ফেনার রাজ্য
গতদিন যাকে বৃদ্ধ দেখেছি
আজ সে যুবক
যাকে মৃত ভেবে দাফন করা হয়ছিলো
সে হাঁটছে আঙিনায়
পা ছিলো না এমন হতভাগা দৌড়াচ্ছে মাঠে
ধুধু বালিয়াড়ি আজ
সমুদ্রের ফেনায় উচ্ছ্বসিত
মৃত মাছ লাফিয়ে নদীতে স্নান করছে
কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি যে অর্জুন
তার বাণ অনির্দিষ্ট
বারবার দেখা হলেও কখনো মিলন
হয়নি রাধা কৃষ্ণের
অন্ধ কবি তামিরিস তাকিয়ে আছে
আলোর দিকে
লোলচর্ম জুলেখা ধীরে ধীরে
যুবতী হয়ে উঠছে
কিন্তু ঈসাকে এখনো ক্রুশ থেকে নামানো হয়নি
আশ্চর্য প্রয়াণ
এইসব আশ্চর্য প্রয়াণ
আমাদের ভাবিয়েছে—কষ্ট দিয়েছে
একদিন স্মৃতি হবো
আমাদের বৃক্ষগুলো তাকিয়ে দেখবে দুঃখ পাবে
পোষা প্রাণীদের চোখে শোকসভা
কত গান কীর্তি কবিতা
ছবির ভেতরে চিরস্থায়ী হবে
মৃত্যুর পর যারা নক্ষত্র হয়
আর মৃত্যুর আগে যারা
উভয়ের বিচারের ভার সূর্য নিয়েছে
একদিন পৃথিবীতে শুধু আলো থাকে
একদিন শুধু অন্ধকার
কেউ কেউ বীরবাহু
কিভাবে বাঁচতে হয় তারচেয়ে
বেশি জানে কিভাবে মরতে
দীর্ঘ পথ দীর্ঘ দূর
গন্তব্য ক্ষীণ হয়ে আসে
বাঘ বিড়াল অথবা বানর
কোনো জন্মে বাঘ বিড়াল অথবা বানর ছিলাম
আমি জানতাম ক্ষুধা আমার অজাত শত্রু
উজাড় হতে থাকলো বন
আর আমি বেরিয়ে এলাম লোকালয়ে
থাবা হানছি গোশালায়—রেস্তোরাঁয়
নিঃসঙ্গ পথের গলায়
আমাকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে
হ্যান্ডসআপ করানো হলো
আর ঢুকিয়ে দেয়া হলো চিড়িয়াখানার বিশাল খাঁচায়
নিজেকে দেখলাম—হাড়ের মালা
শেকলের প্রবাহে সমস্তটুকু
আরামপ্রদ আসবাব
দুধ আর মাছের ঘাটতি দেখে
বাবা বললেন যাও নিজের পথ দেখো
হাঁটতে হাঁটতে পরিশ্রান্ত পায়ে ঢুকে পড়লাম গেরস্তের হেঁশেলে
বিনয় আর মিউ মিউ ডাক
তাদের কুঁচকে যাওয়া চোখে মায়া ধরালো
মাছের বদলে তারা ছুঁড়ে দিলো
কাঁটাকুটি হাড় উচ্ছিষ্ট আর নিঃসঙ্গ দুধের বাটি
আমার থাবায় মাছিও মরে না
টেবিলে শুয়ে থাকি
ক্ষুধার্ত বইয়ের চিৎকার আমাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে
আমি খাটের নিচে লুকোই
আর ঘুমিয়ে পড়ি শত বছরের নির্জনতায়
আমি ঠিকই চিনতে পেরেছিলাম মানুষ আমার ভাই
দাবি করলাম অর্ধেক সম্পদ
দেয়া হলো রুটি আর কলা
অসম্মত আমাকে বেধে ফেললো শেকলে
চাবুক চালিয়ে শেখানো হলো খেলা
আমার প্রশিক্ষক বানর সেজে
নেচে নেচে পাঠ দিতো—
কাঠি দিয়ে ভাগ্য গণনা
আর লেজ ধরে শশুর বাড়ি
নিশ্চিত হলাম সে আমার ভাই
বিক্রি করতো আমার অনিচ্ছার কসরত
দিন শেষে সন্তপ্ত ক্লান্ত হতভাগ্য
ভাবি—এই একটাই পৃথিবী আমরা সবাই এক
চাঁদ আর সূর্য ভাই-ভাই
স্পোক্সম্যান
যে সব দরোজা নিজেদের খুলে রাখার অধিকার চায় তাদের উল্টো করে ঝুলিয়ে দাও
তাদের সন্তান জানালা আর ভেন্টিলেটর ভাইবোনদের সীমাহীন
রাতজুড়ে জ্বালিয়ে দাও
তাদের স্ত্রী চৌকাঠদের এক কোপে
বিচ্ছিন্ন করো
আর তাদের গৃহপালিতগুলো দাও গিলোটিনে
কিন্তু কারো গোলামী আর দাসত্বকে
