আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হই তখন ক্যাম্পাসে দুজন প্রতিনিধিত্বশীল লেখক ছিলেন- একজন কবি মোহাম্মদ রফিক, অন্যজন নাট্যকার সেলিম আল দীন। তখন বাংলা ও ইংরেজি বিভাগ ছিল পুরান কলাভবনের দুই তলায়।
কবি মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল, আমরা তখন একধরনের শিষ্যর মতো বিচরণ করতাম; তার সঙ্গে দেখা করতাম, প্রান্তিকে চা খেতে খেতে তিনি নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। আমার কবিতা সম্পর্কে আগ্রহ থাকায় নানা সময় নানা জায়গায় কবিতা নিয়ে কথাবার্তা আলোচনা হতো। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে বাংলা বিভাগে যোগ দেই, দুটি বিভাগ একসঙ্গে থাকায় শিল্প-সাহিত্য, সমকালীন জীবন ও রাজনীতি নিয়ে তার সঙ্গে বিস্তর আলাপ হতো।
১৯৭০ সালে ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ কাব্যগ্রন্থ ছাপা হলে কবি মোহাম্মদ রফিক বেশ পরিচিতি অর্জন করেন। ছান্দসিক কবি আবদুল কাদির তখন বাংলা একাডেমিতে, তিনি মোহাম্মদ রফিককে বলেছিলেন, ‘ছন্দে তোমার অসাধারণ দখল।’ এই মন্তব্যে রফিক বলেছিলেন, ‘ছন্দ আমি তখনও শিখিনি।’ কবি মোহাম্মদ রফিকের মৃত্যুতে এইসব টুকরো কথা মনে পড়ছে।
তার পরের কাব্যগ্রন্থ- ‘ধুলোর সংসারে এই মাটি’, বা এর আরও পরে এরশাদের শাসনামলে ‘খোলা কবিতা’ নামে একটি এক ফর্মার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, কবিতাটির শুরু ‘সব শালা কবি হবে’ দিয়ে; তখন এরশাদের কবি হওয়ার তোড়জোর চলছে, কবিরা দুইভাগ হয়ে গেছেন; কেউ এরশাদের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে; তো এই কবিতাটি কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা তা তো প্রকাশ্য ব্যাপারই। কবিতাটি দেশে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে এবং এই কবিতার জন্য তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডাকা হয়। কবিতার শুরুটা এরকম:
‘সব শালা কবি হবে; পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে, উড়বেই;
বন থেকে দাঁতাল শুয়োর রাজাসনে বসবেই।
হঠাৎ আকাশফুঁড়ে তৃতীয় বিশ্বের গঞ্জে-গাঁয়ে
হুট করে নেমে আসে জলপাই লেবাস্যা দেবতা;
পায়ে, কালো বুট; হাতে, রাইফেলের উদ্যত সঙ্গীন’’
পুরো লেখাটি একটি দীর্ঘকবিতা, ১৫/১৬ পৃষ্ঠা তো হবেই। নিউজপ্রিন্ট কাগজে ১ ফর্মার এই কবিতাটি ছাপাখানায় গোপনে ছাপা হয়। স্বৈরশাসনবিরোধী ছাত্রছাত্রীরা তা বিলি করতে শুরু করলে তা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।
মোহাম্মদ রফিক খুব সাহসী ছিলেন, লেখায় ও জীবনযাপনে; চলাফেরায় অদ্ভুত দৃঢ়তা ছিল। অনেক পড়তেন; শুধু সাহিত্য না, পৃথিবীর নানা বিষয়ে তার অসম্ভব কৌতূহল ছিল, অন্যকে পড়তে উৎসাহীও করতেন। তিনি ‘শিকড়’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা করতেন, ছাত্রাবস্থায়; তাতে বাংলাদেশের সমকালীন কবিতার বিষয় ও শৈলীর পরিবর্তন, পশ্চিমবঙ্গের কবিতার খবরাখবর এবং আমাদের কবিতার নিজস্ব রাস্তা কীভাবে নির্মাণ করতে হবে- এসব নিয়ে বিভিন্ন সময় আলাপ করেছেন। তিনি আমাদের তথা উত্তর প্রজন্মকে অনেক দিক নির্দেশনা দিতেন।
তার বাসায় আমার যাতায়াত ছিল, ক্যাম্পাসে যারা শিল্প-সাহিত্য চর্চা করতেন প্রায় সবাই তার বাসায় যেতেন। স্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না, স্ত্রীও কবি, জিনাত আরা রফিক। দুই ছেলে বিদেশে চলে গেলে তিনি নিঃসঙ্গতার ভুগছিলেন।
কবি প্রথম জীবনে সাংঘাতিক প্রাণময় জীবনযাপন করেছেন, কিন্তু শেষদিকে, আমার মনে হয়েছে তিনি নিঃসঙ্গতায় পড়ে গেছেন। একসময় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করে দেন।
তার রচনাশৈলী অনন্য। ষাটের দশকে একমাত্র কবি তিনি, যাকে প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই আলাদা করা যায়। কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতার তিনি দৃঢ়চিত্ত ছিলেন, বিচলিত হননি কখনও।
তার আকস্মিক মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছি। তিনি অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু এভাবে চলে যাবেন তা ভাবিনি, তাই ধাক্কাটা বেশি লেগেছে। প্রিয় কবির প্রয়াণে প্রণতি জানাই; আমি মনে করি তিনি তরুণদের কাছে সবসময়ই প্রিয় হয়ে থাকবেন।