষা আর চিত্রকল্পের সুনিপুণ ব্যবহার করেছেন। কোনো ক্ষেত্রে আবার রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। তার ভাব, ভাষা এবং পরিকল্পনার পৃথক মাত্রা দিয়েছেন। তিনি  বাংলা সাহিত্যে আশির দশকের অগ্রগণ্য কবি। তাঁর কাব্যভাষা বেশ শক্তিশালী। কবি স্টালিন স্বাধীন এবং স্বনিয়ন্ত্রিত। নিয়ন্ত্রণটা হচ্ছে শিল্পের। তার অনেক কবিতায় রয়েছে পরাবাস্তবতা বা জাদুবাস্তবতার মিশেল। তার কবিতার প্রধান প্রবণতা প্রেম, দ্রোহ, আধ্যাত্মিকতা। কবিতায় আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। রেজাউদ্দিন স্টালিন এক্ষেত্রে সফল বলে মনে করি। অতিরিক্ত আবেগ বা কম আবেগ কবিতাকে অসফল করতে পারে। সময়কে এড়িয়ে যেতে চান না স্টালিন। গ্রীনহাউজ এফেক্ট বা পরিবেশ বাঁচাও নিয়ে অনেক আন্দোলন হচ্ছে। কবিরাও পিছিয়ে নেই। রেজাউদ্দিন স্টালিনের উচ্চারণ: ‘একদিন বৃক্ষের জন্য সবাইকে কাঁদতে হবে’। তার কবিতার বিযয় বৈচিত্র্যের বহুমাত্রিকতা রয়েছে। ছন্দ, মিল, ধ্বনি, মধ্যমিল, যতিচিহ্ন ব্যতিত কবিতা তার কবিতার আরও কিছু প্রবণতা বা লক্ষণ। মিথ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ, ধর্মীয় অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। একথায় ‘মানবিক প্রেম’ই তার কবিতার উপজীব্য। ‘কীটসের গোলাপ দর্শন (নিরো)’,‘চোখের চুম্বন (অন্বেষণ)’, ‘বিদর্ভ আকাঙ্ক্ষা (বলতেই হবে)’, ‘শয়তানের ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলছে আমাদের আত্মত্যাগ (বিক্ষত পদাবলি)’, ‘না পাওয়ার হিংস্র হাহাকার (অন্বেষণ)’ ইত্যাদির মতো নতুন নতুন চিত্র, চেতনা বা শব্দাবলির ব্যবহার দেখি। অনেক কবিতা আবার আমাদের চৈতন্যকে জাগিয়ে দিতে সক্ষম, কিছু কিছু অংশ আবার চৈতন্যকে প্রসারিত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম:

‘তারপর একদিন বৃষ্টিধারায়স্নাত বধ্যভূমিতে

বৃক্ষের দিন আসে ব্রহ্মপুত্র

পত্রালির নৌকা ভাসে সবুজ বাতাসে

আমি সব কান্না সব মৃত্যু মুছে ফেলে সেই বৃক্ষময় দিনের কাছে যাবো

তার ফসলিম ফুল ও গন্ধময় আশ্চর্যের কাছে

তার ধানশীষ ডালপালা নুয়ে থাকে সম্পদের ভারে

আমি এক সোনামুখী ধানশীষ পূর্ণপ্রাণ যাবো’

(সোনামুখী ধানশীষ পূর্ণপ্রাণ যাবো)


এজরা পাউন্ড, এলিয়েট, বোদলেয়ার প্রমুখ কবি প্রচলিত বা আধুনিক প্রকাশ ও মনোভঙ্গির সঙ্গে তাল-মিলিয়ে নতুন নতুন নির্মাণ কৌশল প্রয়োগ করে জনপ্রিয় হয়েছেন। কবিতায় ব্যতিক্রম চিন্তাভাবনা কবিতাকে হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। আমরা জানি, পাঠক একই জিনিস বারবার দেখতে চান না, শুনতে চান না। তারা চান নতুনত্ব। স্টালিন অনেককিছুই প্রবর্তনা করেছেন, করতে চেয়েছেন। কবিতার কাঠামোতে পরিবর্তন করতে চেয়েছেন। নব-নব অনুষঙ্গ এনে কবিতার ভাষার ধমনীতে নতুন রক্ত দিয়ে শক্তি দিয়েছেন। ছন্দ, অনুপ্রাস নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তিনি। শব্দ দিয়ে ছবি এঁকেছেন-যা আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রধান প্রবণতা। রূপক ও প্রতীক ব্যবহার কবিতাকে হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। হতাশা-নিরাশা, ব্যর্থতা, প্রেম-অপ্রেম ইত্যাদি আধুনিক কবিতার অনুষঙ্গ। ‘মানবতা’ই যেখানে শেষ কথা। রেজাউদ্দিন স্টালিন উল্লিখিত উপাদানে বা অনুষঙ্গে মানবতার পক্ষে জোরালো উচ্চারণ করেছেন। কবিতায় শব্দ-বিন্যাসে ফুটে ওঠে রং, এ রং গাঢ় হয়ে লাবল্য-গুণ পায়। কমনীয় হয়ে ওঠে কবিতা। কবিতার বার্তা কিন্তু অভেদ্য হয়, মিলিয়ে যায় না, লুপ্ত হয় না। ভালো-কবিতার এ গুণ স্টালিনের কবিতায় লক্ষ করা যায়। ব্যঞ্জনা বা দ্যোতনা গুণ কবিতার প্রধান একটি গুণ। শব্দের আভিধানিক বা সাধারণ অর্থ কবিতায় ভিন্নতা পায়, ক্ষেত্রমতে, বহুমাত্রিক অর্থ পায়। কবিতার সার্থকতা কবিতায় শব্দ বা বাক্যাংশের বহুমাত্রিক অর্থ প্রকাশ। কবিতায় বহুমাত্রিকতা অন্যতম গুণ। স্টালিনের সহজ শব্দ বা বাক্যাংশ ব্যবহারেও নতুন-অর্থ পাই, কোনো-কোনো জায়গায় বহুমাত্রিক অর্থ পাই। ধ্বনিময়তা ও চিত্রময়তা কবিতার দুটি গুণ। রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতা পড়লে এ গুণটি পাঠকের কাছে ধরা দেবে। দাড়ি, কমা বা যতিচিহ্ন বাদে রেজাউদ্দিনের প্রচুর কবিতা দেখা যায়। বাংলা-কবিতায় নতুন এ ধারা। বিশ্ব-কবিতায় প্রথম এ-রীতির প্রবর্তন করেন আপেলিয়র।