স্পর্শ করো না
সমাজপতি আর পোষা কবিরা তাদের
মহিমাকীর্তন করবে
মুহুর্মুহু বিবৃতি দেবে বুদ্ধিজীবীরা
রাষ্ট্র তাদের বিভূষিত করবে তকমায়
দরোজাকে দোষী বলবে আদালত
একজন গলাকাটা দরোজা উন্মুক্ত হতে পারে না
মুণ্ডুহীন পোষা বিড়াল মিউ মিউ ডাকতে অপারগ
বুদ্ধিজীবী আর স্পোক্সম্যানরা পাবে
আমৃত্যু ভাতা বাগানবাড়ি এমনকি
স্বর্গের সার্টিফিকেট
অধিকার চেয়ে আন্দোলন করেছিলো
যে বাড়িঘর-দরোজা-জানালা
তাদের কোনো স্পোক্সম্যান নেই
তারা চিরদিন হাঁটতে থাকবে প্রোমিজ ল্যান্ড ইতিহাসের দিকে
উঠে দাঁড়াতে হবে
আদেশের অপেক্ষা না করে
উঠে দাঁড়াতে হবে
যে আদেশের অপেক্ষা করে
সে পরাধীন
শিরচ্ছেদের পরও
নিজেকে প্রতিফলিত করতে হবে রক্তের ব্যাসার্ধ পর্যন্ত
এমনকি মেঘের পেটের মধ্যে প্রাণভোমরা ধরতে হবে
সমুদ্র ঝাঁট দিলে দেখা মিলবে সুরাসুর
ভাবলে চলবে না তোমার মাথা নেই
বরং আর্গাসের প্রতিটি রেখা তোমার মাথা
প্রতিটি রোমকূপ নাক
প্রতিটি পশম চোখ
শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুগ্রহ থেকে মুক্ত হও
প্রলয়ের পর সময় শুধু একা দাঁড়িয়ে থাকে
ভাবো স্পার্টাকাসের কথা শিরচ্ছেদের পর আজো
সে দাঁড়িয়ে আছে
একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে
ঠিক মতো কিছুই হয় না
বাড়ি থেকে বেরুনোর সময়
দরোজার মুখে কুলুপ আঁটা হয় না
জামার একটা বোতাম সাবানে খাওয়া
প্যান্টের ভেতর থেকে শার্টের বিদ্রোহ
জুতোর ফিতে ক্ষুধার্ত বলে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারে না
চশমার জানালায় মেয়াদোত্তীর্ণ কাচ দ্বিখণ্ডিত
শ্বাসকষ্টে ঘড়ির কাঁটার নিঃশ্বাস নিভে আসছে
সূর্য স্থির বলে কতদিন
প্রিয়জনের সাথে দেখা হয় না
তাই বলে পৃথিবীর কোনো কিছু থেমে নেই
পরাশক্তির ক্ষেপণাস্ত্র
আঘাত হানছে বৃষ্টির ফোঁটায়। ইসরাইল টেনে লম্বা করছে রক্তের রেখা
চিনের মৌমাছিরা সিল্করোডে সাজোয়া যান নিয়ে ছুটে যাচ্ছে
ইউক্রেনের সব গম খেয়ে ফেলছে
রুশট্যাঙ্ক
আমেরিকা জুতোর তলায় রোধ
করে রেখেছে ফ্লয়েডের দৃষ্টি
শুধু আমি সবকিছু ঠিক করে উঠতে
অপারগ
ঘড়িকে ঠিক মতো নাস্তা দিতে পারি না
জুতোর দাঁত মাজতে ব্রাশ কেনা হয় না
এবং চশমার জন্য একটা ছোট্ট ফ্লাট
অপেক্ষা করছি
ভাবছি হয়তো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে
সমীকরণ
দৌঁড়ায় সে
এগোয় না একচুলও
পৌঁছায় না
লাগে না পায়ে ধুলো
পদচিহ্ন থাকে না তার পথে
জিহ্বা বুলায় শূন্যের উপর ক্ষতে
দেখা যায় না পদক্ষেপ
দাগ থাকে না—করে না ভ্রুক্ষেপ
তার আত্মবিসর্জন
রক্তনিমজ্জন
বেগের সূত্রতো স্থাণু
জড়িয়ে ধরে জানু
গোলক ধাঁধাঁর সংখ্যাটা কি আছে
তাকে খুঁজতে সে দৌড়ায়
তাকে ডাকতে সে দৌড়ায়
কিন্তু এগোয় না এক পা ও
সে পৌঁছে না কোত্থাও
তাকে শুষে নিচ্ছে ঘর
সে অন্যতে নির্ভর
সে এগোয় না এক চুলও
আংরাখা সব তুলো
সে হাঁটতে থাকে হাঁটে
ভাবে দৌড়াবে তল্লাটে
সে ছুটতে থাকে ছোটে
