X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভৌতিক সিনেমার মনস্তত্ত্ব ও বিবিধ প্রসঙ্গ

শাখাওয়াৎ নয়ন
২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৩:১৮আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৩:১৮

আমরা ভৌতিক সিনেমা কেন দেখি? কিংবা ভূতের গল্প কেন শুনি? এই প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন রকম হতে পারে, সরাসরি উত্তর দেয়া কঠিন। আচ্ছা! ভূত জিনিসটা কী? অস্তিত্ব নেই কিন্তু প্রাণ আছে, এমন প্রাণীকে ভূত বলে। এটা কী ধরনের সংজ্ঞা? অস্তিত্ব না থাকলে প্রাণ থাকে কীভাবে? কেউ কেউ বলবেন, ‘ভূতের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না, তারপরেও আছে’। কারণ ‘ভূত আছে’ একথা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করে। কিন্তু ভূত কোথায় থাকে? কেউ বলেন, জঙ্গলে,  পরিত্যক্ত প্রাসাদে, বড় কোনো গাছে থাকে। ‘থিংস ফলস এপার্ট’; সেই বন একদিন উজার হয়ে যায়, সব প্রাসাদই ভেঙে পড়ে, বিরাট বৃক্ষ একদিন কেউ কেটে ফেলে। তখন ভূতেরা কোথায় যায়? কোন ভূত কোথায় যায়, তা বলা কঠিন। তবে অনেকেই বলেন ভূতেরা শহর পছন্দ করে না; গ্রাম, অরণ্য তাদের প্রথম পছন্দ। আর সুশিক্ষিত মানুষেরা বলেন, অধিকাংশ ভূত বাস করে মানুষের মনে, বেঁচে থাকে রূপকথায়।      

সবাই কি ভূতের গল্প পছন্দ করে? না, তা করে না। যারা পছন্দ করে, কেন করে? ভূতের গল্পের চরিত্ররা তো আমাদের মনে বিভিন্ন রকম ভীতি এবং উদ্বেগ তৈরি করে। ভয় এবং উদ্বেগের মাত্রা এবং পরিমাণ যত বেশি হয় ভূতের গল্প তত বেশি হিট। অনেক দর্শককে বলতে শুনেছি, ‘সিনেমাটি অতটা ইন্টারেস্টিং না, কারণ খুব একটা ভয় লাগেনি’। এর মানে কি এই দর্শকরা আরো ভয় পেতে চেয়েছিলেন? কিন্তু ভয়ের পরিমাণ এবং মাত্রা কম হওয়ায় তারা সন্তুষ্ট নন।  

ভয়ের মাত্রা আবার বয়স, লিঙ্গ, সময়, স্থান ভেদে ভিন্ন হয়। একজন শিশু-কিশোর যা দেখে ভয় পায়, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ তা দেখে ভয় পায় না। একজন নারী যা দেখে সাধারণত ভয় পায়, একজন পুরুষ তা দেখে ভয় না। ভূতের গল্পের/সিনেমার লগ্ন আছে। গভীর রাতে ভূতের সিনেমার দাপট বেশি। কারণ রাত এবং অন্ধকারের সাথে ভূতের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। রাতের বেলা দড়িকেও সাপ মনে হয়। তাই ভূতের সিনেমা রাতে দেখাই উত্তম। তবে সাধারণত কোনো ভীত মানুষ ভূতের ছবি দেখতে চান না; বরং শান্তিপূর্ণ সমাজের সুস্থ স্বাভাবিক মানুষেরা ভূতের ছবি বেশি দেখে।   

