X
সোমবার, ১৭ জুন ২০২৪
৩ আষাঢ় ১৪৩১

রণজিৎ গুহ : ইতিহাসের ‘ঝোড়ো হাওয়া’

সারোয়ার তুষার
২৩ মে ২০২৪, ০০:০১আপডেট : ২৫ মে ২০২৪, ১১:১৫

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহর জন্ম তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বাকেরগঞ্জের সিদ্ধকাটি গ্রামে (বাকেরগঞ্জ উপজেলা বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় এবং সিদ্ধকাটি গ্রাম বর্তমান বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলার অন্তর্গত), ১৯২৩ সালের ২৩ মে। তিনি এমন একজন ভারতীয় ইতিহাসবিদ যাঁর কাজের প্রভাব বিশ্বজুড়ে নানা শাস্ত্রে বহুল স্বীকৃত। ভারত এবং আরও বিস্তৃত পরিসরে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস রচনা ও চর্চার এমন এক পদ্ধতি তিনি শুরু করেছিলেন, যা বিদ্যাজগত ও ক্রিটিক্যাল রাজনৈতিক অঙ্গনে বিপুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ-ইতিহাস চর্চার গণ্ডি ছাড়িয়ে গুহ সূচিত সাবলটার্ন স্টাডিজ নিয়ে আলোচনা এখন বিশ্বের প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক ইতিহাস-রচনার ক্ষেত্রেই শুনতে পাওয়া যায়। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঐতিহাসিক-সমাজবিজ্ঞানীরা অনেকেই স্বতন্ত্রভাবে তাঁদের নিজস্ব ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ গোষ্ঠী তৈরি করেছেন।

গত শতাব্দীর আশির দশকে সেই সময়ের বিচারে নিতান্তই অপরিচিত ও তরুণ গবেষকদের নিয়ে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ তথা ‘নিম্নবর্গের অধ্যয়ন’ নামে যে প্রকল্প তিনি শুরু করেছিলেন, বিশ্বজুড়ে আজ তা সমাদৃত এবং আলোচনা–সমালোচনা–বিতর্ক মিলিয়ে ইতিহাস পঠন-পাঠনের প্রতিষ্ঠিত এক পদ্ধতি। ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহকে আলোচিত নিম্নবর্গের ইতিহাস অধ্যয়ন তথা সাবলটার্ন স্টাডিজ গ্রুপের ‘গুরু’ হিসেবে মান্য করেন খোদ এই গ্রুপে তাঁর সহ–ইতিহাসবিদেরা। সাবলটার্ন স্টাডিজ গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে অনেকেরই লেখাপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় সাবলটার্ন স্টাডিজের কালেক্টিভ ভলিউমে।

প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী ইতিহাস ও তাত্ত্বিক ঘরানার বিরোধিতা করেই সাবলটার্ন স্টাডিজের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চার বিদ্যমান সমস্ত ঘরানাই উচ্চবর্গের প্রতি পক্ষপাতী— শুরুর দিকের এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ছিল এই গ্রুপের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব ও অভিনবত্ব। আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গ এই দুই ধারায় দ্বিধাবিভক্ত এবং এই দুই ধারার মধ্যকার অস্থির-জটিল-বহুমাত্রিক সম্পর্ক বিদ্যমান— সাবলটার্ন স্টাডিজের এই বক্তব্যও আজতক অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে আছে। আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রত্যেক অলিগলি যে নিম্নবর্গের স্বকীয়তা, স্বতন্ত্র চৈতন্য ও নিজস্ব উদ্যোগের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ইতিহাস রচনার উচ্চবর্গীয় ঝোঁক তা কখনো স্বীকার করেনি। কাজেই নিম্নবর্গের দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনা করার গুরুদায়িত্ব ইতিহাসবিদদের নিতে হবে— রণজিৎ গুহ যেন সেই অনিবার্য সত্যই মনে করিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য সাবলটার্ন স্টাডিজ তিন দশক ধরে গ্রুপ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার গোটা সময়জুড়ে নানা বাঁকবদল ও নতুন নতুন প্রকল্প হাজির করেছে। নিম্নবর্গের চৈতন্য ও স্বকীয়তার সুলুকসন্ধান থেকে শুরু হলেও এক পর্যায়ে উচ্চবর্গের রাজনীতিতে কীভাবে নিম্নবর্গের উপস্থাপন ও নির্মাণ হয়ে থাকে সেইদিকে এই গ্রুপকে অধিক মনোযোগ দিতে দেখা যায়।