চোখে বিশ্বভুবন ফোটে
তার আটকে থাকে পা
সে কোত্থাও যায় না
অকাল বোধন
তিনি দূরে আমি অন্তঃপুরে,
ভালো আছি দুরূহ দুপুরে,
ঘুম নেই কর্ণকুহরে।
ক্ষুধা নেই শঙ্কা অজানা,
লোকে বলে তুমিতো রাজা না;
প্রজা আমি দিচ্ছি খাজানা।
কাকে আমি কর দিই রোজ,
তিনি দেবী জানি তার খোঁজ,
দিতে হয় প্রসাদ ও ভোজ।
তাতে নেই তুষ্টি তাহার,
রোচে নাতো মুখেতে আহার,
সব কিছু অম্ল ও ক্ষার।
তবু করি শত নিবেদন,
যদি তার গলে কিছু মন,
মেনে নেয় অকাল বোধন।
তিনি দূরে সেতুর ওপারে,
চোখ রাখি পথে বারে বারে,
ফিরবেন আলো কি আঁধারে।
ফাঁসির মঞ্চ থেকে
কেনো জানি না আজ বহুদিন পর
কারাকক্ষের অন্তরালে বসে মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে
মা বলতেন জানিসতো—কবিতা লিখে বসত হয় না
আমি লজ্জায় অবনত হয়ে থাকতাম
কিন্তু আজ আমার সময় হয়েছে
আমি সাহসী সন্তানের মতো প্রশ্ন করতে পারি—
মা যারা কবিতা লেখে না
তাদেরও কি ভাত হয়
আমার মা এখন মৃত্যুর দিন গুনছে
আর পূর্বপুরুষেরা শুয়ে আছেন কবরে
জানি না ক্ষুধা তাদের মৃত্যুর কারণ
কি না
আর প্রভুদের বিজ্ঞানতো ক্ষুধায় মানুষের মৃত্যুর কথা স্বীকার করে না
রাত্রির তৃতীয় প্রহরে আমার ফাঁসি
শেষ সংবাদটি জানবার জন্যে
সাথিদের চোখে মুখে বৃষ্টিগর্ভ বায়ুর উদ্বেগ
আমার মৃত্যু তাদের চোখের আকাশে
হয়তো বসিয়ে দিয়েছে অসংখ্য বেদনার শিশির
যা ভালোবাসার রোদে মুক্তোর মতো
ঝিকমিক করে উঠবে
আমি সাথিদের কাছে ঋণী ও কৃতজ্ঞ
আমার যা কিছু কবিতা
সবই তাদের জীবনের সারাংশ
আমি শুধু সাজিয়েছি সত্যের অক্ষয় কালিতে
তাদের ভালোবাসার কথা আমি
মৃত্যুর সামান্য বেদনায় বিস্মৃত হইনি
সারাজীবন ধরে যে ভালোবাসা কেউ
আবিষ্কার করতে পারে না আজ মৃত্যুর
শিয়রে দাঁড়িয়ে তা আমি অনুভব করছি
এখন আমি এগিয়ে যাচ্ছি বধ্যভূমির দিকে
আমার ফাঁসি হবার মাত্র একমিনিট বাকি
এরই মধ্যে আমি পতন প্রবণ এক জাতির জন্য
অগ্নিগর্ভ মৃত্যুর উদাহরণ ছাড়া কি রেখে যাবো
ভস্ম থেকে ফেরা
দুপুর যখন বৃষ্টি পড়ে রোদের,
গাছের পাতা নড়ছে না একচুলও।
কাকের কথা হচ্ছে মনে ক্রোধের,
পায়ের সাথে জ্বলছে পথের ধুলো।
পানির সাথে আসছে নেমে লাভা,
চোখের কাছে বারুদ ভরা বায়ু।
অল্প পথ দূরত্বে দূর জাভা,
ঘামের ভয় অবশ করে স্নায়ু।
সামান্য উত্তাপে কাঁপে ঘর,
ভাবনা আসে বোমার কত তাপ।
যুদ্ধে পোড়া শিশুর কত জ্বর,
মাপবে কিসে প্রকৃত সন্তাপ?
গনগনিয়ে উঠছে ধোঁয়া ধুলো,
নদীর পানি টগবগানো ঘোড়া।
ফিলিস্তিনের ভয়ার্ত চোখগুলো,
দেখছে আগুন সূর্য জোড়া জোড়া।
সিরিয়া আর ইউক্রেনের লোক,
তাওয়ার পরে হচ্ছে রুটি রোজ।
ক্ষেপণাস্ত্র ফেলছে খেয়ে শোক,
মা জানে না ছেলের কোনো খোঁজ।
তাপ বাড়ছে বাংলাদেশে যত,
তারচে বেশি চিনে ও তাইওয়ানে।
বিশ্বজুড়ে ভাই হারানোর ক্ষত—
লক্ষ কোটি বোনেরা শুধু জানে।
মানুষ তবু প্রসব করে আশা,
আসবে দিন শীতল জলধারা।
পূর্ণ প্রাণ ফুটবে ভালোবাসা,
ভষ্ম থেকে ফিরবে ঘরে তারা।