আধুনিক সিনেমার অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তারপরেও সিনেমা থেকে আমরা সরাসরি গন্ধ, ওজন, শারীরিক ব্যথা ধরনের অনুভূতি লাভ করতে পারি না। শুধু দেখা এবং শব্দ শোনা এই দুটি অনুভূতি সরাসরি পাই। থ্রি ডি মুভিতে কিছু নড়াচড়া করানো হয়, তাতে এক ধরনের অনুভূতি পাই বটে। তবে তা আবার অধিক এক্সপোজারে মাত্রা হারায়। স্থির চিত্র এবং ভিডিও চিত্র দেখে আমরা অনেক কিছু কল্পনা করতে পারি। কিন্তু তারপরেও আমাদের আবেগ এবং ইন্দ্রিয়গুলিকে আরো বেশি অ্যাঙ্গেজড এবং ইনভল্ভ করার জন্য পটভূমি প্রয়োজন। সেই পটভূমি তৈরিতে শব্দ, আলো এবং রং শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। কারণ শব্দের মাধ্যমে আমাদের কল্পনা শক্তি আরো প্রবল হয়। হাসির শব্দ, গানের শব্দ, চিৎকার কিংবা শীৎকারের শব্দে আমাদেরকে আরো বেশি আন্দোলিত করে। সাদা-কালো ছবিতে রং লেগে রঙিন হয়ে গেল, সেই ছবির সাথে ডলবি ডিজিটাল শব্দ এবং আলোক প্রক্ষেপণে হয়ে গেল বাস্তবের চেয়ে বাস্তব। ভূতের সিনেমার অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে- শব্দ, আলো এবং রং। এগুলো ছাড়া আর যা কিছু বানানো সম্ভব, ভূতের সিনেমা কিংবা অ্যাকশন সিনেমা বানানো যাবে না।     

কিন্তু আমরা কেন সময়, শ্রম এবং টাকা খরচ করে ভয় পেতে চাই? কিংবা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় পড়তে চাই? কারণ আমরা অস্বস্তিকর নেতিবাচক আবেগ উৎকণ্ঠা উপভোগ করি। সেটা আবার কী রকম?      

অ্যাকশন সিনেমার কথাই ধরুন, মারামারি কাটাকাটি ধরনের সিনেমায় কী ভয়াবহ রক্তপাত দেখানো হয়! মানুষ মানুষকে খুন, জখম কিংবা ধর্ষণ করে। কোটি কোটি মানুষ সেই সিনেমা দেখে। কেন দেখে? কারণ এখানেও আমরা অস্বস্তিকর নেতিবাচক আবেগ উৎকণ্ঠাই উপভোগ করি। অথবা যারা এসব অপরাধ করে তাদের পরাজয় দেখতে চাই। বেশিরভাগ অ্যাকশন সিনেমায় নায়কের জয় হয়। কিন্তু আজকাল কিছু কিছু অ্যাকশন ছবিতে নায়ক এবং ভিলেইন কারোই জয় পরাজয় হয় না। তাহলে আমার প্রথম যুক্তিটিই সঠিক- আমরা মারামারি কাটাকাটি, খুনাখুনি, রক্তপাত দেখতে পছন্দ করি।     

রোমান্টিক সিনেমায় নায়ক-নায়িকারা প্রকাশ্যে একদল বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গান গায় এবং নাচে। বাস্তবে কোথাও কাউকে এভাবে নাচতে কিংবা গাইতে দেখেছেন? না, দেখা যায় না। তাহলে সিনেমায় এসব দেখানো হয় কেন? মানুষ নিজে যা করতে পারে না, কিন্তু তার মনে আকাঙ্ক্ষা আছে। এমন কিছু দেখতে পছন্দ করে। পর্নোগ্রাফির মনস্তত্ত্বও তাই। মানব মনের অসীম আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করা যায়- কারো প্রতি রাগান্বিত হয়ে ‘মনে মনে তাকে লাথি মারার কল্পনা করলে’ একইরকম অনুভূতি হয় না, কিংবা সিনেমায় ‘নায়ক কাউকে লাথি মারছে’ দেখলেও একই অনুভূতি হয় না। কিন্তু রাগের মাথায় গেলাস ভাঙলে রাগের তীব্রতা কিছুটা হালকা হয়; কিংবা গাড়ি চালানোর সময় রাস্তায় অন্য ড্রাইভাররা  ডিস্টার্ব করলে F*ck You বলায় অথবা মিডল ফিঙ্গার দেখানোতে একটা নেতিবাচক মজা পাওয়া যায়।   