রণজিৎ গুহ সম্পর্কে সার্বিক কোনো মূল্যায়ন হাজির করার ফুরসত বর্তমান নিবন্ধে মিলবে না। তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ “On Some Aspects of the Historiography of Colonial India”-কে কেন্দ্র করে গুহর ভাবজগত সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করার চেষ্টা করব। এই প্রবন্ধটিকে গুহর অন্যতম সিগনেচার প্রবন্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এই প্রবন্ধেই গুহ সর্বপ্রথম উচ্চবর্গের ইতিহাস-রচনার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এবং নিম্নবর্গের ইতিহাস-রচনার পদ্ধতির শিথিল রূপরেখা হাজির করেছেন। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে, সাবলটার্ন স্টাডিজ কালেক্টিভ ভলিউমের প্রথম খণ্ডে। নাতিদীর্ঘ এই রচনাটিকে পরবর্তীকালে অনেকেই নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার ‘মেনিফেস্টো’ তথা ‘ইশতেহার’ হিসেবে অভিহিত করেন। অন্তত দুটি কারণে এই প্রবন্ধ ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। একটির কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আধুনিক ভারতের জাতীয়তাবাদ যে মূলত দুটি বিবদমান— ঔপনিবেশিক ও বুর্জোয়া-জাতীয়তাবাদী— উচ্চবর্গীয় গোষ্ঠীর ঝগড়া এই অমোঘ সত্য উচ্চারণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে গুহর প্রবন্ধ। এ প্রসঙ্গে রণজিৎ গুহর অন্যতম শিষ্য এবং প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। সাবলটার্ন স্টাডিজের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন—

“স্মরণ করা যেতে পারে, ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে দুটি বিবদমান গোষ্ঠীর ঝগড়া এই সময়ে তুঙ্গে। একদিকে কিছু ব্রিটিশ ও মার্কিন ঐতিহাসিক দেখাবার চেষ্টা করছিলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চবর্গের নীতিহীন আদর্শহীন ক্ষমতা দখলের কৌশল মাত্র। চিরাচরিত জাতি-ধর্ম-সাম্প্রদায়িক আনুগত্যের বন্ধনকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সেখানে শুধু ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা এর তুমুল প্রতিবাদ করে বলেছিলেন জাতীয়তাবাদী আদর্শের কথা, জাতীয়তাবাদী নেতাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কথা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ব্যাপক জনসাধারণের অংশগ্রহণের কথা। রণজিৎ গুহ-র প্রবন্ধে ঘোষণা করা হলো, এই দুটি ইতিহাস আসলে উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত, কারণ দুটি ইতিহাসই ধরে নিয়েছে যে জাতীয়তাবাদ হলো উচ্চবর্গের ক্রিয়াকলাপের ফসল। বিবাদ শুধু সেই ক্রিয়াকলাপের নৈতিক চরিত্র নিয়ে— তা সংকীর্ণ ব্যক্তি বা শ্রেণিস্বার্থের সাময়িক যোগফল, নাকি আদর্শ আর স্বার্থত্যাগের জাদুকাঠির স্পর্শে ব্যাপক জনসাধারণের চেতনার উন্মেষ। এই দুটি ইতিহাসের কোনোটাতেই জনগণের নিজস্ব রাজনীতির কোনো স্থান নেই।”

সুতরাং, সাম্রাজ্যবাদী আর জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বিরোধিতার পথ ধরেই যে রণজিৎ গুহ তাঁর নেতৃত্বাধীন গ্রুপের ইতিহাস প্রকল্পের প্রথম কর্মসূচি নির্দিষ্ট করবেন এতে আশ্চর্যের কিছু ছিল না। পরবর্তীকালে গুহ বলেছেন, সেই সময়ে তাঁর প্রধান নিশানা ছিল দক্ষিণ এশিয় ইতিহাসের উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা : “The critique of elitism in South Asian historiography was central to my concern at the time.”

উচ্চবর্গীয় ইতিহাস-রচনা পদ্ধতির সমালোচনা, বিরোধিতা ও পর্যালোচনা কেন জরুরি? কারণ দক্ষিণ এশিয়াসহ অপরাপর উপনিবেশিত অঞ্চলের নিজস্ব ইতিহাসকে আত্মসাৎ করা ব্যতীত ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা রীতিমতো অসম্ভব ছিল। কাজেই, গুহর উল্লিখিত প্রবন্ধের দ্বিতীয় তাৎপর্য এই যে, দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহাসিক ও গবেষকদের তিনি দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব ইতিহাস-রচনায় হাত লাগাতে আহ্বান জানাচ্ছেন, সেই ইতিহাস নিশ্চিতভাবেই ব্যাপক সংখ্যক জনগণকে বিবেচনায় নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে তাদের অবদান ও ভূমিকাকে প্রাপ্য সম্মান বুঝিয়ে দেবে।

বিখ্যাত দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন একদা বলেছিলেন “to brush history against the grain” তথা ইতিহাসের তুলিকে প্রতিষ্ঠিত প্রভাবশালী স্রোতের বিপরীতে টানা জনগণের পক্ষের ইতিহাসবিদের ওপর অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব। সচেতন পাঠক মাত্রই আলোচ্য প্রবন্ধসহ রণজিৎ গুহর তামাম ইতিহাস-প্রকল্পে বেঞ্জামিনের সেই অমোঘ বাণীরই প্রতিধ্বনি টের পাবেন।

সাবলটার্ন স্টাডিজের ইতিহাস প্রকল্পে নানা বাঁকবদল লক্ষ করা যায়। তার মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আদিকল্পগত পরিবর্তন সংঘটিত হয় গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বিখ্যাত প্রবন্ধ “Can the Subaltern speak?” প্রকাশিত হওয়ার পর। স্পিভাক সাবলটার্ন স্টাডিজের বেশ কিছু অনুমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তী, জ্ঞান প্রকাশসহ প্রায় সকল সাবলটার্ন ইতিহাসবিদ স্বীকার করেন যে স্পিভাকের অভিঘাতের আগের সাবলটার্ন স্টাডিজ আর পরের সাবলটার্ন স্টাডিজ আর একই রকম থাকেনি। “ক্যান দ্যা সাবলটার্ন স্পিক?” প্রবন্ধটি লেখার আগেই গায়ত্রী স্পিভাক পশ্চিমের বিদ্যাজগতে রীতিমতো প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায় তিনি ততদিনে ‘ইউরোপিয়ানিস্ট’ তথা ইউরোপ-বিশারদ। ফরাসি দার্শনিক দেরিদার ‘Of Grammatology’ ইংরেজিতে অনুবাদ করে গোটা বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সেই সময়ে, অর্থাৎ সত্তর দশকের শেষের দিকে এবং আশির দশকের শুরুর দিকে, ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রণজিৎ গুহ বাংলা ও দিল্লি অঞ্চলের কতিপয় তরুণ ইতিহাস গবেষকদের সাথে তাঁর আসন্ন ইতিহাস প্রকল্পের ছক কষছেন; আর অন্যদিকে, ‘ইউরোপিয়ানিস্ট’ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর নিজের অঞ্চল, নিজের মানুষ, নিজের শ্রেণি, যেখান থেকে তিনি উঠে এসেছেন, সেই মানুষদের কাছে ফিরতে চাইছিলেন। আমাদের দাবি, এই দুই ঘটনার প্রতিচ্ছেদেই “ক্যান দ্যা সাবলটার্ন স্পিক?” নামক কালজয়ী প্রবন্ধের জন্ম। প্রাথমিক পর্যায়ে ফুকো-দেল্যুজদের মতো প্রভাবশালী পশ্চিমা দার্শনিকদের সাথে নিজের দ্বিমত বিধৃত করার পরিকল্পনা থেকে রচিত “Power and Desire” (১৯৮৩) নামে প্রবন্ধটি যে পরবর্তীতে “ক্যান দ্যা সাবলটার্ন স্পিক?” শিরোনামে প্রকাশিত হলো তার একটি বড় কারণ রণজিৎ গুহর বর্তমান প্রবন্ধটি। স্পিভাকের জবানে:

“I mention this because when I gave “Power and Desire”, the first version of “Can the subaltern speak?” I had read Gramsci’s “Some Aspects of the Southern Question,” but I read Ranajit Guha’s “On Some Aspects of the Historiography of Colonial India”, only a year later. When I read Guha’s essay I was so overwhelmed by the work of the Subaltern Studies group, which he headed, that I pulled my piece, I pulled my act of private piety, that I had performed to get myself out of the prison house of just being a mere Europeanist, and pushed it into the subaltern enclave. I recoded the story. I learned to say that “the subaltern is in the space of difference,” following a wonderful passage in Guha.”

অর্থাৎ, স্পিভাকের বিখ্যাত প্রবন্ধটি সাবলটার্ন স্টাডিজের আদিকল্পগত বাঁকবদলে প্রভাব রেখেছে এ কথা যেমন সত্যি; পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, গুহর প্রবন্ধ পাঠের পরে খোদ স্পিভাক তাঁর গল্পটি আর আগের মতো রাখতে পারেননি। তাঁকে ‘রিকোড’ করতে হয়েছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, সাবলটার্নিটি তথা নিম্নবর্গত্ব ধারণাটি গুহ এবং স্পিভাকে দুই ধরনের নির্মাণের মধ্য দিয়ে গেছে। এই পরিসরে সেই আলোচনার সুযোগ নেই।

সাবলটার্ন স্টাডিজের ‘মেনিফেস্টো’-এর খেতাবপ্রাপ্ত আমাদের আলোচ্য প্রবন্ধে রণজিৎ গুহর কহতব্য কী? যারা জনগণের পক্ষের রাজনীতি, বুদ্ধিজীবীতা ও ইতিহাসচর্চা করবেন, রণজিৎ গুহ মূলত তাঁদের জন্য এই প্রবন্ধে বেশ কিছু অন্তর্ভেদী দিকনির্দেশনা হাজির করেছেন। ঔপনিবেশিক ভারতীয় রাষ্ট্র এবং ঔপনিবেশিকতার ভাব-স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যযুক্ত বর্তমান উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্রগুলো সম্পর্কে সম্যক বোঝাপড়া গড়ে তুলতে বেশ কিছু সূত্র এই প্রবন্ধ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। তবে নিম্নবর্গ তথা জনগণের রাজনৈতিক চৈতন্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে-যে কোনো চূড়ান্ত কথা বলা যায় না রণজিৎ গুহ অবশ্যই সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। এ কারণেই তিনি কোনো অলঙ্ঘনীয় ‘ফতোয়া’ বা ফর্দ পেশ করেননি। পরিস্থিতি মোতাবেক-যে নানা কিছুই বদলাতে পারে এবং সংশ্লিষ্টদের যে সে অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করতে হতে পারে, এ ব্যাপারে গুহ নিঃসংশয় ছিলেন। তথাপি, এই প্রবন্ধের গুরুত্ব এই যে, ঔপনিবেশিকতা সৃষ্ট আধুনিক ভারতীয় রাজনীতি ও ইতিহাসের প্রধান প্রধান প্রবণতা সম্পর্কে এখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা আছে। যেমন ঔপনিবেশিক ও নব্য-ঔপনিবেশিক সমাজে যে নিছক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বলে কিছু নেই, সব সম্পর্কই যে আদতে ক্ষমতাসম্পর্ক এবং আরও বিশদভাবে বললে এমনকি অর্থনীতির অন্তর্গত সম্পর্কও যে রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, মার্কসবাদী ঝোঁক থাকার পরেও গুহ সে সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। বর্তমান সময়ে যারা জনগণের পক্ষের রাজনীতি ও ইতিহাস-রচনা করবেন, তাদের জন্য এই প্রবন্ধের নানান দূরদৃষ্টি, প্রস্তাব ও পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে কাজে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। ‘জনগণ’ সম্পর্কে কোনো অহেতুক ভাবালুতা কিংবা বর্ণবাদী ঘৃণা দুই-ই এড়াতে গেলে ‘জনগণ’ ধারণাটির নিবিড় বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ‘জনগণ’ কোনো যথাপ্রদত্ত (given) মানুষের দলা নয়; বাস্তব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক রাজনীতিকে তার উপযোগী ‘জনগণ’ বানিয়ে নিতে হয়। জনগণের বিপুল অংশকে তাদের হক সমেত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জায়গা করে দেয় এমন কোনো গণতন্ত্র কায়েম করতে গেলে; জনগণের চৈতন্য, তাদের ধর্মভাব, প্রতিরোধী মনন এবং নানা পারস্পরিক টানাপড়েন, বৈপরীত্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকার কোনো বিকল্প নাই। গুহর বর্তমান প্রবন্ধটি এই অর্থে, গণক্ষমতা কায়েমের লক্ষ্যে জরুরি তাত্ত্বিকতা, তথ্য, পদ্ধতি ও কৌশলের চাহিদা মেটায়।

ইতিহাসবিদদের গোষ্ঠী হিসেবে সাবলটার্ন স্টাডিজ আজ আর ক্রিয়াশীল নাই। তবে ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক’ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও ইতিহাস প্রসঙ্গে এ গোষ্ঠীর উত্থাপিত প্রশ্নসমূহ আজও প্রাসঙ্গিক। প্রশ্নগুলোর উত্তর তারা যেভাবে ভেবেছিলেন, সেভাবে হয়ত আজ আর ভাবা হয় না; তবে, এ কথা নিঃসন্দেহে ঠিক যে, উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর গুরুত্ব আজও বর্তমান। বিশেষত যেকোনো প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাতন্ত্রকে প্রশ্ন ও সমালোচনা করার যে পদ্ধতি সাবলটার্ন স্টাডিজ চারিয়ে দিয়েছিল, তার তাৎপর্য বিপুল।

অমর্ত্য সেন ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহকে বিশ শতকের অন্যতম সৃজনশীল ভারতীয় ইতিহাসবিদ সাব্যস্ত করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদদের মধ্যে গুহ-ই সম্ভবত প্রথম ইতিহাসবিদ যিনি আধুনিক ইতিহাস শাস্ত্রের গোড়ার অনুমানগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈশ্বিক মনোযোগ ও খ্যাতি অর্জন করেছেন। আশির দশকে সজীব চিন্তার কিছু তরুণকে নিয়ে তিনি তাঁর ‘ইতিহাস কারখানা’ খুলেছিলেন। আশির দশকের সেই তরুণেরা প্রত্যেকেই বর্তমানে বৈশ্বিক বিদ্যায়তনিক পরিসরে বিপুল প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। দীপেশ চক্রবর্তী, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, শাহিদ আমিন, জ্ঞান প্রকাশ প্রমুখ দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, তামাম দুনিয়াতেই বহুলভাবে পঠিত ও চর্চিত।

২০২৩ সালের ২৮ এপ্রিল ভিয়েনায় অবস্থান কালে রণজিৎ গুহ মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের শেষদিকে এসে তিনি ইতিহাস লেখা বাদ দিয়ে বাংলা ভাষায় সাহিত্য সম্পর্কে লেখালেখি শুরু করেন। ২০০২ সালে প্রকাশিত হিস্ট্রি অ্যাট দি লিমিট অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি গুহ প্রকাশিত সর্বশেষ ইংরেজি বই।

শেষজীবনের লেখালেখিতে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তিনি বেশ কিছু অন্তর্ভেদী পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। মানবজীবনের ঐতিহাসিকতা বুঝতে হলে প্রথাগত ইতিহাস কেবল নয়, সাহিত্যের ‘সত্য’ অনুধাবন করতে হবে— এই ছিল গুহর শেষ জীবনের উপলব্ধি।

ইতিহাসবিদ হিসেবে গুহর বৈশ্বিক আবির্ভাব বেশ কিছুটা বিলম্বে ঘটেছে; আবার, তিনি আনুষ্ঠানিক ‘অবসর’ও নিয়েছেন বেশ কতকটা আগেই। মাঝখানে তিনি যেন এক সংক্ষিপ্ত ও ঝোড়ো ইনিংস খেলে গেলেন, যার প্রভাব ও সুফল বৈশ্বিক ক্রিটিক্যাল বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর অনেককাল ভোগ করবে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
২৪ বছরের আক্ষেপ নিয়ে ইউরো মিশনে ফ্রান্স
২৪ বছরের আক্ষেপ নিয়ে ইউরো মিশনে ফ্রান্স
ফিলিস্তিনসহ দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান রাষ্ট্রপতির
ফিলিস্তিনসহ দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান রাষ্ট্রপতির
প্রধানমন্ত্রীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন দলের নেতাকর্মীরা
প্রধানমন্ত্রীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন দলের নেতাকর্মীরা
পশ্চিমবঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে মালগাড়ির ধাক্কা, নিহত ৮
পশ্চিমবঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে মালগাড়ির ধাক্কা, নিহত ৮
সর্বাধিক পঠিত
পারমাণবিক কর্মসূচি বৃদ্ধি নিয়ে জি-৭ এর বিবৃতির জবাবে যা বললো ইরান
পারমাণবিক কর্মসূচি বৃদ্ধি নিয়ে জি-৭ এর বিবৃতির জবাবে যা বললো ইরান
গাজায় কৌশলগত বিরতি ঘোষণা ইসরায়েলের
গাজায় কৌশলগত বিরতি ঘোষণা ইসরায়েলের
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: শান্তি সম্মেলন শেষে চূড়ান্ত ঘোষণায় যা বললো সুইজারল্যান্ড
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: শান্তি সম্মেলন শেষে চূড়ান্ত ঘোষণায় যা বললো সুইজারল্যান্ড
ছাগলেই স্বস্তি!
ছাগলেই স্বস্তি!
নেপালকে হারিয়ে সুপার এইটে বাংলাদেশ
নেপালকে হারিয়ে সুপার এইটে বাংলাদেশ