‘আমার সময় গো-ক্ষুরের মতো বিভাজিত/ মুহূর্তগুলো কালো কৃষকের পায়ের মতো ফাটা’ (সূচনাপর্ব/ ফিরিনি অবাধ্য আমি) ইত্যাদির মতো উপমা বা চিত্রকল্পগুলো চৈতন্য-প্রসারী হয়েছে, নান্দনিক হয়েছে। এখনকার সময় দ্বিধাবিভক্ত। দলান্ধ, গোষ্ঠীতন্ত্র বা যে-কোনো কার্যক্রমে একপক্ষের প্রতি আনুগত্য বা ঘৃণা সাধারণ ও আবশ্যিক বিষয় হয়েছে। এখন বিবেক বা বিবেচনা, দেশ-সমাজের কল্যাণকর নিয়ে ভাবনার কথা প্রায় শূন্যের কোটায়। কবি স্টালিন এ বিভক্তিকে ‘গরুর খুরের মতো বিভাজিত’ হিসাবে বলেছে-একসঙ্গে চলে কিন্তু এক হতে পারে না! কী সুন্দর উপমা! কী সুন্দর চিত্রকল্প! জীবনানন্দ দাশ ‘‘কবিতার কথা’’ প্রবন্ধের প্রথম প্যারায় বলেন, ‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি-কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকিরণ তাদের সাহায্য করছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করার অবসর পায়’। আমি মনে করি রেজাউদ্দিন স্টালিন অনেকদূর পর্যন্ত কল্পনা করতে পারেন। উপমা ও চিত্রকল্প গঠনে তার কল্পনার বিস্তৃতির কথা অনুধাবন করতে পারি। ‘আমি এক সোনামুখী ধানশীষ পূর্ণপ্রাণ যাবো (সোনামুখী ধানশীষ পূর্ণপ্রাণ যাবো)’, ‘বক্ষময় বিচরণশীল অশ্বারোহী (অন্বেষণ)’ ইত্যাদির মতো চেতনা-প্রসারী সব চিত্রকল্প। এমন অনেক চিত্রকল্প আমরা স্টালিনের কবিতায় লক্ষ করি।

রেজাউদ্দিন স্টালিন কবিতায় লেগে থেকেছেন এবং কবিতাকে পাঠকগ্রাহ্য করতে পেরেছেন। তার কবিতায় আত্মপ্রকাশে নিজস্বতা রয়েছে; এবং দিনে দিনে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। তার কবিতায় অনু্ভূতি আছে। শৃঙ্খলা, ছন্দ, শব্দের ব্যবহার, চিত্র ও চিত্রকল্পের প্রয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে যুক্তি মানানসই। ফলে রেজাউদ্দিন স্টালিন বাংলাকবিতায় নিজের জাত চেনাচ্ছেন এবং ক্রমশ নিজের জগৎ বৃহৎ থেকে বৃহত্তর করছেন। আঙ্গিক, প্রকরণ বা মানস আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, রেজাউদ্দিন স্টালিন কবিতায় অনেক পরিবর্তন এনেছেন, নতুন কিছু প্রবর্তনাও করেছেন, কাব্যভাষাকে শক্তিশালী করেছেন। আধুনিক কবিতার সব লক্ষণ তার কবিতায় লক্ষ করা যায়।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
দেশ ও জাতির মুক্তির একমাত্র উপায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন: ড. কামাল হোসেন
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
আওয়ামী লীগের অপরাধটা কী?
সর্বশেষ খবর
ভান মুন নোয়াম বমকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
ভান মুন নোয়াম বমকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
পরোয়ানা জারির ৬ বছর পর উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার
পরোয়ানা জারির ৬ বছর পর উপজেলা চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার
পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার-অনিন্দিতার জামিন চেয়ে আবেদন
পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার-অনিন্দিতার জামিন চেয়ে আবেদন
সর্বাধিক পঠিত
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
টাকা উড়ছে রেস্তোরাঁয়, নজর নেই এনবিআরের
টাকা উড়ছে রেস্তোরাঁয়, নজর নেই এনবিআরের
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করবে দুদক
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করবে দুদক
তাপপ্রবাহ থেকে ত্বক বাঁচানোর ৮ টিপস
তাপপ্রবাহ থেকে ত্বক বাঁচানোর ৮ টিপস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