ট্র্যাজেডি গল্প, উপন্যাস, সিনেমায় শেষ পর্যন্ত কী দেখানো হয়? একটা বিরাট দীর্ঘশ্বাসমূলক সমাপ্তি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ উপন্যাসে দেবু গরুর গাড়িতে চড়ে পার্বতীর বাড়ির সামনে গিয়ে মরে। এই উপন্যাস পড়ে কাহিনি জানার পরেও আমরা দেবদাস সিনেমা দেখতে গিয়েছি। কারণ ঘটনাটি আমরা শুধু পড়েই ক্ষ্যান্ত হই না, সিনেমার পর্দায় দেখে আরো ইন্টেনসিভলি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং দুঃখ উপভোগ করতে চাই। আসলে নীরব বিষণ্নতা উপভোগ করার জন্য বিরহের গান, ট্র্যাজিক উপন্যাস, মুভি দেখে অনেকেই কাঁদতে পছন্দ করে। 

এই যে নেতিবাচক আবেগ উপভোগের কথা বললাম; এটা কি সর্বাংশে ঠিক? আমরা যদি এতই অ্যাকশন কিংবা ফাইটিং দেখতে পছন্দ করি, তাহলে প্যালেস্টাইন কিংবা ইউক্রেন যাচ্ছি না কেন? সেখানে তো সত্যিকারে যুদ্ধ চলছে, খুন, ধর্ষণ সবই হচ্ছে। বিমান থেকে বোমা ফেলছে, কামান থেকে গোলা মারছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ মরছে, রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে বহুতল ভবন, স্কুল, হাসপাতাল ধসে পড়ছে। 

কারণ আমরা আসলে সত্যি সত্যি ভীতিকর কোনো কিছু দেখতে পছন্দ করি না। ছোটবেলায় পুতুলখেলার মতো মিথ্যে মিথ্যে রান্না-বান্না, মিথ্যে মিথ্যে খাওয়া দাওয়ার মতো ভৌতিক সিনেমা দেখে মিথ্যে মিথ্যে ভয় পেতে পছন্দ করি। নিরাপদ জায়গায় বসে কোক এবং পপকর্ন খেতে খেতে হঠাৎ প্রিয়জনকে একটু জাপটে ধরতে ভালোবাসি। এসব বানোয়াট, কাল্পনিক চরিত্র এবং তাদের কর্মকাণ্ড দেখে অল্প সময়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় ভয় পেতে পছন্দ করি। 

আধুনিককালে ভূতের গল্পে কোনো কোনো সাইকোপ্যাথদের মধ্যে এক ধরনের অতি প্রাকৃত শক্তি অথবা ক্ষমতা দেখানো হয়। এটা সত্যিই অন্যরকম এবং ইন্টারেস্টিং। হরর মুভির শুরুতে যে দানব/সাইকোপ্যাথকে অসীম শক্তিধর মনে হতে থাকে; যে সবাইকে মেরে কেটে নাস্তানাবুদ করে ফেলে; যার হাত থেকে নায়ক/নায়িকা বার বার মরতে মরতে বেঁচে যায়।  এসব দেখতে দেখতে আমরা ভুলেই যাই যে, সকল দানবেরই একটা দুর্বল পয়েন্ট আছে। সিনেমার শেষের দিকে সেই দানব/সাইকোপ্যাথের দুর্বল পয়েন্টটা নায়ক অথবা নায়িকা খুঁজে পায় এবং জয় লাভ করে। এই বানোয়াট ভয় এবং উদ্বেগ তৈরি করে একটা চরম ক্লাইম্যাক্সে নিয়ে গিয়ে দানবের পরাজয়ের মাধ্যমে দর্শকদের আবার বাস্তব জগতে ফিরিয়ে আনা হয়। এটাই হরর মুভির ফর্মুলা, সংক্ষিপ্ত বয়ান।    

আমি যে নেতিবাচক আবেগ উপভোগের কথা এত করে বলছি, এটা কি শুধু সিনেমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? মোটেই তা নয়। সিনেমা তো অনেক নিরাপদভাবে ভয়ের অনুভূতির উদ্রেক করে এবং শেষে ভয়মুক্তির ব্যবস্থা করে। বাস্তবে প্রায় একই কারণে অনেকে অনেক ধরনের বিপদজ্জনক কর্মকাণ্ড করে। সেগুলি কী?   

পর্বত আরোহীদের কথা ভাবুন। তারা জানে পর্বত আরোহনে কত বড় বিপদের ঝুঁকি! তুষার ঝড়সহ কত অজানা বিপদ, মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে তারা দিনের পরদিন ধরে মাউন্ট এভারেস্টে ওঠে। কেউ কেউ কার-রেইসিং, স্কাইডাইভিং করছে। কিন্তু কেন? কারণ তারা নিজেকে বিপদজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলে ভয়ের রোমাঞ্চ উপভোগ করে। এই ধরনের সত্যিকারের ভয় এবং তা অতিক্রম করার জয়, তাদেরকে একটা তীব্রতম বীরত্বের অনুভূতি দেয়, যা দৈনন্দিন জীবনে পাওয়া অসম্ভব। যারা কোকেন, হেরোইন, এলএসডি’র মতো ড্রাগ নেয়, তাদের মনস্তত্ত্বও প্রায় একই। তারাও এক ধরনের শীর্ষ অনুভূতি পেতে চায়। কিছু কিছু লোকেরা রাগ করার জন্য উপযুক্ত উপলক্ষ্য এবং পরিবেশ খোঁজে; তারা অনেক লোকের মাঝে রাগ করতে বেশি পছন্দ করে। তাই বিয়ে বাড়িতে গিয়ে বিরাট হট্টগোল বাঁধিয়ে দেয়।   

বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ভীতি এবং উদ্বেগের ব্যবহার আছে। আমাদের অক্ষম স্নায়ুগুলিকে পুনরায় সক্রিয় করতে অনেক সময় ভয়-ভীতিকে কাজে লাগানো হয়। যেমন ধরুন স্নেক ম্যাসাজ থেরাপি। ইসরাইলে এই ম্যাসাজ থেরাপি বেশ জনপ্রিয়। রোগীকে পুরোপুরি নগ্ন করে শুইয়ে তার গায়ে বিষধর সাপ ছেড়ে দেয়। রোগী ভয়ে অস্থির হয়ে যায়। সেই সাপ তার শরীরের যে-সব জায়গা স্পর্শ করে সেসব জায়গার স্নায়ুগুলি স্পার্ক করতে থাকে। মানে নার্ভাস সিস্টেমে উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করে, ব্রেইনে সিগন্যাল পাঠায়। একইভাবে যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলা মানুষের যৌন অনুভূতি ফিরিয়ে আনতেও অন্য কোনোভাবে নার্ভ সিস্টেমকে উদ্দীপ্ত করা হয়। ভূতের সিনেমা দেখেও অনেকের অনেক ধরনের অনুভূতি ফিরে পেতে পারে।  

এবার একবার ভাবুন তো ভয়-ভীতি, আবেগ-উৎকণ্ঠা এসব আমরা কোথায় পেলাম? জন্মগতভাবে তো আমরা এসব নিয়ে আসিনি। বাবা-মায়েরা দিনের পরদিন শিশুদের ভয়ংকর রাক্ষস কিংবা ভূতের গল্প বলেন, অতঃপর…

জেড-এস
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পাচার হওয়া বোনকে নিতে এসে কলকাতায় অসহায় দশায় চট্টগ্রামের তরুণ
পাচার হওয়া বোনকে নিতে এসে কলকাতায় অসহায় দশায় চট্টগ্রামের তরুণ
কৃষিজমিতে কাজ করতে গিয়ে ঘুরে পড়ে আ.লীগ নেতার মৃত্যু
কৃষিজমিতে কাজ করতে গিয়ে ঘুরে পড়ে আ.লীগ নেতার মৃত্যু
মাঠে ফিরেই হাল্যান্ডের গোলে জিতলো ম্যানসিটি
মাঠে ফিরেই হাল্যান্ডের গোলে জিতলো ম্যানসিটি
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক