X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১
‘নতুন দুয়ারে করাঘাত’

তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প

.
২৭ জুন ২০১৬, ১৫:৫৫আপডেট : ৩০ জুন ২০১৬, ১৭:৫৮

তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প

নতুন দুয়ারে করাঘাতে তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প একসঙ্গে প্রকাশ করা হলো। যেকোনো গল্প পড়তে নামের উপর ক্লিক করুন। আমি নই, পলাশ ভাই গল্প লিখেছেন...ফাতেমা আবেদীনঅপেক্ষা ছিল, তাই বলে একটা বেবি ট্রেন! : শারমিনুর নাহার; বাকিটুকু প্রেমের সবটুকু জানা নেই : সৌম্য সরকারসেতু আমার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীহামিম কামালসফেদা বাগানের গাভিমোস্তাফিজ কারিগরজেনারেল ও খাঁচা বিষয়ক জটিলতামিলন আশরাফস্বপ্নমৃত্যু : ইসলাম আমিনুলসেই জোয়ারের লজ্জা নেই : মেহেদী শামীম। 


 


তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প আমি তো রীতিমতো আঁতকে উঠছি এসব কথা শুনে। তাদের হাতে কী ক্ষমতা। সারাদেশবাসী যা শুনবে যা দেখবে সেই তথ্য নিয়ে সাংবাদিকদের কী ছেলেখেলা। আর কী অবলীলায় মৃত্যুর কথা বলে যাচ্ছে। এতো হা করে উনাদের কথা শুনছিলাম যে, কখন শ্রাবণী এসে দাঁড়িয়েছে পাশে খেয়ালই করিনি

 

আমি নই, পলাশ ভাই গল্প লিখেছেন...
ফাতেমা আবেদীন
কেতাদূরস্ত নাম ফয়সাল আকবর, ওরফে পলাশ ভাই আমার বন্ধু শ্রাবণীর জামাই। আমার এই সাংবাদিক বান্ধবীর জীবনে কীভাবে একজন রক্ত লাল পলাশ ফুল জুটে গেল সেই গল্পটার কোনও ছিরি ছাঁদ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তারা দুজন একজন আরেকজনকে দেখতে পারতো না। পড়াশোনায় পলাশ ভাই খুব ডেডিকেটেড হলেও আমার বান্ধবীর ছিল লারেলাপ্পা জীবন।
সাংবাদিক হবে বলে কথা। আচার ব্যবহারও ছিল সাংবাদিকের মতো। সব কিছুতেই কি, কেন, কখন, কিভাবে, কোথায় এইসব প্রশ্ন করে তটস্থ রাখত আমাদের। আর পলাশ ভাই ছিলেন সেইরকম সিথাপাটি, মানে অতি গোছানো। আমরা ক্যাম্পাসে তাকে নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা আর হাসাহাসি করতাম ততখানি পড়াশোনা করলেও পিএইচডি হয়ে যেত আমাদের।
আমাদের না হলেও পলাশ ভাইয়ের বেশ কয়েকটি এমএ-বিএ ডিগ্রি হয়েছে। সেগুলো দিয়ে তিনি বেশ করে খাচ্ছেন। শ্রাবণীর সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার পর বেশ একটু সিনিয়র সিনিয়র ভাব ধরেছেন। আমাদের বেশ তুই-তোকারি বলার চেষ্টা করেন। আগে আপনি ছাড়া কথাই বলতেন না। এখন বেশ ভাবধরা লোক হয়েছেন। আর হয়েছেন সংসারী। তিনি সংসারী হবেন, আমরা নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু তার বউ যে লেখক হবে সে বিষয়ে আমরা একটু সন্দিহান ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যাকে অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে বললে কলম খাতা ছিড়ে ভেঙে একাকার করতো সেই শ্রাবণীই কিনা হাল আমলের জনপ্রিয় গল্প লেখক হয়েছে। গল্প নিয়ে আজকে অমুক টক-শো কালকে ওমুক বইমেলায় ছুটছে আদ্যোপান্ত সাংবাদিক মেয়েটা। কী অবলীলায় মনের ভেতরে ঘোরা কথাগুলোকে গল্প করে লিখে ফেলছে। জটিল একটা মেয়ে। আমার বেশ ঈর্ষাই হয় ওকে। অথচ লেখক ছিলাম আমি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অ্যাসাইনমেন্ট থেকে শুরু করে দেয়াল পত্রিকা আর বন্ধুদের প্রেমপত্র লিখতে লিখতে আমি পাস করেছি। সেই আমি কিনা এখন স্কুলে পড়াই। খাতা কাটি। ছাত্রদের খাতায় কমেন্ট লেখাটা এখন আমার সর্বোচ্চ লেখালেখি।
আমার স্বামী অবশ্য একসময় বলতেন আমাকে লিখতে। কিন্তু লেখা হয়ে ওঠে না। সত্যিই বলছি স্কুলে পড়ানোর চাকরিটায় এতো অঢেল সময় থাকা সত্ত্বেও ঘর সংসারের ভেতরে আমি এত বেশি আবদ্ধ হয়ে গেছি যে আমার লিখতে চাইলেও লেখা হয় না। আর সবাই কি রবীন্দ্রনাথ হয় যে, জমিদারি সামলেও লেখালেখি চালিয়ে যাবে। আমি ছুটিগুলো ছুটি বলেই কাটিয়ে দেই। খাই ঘুমাই, বাজার করি, হরেকরকম রান্না করি। মেহমান দাওয়াত দেই। গাদাগাদা শপিং করি। বন্ধুদের বাড়িতে হুটহাট হামলা করি।
গত কালকেই শ্রাবণীর অফিসে আমি হামলা দিয়েছিলাম। বেচারির নাকি রাতে ডিউটি ছিল জরুরি ভিত্তিতে তাকে দুপুরে ডেকে আনা হয়েছে। ওর অফিসের গেস্ট রুমে বসেই শুনলাম দেশে কত কী ঘটে গেছে গত ২৪ ঘণ্টায়। সে সেগুলো সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। কোথায় নাকি ট্রেনের বগীতে লরি ধাক্কা দিয়েছে তাতে ১৮ জনের মৃত্যু। গেস্টরুমের কাচের জানালা দিয়ে সাংবাদিকদের দৌড়ঝাপ দেখতে পাচ্ছি। দরজাটা আধখোলা বলে একটু আধটু কথাও শুনতে পাচ্ছি। ৭ টার খবর শুরু হবে। এই সময়টা টেলিভিশনের সবার নিঃশ্বাস নাকি বন্ধ হয়ে যায়। কিছু বাদ পড়ল কিনা। শেষ মুহূর্তে কি নিউজ আসছে। এখানে যাদের দেখতে পাচ্ছি এদের সবাইকে আমি টিভিতে দেখেই অভ্যস্ত। বাবারে কি বড় বড় সাংবাদিক। শ্রাবণীকে কিছু কারণে ঈর্ষা করলেও এখন একটু একটু গর্বও হচ্ছে তাকে নিয়ে। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কেউ তো আর মিডিয়াতে আসেনি।
কেউ একজন চিৎকার করে জানতে চাচ্ছে, ট্রাকের ধাক্কায় কয়জন মরেছে ১৮ জন নাকি ৮ জন। খুব সিনিয়র একজন বলে উঠলেন, ২০ করে দেন। আমরা এগিয়ে থাকি। হাসপাতালে যে কয়জন আছে তাদের মধ্য থেকে তো দুয়েকজন মরবেই।
মধ্যবয়স্ক এক আপা বললেন, না মরলেও গিয়ে গলা টিপে মেরে দিয়ে আসবেন মুরুব্বী। নইলে তো নিউজের মান সম্মান থাকবে না।
আমি তো রীতিমতো আঁতকে উঠছি এসব কথা শুনে। তাদের হাতে কি ক্ষমতা। সারাদেশবাসী যা শুনবে যা দেখবে সেই তথ্য নিয়ে সাংবাদিকদের কি ছেলেখেলা। আর কী অবলীলায় মৃত্যুর কথা বলে যাচ্ছে। এতো হা করে উনাদের কথা শুনছিলাম যে, কখন শ্রাবণী এসে দাঁড়িয়েছে পাশে খেয়ালই করিনি।
কি রে কি ভাবছিস?
ওর কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। আমি খুব করুণ গলায় বললাম এতো মৃত্যু ধ্বংস নৃশংসতার খবরে তোদের খারাপ লাগে না?
শ্রাবণীকে যেনও ভানুর চুটকি বলেছি এমন হো হো করে হেসে উঠল।
তোর কি মাথাটাথা গেছে? কেউ মরলে তো আমাদের লাভ। দিনে দেওয়ার মতো একটা খবর জুটে। আর যতো বেশি দুর্ঘটনা আর নৃশংসতা আমাদের খেয়ে পড়ে বাঁচার সম্ভাবনা ততোই বেশিরে।
এতক্ষণ ডেস্কে ঘাড় গুঁজে কাজ করা শ্রাবণীর মধ্যে আমি কোথায় যেনও একটা রুক্ষতা দেখতে পেলাম। অবশ্য সাংবাদিক আর ডাক্তারের নাকি কোনও লাজ-লজ্জা ঘৃণা ভয় থাকতে নেই। শ্রাবণী একদম ঠিক পথে এগুচ্ছে। ওর জায়গায় নিজেকে ভাবলাম কিন্তু খুব একটা কঠোর হতে পারলাম না। সকাল বেলা গুড মর্নিং ম্যাম বলতে বলতে অ্যাসেম্বলিতে যাওয়া বাচ্চাগুলোর কচি মুখ ভেসে উঠল। কেনও জানি এইখানে দাঁড়িয়ে কান্না পেল। শ্রাবণীকে শুধু বললাম তুই কাজ শেষ করে আয়। একসঙ্গে ফিরব। আমি অপেক্ষা করছি।
ও জানালো পলাশ ভাই আসছেন আমি চাইলেই ওদের সঙ্গে ফিরতে পারি। আমার অবশ্য তেমন কোনও কাজ নেই। আমার স্বামী দেশের বাইরে। বাসায় দেরি করে ফিরলে বা না ফিরলেও সমস্যা নেই। আজকে রাতে ওদের সঙ্গে থেকে যাওয়ার প্রস্তাব পেলেও আমার জন্য মন্দ হয় না। আমি প্রস্তাব লুফে নিলাম।
শ্রাবণী সব গুছিয়ে কার্ড পাঞ্চ করার সময় আমার টিভিতে দেখা বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আমার তো আবেগে কথা গলায় আটকে যাচ্ছে। কেউ কেউ চা খেয়ে যেতে বললেন। আমি চা খাই না এই কথাটা বলার সুযোগ না দিয়ে একজন তো চা আনতে বলে দিলেন। আমি এই ভদ্রলোকের প্রতিটা টক-শো দেখি। একটা অটোগ্রাফ নিব কিনা বুঝতে পারছি না। আমার ব্যাগে একটা ডায়েরি তো আছেই। পরে মনে হলো একটা ছবি তুলি। কিন্তু সংকোচে আমার এত দামী স্মার্টফোনটাও বের করতে পারছি না। ইশ! স্কুলের কাউকে বলাই যাবে না যে এই টিভি ব্যক্তিত্ব আমাকে চা খাইয়েছে। প্রথমেই তারা ধরবে আপনি না চা খান না, দ্বিতীয়তে বলবে ছবি দেখাতে। আমি এর কোনোটাই করতে পারছি না। কি কথা বলব এমন সাত-পাঁচ ভাবার মধ্যেই শ্রাবণী আমাকে তাড়া দিয়ে বের করে নিয়ে এল। আমি শুধু বাই বলে চলে এলাম। আহা একটু হাত মেলাতেও তো পারতাম!
নিচে নেমেই দেখি পলাশ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখেই কাঁধে বিশাল এক চাপড় দিয়ে জানতে চাইলেন কেমন আছি। দেশসেরা টিভি সাংবাদিক দেখে যতো না খাবি খেয়েছি তার চেয়ে বেশি খাবি খেয়েছি পলাশ ভাইয়ের চাপড়ে! ইনিই পলাশ ভাই! সিথাপাটি করা ভদ্রলোক একদম ড্যাম স্মার্ট হয়ে গেছে। সেই তুলনায় আমাদের লারেলাপ্পা শ্রাবণীকেই খানিকটা গেঁয়ো লাগছে।
বহুদিন পর দেখা হলো তার সঙ্গে। পায়ে হুশ পাপ্পির জুতো, ড্যানিমের জিন্সের সঙ্গে ম্যানজের অফিস শার্ট। কানে কানটুপি। টুপির ফাঁক দিয়ে বের হয়ে এসেছে একটা ব্লুটুথ হেডফোন। মিস্টার পুতুপুতু পুরানা ইমেজ ঝেড়ে একদম প্লে বয় হয়ে গেছেন পলাশ ভাই। আর কুশল জিজ্ঞাসা করার স্টাইলে তো আমি পুরোই ভরকে গেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে লোক এক হাত দূর থেকে কেমন আছি জিজ্ঞাসা করতেন সেই ভদ্রলোক কিনা কাঁধে চাপড় দিয়ে বলেন, কেমন আছিস!
আমার ঘোর আর কাটছেই না।
পলাশ ভাই বাইরে খাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। শ্রাবণী খেকখেক করে উঠল। এই ১২ ঘণ্টা অফিস শেষ করে বাইরে খেতে যাওয়ার এনার্জি তার নেই। আমি অবশ্য তাকে দোষ দেই না। আমরা মাত্র পাঁচ ঘণ্টা স্কুল করে যে পরিমাণ হাপিয়ে যাই। আর তার তো ভয়াবহ চাকরি। আজকে না যাই কোথাও বলে পলাশ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি যেনও আমার মনের কথা ধরতে পেরেছেন। বললেন, তাহলে বাসায় চল। আজকে আমি রান্না করেছি। আমি তো যেতে রাজীই। এক লাফে লুফে নিলাম। স্কুল ছুটি লাভলু দেশে নেই। আমার আসলে কিছুই করার নেই। রাত ৯টায় বন্ধুর বাড়িতে হামলা করতে পারলে আমি বেঁচেই যাই।
বাড়ি যাওয়ার আগে শ্রাবণী টংয়ের দোকানের চায়ের অর্ডার দিল। এমনি আমি চা খাই না এরপর টংয়ের দোকানে। আমার কোনও ছাত্র-ছাত্রী দেখে ফেললে কি হবে এই সংকোচে ইতিউতি তাকালাম। পরিচিত কাউকে দেখতে পেলাম না। কোনও রকম নাকমুখ বন্ধ করে গিলে নিলাম চা। আজকে আমি অতিথি। এই চা হজম করাই আমার কাজ। অনেকদিন পর শ্রাবণীকে বাগে পেয়েছি। ওর গল্প লেখার ইতিহাস আমাকে আজকে বের করতেই হবে। মিশন ইমপসিবল আজকে আমার।
যেতে যেতেই শ্রাবণীর কাছে জানতে চাইলাম, ওর গল্প লেখার কথা। ও জবাব দেওয়ার আগে পলাশ ভাই বলে উঠলেন, আমার স্ত্রী গল্প লেখে আমার অনুপ্রেরণায়। খাবি খাওয়ার আরও বোধহয় বাকি ছিল। এখানেই শেষ নয়।
আমার হতভম্ব ভাবের মধ্যেই পলাশ ভাই বলে চলেছেন, ওর সবকটি প্লট আমারই বলা। আমি যা বলি ও তাই লেখে।
শ্রাবণী যখন কোনও কথার মধ্যে বাধ না সেধে ওস্তাদ গোলাম আলীর গজল শুনে নিরবিচ্ছিন্ন মাথা দুলিয়ে যাচ্ছে তখন বুঝলাম পলাশ ভাই যাহা বলছেন সত্য বলছেন। সত্য বই মিথ্যা বলছেন না। আমি অবশ্য সিথাপাটি করা এই লেবেন্ডিস যুবকের এহেন পরিবর্তন দেখে কিছুটা অবাকই হচ্ছি।
রাতে খাবার টেবিলে পোলাউ, ডিম ভুনা, মোরগ ভুনা আর বেগুনের চাটনি খেতে খেতে শ্রাবণীর লেখক হওয়ার গল্পের আদ্যোপান্ত জানলাম। পলাশ ভাই জানালেন, এই জীবনে তিনি একখানা চিঠিই লিখেছিলেন আমার বান্ধবীকে। সেই চিঠির আগাগোড়া ছিল ‘তুমি লেখ’ বিষয়ক উপদেশ, আদেশ, নির্দেশ, অনুরোধ সম্বলিত। সেই চিঠি নাকি শ্রাবণী কোনও এক পরিত্যক্ত টেবিলের ড্রয়ারে তেলাপোকার সঙ্গে রেখেছিল। এত ভালোবাসা সম্বলিত চিঠির এহেন অপমান পলাশ ভাইয়ের সয়নি। তাই নাকি আর চিঠিই লেখেননি প্রিয়তমাকে। শ্রাবণী আবার ফোঁড়ন কেটে উঠল,চিঠি যত্নে রাখিনিতো কি হয়েছে মানুষটাকে তো রেখেছি। যাদের চিঠি যত্নে রেখেছিলাম তাদের নাম শুনলেও তো এখন গা ঘিন ঘিন করে ওঠে।
শ্রাবণীর কথা শুনে আমারও একই অনুভূতি হলো। আসলেই তো যাদের চিঠি যত্নে গোলাপ পাপড়িতে রাখতাম এই জীবনে তাদের অবস্থান কোথায়?
পলাশ ভাইয়ের রান্না সত্যিই ভালো। খাওয়া শেষে উনিই এসপ্রেসো কফি বানিয়ে খাওয়ালেন। শ্রাবণীকে বললেন, গত সপ্তাহে তোমার যে গল্পটা ছাপা হয়েছিল সেটার আদ্যোপান্ত আমিই তোমাকে বলেছিলাম। তুমি শুধু লিখেছ।
আহারে লেখার বিষয় নিয়ে কি বাহাদুরী। এতোই যখন বাহাদুরি তখন তুমি লেখো না কেন বলে খেকিয়ে উঠল শ্রাবণী।
আমিও কথাটা লুফে নিলাম। আপনি গল্প লেখেন না কেন?
আমার খুব কষ্ট হয় লিখতে। স্টিফেন হকিংয়ের মতো মাইন্ড রিডার যন্ত্র থাকলে আমি বেশ বিখ্যাত লেখক হতাম। আমার মাথায় নানা গল্পের প্লট ঘুরে কিন্তু লিখতে পারি না।
আহারে বেচারা!গল্প লেখার জন্য মাইন্ড রিডার যন্ত্র খুঁজছেন। লাভলু এখন লন্ডনে আছে ওকে আনতে বলব কিনা বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই পলাশ ভাই আর শ্রাবণী একসঙ্গে হেসে উঠলেন। আমি অবশ্য মজা করেই বলেছি। হকিংয়ের ওই যন্ত্রের দাম চুকাতে অর্ধেক বাংলাদেশ বেচতে হবে। সে সামর্থ আমাদের কোথায়? সুতরাং ধরেই নিচ্ছি পলাশ ভাই গল্প লিখছেন না। তিনি গল্প বলেই যাবেন আর শ্রাবণী লিখবে।
এত হইচই কথাবার্তার মধ্যে আমি ভাবছিলাম আমার কথা। আমি তো অফুরন্ত সময় পাই। দিনে দুটো ক্লাস, চারটে ক্লাসের কোর্ডিনেটিং গল্প লেখাটা তো কোনও বিষয়ই না। ছোটবেলায় তো কত কিছু লিখেছি। এখন কি চাইলে পারি না। আর শ্রাবণী সাংবাদিকতা করে যে জীবন দেখছে স্কুল শিক্ষক হয়ে কি আমি তার চেয়ে কম জীবন দেখছি? হতে পারে আমার জানার সীমানা কম, পরিধি খাটো। আমার ভেতরে কেমন জানি আমি ফুসে উঠছি। শ্রাবণী আর পলাশ ভাই হাতে কফির মগ নিয়ে খুনসুটি করছেন। আমার খুব ঈর্ষা হচ্ছে। মনে হচ্ছে মগভর্তি কফিটা ছুড়ে মারি ওদের দিকে। পুড়ে যাক ওরা।
ইদানিং আমার এমনটা হচ্ছে কারও ভালো দেখতে পারছি না। ভালো কোনও মুহূর্তও সহ্য করতে পারছি না। গেল সপ্তাহে স্কুলে মিসেস জান্নাতের ভ্যানিটি ব্যাগটা ডেস্ক থেকে ফেলে দিয়ে রাগ কমিয়েছি। উনি বুঝতে পারেননি। ভেবেছেন কোনও ছাত্র-ছাত্রী দৌড়ে যাবার সময় পড়ে গেছে। ক্লাস-থ্রিয়ের মুনতাহা মেয়েটা যখন জান্নাতকে জড়িয়ে ধরে বলল তুমি এই স্কুলের শ্রেষ্ঠ মিস। তখন কেনও জানি সব ওলট-পালট হয়ে গেল। আমি কেনও শ্রেষ্ঠ নই। মুনতাহাদের ক্লাসে আমার পারফরমেন্স সবচেয়ে ভালো। তবু কেনও জান্নাতের প্রশংসা করবে ওইটুকুন একটা বাচ্চা মেয়ে। কেনও!
আমি বোধহয় বেশ জোরেই কেনও বলে ফেলেছি। ওরা দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। আমি আস্তে করে কফির মগটা নামিয়ে রেখে বললাম, পলাশ ভাই রাতে কফি খেলে আমার ঘুম হবে না। আমি কফিটা না খাই।
পলাশ ভাই তো, হইহই করে উঠলেন। কত কষ্ট করে তোর জন্য কফি বানালাম, আর তুই কিনা খাবি না। আমার বউকে দেখ সোনা মুখ করে খেয়ে নিচ্ছে।
খুব রাগ হচ্ছে, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, আমি আপনার বউয়ের মতো ওতো গুণবতী নই। আমি খুব সাধারণ মানুষ। মানুষকে খুশী করার কোনও পন্থাই আমার জানা নেই। আমি একটু ছাঁদে হাটি বলে ওদের বারান্দা থেকে উঠে এলাম। দুজনেই বেশ বুঝতে পেরেছে, আমি হঠাৎ করে একা থাকতে চাইছি। তাই কেউ আটকালো না। আধুনিক মানুষদের এই এক সুবিধা। কোনও কিছু চাপিয়ে দেয় না। আমার শ্বাশুড়ি-বা-মা হলেই আটকে ফেলতেন। কেনও এখন ছাদে হাঁটব, কেনও একা থাকব । হাজার কৈফিয়ত। কোনও উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না আমার।
শ্রাবণীদের ১৩ তালা বাসার বেলকনির পাশে একচিলতে ছাদ। অনায়াসে এখানে বারবিকিউ পার্টি হয়ে যেতে পারে। আজকাল ছাদ দেখলেই আমার পার্টি দিতে ইচ্ছা করে। লাভলু বেশ পছন্দ করে। আমিও প্রতিবার বেশ উৎসাহ নিয়ে শুরু করি। কিন্তু পার্টি শেষ হতে হতে কোথায় আমাকে একটা ভয়ঙ্কর একাকিত্ব গ্রাস করে বসে। খেই হারিয়ে ফেলি।
গত দু‘বছর যাবৎ এই সমস্যায় ভুগছি। লাভলু কয়েকবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমার অনীহার কারণে আর চেষ্টা করেনি। এখন বেশ আলাদা আছি ভালো আছি। সে তার ব্যবসার কাজ নিয়ে দেশ-বিদেশ করছে। আমি স্কুল শেষ করে এখানে সেখানে আড্ডা মেরে বেড়াচ্ছি। সময় তো কাটছে। আমাদের মধ্যে যে গোপন দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেটা তো আর কেউ জানতে পারছে না।
রাত প্রায় দুটো বাজে। আমি ছাঁদের এ মাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করে বেড়াচ্ছি। ভেতরে পলাশ ভাই- শ্রাবণীর কথার হুল্লোড়ের ছিটেফোটা ভেসে আসছে। আমি যে একজন মানুষ ওদের মাঝে আছি এটা বোধহয় ওরা ভুলেই গেছে। রাগ হচ্ছে খুব রাগ হচ্ছে। আমার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে। কেনও কাঁদছি নিজেই জানি না। তবে কাঁদতে খুব ভালো লাগছে। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, আমার ভেতরের ঈর্ষাগুলো কান্না হয়ে ঝড়ে পড়ছে।
শ্রাবণী এসে আমার মৌনতা ভাঙল। আমি কতক্ষণ লাভলুর সঙ্গে প্রেমালাপ করলাম সেটা সুধালো। আমার হাতের বন্ধ ফোন কেড়ে নিয়ে বলল- দেখি দেখি কত মিনিট কথা বললি? বন্ধ ফোন দেখে টিপ্পনির ফোয়ারা ছুটতে লাগল। আমি নাকি এত কথা বলেছি যে- ফোনের চার্জই শেষ হয়ে গেছে।
আমার শ্রাবণীকে খুব জানাতে ইচ্ছা করছে , তার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছে ১৯ দিন আগে। সেদিন মায়ের জন্য একটা ওষুধ আনতে হবে সেটি মেইল করে ফোন দিয়েছিলাম। বলা হলো না। আমিও বেশ সুখী মানুষের ভান ধরে বললাম স্বামী-স্ত্রীর কত কথাই তো থাকতে পারে। এখনও তো অনেক কথা বাকি। চার্জ দিয়ে নিয়ে ফের কথা বলব।
পলাশ ভাই এসে হাজির হয়েছেন। শ্রাবণীকে বলছেন, এই ফোনালাপ নিয়ে তুমি একটা দারুণ গল্প লিখতে পারো। ক্রসকানেকশনের প্রেম।
শুরু হলো পলাশ ভাইয়ের গল্পের প্লট দেওয়া। আমার কেনও জানি মনে হচ্ছে আমি প্লটটা লুফে নেই। আমিও তো একসময় তুখোড় লেখক ছিলাম। শ্রাবণীকে বললে নিশ্চয় আমার লেখা কোথাও না কোথাও ছাপিয়ে দিবে। ও নিশ্চয় আমাকে ততোটা ঈর্ষা করে না। যতোটা আমি ওকে করি।
সকালবেলা আমি আর পলাশ ভাই একসঙ্গে বের হলাম। আমাকে বাসার সামনে ড্রপ করে দেওয়ার সময় বললেন, এতো অফুরন্ত সময় হেলায় নষ্ট করছিস কেন? তুইও গল্প লেখ। সময়ও কাটবে মন ভালো থাকবে।
আমার কেনও জানি খুব হাসি পেল। বললাম আপনি লিখেন। এত প্লট দিতে পারেন। লিখতে শুরু করলেই লেখা হয়ে যাবে। আমার মতো উনিও হেসে দিলেন। লিখব হয়তো। তবে শ্রাবণীর মতো অতো বিখ্যাত হতে চাই না। নিজের জন্যই কিছু অনুভূতি লিখে রাখতে চাই। তুই ছাড়া ছাড়া অনুভূতি লিখে হাত মকশো কর। এর পর গল্প লেখা শুরু কর। তোর তো কল্পনা শক্তি অসীম ছিলরে।
বুকের ভেতরে কাঁপন দিয়ে উঠল। পলাশ ভাইয়ের আমার কল্পনা শক্তির কথা মনে আছে। কেমন একটা শক্তি ফিরে পেলাম। এই একটা মানুষের অন্তত আমাকে মনে আছে। আমি তার হাত ছুঁইয়ে দিয়ে বললাম। তোমার মতো আইডিয়া দাতা থাকলে হয়তো আমিও গল্পকার হয়ে উঠতাম। তুমিই বরং লেখ পলাশ ভাই। আমি বাকি জীবনটা পাঠক হয়েই কাটাব।
অনেক বছর পর তুমি বলার জন্য ধন্যবাদ বলে পলাশ ভাই লাল রঙের টয়োটা প্রিমিউ হাঁকিয়ে চলে গেলেন। আমি পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার আর কিইবা করার আছে।
শ্রাবণীর বাড়ি থেকে আসবার পর গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার খাতা-কলম নিয়ে বসেছি। কখনও ট্যাবে লেখার চেষ্টা করছি। আমার লেখা হচ্ছে না। আমার হারিয়ে যাওয়া কুয়াশার ফুল আমার দুহাত টেনে ধরে বলছে, মা আমার সঙ্গে খেল। তুমি লিখতে পারবে না। জন্মের দুদিন পর হেপাটাইটিস-বি হয়ে মারা যাওয়া সেই ছোট্টো শিশুটাকে চাইলেই আমি উপেক্ষা করতে পারি না। যেমন লাভলু পারে। তার জন্যই আমার তাবৎ বদলে যাওয়া। “লিখতে পারছি না। লেখা আমাকে দিয়ে হবেও না, তুমিই বরং লেখ ভাইয়া”- কথাটা লিখে পলাশ ভাইকে এসএমএস করলাম।
গত এক সপ্তাহ ধরে হরতালের কারণে স্কুল বন্ধ। এসএমএসের শব্দে ঘুম ভাঙল। পলাশ ভাই আমার এসএমএসের কোনও উত্তর দেননি। তার মেসেজ ভেবেই খুলে অবাক। লাভলু ফিরছে আজ রাতে। পছন্দের খাবারের মেনু লিখে এসএমএস করেছে। এই খুদে বার্তা পেয়ে মনে হলো-তৃষিত মারা যাওয়ার পর আমাদের মধ্যে যে ভাঙন ধরেছিল সেটা কোথাও জোড়া লাগতে শুরু করেছে। আবার আমরা ছোট্ট একটা শিশুর স্বপ্ন নিয়ে দিন শুরু করব।
লাভলুকে চমকে দিতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করলাম। অনেকদিন পর সময় নিয়ে সাজলাম। আমার সাদা জামদানিটা পড়লাম। লজ্জা শরমের বালাই উপড়ে চুলে একটা সাদা ফুলও গুজলাম। লাভলু মায়ের বাসা হয়ে আসবে। আমার ছোটো দেওর জানালো ওখান থেকে আমার এখানে রওনা হয়েছে। মনের মধ্যে গুনগুন করছে গান।
আমাকে দেখে লাভলু কতটুকু চমকেছে আমি জানি না। কিন্তু তার চেহারা বেশ খোলতাই হয়েছে। বেশ প্রাণবন্ত আর হাসিখুশি লাগছে। বাবু মারা যাবার পর যে ভঙ্গুর চেহারা হয়েছিল সেটা কাটিয়ে উঠেছে। খাবার টেবিলে বসতে বললাম ওকে। সেখানেই আমার জন্য সবচেয়ে বড় চমকটা অপেক্ষা করছিল। লাভলু এক তোড়া কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল, দেখতো কেমন হয়েছে গল্পটা। সুমি বলেছিল, ডিপ্রেশন কাটাতে লেখালেখি করো। লাভলুর গল্প লেখার বিষয়টা আমাকে বেশ স্পর্শ করল। আমি ওকে বলতে চাইলাম, আমিও একটা কিছু লেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু সুমি শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কেমন আড়ষ্ট হয়ে এল জিভ। কেউ যেন জিভটা কেটে নিল মুহূর্তেই।
সুমি লাভলুর বান্ধবী। আমার দিকে না তাকিয়েই ও বলে চলছে, সুমির কথা শুনে আমি বেশ ফল পেয়েছি। ওর সাজেশনগুলো এতো কাজে লাগে, তা বলার মতো না। আর মেয়েটা আমাকে বেশ বুঝতে পারে।
আমি লাভলুর কথাগুলো না শুনে গল্পটা পড়তে লাগলাম। মাঝামাঝি এসে আটকে গেলাম ইংরেজি-বাংলা মেশানো স্ট্যাম্প লাগানো কাগজে। শেষ আট পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখে গল্পটা মেলাতে পারলাম না। আমার জন্য লাভলুর কিছু একটা সংকোচ এখনও রয়ে গেছে। তাই একেবারে নির্লজ্জের মতো ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে না দিয়ে গল্প দেওয়ার ছলে দিয়েছে কাগজগুলো। ও জানতো আমি গল্প পড়তে ভালোবাসি। তাই শেষ আট পৃষ্ঠায় কোনও গল্প রাখেনি, রেখেছে ডিভোর্স পেপার।
আমার হাতে তালাকনামা। আমার বিস্ফারিত চোখের দিকে চেয়ে লাভলু বলল, তুমি আমার জীবনের অনেক কিছুর অনুপ্রেরণা ছিলে এবং থাকবে। আমি তোমাকে ঠকাব না। দেনমোহরের পুরো টাকা, হাতিরপুলের এই ফ্লাট সবই তোমার নামে থাকবে। বিনিময়ে তুমি এখানে সই করে দিও প্লীজ। তুমি নিজেও নিশ্চয় বুঝতে পারছ- তোমার সঙ্গে আমার আর হচ্ছে না।
কলমটা দাও, অনেকটা নিঃশব্দে বললাম আমি।
লাভলু আশাও করেনি এত সহজে সে মুক্তি পেয়ে যাবে। আমি কান্নাকাটি করব, তাকে আকড়ে ধরে থাকতে চাইব, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কেন জানি হলো না। আমার কাউকে আকড়ে ধরে বাঁচার সাধটাই মরে গেছে হয়তো।
রাত ১টা বাজে। আমি ঘড়ি না দেখেই দিব্যি বলে দিতে পারি। এসময় একটা তক্ষক ডাকে পাশের নারকেল গাছটায়। আজকে রাতটা খুব বেশি নীরব। সব নীরবতা ঝনঝনিয়ে ভাঙল ফোনের শব্দে। শ্রাবণীর ফোন-হ্যালো বলার সুযোগ না দিয়ে সে কথা বলা শুরু করেছে... জানিস, তোর পলাশ ভাই আজকে অসাধ্য সাধন করেছে। একটা গল্প লিখে ফেলেছে। আমি তো পুরো অবাক। তুই নাকি গত কয়েকদিন তাকে গল্প লিখতে চাপাচাপি করেছিস। যা একটা গল্প হয়েছে না, বিশ্বাস করবি না! গল্পটা অচিরেই পত্রিকায় ছাপতে দিব। আমার যে কী খুশি লাগছে তোকে বলে বোঝাতে পারব না। অনেক থ্যাংকসরে দোস্ত। তুই চেপে না ধরলে এই গল্প লেখাই হতো না।
আমার মাথার মধ্যে পৃথিবীর তাবৎ গল্প নেচে উঠছে। আমি কি কলম খুঁজে বেড়াচ্ছি সেগুলো লিখব বলে, নাকি কলম খুঁজছি বিচ্ছেদ বাক্য লেখার জন্য...।




তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প আষাঢ়, ওহ্ তুমি, তুমিই তো কাল রাতে জানতে চেয়েছিল। আজ আষাঢ় কিনা! আজ আষাঢ়ের রঙ পরবে তুমি। তোমার একগাদা নীল থেকে হয়তবা কম পছন্দ বা ইচ্ছে হলে বেশি পছন্দও পরতে পারো। এটা আসলে নির্ভর করবে সকালে তোমার মুড কেমন থাকবে বা আদতে সকালে বৃষ্টির মুড কেমন থাকবে তার উপরে

অপেক্ষা ছিল, তাই বলে একটা বেবি ট্রেন!
শারমিনুর নাহার

হু হু করে একটা ট্রেন চলে গেল। যদিও ট্রেনের সিগনাল বারটা তোলা হলো না। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট থেকে পনের মিনিট, বিশ মিনিট হয়ে গেল। এখনো বারটা তোলা হচ্ছে না। অফিসগামী মানুষজন বাসে গরমে সেদ্ধ হতে হতে পুরোই আলুর্ভতা হতে চলল। বিরক্তির চরম। ওই মিয়া, তোমার ট্রেন আসতে কতক্ষণ লাগে? একলগে এতগুলান আহে ক্যান, একটু টাইম গ্যালে আইতে পারে না! হালার রেলওয়ে! বাংলাদেশ রেলওয়ের চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করবার পরেও ট্রেনের দেখা নেই। এমন সময়, ঠিক এমনি ভ্যাপসানো, তাতানো মেজাজের মধ্যে একটা হুইসেল শোনা গেল, পর পরই দ্রুতগামী কি একটা রেলের লাইন বরাবর দৌড়ে পালাল। ইঁদুরটা যেন চোখ ফাঁকি দিয়ে আলমারির তলায় লুকালো। একটি ইঞ্জিন, ঠিক ইঞ্জিনও নয়, শুধু চাক্কা লাগানো। সেই চাক্কার উপরে তিনজন বসা। একজন নারীও আছে। কালো জিন্সের প্যান্ট পরা। অন্য দুজন পুরুষ। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে ইঁদুরের দৌড়ে পালানো এবং হঠাৎই কল ছাড়বার পরে চাপে ফোঁস শব্দে ছিটকে পানি পড়ার মতো। কল ছেড়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ছিটকে পানি আসায় যেমন প্রাণের দেখা মেলে তেমনি ছোট এই চলে যাওয়া সবার চাপ নামিয়ে একেবারে জেসমিন ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিলো। এটা কি বেবি ট্রেন? এমন ট্রেনও আছে নাকি! এরা কি লাইন ক্লিয়ার করে?- এমন নানান কথা চারপাশ থেকে আসতে লাগল। সবুজ ফ্লাগ আর নীল সাফারি পরা যে লোকটা সমান্তরাল হাত তুলে ছিল প্রথমে সেই হো হো হাসছিল। মগবাজারে রেল লাইনটার স্থানটাই এখন শুধু ফাঁকা। আশপাশটা ইলেকট্রিক খাম্বার তারে ঝুলানে ত্রিকোণা, গোল, চারকোণা নানা গ্যাঞ্জামের যানবাহনে ভর্তি। ফাঁকা রেল লাইনের পাশে লাইনম্যান দাঁড়িয়ে হো হো হাসছে। দৃশ্যত আর কোথাও যেহেতু কোন পরিবর্তন হচ্ছে না সেহেতু সবার দৃষ্টি সেই নীল সাফারির উপরেই নিবদ্ধ। আর আমরা যারা বাসে আলুভর্তা বা কচুভর্তা বা বেগুনভর্তা হচ্ছিলাম তাদের কাছে মনে হলো, কি যেন একটা চলে গেল। ঠিক বেবি বললেও বেশি বলা হয়। সদ্যজাত কোন ব্যাকটেরিয়ায় হতে পারে যাদের খালি চোখে দেখা যায় না। যার জন্য অপেক্ষা যতটা সে ততটা নয়। তার শব্দ যতটা পরিমাণ ততটা নয়। আমাদের দেখবার প্রত্যাশা যা সে ততটা নয়। আপাতত পথটা ছেড়েছে এই তৃপ্তিতে আমরা কতিপয় বাসযাত্রী পেছনের সব উদ্বিগ্নতা ভুলে শ্বাস নিতে শুরু করলাম।
রেল বারের একোবারে সামনের বাসটাতেই আমি ছিলাম। একেবারে সামনের সিটে মানে ড্রাইভার বরাবর সিটটাই বসে। ডান দিকে বাস ধাক্কা খেলে ড্রাইভার মরবে আর বাম দিকে ধাক্কা খেলে আমি মরব। রাস্তার মুখোমুখি এই সিটটাতে জায়গা পেলে আমার কেবলি মরে যেতে ইচ্ছে করে। মৃত্যু কি বীরদর্পে আসে এটা দেখবার জন্যই কেবল এই ইচ্ছেটা। হুইসেল এবং ট্রেনের শব্দে হঠাৎ বাড়ি ফিরে গেলাম। তখন কত বয়স, চার বা পাঁচ বা ছয় হবে একটা। বাম হাত দিয়ে দু’গাল চেপে ধরে ডান হাতে চুলে চিরুনি করে দিতেন আম্মা। সে সময় আমাদের সব ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা আসেনি। দাদা ভাই গ্রামের বাড়ি থেকে আমাদের বাসায় বেড়াতে এলে দিনগুলো যেন ফুল হয়ে ফুটত। ভীষণ মজা পেতাম ভাই-বোনরা। দাদা ভাইয়ের গায়ে চড়াচড়ি করে আমাদের সন্ধে নামত। পরস্পরের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে যেত কে রাতে দাদা ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমোবে। দাদা ভাই সারারাত পাখা নাড়াতেন। সেই বয়সে এটা বিস্ময় ছিল আমার কাছে। কিভাবে একজন মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাখা নাড়ে! পাখার দুলনির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম আবার জেগে দুলনি দেখতাম। দাদা ভাইয়ের হাতটা দুলত। তার ঝুলে যাওয়া চামড়া আঙ্গুল দিয়ে পেচাতাম। আর কি ভীষণ ঠাণ্ডা সে গা! তোমার কি গরম লাগে না? ঘেমে ঘেমেই তো এমন ঠাণ্ডা হয় রে বুড়ি। আদর করে বাচ্চাদের বুড়ি ডাকে। শুনলেই খেপে যেতাম। আমি কি বুড়ি? হু, বুড়ি, তুই আমার বুড়ি, বলে কোলে নিতে চাইত। যদিও পারত না, শক্তিতে কুলাতো না। আর একবার ছোট ফুপির বাসা থেকে ফিরতে, ঠিক সন্ধে হয়নি তখনও আমি আর দাদা ভাই রিকসায় ছিলাম- কিন্তু হঠাৎই যেন সন্ধে হয়ে এলো। চারপাশ কালো করে মেঘ ডাকতে লাগলো, বিজলি চমকাতে লাগল। ভয়ে আমি দাদা ভাইয়ের কালো হাতটা সাপের মতো জড়িয়ে ধরেছিলাম। ঠিক এমন সময়ে প্রচণ্ড হুইসেল বাজিয়ে কতগুলো লাল নীল আলোর গাড়ি আমাদের রিকসাকে দ্রুত পাস করে গেল। আকাশের বিজলী আর কালো গাড়ির উপরে লাল নীল আলোর চমকে গা ছমছম করে উঠেছিল। এরপরেই রাস্তাগুলো অন্ধকার হয়ে গেল। শহরের সব বাতি নিভে গেল। আর প্রচণ্ড গর্জন করে বৃষ্টি নামল। মাঝারি একটা কোলাহলে সম্বিত ফিরে পেলাম। বাসের যাত্রীরা একে একে নেমে যাচ্ছে। কি হয়েছে, সবার গন্তব্য একসঙ্গে চলে এলো? না, সময় ঠিকই চলছে। শুধু থেমে যাওয়া সময়ে লোকের পোষাচ্ছে না বলে তারা গতি বাড়ানোর জন্য বাস থেকে নেমে যাচ্ছে।
আমি চোখ বড় বড় করে সামনে দেখতে লাগলাম। টু করে মোবাইল তার প্রাণ জানাল। একটা মেসেজ...শুভ আষাঢ়। যদিও আননোন নাম্বার, কিন্তু বুঝতে পারলাম। আষাঢ়, ওহ্ তুমি, তুমিই তো কাল রাতে জানতে চেয়েছিল। আজ আষাঢ় কিনা! আজ আষাঢ়ের রঙ পরবে তুমি। তোমার একগাদা নীল থেকে হয়তবা কম পছন্দ বা ইচ্ছে হলে বেশি পছন্দও পরতে পারো। এটা আসলে নির্ভর করবে সকালে তোমার মুড কেমন থাকবে বা আদতে সকালে বৃষ্টির মুড কেমন থাকবে তার উপরে। যা তোমাকে পছন্দ করতে সাহায্য করবে কোন নীল শাড়িটা আজকের জন্য পারফেক্ট। এরপর নীল টিপ পড়ে পুরোদস্তুর একটা পূর্ণকবিতা হয়ে তুমি ঘর ছাড়বে। কই যাবে তুমি আষাঢ়ের প্রথম প্রহরে? বৃষ্টির দিনে আমার কেবল স্কুলের রেইনি ডের কথা মনে পড়ে। খুব মন খারাপ খারাপ ভাব আর বসে বসে ভাবা। শুধু ভাবো আর ভাবো। ভাবনার জন্যেই একটা দিন বরাদ্দ। কত রকম রঙ সে সব ভাবনার। কোন নীল, কদম, অভিসার বা রাধা সেখানে নেই। একেবারে খটখটে একটা বর্ষা। আর খুব চমৎকার একটা শব্দ, আর ব্যাঙের ডাক। সোনা ব্যাঙের ডাক। হলুদ গায়ে আর কালো রংয়ের দাগ। যখন শব্দ করে তখন গলার নিচে ফুলে ওঠে। সে রঙ কালো। ঘ্যা ঘু। আমরা জানালা খুলে বিছানায় বসে বসে ব্যাঙের ডাক শুনতান। বাইরে যাওয়া যাবে না। নিচে নামা যাবে না। বৃষ্টিতে পা ভেজানো যাবে না। হাজারো কেয়ারিং মা বাবাদের।
না না করে যে যত্ন নিয়ে সন্তান বেড়ে ওঠে, তার ভেতরে যে মানুষটা তৈরি হয় তাকে পরিবার কি আর সুরক্ষা দিতে পারে? বাস থেকে নেমেই ঝপাৎ পানিতে পা ডুবে গেল। নোংরা কালো পানির মাঝে হলুদ দলা দলা। উপায়হীন, পা দিতে বাধ্য। এই পানিতে পা না-চুবালে তুমি সামনের পা তুলতে পারবে না। খানা-খন্দ মহানগর। এখানে এখন বাস আমার। আষাঢ়ের আগমনে তাই ভীতি। না ঝরো বৃষ্টি তুমি, দোহাই আমার পথটা শেষ হোক। ঘরে গিয়ে পৌঁছাই। জানালা খুলে তোমায় দেখবো। ট্রেনে শব্দে প্রাণের ডাক আসবে। আকাঙ্ক্ষা থাকবে একটা ট্রেন, যার পু ঝিক ঝিক ধ্বনি অভিসারে ডাকবে। কখন তার আদর মাখা হাত আমায় বুকে জড়িয়ে ধরবে। যদিও খরতা বাড়লেই কেবল তুমি এক বিন্দু হাওয়া নিয়ে আসবে। বলবে আছি! আছি! অপেক্ষায় থাকো, মরে যেয়ো না।
মহানগরে ঝুম বৃষ্টি নামবে। আমার পরস্পর হাতড়ে মরব। তবু আমাদের দেখা হবে না।


 

তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প কিন্তু লিখতে-লিখতে বুঝলাম আমি আর একটু নগ্ন হতে চাই কিন্তু পুরোটা না। তাই আমি একটা গল্প লিখতে শুরু করছি। অথবা একে আপনারা একটি ছোট চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট বলতে পারেন। আমি আগে কখনো প্রেমের গল্প লিখিনি। ব্যাপারটি আমার আসে না

বাকিটুকু প্রেমের সবটুকু জানা নেই

সৌম্য সরকার

কবিরা মুটে বহন করে না, তারা কবিতা বহন করে- এটা ধরে নেওয়া সত্য। সাধারণ জনতা অনেক কিছু ধরে নেয়। বাদ দিন।
আমি একটা কবিতা বহন করে ঘরে ঢুকেছি আজ। তার মানে আমি কবি। কাল যদি মুটে বহন করি, আমি কুলি হয়ে যাব, কবি থাকব না। সেটা ব্যাপার না। একট কিছু হলেই সই।
জানি মানুষজন আমার সাথে কষে ষড়যন্ত্র করে। না হলে সাতজন মানুষ এই মহা গুরুত্বপূর্ণ সতের মিনিটে আমাকে এগারো বার ফোন-কল করবে কেন? তবে আমি অবশ্য সকল ষড়যন্ত্রে হাগু ঢেলে দিয়েছি। তারা আমাকে নিঃস্ব করতে চেয়েছে, তারা আমাকে ধ্বনিহীন করতে চেয়েছে তারা ভারমুক্ত করতে চেয়েছে আমাকে অথচ আমি ভারমুক্ত হতে চাইনি বরং এই কথার বোঝাকে ভালোবেসেছি আমি। তাই আমি ওদের কারো সাথে এক বর্ণও কথা বলিনি। শুধু আমার বয়ে বেড়ানো কথাগুলোর সাথে কথা বলেছি। কথাগুলো খুব সম্ভব প্রেমের অথবা ক্রোধের অথবা ঘৃণার অথবা হিংসার অথবা দুঃখের। ঘাবড়াবেন না, একটু গভীরভাব চিন্তা করলে বুঝবেন এগুলো খুব সম্ভব একই তারে বাঁধা।
কথাগুলো বলতে চাই কিন্তু আমি আমার পেনসিল দিয়ে মিথ্যা বলা শিখিনি এখনও কিন্তু শালার কবিদের সত্যটাকে সত্যের মতো করে বলতে নেই তাই আমিও মিথ্যা করে বলব। যেহেতু আমি একটি কবিতা বহন করছি। আশা করি অপরাধ নেবেন না:

তুই যখন লজ্জা পেতে থাকিস
আমার তখন গা জ্বলে যায়।

তুই যখন মেয়ে হতে থাকিস
আমার তখন পিত্তি জ্বলে যায়

তুই কি জানিস, পাহাড়গুলো আটকে থাকে
আর মেঘগুলো হেঁটে যায়?
জানিস, এতে পাহাড়ের পিত্তি জ্বলে যায়?

মেঘগুলো ফেটে বৃষ্টি পড়তে থাকে
ফসলেরা সবুজ হয় আর সবুজ হয়
আর এতে মেঘগুলোর গায়ে আগুন ধরে যায়, জানিস?

আমরা ভুলে যাই মাটি বলে কেউ ছিল;
বৃষ্টিগুলোর আগে সে চৌচির হয়ে ছিল, তাও ভুলে যাই
আমরা ভুলে যাই চৌচির মানে ব্যথা;
বৃষ্টি এলে ফসলের দেহে ভোর আসে, এটা মনে থাকে,
আর যে ছিল চৌচির
তার সমস্ত শরীরে আগুন আর আগুন যে আগুন আমরা ভুলে যাই!

আমার ধারণা- ধারণা কেন, দৃঢ় বিশ্বাস- আপনারা আগা-মাথা কিছুই বোঝেননি! কারণ আমি বোঝাতে চাইনি, লুকাতেই চেয়েছি।
আমি খুব মুনশিয়ানার সাথে সত্যটা লুকিয়েছি। সত্যটা জানলে আপনারা আমাকে নগ্ন হয়ে যেতে দেখতেন। আমি সেটা হতে দিতে পারি না। ভাবছেন খুব বাহাদুরি দেখালাম? তা একটু। মানুষের লজ্জাবোধ তাদের কবিতা লিখতে শিখিয়েছে।
কিন্তু লিখতে-লিখতে বুঝলাম আমি আর একটু নগ্ন হতে চাই কিন্তু পুরোটা না। তাই আমি একটা গল্প লিখতে শুরু করছি। অথবা একে আপনারা একটি ছোট চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট বলতে পারেন। আমি আগে কখনো প্রেমের গল্প লিখিনি। ব্যাপারটি আমার আসে না। যাই লিখি ইয়ে, মানে, রূঢ় হয়ে যায়- আমার এক বন্ধু আমাকে সেটা মনে করিয়ে দেয় বারবার। এবার খুব সম্ভব আমি একটি মিষ্টি সামাজিক প্রেমের গল্প লিখতে যাচ্ছি যেটি দিয়ে যদি আমাদের ভবিষ্যৎ ফিল্ম মেইকার পামেল একটি ফিল্ম বানিয়ে ফেলে, তবে তাকে ‘সামাজিক একশনধর্মী ফিল্ম’ বলা যেতেও পারবে যেটি কিনা পরিবারের সকলে মিলে একসাথে বসে দেখা যাবে, কাউকে লজ্জায় জিভ কাটতে হবে না! কথা দিচ্ছি। এখানে যা কিছু সব লুকিয়ে চুরিয়ে হবে।
প্রথমে আমি আমার চরিত্রদের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই:
দ-১ স-৩
স-২ আ-১
প-১ ত-১
স-১
প-২
শ-১
জ-১

এখানে বলে রাখি
শ-১ হচ্ছে শিশু চরিত্র যার যৌন-অর্থে প্রেম বিষয়ে কোনো ধারণা এখনও জন্মেনি। সে থাকবে সবার কোলে-কোলে। তার পা ব্যথা- সারাদিন সে ভাইয়া এবং আপুদের সাথে শিশুপার্কে অনেক দৌড়েছে। সে হচ্ছে কবি ব্লেইকের ভাষায় ‘সঙস অফ ইনোসেনস’। অন্যদিকে ভাইয়া এবং আপুরা হচ্ছে ‘সঙস অফ একপেরিএন্স’ যাহা হইতেছে বড়ই ডেইঞ্জারাস। বড়ই জটিল।
তার ওপর কোকিলের নিজস্ব সম্পত্তি বলিয়া খ্যাত যে বসন্ত ঋতু তাহার প্রভাবে এই ডেইঞ্জার লেভেল বহুত বেড়ে যায়। তখন শূন্য আকাশে, দখিনা বাতাসে অনেক হাহাকার ধ্বনিত হয় যার অধিকাংশই যৌন-হতাশা-তাড়িত বলে আমরা গবেষণা করে জেনে ফেলেছি!

জ-১ ঘটনাকালে নিশ্চুপ চরিত্র হিসেবে থাকবে। অথবা বলা যেতে পারে পরিচালক তার নিশ্চুপতা নিশ্চিত করবেন কারণ এতে অন্য সব সরব এবং বাচাল চরিত্রদের সাথে একটি কন্ট্রাস্ট তৈরি করা যায়। ভেরি টেকনিকাল। এ বিষয়ে আরও জানতে চাইলে পামেলের সাথে যোগাযোগ করুন। তার ফোন নম্বর : +৮৮০১৬৭৯২৮৫৪৬৭

আ-১ অন্যদিকে ঘটনার স্থানে শারীরিকভাবে অনুপস্থিত চরিত্র কিন্তু সে তারপরও আছে ত-১ এর ভিতরে এবং স-৩ এর ভিতরে। ত-১ এর ভিতরে সে প্রেম, স-৩ এর ভিতরে সে ঘৃণা।

বাহ! কী চমৎকার! আমি ইচ্ছা করে ব্যাপারটা গুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি যাতে আপিনারা কম বুঝতে পারেন কিন্তু তবু আপনারা খেই হারাবেন না বলে আশা করছি প্রিয় বুদ্ধিমান দর্শক; খেই হারানোর মতো এখনও তেমন কিছুই বলা হয়নি, তবে হবে।

কথা হচ্ছে, মহান এরিস্টটল সাহেবকে আমাদের একটাই কথা বলার আছে : ‘ভাই আপনি মারা খান। আপনার ইউনিটি অফ টাইম, প্লেইস, একশন আমরা মানতে পারি না এই যুগে। দেখেন আমরা মডার্ন ফডার্ন ক্রস করে পোস্ট মডার্নকে ফালা-ফালা করে কোথায় যে যাইত্যাছি জানি না। ফিসিকাল টাইম থেকে সাইকোলজিক্যাল টাইম এমনকি সাইকেডেলিক টাইমে ঢুকে গেছি আমরা যেখানে বিভিন্ন রঙের, আকারের, বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন সময়-চেতনা ও বাস্তবতা চলে আসে, বুঝলেন কিনা? যাই হোক, মৃত মানুষকে জ্ঞান দিয়ে লাভ নেই। আগে বারি...
ফিজিকাল স্থান, ধরি সাবেক কন্টিনেন্টাল, সাবেক শেরাটন, প্রাক্তন রূপসী বাংলা, বর্তমানে আবার কন্টিনেন্টাল মোড়। কাল বসন্ত- যে ঋতুতে মরার কোকিলেরা আন্দাজে গান তুলে আমাদের ঘুমও ভাঙায়, উদাসও করে দেয়, যাঃ! সময় সন্ধ্যা। ব্যস্ত ট্রাফিক, ভয়ানক ব্যস্ত। এর মধ্যে আমাদের চরিত্ররা, মানে উপস্থিত চরিত্ররা রাস্তা পার হচ্ছে। একটু দাঁড়ান, এইমাত্র আমাদের মনে এল দ-১ ও একটি অনুপস্থিত চরিত্র যার অবস্থান স-১ এর হৃদয়ে ভালোবাসার ও শ্রদ্ধার। তার মানে হলো স-১, দ-১ কে ভালোবাসে কিন্তু এমনটা কোথাও লেখা নেই যে স-১ ক, খ, গ, ঘ ও ঙ কিংবা চ, ছ, জ, ঝ, ঞ এরকম আর কাউকেই ভালোবাসতে পারবে না আর একই নিয়মে দ-১ ও ট, ঠ, ড, ঢ, ণ কিংবা ত, থ, দ, ধ, ন-কে ভালোবাসতে পারবে না।

এই রকম মনের মধ্যে একে-ওকে বহন করে রাস্তা পার হলে বাস্তবের ঢাকা শহরে আপনাকে আস্ত পাওয়া যাবে না কিন্তু এটা গল্প কিংবা সিনেমা-লেখক এবং ডিরেক্টরকে না বলে কোনো, ডেইলি স্টারের ভাষায়, ‘রেকলেস’ বাস তার গল্পের বা সিনেমার চরিত্রকে ভর্তা কিংবা কিমা বানাতে পারবে না। তাই আমাদের চরিত্ররা নির্বিঘ্নে ভাবতে-ভাবতে কিংবা কথা বলতে রাস্তা পার হচ্ছে।

আসুন আমরা আমাদের ক্যামেরাটা একটু ফোকাস করি; দেখি কে কার সাথে আছে। স-৩ এবং ত-১ একসাথে আছে, কথা বলছে না, তারা নাকি পরস্পরকে ঘৃণা করে! এটা অবশ্যই আয়রনি অফ সিচুয়েশন! আমাদের যেহেতু সবজান্তা আখ্যানকারী হতে আপত্তি নেই তাই আমরা জানি স-৩ পাগোল-ছাগলের মতো ভালোবাসে ত-১ কে, অথবা বলা ভালো: ‘ভালোবাসতো’। ত-১ সেই মহান আবেগকে গ্রহণ না করে বা না করতে পেরে ন-২’র (ত-১ এর বান্ধবী) ভাষায় ‘পায়ে ঠেলে’ ঘ্যাচাং করে বরং পাল্টি মানে প্রেম খেয়ে গেল আ-১ এর উপর।
এজন্য সামাজিক অবস্থাকোণ থেকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাবো এই, স-৩ যে আ-১কে হিংসা বা ঘৃণা করে এটা স্বাভাবিক নয়। বরং অস্বাভাবিক এটি যখন আমরা জানতে পারি ত-১ যে স-৩ কে ভালোবাসে না বলে ঘোষণা করে এবং স-৩ কে যে তার প্রায়ই অসহ্য লাগে বলে দাবি করে ইহাও সঠিক নহে। ত-১ বরং তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করে স-৩ এর যন্ত্রণাদগ্ধ বাস্তবতা। খুবই নিষ্ঠুর। নিরপেক্ষ আখ্যানকারী হলেও আমরাও মানুষ, তাই আমরা ত-১ কে ত্বরিত একটা অভিশাপ দিয়ে ফেলি! প্রকৃতি তাকে শাস্তি দিবেন, আমিন!

স-২ এর মুখ ভার। স-২ প-১কে তুঙ্গ পর্যায়ের ভালোবাসে বলে ক্লেইম করে। প-১ তাকে নাকি প্রচুর প্ররোচনা দিয়েছে একসময়। ওদিকে প-১ এর ভাষায় সে স-২ কে নিখাঁদ বন্ধু হিসেবে দেখতে চায়। স-২ তাই অলটাইম প্যারার ওপর থাকে! প-২ এর কোলে শিশু শ-১। শ-১ এর পা ব্যথা আমরা আগেই বলেছি। জ-১ নিস্পৃহ চরিত্র।

প-১ আর স-১ কী যেন বেশ বলছে হাসতে হাসতে। তাদের হাসি দেখতে সুন্দর। দেখে ধাঁধাঁ লাগে- তারা বোধহয় ‘সঙস অফ ইনোসেন্স’ খেলছে! কিন্তু তা কী কইরে হয়! সামথিং ফিশি গোয়িং অন...
আমাদের একটু ইতিহাস জানা দরকার। বেশি আগের না, দুই দিন আগের। লাল-মেরুন টাইপের ক্যাটক্যাটা, ড্রেস পরে এবং চশমার বদলে চোখে অতিরিক্ত গাঢ় কাজল দিয়ে এসে চোখ প্রয়োজনের বেশি বড়-বড় করে নাচিয়ে, দন্ত বিকশিত করে মানে দাঁত কেলিয়ে প-১ সেদিন স-১ কাছে এসে বলল, আমি আপনাকে বিরাট একটা সিক্রেট বলতে চাই, আপনাকে না বললে মারাই যাব। স-১ এর মন খারাপ ছিল বিশ্রি টাইপের- সেই পুরনো রোগ- নিজেকে নিজে প্রশ্ন করা এবং নিজের অসংগতি খুঁজে বের করে মেলানকলিয়া যাপন করা।
স-১ বলল, না বললে কি চলবে না?
না, চলবে না। পেটের ভাত হজম হবে না, আপনাকে সব বলতে হবে।
জানেন কি, আমি নতুন প্রেমে পরিয়াছি
যা-তা টাইপের প্রেম
স-১ বলল, দেখে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আ-২ এর কী হলো?
প-১ বলল, সে মারা খাক! তিন বছর ধরে তো মেস্ড আপ! আর কতো? আপনি জানেন কে এবার?
স-১ ত-২, ম-১ এমনকি স-২ এর কথা ভেবে ফেলল। কিন্তু না। প-১ বলল প-২ এর কথা! স্ট্রেইঞ্জ! বলে সে লজ্জা-টজ্জা পেয়ে একদম সিনেমা বানিয়ে ফেলল। স-১ প-১ এর মুখে এই লজ্জা দেখতে চায় না, এই অযথা লজ্জা প-১ কে মানায় না, এটা তাকে অযথাই মেয়ে বানিয়ে দ্যায়। স-১ একজন সেইরকম টাইপের ফেমিনিস্ট- থিওরী না কপচিয়ে কথাই বলে না! মাগো-মা!

প-১ এর এই দাপাদাপি সত্যি কিনা স-১ বুঝতে পারে না। সে ব্যথা বোধ করে। ব্যথার প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল হলেও আমরা এখনই সেটা ফাটাবো না।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এইটা আমার দ্বিতীয় প্রেম-পতন। প্রথম পতন কার ওপর জানেন? আপনার ওপর! প-১ বলে দাঁত বের করে। খুব সম্ভব তার হাসি সুন্দর: সঙস অফ ইনোসেন্স কিনা জানি না, সঙস অফ ননসেন্সও হতে পারে!
স-১ এর মুখে দুই স্তরের কষ্টবোধ ব্যবস্থা ভেদ করে একখানা আধা খ্যাচড়া ধ্যাবড়া টাইপের হাসি বেরোয়। ইহা আমাদের কাছে গর্বের হাসি বলিয়া বোধ হয়।
প-১ আরও বলে, আমি জানতাম না আপনার মতো মানুষ হয়! আমার মনে হয়েছিল ‘ও মাই ডগ’! কিন্তু আমি জানতাম আপনি কে বা কী-
নিজের সম্পক্কে এইসব সুইট-সুইট কথা শুনতে কার না ইয়ে হয় কিন্তু পৃথিবীতে লজ্জা এবং ভদ্রতা বলে এখনও কিছু একটা আছে বলে স-১ প্রসঙ্গ পাল্টায় বলে, বেশ, ভালো কথা, এখন কী করা? সে জানে সে কী কেন, কে, অতএব... দ-১ তার মনের ভিতরে...
কিছু না, চাইপা যান। আপনাকে বলার দরকার ছিল বললাম। তারপর প-১ আবারো অযথাই দাপাদাপি করে। একটু পরে জানতে চায় স-১ এর মন খারাপ কেন? ইত্যাদি...

এর মধ্যে আরো দুইদিন গেছে। নদীদের অনেক ঘোলা জল সমুদ্রের নোনা জলের সাথে সংগম করেছে। স-১ ওদিকে প-১ এর সাথে বিট্রয় করে প-২ কে সব বলে দিয়েছে। আবার প-১ কেও বলে দিয়েছে যে সে প-২ কে বলে দিয়েছে। এর নাম সে দিয়েছে ‘বিষ থেরাপী’। বিষে বিষক্ষয়। প-২ কে সে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিতে অনুরোধ করে। প-২ আত্মগর্বের ঠেলায় বলে ফেলে, তার জীবনে এটা নতুন নয়, কত মেয়ে...ইত্যাদি। স-১ এর অস্বস্তি লাগে। স-১ এরপর প-১ কে বোঝায়-
এর মধ্যে কোনো পাপতো নেই। ভালোবাসাইতো। এন্ড দিস ইজ ইউর বেস্ট চয়েস সো ফার!
চোখ মেরে প-১ উত্তর দেয়, বেটার choice than you?
স-১ এর পাল্টা জবাব, আমি চয়েসের ঊর্ধ্বে, বৎস! ওদিকে প-২ এর মন উদ্বেল হলেও আমরা প্রচুর উদ্বেগ লক্ষ করি- আমরা সেগুলো জানি কিন্তু তা বলতে গেলে আমাদের গল্প বে-লাইনে চলে যাবে বিধায় বলছি না, মাফ করবেন!

আবার আমরা হেটেল কন্টিনেন্টাল মোড়ে ফিরি। প-২ বিজ্ঞের মতো আচরণ করে। স-২, স-৩, ত-১, ও জ-১ কে সে কিছুই বুঝতে দেয় না। তার আচরণ স্বাভাবিক এই রূপসী বাংলার মোড়ে। তার কোলে তখন শিশু শ-১।
স-২ এর প্যারা উত্তুঙ্গ পর্যায়ে। প-১ কেন স-১ সাথে এভাবে হাসিয়া হাসিয়া ফাটিয়া পড়িতেছে? ইহা তাহার সহ্য হয় না। ওথেলো সিনড্রোমে আক্রান্ত হয় সে। সে ভাবে এটা খুবই অসামাজিক।

প-১ স-১ কে হাসতে হাসতে বলে, জানেন স-২ এখন কী ভাবছে? ভাবছে আমি আপনার প্রেমে পড়েছি। স-১ ভাবে সেটা হলে কার বাবার কী এবং বলে, পড়েছিলে তো! ‘ড়’-এর ওপর বেশি জোর দিয়ে প-১ বলে, পড়েছিলাম তো। পাস্ট টেন্স। কিন্তু আমি জানি আপনি কে, কী কেন ইত্যাদি অতএব আমি এখন সেকেন্ড বেস্ট চয়েসে আছি, হি! হি!
স-১ বিশ্বাস করে প-১ এখন প-২ এর প্রেমে হাবুডুবু। শিশু কোলে প-২ও তাই বিশ্বাস করছে। সে বিশ্বাস করে স-১ তার অর্থাৎ প-২ এবং প-১ এর সম্ভাব্য প্রেম বিষয়ে সাহায্য করতে আজ এখানে ওদের সাথে। ত-১ যথারীতি ভাবছে আ-১ এর কথা আর পাশে হাঁটা স-৩ এর বিক্ষুব্ধ মনের আঁচে তার হৃদয়ে উত্তাপ।

আমরা যেহেতু চাইলে আরেকবার সবজান্তা আখ্যানকারী হতে পারি, তাই আমরা দেখে নিতে চাই প-১ এর ভিতরটা। স-১ এর জন্য তার প্রেমটা কমে তো যায়ইনি, বেড়েছে কিন্তু তার এটি আড়াল করা দরকার। কেন দরকার জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ। সে বহুত প্যাঁচালের মামলা। স-২ এর মতো আপনিও জেনে রাখুন এটা অসামাজিক। স-১ জানে সে আজ এখানে এসেছে প-১ আর প-২ এর মধ্যের উত্তাপ বাড়াতে তাহলে হয়তো প-১ কে এই পরিচিত ধ্বনিমালার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে, সে হারিয়ে যাবে না অন্য কোনো ধ্বনি বা বর্ণের হয়ে। (কেমন একটা বর্ণমালাভিত্তিক মেটাফোর মেরে দিলুম দেখেন! শুনতে ননসেন্সিকাল লাগলেও ক্যারিশমা আছে, কী বলেন?)

জাতির কাছে প্রশ্ন, তাহলে প-১ কেন বলছে সে প-২ এর প্রেমে পড়েছে?

প-২ কে প-১ এর দরকার একটি বর্ম বা ঢাল হিসেবে যাতে স-১ কোনোভাবেই তার গোপন কথা জানতে না পারে: ভালো তামাশা বটে! তাই প-১ স-১ এর সাথে সঙস অফ ইনেসেন্সের খেলা খেলছে। স-১ও সঙস অফ ইনোসেন্স খেলছে না তা কে বলবে? সে জানে সে দ-১ কে ভালোবাসে, তবু কি প বর্গেও বা বর্ণের, কিংবা ত বর্গের বা বর্ণের, অথবা ত বর্গের বা বর্ণের বা অন্য যে কোনো বর্গের বা বর্ণের কাউকে ভালোবাসলে সেটি ‘অসামাজিক’ হবে? মানব সমাজে এমনটাই হয়।

এদের মধ্যে শুধু জ-১ নিস্পৃহ আছে। এত কিছুর মধ্যে কীভাবে সে নিস্পৃহ আছে এখন পর্যন্ত আমরা সেটা বের করতে পারিনি।

যে আমি কবিতা বহন করে ঘরে ফিরে মুটে না হয়ে কবি বনে গিয়েছিলাম, সেই আমি যদি বাই চান্স স-১ বলে প্রমাণিত হয়ে যাই, তবে আমার বাকি গল্পটুকু প্রেমের- যে প্রেম মানব-বাস্তবতা একদমই বুঝতে পারে না। আমার সব গান যে আমি নিজেই জানি না।


 

তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প বেশ অনেকদিন কেটে গেলো, আমাদের আরো দেখা হলো, কিন্তু ওই স্বামী স্ত্রীর বিষয়ে আর কিছু শোনা গেলো না। জিজ্ঞেস করলাম না পাগলের গোপনকথা বিষয়ক নিজস্ব ওই নীতিবোধের কারণে। একটা কোনো সূক্ষ্ম বিষয় যেন ধরতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে ফসকে যাচ্ছে, ধরতে পারছি না

 

সেতু আমার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী
হামিম কামাল

নিজেকে বুধবারের ফকির বলে পরিচয় দেওয়া গনি নামে পাগল লোকটা তুরাগ নদের পারে আদি বট গাছটার গোড়ায় বানানো মাচার মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন।
কারো সঙ্গে কথা টথা বলেন টলেন না, নামাজ কালামেও কেউ তাকে দেখেননি কখনও। চারপাশ ভরা এতো সমাজি মানুষ রেখে গনি কথা বলেছেন আমার সঙ্গেই কেবল, দুই একটা নয়, অনেক কথা। আমাকে বলেছেন মসজিদটা তার রাত কাটানোর আশ্রয় মাত্র। বলেছেন নামাজ তার দিলে পয়দা আছে বলে নিত্য আদায় হতে থাকে, তাই আর দশজনের মতো না পরলেও আল্লাজি রাগ করেন না, যদিও এই বাক্য সবার বোঝার নয়। আরো একটা কথা বলেছিলেন বিচিত্র এই লোক। তুরাগ নদের পারের এই দেড়শো বছরের পুরনো বট গাছটার গায়ে কান ঠেকিয়ে তিনি নাকি অতীত শোনেন। বহুবার জিজ্ঞেস করেছি, ‘কী শুনলেন মিয়া, কী বলে অতীত?’ সদুত্তর পাইনি। পাগলদের লুকিয়ে রাখা কথা বেশি জানতে চাইতে নেই। কারণ পৃথিবীতে দুটো তিনটে গোপন কথাই ওদের বেঁচে থাকার সম্বল। ওসবে টান পড়লে সৌম্য পাগলা পুরো ক্ষ্যাপা রুদ্র হয়ে ওঠে। এই মানুষগুলোকে আমি ক্ষ্যাপাতে কখনও চাইনি। ছোটবেলায় পাগল দেখে সমবয়েসী ছেলেমেয়েদের পাথর ছুড়তে দেখে কষ্ট পেয়েছি। পেছন থেকে বড় বড় পাথর ছুড়ে নিষ্পাপ ফুলের মতো শিশুরা দৌড়ে পালাতো। আমি দূর থেকে ওই শিশুদের ঘৃণা করেছি। ছোটবেলা থেকেই আমি অমন, দূর থেকে ঘৃণা করা ঘরানার লোক।
পাগলরা অস্তিত্ব সংকটে ভোগে না বলে তাদের মনে কোনো দেয়াল তোলা থাকে না। দেয়ালহীনতার সুযোগ নিয়ে ওদের মনে সুট করে ঢুকে পড়ার লোভ সামলাতে পারেন না অমন মানুষও আমি দেখেছি। ওদেরও আমি ঘৃণা করি দূর থেকে।
গনি সেদিন একটা গল্প আমাকে শোনালেন, অসমাপ্ত। গল্পটার যতটুকু শোনা গেল এর ভেতর বিস্ময়কর উপাদান কিছু না থাকলেও বিভ্রান্তির উপাদান ছিল। আর ছিল আবেগের ছোঁয়াচ, কোনোক্রমেই যা সামান্য নয়। গনি বলছিলেন এটা তার নিজের গল্প নয়, এক ঘনিষ্ট বন্ধুর। ঘনিষ্ট ওই বন্ধুর নামও কাকতালীয়ভাবে গনি। গল্পটা শুনতে শুনতে যে কেউ মনে করবে যে ধরে ফেলেছে, দুই গনি আসলে একই ব্যক্তি যদিও এই অভিন্নতার খবর কথকের জানা নেই। বিধাতাময় কোনো উপায়ে নিজের স্মৃতি থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন। নিজের স্মৃতি আজ অন্য কারো স্মৃতির ছদ্মবেশে মগজে জমে আছে। তো, গল্পটা তার ওই বন্ধু গনির স্ত্রীর মৃত্যু বিষয়ক। মেয়েটার নাম সেতু। এই সুরবঙ্গের আরো অনেকের মতো পানিতে ডুবে তিনি মারা গেছেন। সাঁতার জানা এই নারী শাড়ি পরতে নাকি একটুও ভালোবাসতেন না।
গনি ভুরু উঁচিয়ে অমোঘ নিয়তি যেন বর্ণনা করছেন এমনভাবে বললেন, ‘মেয়েটা সাঁতার জানতো, কিন্তু শাড়ি পরতে একটু ভালো বাসতো না।’
সম্বন্ধহীন এই দুটো বিষয়কে এক করে বলা বিশেষ এই বাক্যটা ছিল ওই স্বামী স্ত্রী যুগলের ভ্রমণের অসমাপ্ত বিবরণের শেষ বাক্য। বুধবারের ফকির ঠিক এরপর চুপ।
বেশ অনেকদিন কেটে গেলো, আমাদের আরো দেখা হলো, কিন্তু ওই স্বামী স্ত্রীর বিষয়ে আর কিছু শোনা গেলো না। জিজ্ঞেস করলাম না পাগলের গোপনকথা বিষয়ক নিজস্ব ওই নীতিবোধের কারণে। একটা কোনো সূক্ষ্ম বিষয় যেন ধরতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে ফসকে যাচ্ছে, ধরতে পারছি না। কারো সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করবো ভেবেও পরে ছেদো কোনো রসিকতার শিকার হওয়ার ভয়ে চিন্তাটা বাদ দিলাম।
হঠাৎ মাথায় একটা ছোট উপায় যেন খেলে গেলো। গনির ভেতরকার দ্বৈততার মতো আমারও ভেতরটাকে দ্বিখণ্ড করে গল্পের স্বামীর স্থানে নিজেকে বসালাম।অদ্ভুত রহস্যের সমাধান ঘটে অবিশ্বাস্য পথে। ওই স্থানে নিজেকে বসানো মাত্র আচমকা ধরে ফেললাম অসমাপ্ত গল্পের বাকি অংশ, নিখুঁত অনুমিত।
যেন পরিষ্কার জেনে গেলাম সেতু নামে ওই নারী পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন এবং ওইদিন তার পরনে ছিল শাড়ি, আর এই শাড়ির কারণেই পায়ে পা জড়িয়ে গিয়ে সাঁতার তিনি আর পারেননি কাটতে। ঘোরালো কোনো নৌকাডুবির ঘটনায় সেতু তলিয়ে গিয়ে তলদেশের দ্বিগুণ বেগবতী স্রোতে তাল হারিয়ে প্রাকৃত শক্তির কাছে পরাজিত হন, মারা পড়েন। তার স্বামী শাড়ি ভীষণ পছন্দ করতেন। ঘটনার দিন মন রাখতেই ওই শাড়ি পরা, যে বিষয়টা গনির শেষ বাক্যে কিছুটা আক্ষেপের মতো, কিছুটা নিয়তির মতো এসেছে। মন রাখার পেছনে ছিল দীর্ঘ মান অভিমান পর্ব। হয়তো গর্ভের সন্তানকে মানুষ করা নিয়ে বা ধর্মদীক্ষা দেওয়া নিয়ে কোনো বাগবিতণ্ডা চলছিল দু’জনার। একসময় একটা সমঝোতা হয়ে এলে দু’জন খানিকটা বেড়াতে বেরোলেন। সেতুর পরনে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা রূপালি ধূসরতাঁতের শাড়ি, গনির উপহার। গনির পরনে সাদা পাঞ্জাবি, কলারের কাছে সেতুর হাতে তুলে দেওয়া নীল ফুল।
তো, রহস্য সমাধান করে এক পূর্ণিমা রাত দেখে তুরাগ নদের পারে গেলাম। তীরে শতবর্ষী বট আর বেলে মাটিতে চাঁদ নকশার ধূসর নীল সাদা ফুল। জোছনার পার্থিব এই সৌন্দর্য যেন হাতের মুঠোয়ধরতে পারা যায়। যেন খুব নরম কোমল আর আদরের। জোছনায় সামনের নদটাকে লাগছে তাঁতে টেনে রাখা রূপালি সুতোর লম্বা শাড়ির মতো। পার্থক্য শুধু এই, টানটান ওটা নয়, একটু শিথিল। জোছনায় দূরে আশুলিয়া দেখা যায়।
আশুলিয়া দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে নদীর বুকে যেখানে পলির চর জেগেছে ওসব জায়গায় ধানের চারা রুঁয়ে দিয়েছে মানুষ। বাতাসে বীজ তলায় শুইয়ে রাখা ওই পুরু মখমলের ওপর দিয়ে একটা ঢেউ যেন বয়ে চলেছে। স্বর্গ ছেঁড়া ওই দৃশ্য দিব্যি দেখতেও পাওয়া যাচ্ছে এমন চাঁদের আলো। চাঁদের এমন আলোর সঙ্গে পাগলামির যোগ আছে বলে শুনেছি। গনি ঠিক আছে কি নেই জানি না, তবে বিচিত্র এক পাগলামিতে পেয়ে বসলো আমাকে। আদি বটগাছের নিচেই কান ঠেকিয়ে অতীত শুনতে থাকা মলিন বুড়ো গনিকে পাকড়াও করে বলতে শুরু করলাম, ‘আপনার বন্ধু নয় বরং আপনিই গনি। আর সেতু আপনার স্ত্রী। তীব্র অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে নিজের ওই সত্ত্বাকে আপনি মূল থেকে আলাদা করে দিয়েছেন। আপনাকে খুশি করার জন্যে শাড়ি পরতে গিয়ে সেতু মারা গেছে ওইদিন, এটা পরিষ্কার। আর সেতু গাঁয়ের মেয়ে নয়, মফস্বলের মেয়ে। সাঁতার যা জানতো তা নদী সামাল দেয়ার মতো নয়। এরপরও একটা সম্ভাবনা হয়তো ছিল, কিন্তু আপনার জন্যে সেটুকু গেছে।
কী, সব বলে দিচ্ছি দেখে ভয় লাগছে! আমি দেখতে পাচ্ছি, মাঝনদীতে আপনাদের নৌকা উল্টে গেলো। একটা ট্রলারে যাত্রীদের তুলে দিতে চলেছিল ওই নৌকা, ট্রলারের নাম ময়ূরী। ওই ট্রলার এগিয়ে এলে কাছে ঘেঁষতে গিয়ে হঠাৎ যন্ত্র দানবের অবাক এক ধাক্কা উপস্থিত। মুহূর্তে টলমলিয়ে নৌকা গেল উল্টে। এমন যে হবে ভাবতেও পারেনি কেউ, কারণ নিত্য এই নৌকা ট্রলারে ঠেসছে, নিত্য মানুষ উঠছে নামছে এখানে। ট্রলারের ঠেলে দেয়া ভারি কত শত ঢেউয় উৎরে নিয়ত চলছে এই নৌকা, আর আজই কেন এমন হতে যাবে? তখন মনে এসব ভেবে তো লাভ নেই, যা হওয়ার হয়েছে। নৌকা উল্টে গেছে। আপনি সাঁতরে তীরে এসে উঠলেন, সেতু পারলেন না। কাপুরুষ!’
একটানে অনেকটুকু বলে আমি থামি। ক্ষণে ক্ষণে পরীক্ষা করি গনির মুখ। রুক্ষ ওই মুখটা জোছনায় কোমল মনে হয়। থুতনির কাছে জমে থাকা পাটের আঁশের দাড়িগুলোকে মনে হয় ডিকেন্সসদৃশ, মনে হয় রেশমের তৈরি, আলগা। ধরলেই বুঝি খুলে চলে আসবে। গনি কথাগুলো শুনতে শুনতে বাইরে বিছানো তাঁতের রূপালি শাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন।স্থির চোখজোড়ায় চোখ রেখে যেন সম্মোহিত শিকারের বুকে ঠাণ্ডা মাথায় শেষবার ছোরা গাঁথছি, এমনভাবে বললাম- সেতু অন্তঃসত্ত্বা ছিল।
স্তব্ধতা।
‘এই কি সেই নদী?’
‘এই সেই নদী।’
‘আজই কি সেই দিন?’
‘আজই সেই দিন।’
বাতাসে বটপাতা কাঁপা আর এর- ওর সঙ্গে ঘষে যাওয়ার মিহি শব্দ আসছে। অষ্টাশির পর বন্যা থেকে বাঁচতে তুরাগের পার বেঁধে দেওয়া হয় যে বাঁধে, এর ওপর দিয়ে সশব্দে চলে যাচ্ছে একের পর এক দ্রুতগামী ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি। ব্যক্তিগত এক গাড়ির হর্নের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগে রেশটা ধরে গনি বললেন, ‘বাসায়!’
তার বাসা বলতে নদীর তীরে বটের ছায়ায় জলের ওপর গড়ামাচা মসজিদটার বারান্দা। ওখানে পাতা চটের ওপর ভাঁজ করা আরো চট বিছিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করে নিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে নড়বড়ে সিঁড়ি বাওয়া প্রৌঢ় দেহটা এর কালো অবয়ব নিয়ে বারান্দায় অদৃশ্য হলো। শুয়ে পড়েছে। একবার তাকে মুক্তি দেওয়া উচিৎ বলে মনে হলেও আরবার মনে হলো, জোছনা আমাকে আজ উন্মাদ যখন করেছে, এই মুহূর্তটাকে আরো দীর্ঘায়িত করে তোলা যাক। মসজিদের সিড়ি ভেঙে বারান্দার প্রবেশপথে ঝুঁকে হিসহিসিয়ে উঠলাম, ‘সুতরাং আপনি খুনি!’
পরদিন সকালে তুরাগের পারে আবার এসে লোকটা কপালে হাত রেখে দেখি বেশ জ্বর। অনবরত বকে চলেছে, ‘আহা, কী ভালো যে বাসতাম বউটাকে! কী আদুরে যে ছিল! আমার ভেতর ওর বাপের ছায়া দেখে নাকি প্রেমে পড়েছিল। নয়তো কাছেও আসতো না ভালোও বাসতো না। আমাকে দেখি ছায়া পেয়ে বসে, শুধু ছায়াই পেয়ে বসে, কায়া না। আমি কি আর মানুষ? আমি তো আস্ত এক ছায়া, বেহায়া বেলাজ এক ছায়া শুধু আমি। হায়, আমি একটা ছায়া। আমার বউ শাড়ি পরতে চাইতো না, মিঠা করে বলতাম, বাঙালি মেয়ের জন্য বেহেশত থেকে পাঠানো হয়েছে এই উপহারে তোর হেলা? ওই দিন, ওই দিন আমার মন রাখতে গিয়েই তো রূপালি শাড়িটা পরেছে, আর নৌকা উল্টে মরেছে। আচ্ছা, এই এক নদী কতবার পেরোলাম দুজনে, কখনো উল্টে নাই। আর দেখো, কী কারবার, কোনোদিন তার পরনে শাড়িও তো ছিল না পেরোনোর সময়, সেদিনই ছিল! আল্লার হুকুম...’
পরের রাতে আবার মসজিদের ওই বারান্দায় গেলাম। একটা যুবসংঘের সাইনবোর্ড কাত হয়ে পড়ে আছে যা আগে দেখিনি। লোকটার শিয়রে বসে আরেকজন লোক উবু হয়ে তাকিয়ে আছে বুধবারের ফকিরের ঘামে ভেজা মুখটার দিকে। পায়ের শব্দে তাকিয়ে আমায় দেখে বললেন, ‘আমি মসজিদের খাদেম। আপনি কি ওনার পরিচিত? ইনি কিছুক্ষণ পর মারা যাবেন।’ এরপর থেমে থেমে বললেন, ‘আমার আব্বাজির মতো চলছে ওনার শ্বাস-প্রশ্বাস। আব্বাজি‘আল্লা’ বলে শ্বাস টানেন আর ছাড়ার সময় বলেন ‘হু’। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ একবার ‘আল্লা’ বলে থেমে গেলেন। আমরা সমস্ত ভাইবোন আল্লা আল্লা করতে করতে শ্বাস বন্ধ করে আব্বাজির দিকে তাকিয়ে থাকলাম, কখন ‘হু’ বলবেন। আর বলেন নাই।’
আরো উবু তাকালেন খাদেম ঘামে ভেজা মুখটার দিকে। যেন ঝুঁকে মমতায় জড়িয়ে ধরতে চান হেলা করা এই মানুষটাকে। অথকা কোনো বার্তা পৌঁছে দিতে চান, কারণ এই লোকটা কিছুক্ষণের মধ্যেই তার আব্বাজির কাছে চলেছে। আমি চটি খুলে এগিয়ে এসে শুয়ে থাকা বৃদ্ধের কানে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, ‘আপনি গনি নন। সবাই বেঁচে আছে। কেউ মরে নাই। আপনি খুনি নন।’
চাঁদের আলোয় লোকটার কপালে মৃত্যুর বিন্দু ঘাম ঝিকমিক করছে। কাঁপা গলায় বললেন, ‘তাই তো! আমি তো গনির বন্ধু। কিন্তু এই গনিটা কে, আর সেতুই বা কে!’
‘ধরুন গনি আমি নিজে। আর সেতু আমার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী।’


 

তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প শুক্রবার বাদ জুম্মায় গাভীটিকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার খবর মুসলমান পাড়া ঘুরে ঘুরে হিন্দু পাড়াগুলোতে আছড়ে পিছড়ে পড়েছে। চারিদিকের এক বায়ুভারি দৃশ্য মানুষের চোখে চোখে। হিন্দুপাড়ার লোকেরা এই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও মুসলমান পাড়ার কোন বিষয়ে নাক বাড়িয়ে দেওয়ার এখতিয়ার রাখে না

 

সফেদা বাগানের গাভি
মোস্তাফিজ কারিগর

বাম হাতে বেও ধরে পায়ের সাথে লাইলনের চিকন সোনালি সুতো জাপটে ডান হাত দিয়ে কুরচি ঠেলে ঠেলে বুনে যাচ্ছে জাল, মকসেদ মোল্লার কাছে শমসেরকে নিয়ে করা সকল নালিশ আজকের এই হাটবারের ব্যস্ত মানুষের হল্লার ভেতর হারিয়ে যাক বা না যাক, এক আঠালো মগ্নতার ভেতর ডুতে গিয়ে এই যে নিবিষ্ঠতায় জাল বুনে যেতে যেতে ময়িনুল্লার যেনো কোন ভূক্ষেপই নেই গ্রামের বিশেষজনদের ডেকে দ্বিতীয়বারের মতো বসানো সালিশি মজলিসে। যদিও প্রথমবার অনানুষ্ঠানিকভাবে পাড়া-প্রতিবেশীদের আয়োজন করা সালিশিতে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করে একটা সমাধান করা গিয়েছিল, কিন্তু পাড়ার আলেম-মৌলভীরা এই রায়ে কিছুতেই সম্মতি দিতে চাইলো না। তাদের একটাই কথা- বুঝলাম বাপু, ময়িনুল্লার গাভি গরুটারে রাতের অন্ধকারে শমসের নষ্ট করিল, মানে গরুর সাথে সহবাস করিল। এই অপরাধে শমসেরের না হয় পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করিল লোকজন। কিন্তু এই গাভীটার কি হবি। এই গাভী তো নাপাক হয়ে গেলো। একটা মানুষ মানে ইনসান না হয় সুযোগ পায়ি রাত্রির বেলা গরুর সাথে সেক্স তত্তবা সহবাস করিল, তা গাভিটা কী বলদ- সে হাম্বা হাম্বা করি ডাকি উঠিল না ক্যান। মানুষ মানে ইনসান দ্বারা নষ্ঠ হইলো এই গাভি, এখন সে নাপাক। এই গাভির গোসতো তো আর খাওয়া যাবেন না। এই গাভিরও শাস্তি হওয়া দরকার। ফলে পাড়া-প্রতিবেশীদের এই সালিশি রায় ভেস্তে গিয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে তৈরি হলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জোট। এক এক জোটের এক এক ফতোয়া। দিনের পর দিন চলতে থাকলো। এ দোকানে, ও দোকানে, ওমুকের দাওয়াই নানা রকম আলাপ-আলোচনার বিষাক্ত জালের ভেতরে আটকে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকলো ময়িনুল্লার। আগামি আশ্বিন মাসে ধার্য হয়ে থাকা বড় মেয়ে রফিকুন্নাহারের বিয়ের তারিখ ক্রমশ নিকটতর হয়ে এলো। এই গাভি গরুটা বিক্রি করেই রফিকুন্নাহারে বিয়ের খরচ জোগাবে বলে বাজারের দোকান থেকে ধারদেনা করে ভূষি-খৈল খাইয়ে গাভিটার স্বাস্থ্য বৃদ্ধি করার সমস্ত চেষ্টাই করে চলছিল ময়িনুল্লাহ। কিন্তু কী একটা ফ্যাসাদে আটকে গাভিটা বিক্রির জন্য কোন খরিদদার খোঁজার অগ্রগতিই করতে পারছিলো না সে। শেষমেশ পাড়া-প্রতিবেশী, মহিলা মেম্বর, কাউন্সিলর, ওমুক-তমুক করতে করতে সালিশের দায়িত্ব গিয়ে পড়লো ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মকসেদ মোল্লার উপর। সতীঘাটা হয়ে একটা ছাল-বাকলা ওঠা পিচের রাস্তা মরা মুক্তেশ্বরীর বুকের উপর দিয়ে উঠে এসে ঢাকুরিয়াকে ভায়া করে হরিদাসকাটি হয়ে সুন্দলীর দিকে যেইখানে মোড় নিয়েছে, ঠিক তার চাঁদির উপরই পুরানো মেহগুনি কাঠের পাল্লা-দরজাওয়ালা একটা আধাপাকা ঘরেই বিকালে বসেন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মকসেদ মোল্লা। ইউনিয়ন পরিষদের ভবনটা বাজারের পেছনে হলেও এই ঘরটিতে বসার কারণে মকসেদ মোল্লার পৈত্রিক হোমিওপ্যাথি চর্চাটা ধারাবাহিক রয়েছে কিছুটা, যদিও তার ওষুধে কারো রোগ-বালাই দূর হয়েছে বলে গ্রামের মানুষের তেমন ধারণা নেই। রোগ ভাল হোক বা না হোক মকসেদ মোল্লার এই ঘরটিতে রুটিন বেধে কিছু মানুষতো প্রতিদিনই আসে। আজও আর সকলের মতোই পাশের গায়ের হরেন মণ্ডল তার আজন্ম কাশিকে প্রচার করতে করতে এসে কাঠের বেঞ্চে বসেছে। পাশের গাঁ বলতে গোবিন্দপুর। হিন্দু গ্রাম। এই ছিয়ানব্বই গ্রামের মধ্যে সবই তো হিন্দু গ্রাম, তার ভেতরে দ্বীপের মত জেগে থাকা এই ঢাকুরিয়াই হল মুসলমানপাড়া। হিন্দুপাড়ার লোকেরা তেমন আসে না এই বাজারে। হরেন মণ্ডলের মতো দুই একজন যা দেখা যায় তাও একদম ঘাটের মরা যারা। ধুতিটা ঠ্যাঙের উপরে তুলে তেলচিটে এক পাঞ্জাবি পড়ে বিড় বিড় করতে করতে এসে এ দোকানে, ও দোকানে বসে। যে দু’একজন আসে, তাদের আবার কিছু বাধা জায়গা আছে, সেখানেই প্রতিদিন বসে। আব্বাসের চায়ের দোকানে বসে তো কেউ, কেউ বসে একরামুলের চায়ের দোকানে। হরেন মণ্ডলের জন্য বাধা এই মকসেদ মোল্লার হোমিওপ্যাথি চেম্বার। তো প্রতিদিন আঠালোর মতো বসে থেকে থেকে কোনো কাজ হয়নি, কেন না মকসেদ মোল্লার হোমিওপ্যাথির ডোজ হরেন মণ্ডলের কাশির সাথে এক ধরনের প্রেমে জড়িয়ে গেছে। তাই হরেন মণ্ডল মানেই কাশি। অন্যদিন এই কাশিতে কারো কোন ক্ষতি হোক বা না হোক আজ এই সালিশি মজলিসে হরেন মণ্ডলের কাশি নছিমনের ইঞ্জিনের শব্দের চেয়েও বিরক্ত লাগছে সবার। আজ আবার তার এই কাশির সাথে যোগ হয়েছে- রাম রাম রাম, এই নামকীর্তন। যখন বলা হচ্ছে শমসের গরুর সাথে সহবাস করিল তখনই, রাম রাম রাম বলে বিষাদগার করছে হরেন মণ্ডল।এতে মুসলমানরা বেশ ইতি উতি করছে। হরেন মণ্ডল যেমন রাম রাম করছে তেমনি নাউজবিল্লাহ বলার লোকও এই মজলিসে যথেষ্ঠ। বরং তা গলা মিলিয়ে উচ্চকিত হচ্ছে। একবার উচ্চস্বরে নাউজবিল্লাহ বলে মকসেদ মোল্লা শমসেরকে বলল- আচ্ছা, তুই বল, ঘটনা কী ঘটিল। বেঞ্চের পায়ার সাথে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকা শমসের মাত্রই মাথা উঠিয়ে কথা বলার প্রস্তুতি নিতে না নিতেই তাকে দাবিয়ে দিয়ে মসজিদের পেশ ইমাম রহিমুদ্দিন বলে উঠলো- চেয়ারম্যান সাহেব, যা শুনার আমরা তা শুনিলাম, এখন বিচারটা করে দেন, ঝামেলা শেষ। ইমাম সাহেবের কথার একটা গুরুত্ব তো চেয়ারম্যান সাহেবকে দিতেই হয়, তবুও চেয়ারম্যান হিসাবে তার কিছু কাজ থাকে। তখন ময়িনুল্লাহকে বলল- তোমার কিছু বলার আছে। শমসের যে গরুটারে নষ্ট করিল তুমি দেখলে কিরাম। ময়িনুল্লার মুখে কোন কথা নেই, কুরচি ঠেলে ঠেলে জাল বুনে চলেছে, নির্লিপ্ত সে। বাজারে কোলাহল থাকলেও এই ঘরটার ভিতর একটু নীড়বতা চলছে এখন। হঠাৎ আয়ানউল্লাহ, মানে মুয়িনুল্লার ছোট ছেলে চেয়ারম্যান সাহেবের মুখের দিখে একটা তীব্রতায় তাকিয়ে বলতে শুরু করে- শোনেন চেয়ারম্যান কাকা, আমি রাত্রির বেলা মুততি উঠিলাম। রাত তো মেলাখানেক হবিই। এই একটা কি দুটো। আমি গোয়ালের পেছনে দাড়া মুততি ছিলাম, হঠাৎ শুনি গোয়ালের মধ্যে একটা মানুষ হাপাচ্ছে। আমি ভাবতিলাম চোর হবি। তাই পা টিপি গোয়ালের ভিতরে যেই না ঢুকিলাম, ও আল্লা দেখি শমসের কাকা ন্যাঙটা হয়ে গরুর পাছার কাছে দাড়ায়ে গুতাগুতি করতিলো। ভাবিলাম একি! আমি তারে ঝাপটে ধরতিই আমারে একটা গুতো মারে দৌড় দিয়ে পালাইলো।
মকসেদ মোল্লার ঘরের মধ্যে কম বেশি ভালই ঝুলকালি জমে আছে। টিকটিকিগুলো বেশ স্বাস্থ্য পেয়েছে ঝুলকালি অভয়ারণ্যে। দেয়ালে দুটো টিকটিকি একটা আর একটার গায়ের উপর উঠে শুয়ে আছে। শমসের সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিলো তা কেবল সেই জানে। ময়িনুল্লার হাতে খুরচি চলছেই, একটু একটু করে বেড়ে চলেছে জালের ফোঁড়। ময়িনুল্লা হয়তো ভাবছে এবার বিলে খুব মাছ হবে। বর্ষা তো ভালই হয়েছে। চারিদিকে থই থই জল। মকসেদ মোল্লা খেকিয়ে উঠল- বালের জাল বুনি যাচ্ছে। জাল দিয়ে পাছার ভিতর খ্যাপ মারবা। মাছ কই যে জাল বুনতিছো। মাছের দিন শেষ। ময়িনুল্লা মাথা তুলে তাকালো। দু’এক পলক চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে মজলিসে সবার দিকে একবার চোখ ঘুড়িয়ে আবার জাল বুনতে থাকলো। শমসের হয়তো ভাবছে সত্যিই তো জাল যে বুনছি, মাছ কই। কোথায় জাল ফেলবো। বিল এখন ভাগ ভাগ। মসলিন শাড়ির মত স্বচ্ছ নেট দিয়ে ঘেরা ঘের। বিলের জমি বর্ষাকালে কারো একার ছিল না। বিল তখন সবার। মাছ ধরো, শাপলা তোলো, উন্মুক্ত সব। সাতক্ষীরা, যশোর থেকে ব্যবসায়িকরা এসে বিঘা প্রতি বছরে বিশ হাজার টাকা করে দিয়ে বিঘার পর বিঘা গড়ে তুলছে ঘের। গায়ে গতরে খেটে, চারা সার কিনে বছরে দুই বার ধান তুললেও বিঘা প্রতি বছরে ১০-১২ হাজার টাকা ঘরে তোলা অভাবনীয় হয়ে গেছে। সেখানে কোন বিনিয়োগ, মজুরি বাদেই ঘরে বসে ২০ হাজার টাকা আসবে এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়।
দেয়ালে জড়াজরি করতে করতে ঝপ করে দুইটো টিকটিকি আছাড় খেয়ে পড়লো মকসেদ মোল্লার টেবিলের উপর। পরে চুপ করে আছে। মুখে কিছু শব্দ করে তাড়ানোর চেষ্টা করে মকসেদ মোল্লা অপারগ হলে টেবিলের উপরে থাকা টর্চলাইটের পেছনের অংশ দিয়ে গোতা দিলে একটা টিকটিকির লেজ কেটে পড়ে টেবিলের উপরে লাফাতে থাকলো আর শরীর নিয়ে টিকটিকি দু’টো নিজেদের মতো করে হারিয়ে গেলো হোমিওপ্যাথির শিশি সাজানো আলমারিটার পেছনে। একটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আলমারির দিকে মুহূর্ত কয়েক তাকিয়ে থেকে চেয়ারম্যান সাহেব পেশ ইমাম রহিমুদ্দিনকেই ন্যস্ত করলেন মাসালা দেওয়ার জন্যে। বললেন- আমরা মুসলমান, কোরান হাদিস বিশ্বাস করি। কে কি বলিল, কি করিলো এসব আমাদের দেখার বিষয় না। ইমাম সাহেব ধর্মের আলোকে যা বলবেন সেটাই শেষ রায়। ইমাম সাহেব মাথার টুপিটা খুলে একটা ফু দিয়ে আবার মাথায় দিতে দিতে বললেন- কোনো অবলা জীবকে যদি মানুষ নষ্ট করে; মানে অবেলা জীবের সাথে সহবাস করে তাইলে ঐ অবলা জীব নাপাক হয়া যায়, তখন তার মাংস আর খাওয়া যায় না। এই গরুটাকে এখন মেরে ফেলতি হবি। এই নাপাক গরুকে এই গ্রামে বাঁচিয়ে রাখলে বিভিন্ন গজব নাজিল হবি। ইমামের এই কথায় কিছু নামাজি মুসল্লি বলল- ইমাম সাহেব, গরুটাকে না মেরে জবাই করে ছিন্নি করে দিলিও তো হয়- গরীব-দুঃখী মানুষেরা সারা বছর গোসতো খাতি পারে না, একটু খায়িল আর কি। আর এক দল মানুষ ভাগ হয়ে বলল- ইমাম সাহেব যখন বলিল, এই গরু নাপাক মানে এর গোসতোও নাপাক, এই গোসতো খাইলে পড়ে বালাই হতি পারে। চেয়ারম্যান সাহেব তখন সবাইকে থামিয়ে দিয়ে ময়িনুল্লাহর দিকে তাকালো, ময়িনুল্লাহ জাল বুনে যাচ্ছে। শমসেরের দিকে তাকালো, শমসের হা করে তাকালো চেয়ারম্যানের দিকে। চেয়ারম্যান মুখটা খচ্চরের মতো করে দাঁত খিচিয়ে বললো- তাইলে এই শুয়োর বাচ্চার বিচার কি হবি ইমাম সাহেব। একটা জানোয়ার, গ্রামে এতো মেয়ে মানুষ থাকতি তোর গরুর সাথে লাগানো লাগলো। বৌটা মুসলমানের জাত মারি হরি চাড়ালের ল্যাওড়া নিতি দিন-দুপুরে পালায় গেলো বলে তোর কী মানুষ-গরু বাছ-বিচার নাই। কত করে মুরব্বিরা কইলো আবার বিয়ে করতি, শালা জানোয়ার, তাও করিল না। নাউজবিল্লাহ, নাউজবিল্লাহ রব উঠে গেলো ঘরটায়। ইমাম সাহেব শেষমেশ বললো- চেয়ারম্যান সাহেব শরীয়তে আছে- কোন প্রাণীর অপমৃত্যু হলে তাকে খাড়া করে কবর দিতি হবি। যেহেতু এই গরুটাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, মানে একটা অপমৃত্যু। আমাদের গায়ের শরীয়ত পন্থীদের অনুযায়ী কবর খুঁড়ে খাড়া করে এই গরুটাকে কবর দিতি হবি। আর শমসের যেহেতু গরুর সাথে জেনা করিল তার একটা জরিপানা হবি, ৫০০০ টাকা।
টাকার কথা উঠলে এবার আলোচনাটা এক নতুন পেক্ষাপটে গিয়ে দাড়ালো। তাইলে এই যে ৫০০০ টাকা জরিপানা তা কে পাবে, এই রায় দেয়ার দায়িত্ব ইমাম সাহেবের উপর পড়লে জরিপানার এই টাকার বিষয়ে যে মাসলা দাঁড়ালো শেষমেশ সেটাও ময়িনুল্লাহর জন্যে কোন সুসংবাদ হলো না। ইমাম সাহেবের মতে এই টাকার দু’টো ভাগ হবে, যার অর্ধেক যাবে মসজিদের কোষাগারে, আর যেহেতু এতোদিন ধরে গাভীটাকে খাইয়ে দাইয়ে পুষেছে ময়িনুল্লাহ, বাকি অর্ধেক টাকা পাবে সে। এবার অনেকক্ষণ পর হাত থেকে খুরচি থামিয়ে ময়িনুল্লাহ মুখ তুলল। কাচের মার্বেলের মত চকচকচ করছে তার দু’চোখের মণি। মাথার উসকো খুসকো চুল ফ্যানের বাতাসে এলোচ্ছে-দুলোচ্ছে। বাইনোকুলার দিয়ে সমুদ্রের ভেতরে তাকিয়ে অদূরে দস্যুদের জাহাজ দেখার মত একটা ভঙ্গি করে ময়িনুল্লা মজলিসের সকলের দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো। তারপর অলস মুদ্রায় বাম পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ডান হাত দিয়ে থাপড়ে থাপড়ে লুঙ্গির সাথে লেগে থাকা ধুুলো ঝেড়ে নিলো। এক দু’পা করে মকসেদ মোল্লার হোমিওপ্যাথি ডিসপেন্সারির ভেতর থেকে বেড়িয়ে বাড়ির দিকে হাটতে থাকলো। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত আটটা-নটা। আয়ানউল্লা বাপের পেছন ধরে হাঁটছে। পাঁকা রাস্তা থেকে নেমে দিগঙ্গার ব্রীজের উপর যখন উঠলো তখন আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো, মেঘ ডেকে উঠলো। আব্বা, তুমি কিছু করিলে না, শালার শরীয়তের গুষ্টিমারি। একটা নগণ্য খিস্থি এলো আয়ানউল্লাহ মুখে। ময়িনুল্লার পা চলছে খুব ধীরে ধীরে। এতোক্ষণ কোনো কথাই বলিনি সে। আয়ানউল্লার কথায় সে কি বলবে তা ঠিক করে ভাববার আগেই বাপ বেটা পৌঁছে গেলো বাড়ির উঠোনে। উঠোনের পশ্চিম কোনে বিরাট সফেদা গাছ। অনেক সবেদা পেকেছে। পাকা সবেদার ঘ্রাণ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। সবেদা গাছটাকে সংলগ্ন করেই বাঁশ চাটাই দিয়ে ঘিরে তৈরি করা গোয়াল ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে গাভীটি। সবেদার ঘ্রাণ নিতে নিতে ময়িনুল্লাহ গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো গোয়াল ঘরের খুঁটির সাথে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণ পড়ে হাটু মুরে বসে পড়লো। সামনে নির্লিপ্ত হয়ে একটা নিরীহ কলাগাছের মত দাঁড়িয়ে থাকা আয়ানউল্লার দিকে তাকিয়ে বললো- ময়মুরব্বি, ইমাম সাহেব যা মাসালা দিলেন তাই। আল্লার মাল আল্লা-অলিরা যা ভাল মনে করলেন তাই করিল। সমাজ-শরীয়তের বাইরে চললি তো গ্রামে থাকা যাবেন না।
শুক্রবার বাদ জুম্মায় গাভীটিকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার খবর মুসলমান পাড়া ঘুরে ঘুরে হিন্দু পাড়াগুলোতে আছড়ে পিছড়ে পড়েছে। চারিদিকের এক বায়ুভারি দৃশ্য মানুষের চোখে চোখে। হিন্দুপাড়ার লোকেরা এই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও মুসলমান পাড়ার কোন বিষয়ে নাক বাড়িয়ে দেওয়ার এখতিয়ার রাখে না। এলাকার হিন্দুরা যতটা কট্টর, মুসলমানরাও তাদের ধর্মীয় অনুশাসনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেড়েছে। শুধু ধর্মীয় অনুশাসন সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। অন্ধ ধর্মীয় রাজনীতিতে উগ্র হয়ে ওঠে এই মুসলমান পাড়ার মানুষেরা। একাত্তরের যুদ্ধোপরাধীর বিচারে বড় বড় আলেম-মাওলানাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হতে থাকলে সারাদেশে যে জঙ্গী হামলা, বোমা বাজি, মন্দির ভাঙ্গার তাণ্ডব শুরু হয় তার সম্পূর্ণ আচ পায় ঢাকুরিয়ার মুসলমানরাও। গ্রামের মেঠো পথের ভেতরে গাছের ডাল কেটে রাস্তা অবরোধ করে রাখা শুরু করে। সামান্য বাইসাইকেলও চলা বন্ধ করে দেওয়ার মহড়া চলতে চলতে এক গভীর রাতে মুসলমান পাড়ার কোনায় ঢুকে পড়া এক হিন্দুবাড়িতে বয়স্ক মা-সহ চৌদ্দ বছরের মেয়ে ধর্ষণের খবর পরেরদিন সকল টেলিভিশন চ্যানেলে প্রকাশ হলে প্রাণের ভয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে উধাও হয়ে যায় হিন্দু পরিবারটি। সাতচল্লিশের আগেও এই ছিয়ানব্বই গ্রামে মুসলমানদের লতিকা প্রাণই পাইনি। দেশ ভাগ হলে সারাদেশেই হিন্দুবাদীরা ক্রমশ লীন হতে থাকলে এই ছিয়ানব্বই গ্রামেও ধীরে ধীরে মুসলমানরা একটু একটু করে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। শোনা যায় এই ছিয়ানব্বই গ্রামে প্রথম আস্তানা গাড়ে শাহ মানদার ফকির নামে এক দরবেশ। সেই কত কত বছর আগে চারপাশে যখন থই থই বিল, সেই বিলের মাঝে ছোট একটু উঁচু জায়গার কোথা থেকে এসে বসেছিল শাহ মানদার ফকির তা এলাকায় মানুষ তো কখনোই জানতে পারিনি, বরং ফাঁকা বিলের ভেতর একটু খানি উঁচু জায়গার হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা একটা বিরাট বটগাছ চারপাশের মানুষকে ভাবাতে সাহায্য করে যে- শাহ মানদার ফকির কোন সামান্য লোক নয়। সারাদিন আহারহীন, গোসলহীন, প্রক্ষালন ব্যতীত বটগাছের নিচে নিশ্চুপ বুদ্ধমূর্তির মতো বসে থাকা শাহ মানদার ফকিরের কাছে তালগাছের ডিঙ্গায় চড়ে গ্রামের নারী-পুরুষ আসতে থাকে বিভিন্ন মানত নিয়ে। বিচিত্র রোগে-শোকে শাহ মানদার ফকিরের ফু আর পড়াপানিতে মানুষের আস্থা জমতে থাকলে এই ছিয়ানব্বই গ্রাম বাদেও দূর দূর সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর থেকে মুসলমানরাও আসতে থাকে তাদের নানা বিপদ-আপাদের থেকে মুক্তি পেতে। গ্রীষ্মকাল এলে বিলের ভেতর থেকে মাটি তুলে একটা সরু সড়কের যোগসূত্র হতে থাকে গ্রামের প্রধান সড়কগুলোর সাথে। একজন দু’জন করে মুসলমানরা সহায়হীন হিন্দু পরিবারের থেকে জমি কিনতে সক্ষম হতে থাকলে ধীরে ধীরে মুসলমান পাড়ার গুটি কয় ঘরবাড়ির উনুনের ধোয়া মুসলমানপাড়ার সীমানা ক্রমশ বর্ধিত করতে থাকে। শাহ মানদার ফকিরের আস্তানাস্থ উঁচু জায়গাটি একটা ছোট মসজিদ স্থাপনের বাহাদুরিও দেখাতে পারে মুসলমানরা। মুসলমানপাড়ার লোকেরা শাহ মানদারকে মসজিদের ভেতরেই থাকবার জন্য অনুরোধ করলে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানানোর পর থেকে মৃত্যু ঝড়-বৃষ্টি-রোদ্দুরের ভেতরে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস সে পৃথিবীর জন্য রেখে যায়। শাহ মানদারে অবর্তমানে এই বটগাছটির বিভিন্ন ডালে, ডাল থেকে নেমে আসার বটের ঝুড়ির সাথে লাল রঙের ফিতার সাথে ইটের টুকরো বা পাথর বেঁধে দিয়ে মানত করার রীতি প্রতিষ্টিত হতে থাকে। হিন্দু মহিলারা কপালের সিঁদুর গাছের শেকড়ে ঘষে ঘষে মনের বাসনা পুরনের সাক্ষী রেখে যায়। জায়গাটি পরিচিতি পেতে থাকে। কোন কোন গৃহস্থ বৌ তার মনের বাসনা পূরণ হবে ভেবে এখানে একটা দুটো করে তুলসী গাছ রোপন করতে থাকে। শাহ মানদার ফকির মারা যাওয়ার পর আস্তে আস্তে মুসলমানরা এখানে আসা কমিয়ে দিতে থাকে। শরীয়াতে গাছকে পূজো করা বা কোন জড় বস্তুর কাছে কৃপা প্রার্থনা করা শেরেকি বলে ঐ বটগাছের সাথে ইটের টুকরো বেধে মানত করা থেকে দূরে সরে যায় মুসলমানরা। এক সময় শাহ মানদার তলার মসজিদটিও ভেঙে গড়ে উঠে মন্দির। বাসন্তী পূজোর ঢাকের শব্দ দিনে দিনে শাহ মানদারতলা নামটিকে রূপান্তরিত করে বিশ্বমিত্রের তপোবিঘ্নার্থ প্রেরিতা মেনকার গর্ভে বিশ্বমিত্রের ঔরসে জন্ম নেওয়া কন্যা; যাকে মা মেনকা মনিনী নদীর তীরে পরিত্যাগ করে চলে গেলে, বনের পাখিকূল কন্যাশিশুকে রক্ষা করার পর কন্বমুনি কন্যারূপে পালন করে শকুন্তলা নামে বড় করতে থাকে, সেই শকুন্তলার সাথে সাযুজ্য রেখে শাহ মানদারতলা রূপায়িত হয়- শামন্তলা নামে। শাহ মানদারতলা শামন্তলা হয়ে গেলে জায়গাটি মুসলমান পাড়ার মানুষের কাছে ভৌতিক জায়গা রূপে ভাবান্তরিত হতে থাকে। শাহ মানদার ফকির যেহেতু ওখানকার বটগাছটির নিচেই রাতের বেলা মরে পড়ে ছিল আর তার দাফন হয় এখানেই শানবাঁধানো পুকুরটির পশ্চিম মাথায়। পড়ে নাকি হাজিরহাট বা মনিরামপুর থেকে হাটবারে বাজার শেষ করে মাঝরাতে বাড়ি ফেরা কত মানুষের সাথে দেখা হয়েছে শাহ মানদার ফকিরের। শাহ মানদার ফকির পুকুরের পশ্চিম মাথার কবর থেকে উঠে এসে বটগাছের নিচে বসে থাকে। শাহ মানদার ফকির বেঁচে থাকতে কখনো মানুষের সাথে কথা বলেনি। সেই লোক নাকি কাউকে কাউকে সালামও দিয়েছে। যারা একটু সাহসী তারা ঠিক ঠিক বাড়িতে ফিরলেও ভয় কাতুরে অনেককেই অজ্ঞান হয়ে সকাল বেলা পর্যন্ত পড়ে থাকতে দেখা গেছে শামন্তলায়।
হিন্দুপাড়ার মানুষদের কাছে গো-দেবতার প্রতি এমন অবিচার আলোচনা মুখর হলেও পাড়ার ছেলে-বুড়োদের কাছে ব্যাপারটা কৌতূহলী হয়ে উঠে। একটা গরুকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে। সেই দৃশ্য দেখার জন্য পাড়ার ছেলে-বুড়ো-মহিলা একে ঘিরে ধরে ময়িনুল্লাহর বাড়ির উঠান। একটা ফিফটি মটর সাইকেলের পেছনে পেশ ইমাম রহিমুদ্দিনকে নিয়ে বিকট শব্দ আর ডিজেলের পোড়া গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে চেয়ারম্যান মকসেদ মোল্লাও এসে হাজির হয় ময়িনুল্লাহর বাড়ির উঠোনে। ফিফটি মটর সাইকেলের শব্দ প্রশমিত হতে থাকলে ময়িনুল্লাহর দোচালা টিনের ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসে কান্নার স্বর- কতদিন নিজের হাতে বিছালি কেটে ভাতের মাড় খাইয়ে দিয়েছে ময়িনুল্লাহর বৌ আসমাতারা। আজ নিমর্মভাবে সেই গাভীটির মৃত্যুর আয়োজনের সাথে প্রকটভাবে জড়িয়ে পড়েছে মেয়ের বিয়ের খরচের টাকা- যা তাদের অর্থ যোগানের একমাত্র সহায় হয়ে ছিল। বাড়ি ভর্তি মানুষের কোলাহল আর কানাঘুষাকে থামিয়ে দিয়ে মকসেদ মোল্লা ময়িনুল্লাহকে ডেকে বললেন- শোন ময়িনুল্লাহ, শরীয়তের বিধান অনুযায়ী মৌলবি সাহেব যে রায় দিয়েলো, আমরা তার বাইরে যাইতে পারিলাম না। চিন্তা করো না, এতে তোমার মঙ্গলই হবি। নাপাক জিনিস বাড়িত রাখতি নাই। আল্লাহর মাল আল্লাহ কাছে ছাড়ি দাও। মুখের খোঁচা খোঁচা অবাধ্য দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে ময়িনুল্লাহ বললো- চেয়ারম্যান সাহেব, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন। গরুটাকে যেখানে সেখানে কবর দিয়েন না। শেয়াল কুকুরে ছিড়ে খাবি। আমার উঠোনোর পশ্চিমে ঐ সফেদা বাগানের ভিতরে যদি আপনারা কাজটা সাড়েন তালি ভালো হয়। নিজের পোষা জিনিস, আমি একটু দেখে শুনে রাখতি পারিলাম। শিয়েল-কুকুরের হাত থেকে ...।
গ্রামে এখানে ওখানে কত অকেজো জায়গা পড়ে থাকে, সেইসব জায়গায় এই নাপাক গরুটির কবরের কথা না ভেবে বাড়ির আঙ্গিনায় সফেদা বাগানের ভিতরে কবরের কথা উত্থাপনের পর এ বিষয়ে কেউই তেমন কোন কথা বলবার প্রয়োজন বোধ না করলেও পেশ ইমাম রহিমদ্দিনের যেন কিছু মাসালা এই বিষয়ে সঞ্চয়ই ছিল- শোন ময়িনুল্লাহ, সফেদা বাগানের ভেতর এই নাপাক জিনিসের কবর দিতি চায়লে তাতে আমাদের কোন ছে নাই। কিন্তু তুমি ভাবি দেখ- এরাম একটা নাপাক আত্মারে তোমার ঘরের কোনায় শোয়াই রাখা অমঙ্গল হতি পারে। পেশ ইমামের কথার দিকে কোন রকম রসায়ন না রেখেই ময়িনুল্লাহ নির্জীব চোখে তাকিয়ে থাকে সফেদা বাগানের দিকে। একসাথে বেশ কতগুলো সফেদা গাছ। সফেদা যে তার প্রিয় ফল এমন নই। এমন নই যে এই সফেদা বাগানে সফেদা বিক্রি করে ঘরে কোনে টাকা পয়সা আনতে পেরেছে কখনো। কিন্তু ময়িনুল্লাহ কেন জানি ভালো লাগে এই সফেদা বাগান। সংসারে কোন বিষয়ে মন খারাপের মুহূর্তে ময়িনুল্লার অজস্র সময় কেটেছে এই সফেদা বাগানের যে কোন সফেদা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। বৌয়ের সাথে কোন বিষয় দিয়ে ঝগড়া হলেও এমনকি সারারাত সে এই সফেদা বাগানে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিয়েছে; এমন দিনেরও সংখ্যা কম নয়। একবার তো মাঝরাতে রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আসমাতারা খুঁজতে খুঁজতে সবেদা বাগানের দিকে এগিয়ে গেলে দেখে- একটা সফেদা গাছের সাথে ন্যাংটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ময়িনুল্লাহ। ভীষণ ঘাবড়ে চিৎকার দিয়ে উঠতে গিয়ে নিশ্চুপ এগিয়ে যেয়ে গায়ে হাত দিলে ময়িনুল্লার শরীরটা একটা ঝাকুনি দিয়ে ওঠে। একটা ঝাকুনির পর ময়িনুল্লাহ মাঘের শীতে আক্রান্ত পায়বার মতো ঝির ঝির করে কাপতে থাকে। আসমাতারা তেমন কোন কথা না বলেই তার শরীরের সকল কাপর একে একে খুলে ফেলে, সেই কত কাল আগের কথা। বাগানের সফেদা গাছের সাথে হেলান দিয়ে আসমাতারা ময়িনুল্লাহকে বুকের ভেতর জাপটে ধরে। বারোমাইস্যা সফেদা গাছে পেকে ওঠা অসংখ্য সফেদার গন্ধের ভেতর তারা হারিয়ে যায়। সেই সফেদা বাগানেই গরুটিকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়া গুটিয়ে ফেলার পর ইমাম সাহেব বলল- শোনেন ঈমানদার ভাইয়েরা, আমাদের গ্রামে অপমৃত্যু হলে তাকে দাঁড়িয়ে কবর দেওয়ার রীতি তো আপনারা সকলেই জানেন। এই গাভীটি যেহেতু পাপী, শরীয়ত অনুযায়ী তার মাংস হারাম। তাকে বিনাশ করে দিতি হবি। যেহেতু আমরা একটা নাপাক বালাই দুর করতি পদক্ষেপ নিয়িলাম, নেন তার আগে আমরা সবাই আল্লাহর কাছে একটু দোয়া-আসতাগফিরুল্লাহ পড়ি। মা বোনেরা সূরা ফাতেয়ার সাথে তিনবার সূরা ইখলাস পড়বেন। বাড়ির উঠোন আর সফেদা বাগান ঘিওে থাকা উৎসুক মানুষেরা মুখে বিড় বিড় করে শব্দ প্রবাহিত করতে থাকে। সূরা-আসতাগফিরুলায় পড়া শেষ হলে চেয়ারম্যান সাহেব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা তোলেন- শোনেন সবাই, যেহেতু এই ঘটনার সাথে সমশের আর এই গাভী গরু জড়িত, যেহেতু গাভীর শাস্তি আমরা নিশ্চিত করিলাম, কেন না গাভী তো আসতাগফিরুল্লাহ বলে তার প্রাণ ক্ষমা চায়ে নিতি পারবি না তাই তার এ বিধান। আর শমসের যেহেতু মানুষ, এই মজলিসে তার জরিমানার টাকাটা ইমাম সাহেবর কাছে বুঝিয়ে দেবে। আর সে আসতাফিরুল্লাহ বলবে সমবেত জামাতের মধ্যে। আর আমি একটা প্রস্তাব রাখিলাম, যেহেতু শমসেরও অপরাধী, তার প্রায়শ্চিত শুধু টাকা জরিমানা দিয়েই শেষ হবি না। এই গাভীকে এখানে জ্যান্ত কবর দেওয়া জন্যে কবর খুড়তি হবি শমসেরকে।
সমবেত জামাতের নারী-পুরুষের মধ্যে কোন বিষয়েই কোন সিন্ধান্ত না থাকলেও, শমসেরের অপরাধকে গ্রাহ্য করবার মানবিক মনস্তত্ব থাকলেও, একটা জ্যান্ত গরুকে এভাবে কবর দেওয়ার ভবিষ্যৎ দৃশ্যের জন্যে এক ধরনের উদ্বেগ মুখরিত অপেক্ষা ঘণীভূত হতে থাকে। শমসেরের হাতে কোদাল ধরিয়ে দিলে ছোট ছেলে-মেয়েরা হাসাহাসি করলেও বয়স্ক মানুষেরা একটা রুদ্বশ্বাসের ভেতর পড়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। হুজুর মওলানাদের কথার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এখানে কারও কোন মতামত দেওয়ার মতো স্বাধীন মত সঞ্চিত নেই বলেই তারা বরং আগ্রহী হয়ে ওঠে কোদাল হাতে সফেদা বাগানে এগিয়ে যাওয়ার দিকে। সফেদা বাগানের সবচেয়ে বড় সফেদা গাছের নিচে। প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে গাভীর জন্যে কবর খুড়তে খুড়তে সন্ধের অন্ধকার প্রায় চারপাশটাকে ঘিরে ধরলে পাড়ার দু’টো জোয়ান ছেলে টেনে হিচড়ে গোয়াল থেকে গরুটাকে বের করে সফেদা বাগানের দিকে নিয়ে আসতে থাকলে ইমাম সাহেব বলে- শিগ্রি কর তোমরা। মাগরিবের নামাজের সময় হয়ি যাচ্ছে। আযানের আগেই কাজ সারি ফেলতি হবি। আরো কয়েকজন জোয়ান ছেলেকে ডেকে গরুটাকে টেনে হেচড়ে শমসেরের খুড়ে শেষ করা গর্তের ভেতরে ফেলে দিয়ে ইমাম সাহেব বলে উঠেন- নাউজবিল্লাহ। চারপাশ থেকে উৎসুক কিশোর আর তরুণ ছেলেরা গর্তের ভেতর মাটি গড়িয়ে দিতে থাকলে সফেদা বাগানের পশ্চিম মাথায় গাছের আড়ালে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। তখন কেবল একটা আত্নপক্ষ ঝাটকা মেরে গরুটি উপরে আসার চেষ্ঠা করে ডেকে ওঠে- হাম্বা। এরপর আসমাতারার কান্না বাড়িটাকে ভাসিয়ে রাখলে ধীরে ধীরে মানুষহীন হতে থাকে এ বাড়ির উঠোন।
সফেদা বাগানের নেমে এসেছে গভীর অন্ধকার। বারান্দায় পেতে রাখা এক পায়াভাঙ্গা চৌকির সাথে হেলান দিয়ে বসে থব্ব ধরে আছে ময়িনুল্লাহ। আকাশে এখন চাঁদ নেই। অন্ধকার সফেদা বাগানের ভেতরে সেই ভুরকুটি অন্ধকার। সুনশান ঝি ঝি পোকা ডাকছে কী ডাকছে না। আসমতারার কান্না থেমে গেছে অনেক আগেই। হয়তো সে ঘুমিয়ে পড়েছে কান্নাক্লান্ত হয়ে। এই কদিন গাভীটাকে নিয়ে এত যে হেস্তনেস্ত হতে হলো ময়িনুল্লাহর- তার যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হলো- মেয়ের আসন্ন বিয়ের আয়োজনের সংকট সমস্তই ময়িনুল্লাহকে কিভাবে যেন গলা টিপে ধরে রেখেছিল। তাকে কথা বলতে দেয়নি। দেয়নি কাঁদতে। অথচ এই নিশ্চুপ অন্ধকার দাওয়ায় বসে ময়িনুল্লাহর আকস্মিক কান্না সফেদা বাগানের অন্ধকারে ধাক্কা খেয়ে এসে উচুট খেয়ে পড়লো বাড়ির উঠোনে। কান্নাটা মিহি, মেয়েলী, চিকন। শরীরে টগবগে রক্ত ধরে রাখা যুবক ছেলে আয়ানুল্লাহও পিতার মিহি কান্নার ভেতরে দুই হাটুতে মুখ গুজে বসে শরীয়াতপন্থীদের নির্মমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদহীন থাকার মানসিক যন্ত্রণায় পুড়ে যাচ্ছিল, গায়ে-গতরে জোর দিয়ে হয়তো একটা হেজিপেজি বাধিয়ে দিতে পারতো আয়ানউল্লাহ। কিন্তু গ্রামে আলেম-মৌলভীদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই ভিটে ধরে রাখা সহজ ছিল না। বার বার উৎপন্ন ক্রোধ জাকিয়ে বসানোর প্রস্তুতি নিলেও সম্পূর্ণ সাবালক আয়ানউল্লাহ থেমে গেছে পিতার সামান্য ভিটে-মাটির জন্যে। মেয়েলী সুরে আলুলায়িত হওয়া পিতার কান্না তাকে আহত করতে থাকলে একটা বুদ্ধি আসে তার মাথায়। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ উঠোনে পায়চারি করে এসে পিতার পাশে বসে। এখন ময়িনুল্লাহর কান্নার মিহি স্বর থেমে গিয়ে ফোফানোর স্থূল ধ্বনি কেবল প্রস্ফূটিত হচ্ছে। আয়ানুউল্লাহ তার পরাজিত বেকার ডান হাতটি পিতার কাঁধের উপর রেখে বলে- আব্বা, যা হওয়ার তো হলিই। এখন কী আর করার। গ্রামে থাকতি হবি। ভিটে মাটি ছাড়ি তো আর যাওয়ার ক্ষেমতা নাই। কোনে যাব? শুয়েরের বাচ্চারা মানুষ না। বালের আলেম। একটা আস্ত জানরে এরাম করি কবর দেয়। এডা যদি হাদিস কোরানেও থাকে তো আমি তা বিশ্বেস করি নে। ছেলের মুখের কথার সাথে পারদ গলে পড়তে দেখে ময়িনুল্লাহ চঞ্চল হয়ে ওঠে- যাক বাপ এসব নিয়ে কাওরে কিছু আর বলা কওয়ার দরকার নি। সে না হয় কাউরে কিছু বলল না আমানুল্লাহ কিন্তু একটা বুদ্ধি তার মাথায় ভেতরে পাক খাচ্ছে- আব্বা, আমাদের তো সব দিক দিয়ে ক্ষতি হয়ে গেলো, আমরা ঐ গরুর চামড়া ডা ছুলে বেচবো, তাতে হাজার পনেরশো টাকা যাই আসে কাজে লাগবিনে। আতকে ওঠে ময়িনুল্লাহ- একি করি সম্ভেব। সম্পূর্ণ দ্বিমত থাকলেও আয়ানউল্লাহ তার বাবাকে নিমরাজি করিয়ে ফেলে, কিন্তু আরেকটি নতুন সংকট তাদের ভাবিয়ে তোলে- চামড়া ছাড়াতে তো ধারালো ছুড়ির প্রয়োজন, যা তাদের কাছে নেই। কোদাল আছে গর্তটা খুড়ে ফেলার জন্যে। বেশ কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হেজিপেজি করতে করতে হেসেলের খড়ের চালে গুজে রাখা একটা মরচে পড়া ছুরি বের করে নিয়ে আসে আয়ানউল্লাহ। তাতে এতোটাই মরিচা পড়েছে যে ছুরিটাকে হরেনের কামার শালায় নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় খুঁজে দেখছে না। এই উপায়হীনতার ভেতর দাঁড়িয়ে আয়ানউল্লাহ ঘুল্লি খেতে খেতে হেসেল থেকে বেড় করে আনে শিলপাটার নোড়া, আর তার সাথে ঘন ঘন ঘষে ছুরিটার গায়ের মরিচা তুলে ফেললেও চামড়া ছাড়াবার মতো যোগ্য করে তোলা খুবই কষ্টসাধ্য হলো। শিলপাটার উপরে রেখে জোর দিয়ে বিরামহীন ঘষতে থাকে। খস খস শব্দ কিছুটা এদিক ওদিক ছড়ালে ময়িনুল্লাহ বলে- কেউ যদি দেখে ফেলে। সফেদা বাগানের গাছগুলোতে থোকা থোকা সফেদা পেকে সুমিষ্ট গন্ধে ভরপুর করে তুলছে রাতের অন্ধকারকে- বাপ বেটা পলাতকের মতো বড় সফেদা গাছটির নিচে শেষমেশ এসে দাঁড়ায়। বাগান থেকে ছড়িয়ে পড়া আজকের গন্ধটা ময়িনুল্লাহকে চন্দ্রাহত বালকের মতো এলোমেলো করে দিতে থাকে। যেই বড় গাছটির নীচে প্রায় সন্ধাবেলা জীবন্ত গাভীটাকে পুঁতে ফেলা হয়েছে, সেই গাছের সাথে হেলান দিয়ে ময়িনুল্লাহ ছেলেকে বলে- বাজান আমার ভয় করে। কিন্তু আয়ানউল্লাহর কোন ভয় নেই, বরং পিতার দুর্বল মানসিক ক্রিয়াকে এক ঝাটকায় সে সচল করে বলে- শিগগির করতি হবি আব্বা, সলোক ফুটে গেলে আর কাজ হবি না। অমাবস্যা নয় তবুও আজ রাতের সফেদা বাগানের এই অন্ধকার অন্যে যে কোনদিনের চেয়ে প্রগাঢ়। জোনাকি নেই। বিলের ধারে পশ্চিমের বাঁশ ঝাড় থেকে প্রতিদিনের মতোই ভেসে আসছে কুবোপাখিটির কুবো কুবো ডাক- যা আজ বেশ করুন, ভীতিপ্রদও। ময়িনুল্লাহর গা ক্রমশ ওজনদার হয়ে উঠছে। গায়ের লোমকুপে একটা শিহরণ, বেশ ভয় জাগাচ্ছে। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ বলে কোদালের প্রথম কোপটি দিয়ে ফেলেছে আয়ানুল্লাহ। খুব সচেতনভাবে তাকে কোদাল চালাতে হচ্ছে। ময়িনুল্লাহ মিহি স্বরে ফ্যাল ফেলিয়ে বলল- বাপ্, আস্তে। কিছুক্ষণ কোদাল চালানো পর আয়ানুল্লাহ হাফিয়ে উঠলে ছমছমে গা নিয়ে কোদালের হাতল ধরে ময়িনুল্লাহ। বেশ মাটি খুড়ে চলেছে। মুখ থেকে কিছুটা থুথু বেড় করে দুই হাতের তালুলে ঘষে আয়ানুল্লাহ বলে- আব্বা দেও, এইবারে আমি কুপাই। কুবোপাখির ডাক ক্রমশ ভৌতিক হয়ে উঠছে। অনেক খানি গর্ত খোড়ার পর বাবা-ছেলে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো-কি ব্যাপার, এতোখানি গর্ত হয়ি গেলো কিন্তু গরুর দেখা পাচ্ছি নি আব্বা। আমরা কি ভুল জায়গায় কুপাচ্ছি। ময়িনুল্লাহ ভয়ে কাপতে থাকে- বিকাল বেলাতো এই বড় সফেদা গাছের নিচেই গরুটারে পোতা হলো শমসের খোড়া গর্তে, এখানেই তো সেই খোড়া জায়গাটা এলো মেলো হয়ে আছে। শমসের যত খানি গর্ত খুড়িল, বোধহয় আমরা তাচ্ছি বেসিই খুড়িলাম। আয়ানউল্লাহ থেমে যাওয়ার জন্যে আজ এই কাজে পা বাড়াইনি, সে কোদাল চালাতে থাকে এবার একাই। রাত বাড়তে বাড়তে অন্ধকারের আয়ু কমে আসছে। এই আর একটু পরেই যেন সফেদা বাগানের ভেতর আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়বে নবাগত সূর্যের রশ্মি। কিন্তু গরু কোথায়? গর্ত যা খোড়া হলো এর ভেতরে আরো দুই চারটা গরু পুতে রাখা যাবে। শেষমেশ হাফিয়ে কোদালটা সফেদা গাছের গোড়ায় হেলিয়ে দিয়ে আশরীরে খুড়ে তোলা মাটির স্তুপের উপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ে আমানুল্লাহ- আব্বা, তুমি আর একটু দেখো।
কুবোপাখিটি ডেকে ডেকে থেমে গেল। অন্ধকারে আঠালোতা ছেড়ে ছেড়ে যাচ্ছে। এই বুঝি মসজিদে আযান দিয়ে উঠবে মোয়াজ্জিন। শেষবারের মতো কোদাল চালাতে চালাতে ভীষণ শক্ত কোন কিছুর উপর কোপ পড়ে যায় কোদালের। ময়িনুল্লাহ শরীরে সমস্ত রক্ত শীতল হয়ে আসতে থাকে। সফেদা বাগানের ভেতর পাকা সফেদার সুতীব্র গন্ধ। বাগানে আশ্রয় নেওয়া রাতের পাখিরা এক-দু করে উড়ে চলেছে খাবারের খোঁজে। ময়িনুল্লাহ কোদালের মাথায় দিয়ে এক ঝটকা মারে, গোলাকৃতি শক্ত কিছু একটা উঠে আসে। ঝুকে পরে দুই হাত দিয়ে উচিয়ে ধরে লাফিয়ে ওঠে, ভয়ানক চিৎকার করতে গিয়ে মুখে কুলুপ আটে- দেখে, একটা মাথার খুলি, মানুষের। খুলির সাথে সম্পূর্ণ অক্ষত আছে চোয়ালের বত্রিশটি দাঁতের পাটি, দাঁতগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় আকস্মিক বড়, সুতীক্ষ্ম এবং বিশ্রী।
ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম- একটু পরেই মোয়াজ্জিনের আজানে জেগে উঠবে মানুষ।


 

তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প বাংলার সব সুন্দরীদের জন্য একটা বড় প্রাসাদ বানানোর ইচ্ছে তার বহুদিনের। আদিম গন্ধের মেয়েটিকে দেখে বুকের বামপাশে কিছু হাওয়া ঢুকে তোড়পাড় করতে লাগল তার। নীরবতা ভাঙল স্লোগান শুনে। নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে আবার সামনে দিকে এগোতে থাকলেন তিনি। চক্কর দিতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে হাত মেলাতে হল জেনারেলের

 

জেনারেল ও খাঁচা বিষয়ক জটিলতা
মিলন আশরাফ
হেলিকপ্টারে আসবেন জেনারেল। নানা রঙে সজ্জিত হচ্ছে শার্শা বাজারের ছোট্ট স্টেডিয়ামটা। পোস্টার আর রঙিন কাগজে মুড়ে ফেলা হয়েছে পুরো বাজার। বাতাসে পতপত্ করে উড়ছে পোস্টারের মাঝ বরাবর জেনারেলের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। ছবির নিচে লেখা জনবন্ধু। দেশের প্রধানতম এক রাজকবি এই তকমাটা নামের আগে জুড়েছেন খুব যত্নের সঙ্গে। জনবন্ধুও তার নজরানা হাতে হাতে দিয়েছেন। গুলশানে আলিশান এক বাড়ি। ছেলে-বুড়ো সবার হাতে হাতে বিলি হচ্ছে লিফলেট। স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় পড়ে থাকা লিফলেটগুলো নিয়ে কাগজের নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে শার্শা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের পুকুরটাতে। পানার মতো শ শ জনবন্ধুর ছবি সংবলিত কাগজের নৌকা ভাসতে থাকে পুকুরে। সেসব নৌকা টপাটপ গিলে ফেলে পুকুরে চাষ করা বিদেশি মাগুরেরা।
এলাকা জুড়ে সবকিছুতে চলছে তোড়জোর। স্টেডিয়ামের মাঠে আনা হয়েছে স্টিম রোলার। মাটিগুলো গেদে গেদে ভেতরে ঢুকানো হচ্ছে হালকা পানি ছিটিয়ে। দূর থেকে লোকজন অবলোকন করছে সেইসব দৃশ্যালোক। মেশিন দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক মাপায় ব্যস্ত সেনাবাহিনিরা। সেই সঙ্গে সঙ্গে হাত লাগিয়েছে দলীয় লোকজন। আট দশ গাড়ি আর্মি সকাল-দুপুর চক্কর দিয়ে টহল মারছে শার্শা বাজার। পানি দিয়ে স্টেডিয়াম ভিজিয়ে সেগুলো শুকানোর জন্যে আবার আনা হয়েছে বড় বড় টেবিল ফ্যান। বাতাসের তোড়ে নুইয়ে পড়ছে আশেপাশের গাছপালা। তারাও যেন কুর্নিশ করতে সদাব্যস্ত। জেনারেলের পা পড়বে এই মাটিতে, এটা কী কম কথা! দূরে দাঁড়িয়ে পালে পালে স্কুল ফেরত ছেলে মেয়েরা ধাক্কাধাক্কি করে দাঁড়িয়ে দেখছে সেইসব কাণ্ডকারখানা। গত দু’দিন ধরে তাদের বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে। এ নিয়ে বাড়িতে হালকা বকাবকি হলেও থেমে যাচ্ছে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। হাজার হোক জেনারেল আসবে বলে কথা! মা-বাবারা চুপ থাকলেও প্রচার প্রচারণা তো আর থেমে থাকবে না। মাইকের আওয়াজে কানপাতা দায় হয়ে যাচ্ছে শার্শা থানার সব গ্রামের মানুষের। প্রত্যেক গ্রামে জোয়ান তাগড়া যুবকরা মিলে জটলা বেঁধে মিটিং করছে বিরতিহীনভাবে। ছোট ছোট মিছিলও বের করছে ভক্ত আমজনগণ। ঘরের মেয়েরাও আলুক ফালুক মারছে বেড়ার ফাঁক গলিয়ে।
শার্শা বাজারের বুলেট বঙ্কারও যোগ দিয়েছে তাদের সঙ্গে। ও হ্যাঁ, এই গল্পে তার অ্যান্টির আগে একটু পরিচয় দেবার প্রয়োজন মনে করছি। নামটা তো আগেই বলা হল, এবার আসি তার মটর সাইকেল প্রসঙ্গে। এলাকার লোকজন তাকে কখনো মটর সাইকেল আস্তে চালাতে দেখেনি। চোখের পলকে সবার নাকের ডগায় উপর দিয়ে মুহূর্তে শো করে উধাও হয় সে। সত্যিই দেখবার মতো সেই ক্যারাবাজি। সে জানে এবং বলেও যে, ‘যেদিন আমি অ্যাক্সিডেন্ট করবো, হাঁড়গোড় ছাড়া কিছুই পাবি না তোরা।’ মূলত এই মটর সাইকেল চালানোর ক্যাপাসিটির কারণেই সে থানাখ্যাতি থেকে শুরু করে জেলাখ্যাতি পর্যন্ত পেয়েছে। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে এই খ্যাতি এখনো পৌঁছায়নি। তবে সে আশায় থাকে জেনারেল এসে তার নৈপুণ্য দেখে জাতীয়ভাবে একটা সার্টিফিকেট দিবেন। বঙ্কার তার মটর সাইকেলকে আদর করে বুলেট নামে ডাকে। কিন্তু স্থানীয় জনগণ বুলেট নামটা মটর সাইকেলকে নয়, বরং তারা আনন্দ লাভ করে বঙ্কারের নামের আগে বুলেট শব্দটা সংযোজন করে। সুতরাং সে হয়ে যায় এলাকার বুলেট বঙ্কার। এবার চলুন মূল গল্পে।
তো বুলেট বঙ্কার তার বিকট শব্দের মটর সাইকেল নিয়ে ঘন ঘন চক্কর মারছে আশেপাশের প্রায় সব গ্রাম। মটর সাইকেলের আওয়াজ কানে আসলেই ছেলেমেয়েরা হুমড়ি খেয়ে রাস্তার দিকে দৌড় লাগায় বুলেট বঙ্কারকে দেখতে। কিন্তু বুলেট বঙ্কার এতো স্প্রিডে গাড়ি চালায় যে চোখের পলকে উধাও। বিরক্ত হয়ে কিশোর’রা বলে, ‘ধুর বাড়া, আর একটু আগে আসলি দেখতি পাতাম’। তাদের এই আপসোসের জবাব দিতে পর পর দুটো হেলিকপ্টার বঙ্কারের বুলেট মটর সাইকেলের চেয়েও দ্বিগুন শব্দে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। বালকদের আগ্রহ সেই হেলিকপ্টারমুখী হয়ে যায় চোখের পলকে। তারা পড়িমড়ি করে সকল সঙ্গীদের ডাকতে থাকে দৌড়ে দৌড়ে। শার্শা থানার ১৬৮টা গ্রামের সকল মানুষের চোখ আজ আকাশপানে। মাটির দিকে তাদের আজ খেয়াল থাকে না। নিজামপুর বাজারে গিয়ে বঙ্কার থেমে যায় ঐ একই কারণে। সে যখন যে গ্রামে গেছে তখন সবার নজর তার দিকে পড়েছে। কিন্তু আজ তার ভাত মার। বাজারের চায়ের দোকানে এ নিয়ে আলাপ জমে ওঠে এবং সেই আলাপ বঙ্কারকে দেখে আরও দ্বিগুন হয়। বঙ্কারের মনে হয় তাকে দেখে বোধ হয় সবাই মশকরা করছে। আগেপিছু কিছু না ভেবে দোকানে বসা মানুষদের মুখের অভিব্যক্তির উপর সজারে আঘাত হেনে বলে, ‘হেলিকপ্টার না গাড়। আমার বুলেটের কাছে ও ধোন কিছু !’ দোকানদার বঙ্কারকে দেখে বলে ওঠে, ‘বঙ্কার ভাই বসেন, কড়া লিকারে একখান দুধ চা দিই।’ তার কণ্ঠেও ঠাট্টার আভাস পায় বঙ্কার। রেগে গিয়ে বলে, ‘তোর ও বালের চা খাওয়ার জন্য আমার লেওড়া কানছে।’ অবস্থা বেগতিক দেখে উপস্থিত দোকানে উপবিষ্ট লুঙ্গিপরা খাজুরে আলাপের লোকজন তাকে আর ঘাটলো না। মোটা শরীরের বঙ্কার গো গো করতে থাকে। কেউ কিছু বলছে না এ অবস্থা দেখেও তার রাগ হয়। সোজা মটর সাইকেলে বসে গায়ের জোরে স্টার্ট দেয়। একসঙ্গে ৪টা গিয়ার মেরে ডান হাতের পিকআপ ছাড়ে জোরের সঙ্গে। গো গো করে ওঠে তার বুলেট। বিকট শব্দ শুনে বাজারের লোক সবাই সেদিকে তাকায়। বঙ্কার মানেই তাদের চোখে বিস্ময়। নতুন ক্যারাবাজি দেখতে তারা দোকান থেকে উঠে রাস্তায় দাঁড়ায়। শরীরের সমস্ত শক্তি আজ যমে রূপ নিয়েছে বঙ্কারের। সামনে একটি ট্রাককে দেখে ক্ষেপে যায় সে। দুইবার হর্ন বাজালেও সাইট দেয় না ট্রাকটি। গালাগালি দেয় বঙ্কার, ‘মাদারচোদ, সর বলছি। আজ আর ফিরবোই না’ বলার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষলো কড়া। মুহূর্তে লাফিয়ে উঠল বুলেট। ভুম ভুম শব্দে চারপাশে ধূলায় ভরপুর হয়ে যায়। ধূসর সেই ধূলার বুকে এক বিভ্রমের খেল দেখায় বঙ্কার। উপস্থিত সবার চোখের সম্মুখে উধাও হয়ে যায় সে। ট্রাকটা পড়ে থাকে পেছনে। মানুষের দৃষ্টিভ্রম হয়। কেউ বলে, ট্রাকের উপর দিয়ে উড়ে গেছে, আবার কেউ বলে নীচে দিয়ে। কিন্তু গাল খাওয়া চা দোকানদার বলে, ‘ও আমার বাল ছিঁড়েছে। এক সাইট দিয়ে গেলো যে !’ সবার এই বলাবলিতে যে কথাটি প্রতিষ্ঠা পেলো সেটি হল, বঙ্কার আজ দুপুরের একটু আগে নিজামপুর বাজারে স্কুলের সামনে এক ট্রাকের উপর দিয়ে উড়ে ডিগবাজি খেয়ে পার হয়ে গেছে।


বিকাল ৩টায় পৌঁছবেন জাদরেল জেনারেল। দলে দলে মানুষজন শার্শা স্টেডিয়ামের দিকে ছুটছে। শার্শা পাইলট হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও লাইন ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে স্যালুট করার মোশনে। বাঁশি বাজিয়ে তাদেরকে কন্ট্রোলে রেখেছেন শারীরিক শিক্ষার স্যার আলতাপ হোসেন। লাইন একটু বেঁকে গেলেই সেনাবাহিনির স্টাইলে পিঠের উপর দমাদম বসিয়ে দিচ্ছেন দু’এক ঘা। স্কাউটের ব্যান্ডদলও সমানে বাজিয়ে যাচ্ছে বাজনা। হাজার হাজার মানুষ আজ কর্ম-কাজ ফেলে ছুটছে জেনারেলকে দেখতে। চাষাভূষা- ক্ষেতমজুর-রিকশা চালক-কামারকুমার-জেলে-মুচি-সুদখোর-ঘুষখোর-মাগিখোর-সুন্দরী তরুণ-তরুণী এরকম হাজারও ছেলে বুড়ো হাবড়া সব্বাই হুমড়ি খেয়ে দৌড়াচ্ছে। স্টেডিয়ামের ঘাসগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ভারি গাড়ির চাপে। মাঠের দুই পাশে লাল পাতার কচাগাছগুলো কুর্ণিশ করার স্টাইলে দোল খাচ্ছে হালকা বাতাসে। দক্ষিণ দিকের মাঠ মাড়িয়ে আলপথ ধরে সারি সারি মানুষ হইজকার করতে করতে ছুটছে স্লোগান দিতে দিতে। যেন বিরাট সার্কাসের আয়োজন আজ। পড়িমরি করে কিছু মানুষ লুঙ্গিতে গিঁট বেঁধে কাদার মধ্যে পা ডুবিয়ে পচপচ শব্দে গন্তব্যের দিকে হামলে পড়তে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন মিছিল প্রদক্ষিণ করছে মাঠের চৌদিকে। জেনারেলকে অভ্যর্থনা জানাতে সকল প্রকার আয়োজনের যেন কমতি না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি প্রশাসনের। আয়োজন সম্পন্ন। এখন শুধু প্রতীক্ষার প্রহর গুনার পালা। জটলার ভেতর গাদাগাদিতে দু’একজনের মধ্যে হাতাহাতি লেগে যায়। বাঁশি বাজিয়ে ভলেন্টিয়ার’রা দ্রুত সেখানে গিয়ে থামায় জনগণকে। পিনপতন নীরবতায় চারপাশ আতঙ্কে ভরে উঠেছে। সবাই একটি বিশেষ শব্দের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান। এইমাত্র বুমবুম শব্দে বাঁশি বাজিয়ে দুটি সেনাবাহিনির গাড়ি প্রবেশ করলো মাঠে। মাইকে ঘোষণা করা হল, আর কিছুক্ষণের মধ্যে মাননীয় জেনারেল সাহেব এসে উপস্থিত হবেন মাঠে। মানুষের হুড়োহুড়ি বাড়তেই লাগলো। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না চিৎকার চেচামেচি। বাঁশ দিয়ে মেয়েদের লাইন আলাদা করা হয়েছে। মাঠের চারিদিকে জেনারেলের হাস্যোজ্জ্বল ছবি দড়ি দিয়ে টাঙানো হয়েছে গোলাকৃতি করে। চিকন গোঁফের আড়ালে মৃদু হাসির ঝলকানিতে পুরো মাঠ ছেয়ে গেছে পোস্টারে পোস্টারে। কিছু সময় পর পর স্লোগান দিচ্ছে উপস্থিত আমজনতা। প্রথম লাইন মাইক থেকে ‘জেনারেলের আগমন’ সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে শুভেচ্ছা স্বাগতম ধ্বনিত হচ্ছে। গমগম করে আকাশে বাতাসে সেই শব্দ ছড়িয়ে তৈরি হচ্ছে এক আশ্চর্য বলয়। তারি মধ্যে পড়ে মাঝে মাঝে লাঠি ও মানুষের গুঁতা খাচ্ছে গোবেচারা গোছের হাবদাগাবদা চেহারার কিছু নীরব দর্শক। ইতোমধ্যে কুচকাওয়াজের জন্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেছে স্কাউটের ব্যান্ডদলসহ।
উত্তরপাশের মেয়েদের মধ্যে কী একটা গণ্ডগোল দেখে বাঁশি বাজাতে বাজাতে ভলান্টিয়ার’রা দৌড়ে গেলো। গিয়ে দেখে একটি মেয়ে সামনে দাঁড়ানোর জন্য ৪/৫ জনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ফেলেছে। দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা এই রকমটিই অভিযোগ দিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেখে একদল আর্মি সেখানে স্বশরীর ও স্বপোশাকে হাজির। আর্মিকে দেখে সবাই থতমত খেয়ে জবুথবু হয়ে গেল। কিন্তু দমল না ধাক্কা দেওয়া মেয়ে সোনামুখী গ্রামের সোনাভান। গায়ে গতরে অন্যদের তুলনায় বেশ বলিষ্ঠ সে। এই সুযোগটাই সে গ্রহণ করেছে। দেখতেও রূপসী তন্বী। এটাও তার বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে সে ব্যবহার করতে পিছপা হয়নি। আর্মিরাও ভেবে দেখলো এমন একজন চাক্ষুস দেহপল্লবী তরুণী সামনে দাঁড়ালে জেনারেল আহ্লাদে আটখানা হবেন। সুযোগ যখন সামনে স্বয়ং দেহ দুলিয়ে হাতছানি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তখন মিছে কেনো তাকে পেছনে ঠেলে পাঠাবে তারা। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। সামনেই থাকবে সোনামুখীর সোনামুখ সোনাভান। এই রায় প্রদান করে সঙ্গে আরও যুক্ত করলো যে, তাকে কেউ যেন পেছনে ঠেলে না পাঠায়। এহেন সতর্কবাণীতে সবাই স্তব্দ হয়ে যায়। সুযোগ পেয়ে চওড়াবুকের সোনাভান সেখানেই দণ্ডায়মান হয়ে বাঁশ ধরে দেহ দুলিয়ে দুলিয়ে দেখে নিচ্ছে মাঠের পজিশন।
জনগণের ধৈর্যের বাধ ভাঙতে না ভাঙতেই আকাশে কান পাততে হলো সবার। দূর থেকে শব্দ বাতাসে তরঙ্গ হয়ে ভেসে আসছে এদিকে। শব্দটা ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততায় রূপ নিল। আনন্দে জনগণ স্লোগান দিতে থাকলো ঘনঘন। মুহূর্তে বিকট শব্দে সবার কান তালা লাগার উপক্রম হল। পাখির মতো ডানা মেলে শার্শা বাজারের উপরে প্রদক্ষিণ করতে লাগল দুটি হেলিকপ্টার। মানুষের চোখ তখন কপালের উপর দিয়ে সোজা আকাশ পানে। দুই চক্কর মেরে তৃতীয় চক্করে শো করে নেমে পড়ল একটি। আরেকটা তখনো উপরে চক্কর মেরে টহল দিচ্ছে। মাটিতে নেমে পড়া হেলিকপ্টারের পাখা তখনো বো বো করে ঘুরছে। সেই বাতাসে লালচে রঙের কচাগাছের পাতা ফত্ফত্ করে ছিঁড়েফুঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে পাক খেয়ে দূরে ছমিরের মাঠের দিকে উড়ে গিয়ে উধাও হয়ে গেল মুহূর্তেই। স্কাউট দল তাদের নিজস্ব স্টাইলে লেফট রাইট করতে ব্যতিব্যস্ত। সবার নজর তখন হেলিকপ্টারের সদর দরজার দিকে। এখনি জেনারেল সাহেব নামবেন। সবাইকে হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানাবেন। আবার যদি তার একটু দয়া হয় মাঠটা প্রদক্ষিণও করবেন। এমন আশায় সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো নিজেদেরকে ভেতরে ভেতরে তৈরি করে নিচ্ছে। হাতটাও একটু প্যান্টে কিংবা কেউ কেউ লুঙ্গিতে মুছে চকচকে করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেয়েদের চোখেও হ্যান্ডসাম জেনারেলকে দেখার বিস্ময় খেলা করছে। চনমন করে উঠছে দেহমনপ্রাণ। হাতের আন্দাজে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে কপালে পড়ে থাকা চূর্ণ চুলগুলো। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘দেখতো বু, সব ঠিক আছে তো ! ’ সম্মতিসূচক শব্দ শুনলে আনন্দে গদগদ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে নিজেকে সুন্দরী ভাবা মেয়েরা। কিন্তু ওমা! হেলিকপ্টার থেকে একের পর এক চকরাবকরা পোশাকের মানুষ নামলো। জেনারেলকে কেউ নামতে দেখলো না। সবাই হা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে এক ধরনের বিলাপে ফেটে পড়ে। হায়! কোথায় জেনারেল? এ ওর মুখের দিকে চেয়ে হট্টগোল বাধায়। মাইকে ঘোষণা হল, আপনার শান্ত হয়ে অপেক্ষা করুন। জেনারেল সাহেব এসেছেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাবেন আপনারা। গ্যানজাম করবেন না কেউ। মাইকে ঘোষণা শেষ হতে না হতেই বিকট শব্দে আরেকটি হেলিকপ্টার নামল মাঠে। পাখার ঘূর্ণায়নে রশিতে বাঁধা জেনারেলের বড় বড় পোস্টার গুলো ছিঁড়ে বাতাসে গায়ে ধাক্কা মারতে মারতে জনগণের মাথার উপর দিয়ে নাই হয়ে গেল নিমিষেই। এমন রসিকতায় জনগণ তেমন মজা পেল না। তাদের অপেক্ষা শুরু হয়েছে এক সপ্তাহ ধরে। এই সাতদিনে তারা তেমন কাজে মনোযোগী হতে পারিনি। স্কুলের শিক্ষকরাও বাচ্চাদের পড়ালেখা শিকেয় তুলিয়ে মুখে মুখে জেনারেল জেনারেল শব্দে ফেনা তুলিয়ে ছেড়েছে। এমন ইয়ারকিতে শিক্ষকদের মনেও চোট লাগে। এমতবস্থায় সেখানে মলম লাগাতে দ্বিতীয় হেলিকপ্টার থেকে জেনারেল হাত নাড়াতে নাড়াতে চিরচেনা স্টাইলে মুখ দেখাল। তাকে দেখার আবেগে এ ওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে লাগলো। সপাং সপাং লাঠির বাড়িতে শান্ত হয়ে গেল জনগণ। পান্তাপাড়ার ছাদেক বলল, ‘শালার জেনারেলের কায়দায়-ই আলাদা! কিরাম ম্যাজিক দেকালো দেকলি।’ তার কথার কেউ কর্ণপাত করে না। সুতরাং সেটি স্বগোক্তির মতোই রয়ে যায়। জেনারেল স্যুটবুট পরিহিত অবস্থায় নামলেন। হাত তার অটোমেটিক নড়তে থাকল। নেমেই ভাবলেন চারদিক এক চক্কর দিয়ে তবেই স্টেজে উঠবেন। গটগট পায়ে এগোতে থাকলেন তিনি। গোফের নীচে মুচকি হাসি লেগেই আছে। বাঁশ দিয়ে ঘেরা চারপাশ। বাঁশের ওপাশে আমজনতা। স্কাউট দল বাদ্য বাজিয়ে কান ঝালাফালা করে দিচ্ছে। তাদেরকে থামতে নির্দেশ দিলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে স্তম্ভ হয়ে গেল। গলায় ফাঁস লাগার মতো চুপ সবাই। শুধু বাঁশের ওপাশ থেকে স্লোগান ভেসে আসছে। জেনারেল এতে আমোদ অনুভব করছেন। বুকটা তার ফুলে ফেঁপে দ্বিগুন চওড়া হয়। বুক ফুলিয়ে সামনে পা বাড়ান। সঙ্গে থাকা প্রটোকলের হঠাৎ মনে পড়ল এই যা জেনারেলকে বরণ করতে মালাটা তো পরানো হল না। কাউকে তো প্রস্তুত করতেও ভুলে গেছে তারা। মালাটা স্টেজের কাছেই রাখা আছে। ঊর্ধ্বতন একজন নিম্ন পদস্থের কানে কানে কী যেন বললেন। সে দৌড় দিল স্টেজের দিকে। জেনারেল আস্তে আস্তে হাঁটছেন। আর অনুভূতির সকল দরজা খুলে শুষে নিচ্ছেন সকল অভিনন্দিত স্লোগান। দু’শ গজ সামনে যেতেই জেনারেলকে থামতে হল। এক সুন্দরী তন্বী নয়নের বহ্নি শিখা তার সামনে দণ্ডায়মান মালা সমেত। জেনারেল বিস্মিত হলেন। খুশিতে গদগদ হয়ে গলাটা দিলেন বাড়িয়ে। আত্মহারা সোনাভান কালবিলম্ব না করে সোজা জেনারেলের গলায় মালাটা পরিয়ে লজ্জায় ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। জেনারেলেরও চক্ষু চড়ক গাছ! একটা আদিম গন্ধ মেয়েটির শরীর থেকে এসে নাকটা ঝাঁঝিয়ে দিল জেনারেলের। সুন্দরের এই অযত্ন তার প্রাণে বড় বেশি দাগা দেয়। এমন পাড়া গায়ে পড়ে থাকবে এমন হুর। মনে মনে বললেন, হায় আল্লাহ! এই রূপসী তো আমাকে আদিম গন্ধে ডুবিয়ে মারার ক্ষমতা রাখে!
বাংলার সব সুন্দরীদের জন্য একটা বড় প্রাসাদ বানানোর ইচ্ছে তার বহুদিনের। আদিম গন্ধের মেয়েটিকে দেখে বুকের বামপাশে কিছু হাওয়া ঢুকে তোড়পাড় করতে লাগল তার। নীরবতা ভাঙল স্লোগান শুনে। নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে আবার সামনে দিকে এগোতে থাকলেন তিনি। চক্কর দিতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে হাত মেলাতে হল জেনারেলের। গাড়িতে ভাড়া করা লোকজন একের পর এক আসছে তো আসছেই। স্টেজে উঠে ভাষণ দেবার আগে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে শান্তির প্রতীকরূপী ৪টা সাদা কবুতর উড়িয়ে দিলেন সবাই মিলে। কবুতরগুলো কিছু পাখনা ফেলে ফত্ফত্ শব্দে হাজার হাজার মানুষের মাথার উপর ঘুরতে লাগল। দিশেহারা মানুষ একযোগে সবাই হাততালিতে মুখরিত করল স্টেডিয়াম। মাইকে জেনারেলের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ভাষণ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে উড়ন্ত কবুতর চোখের পলকে কাগজের হেলিকপ্টার হয়ে শো করে নেমে গেলো দূরের মাঠ পানে। স্টেজের পাশে দলীয় চামচারা স্লোগানে স্লোগানে জেনারেলের ভাবমূর্তি আকাশে বাতাসে, পারলে যেন পাতালেও পাঠিয়ে দিবে এরূপ হাম্বিতাম্বি। স্টেডিয়ামের পূর্ব দিকে ধূ ধূ মাঠ। মাঠের মাঝখানে তালগাছের নিচে একসঙ্গে তিনটি বালক জেনারেলের মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা হাস্যোজ্জ্বল ছবির পোস্টারের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন করছে আর আড়চোখে মেপে নিচ্ছে নিজেদের বিশেষ অঙ্গের আকার। তরল পদার্থের কাটাকাটি খেলারও চলছে প্রদর্শন। ওদিকে জেনারেল বলছেন, ‘আপনারা জানেন, এখানে আমার আত্মার বন্ধন আছে। আমার ছেলে (পাতানো বা ধর্মছেলে আপনাদের সবার প্রিয় নেতা। সেই বন্ধন অটুট রেখে আপনাদের সঙ্গেও জড়াতে চাই গভীর বাঁধনে।’ কথার এইখানটাই এসে স্টেজে রাখা বড় টেবিল ফ্যানের বাতাসের তোড়ে জেনারেলের শার্টের উপরের দিকের প্রথম বোতামটি গেল ফট করে ছিঁড়ে। বিরক্ত ও অস্বস্থিতে পড়লেন তিনি। বক্তব্য দীর্ঘায়িত না করেই বসে পড়লেন নিজের আসনে এসে। এরপর একে একে বড় নেতা, ছোট নেতা, পাতি নেতা, উঠতি নেতা ও শিক্ষানবিশ নেতা কেউ বাদ পড়লো না স্টেজে উঠতে। মিথ্যে প্রতিশ্রুতির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে জনস্রোতে। স্টেজ দুলে দুলে জানান দিচ্ছে জেনারেলের ক্ষমতা বহরের দাম্ভিকতা। ট্রাকে করে আসা দূরগামী গ্রামের মানুষেরা জেনারেলের বক্তৃতা না শুনতে পেয়ে মন খারাপ করে স্টেডিয়ামের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ধুর বাড়া, আসল বক্তিতাটাই তো শুনা হলো না। চল্ বাড়ি যাই। ও ধোনেদের কতা শুনে লাব আচে কোনো ?’


মঞ্চে যেসব কথা বলা নিষেধ সেসব বিষয় নিয়ে মিটিং বসেছে জেনারেলের ধরমপুত্র মো. আখলাস উদ্দীন দফাদারের মহলে। প্রাসাদসম এই মহল। জেনারেল তার ধরমবাপ হওয়াতে সে বাগিয়েছে বেশ। দলীয় লোকজন সব বসে আছে গোলটেবিলে গোল হয়ে। ইন্ডিয়া থেকে আনা হলদিরামের শন পাপড়ি, চানাচুর প্লেটে প্লেটে সাজানো। কয়েক ব্রান্ডি বোতলও যথা নিয়মে থরে থরে বুকচেতিয়ে টেবিলে আসন গেড়ে রয়েছে। জেনারেল গোফের নিচে মুচকি মেরে হেসে বললেন, ‘শোনেন, সব কথা তো আর মঞ্চে বলা যাবে না। মঞ্চ হল মিথ্যাচারের বেদি। এখন বলতে পারেন সত্যের গোপন গোলটেবিল বৈঠক হবে। মনে রাখবেন রাজনীতির সত্য সব সময়ের জন্য গোপন। এটাই রাজনীতির মূলমন্ত্র।’ উপস্থিত নেতাদের ঘাড় নেড়ে সায় দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো গতি আছে বলে মুখে স্পষ্ট নয়।
ওদিকে সন্ধ্যার প্রায় গত। জেনারেল হাই তুললেন। সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমাদের পরবর্তী কার্যপ্রণালী কী কী হবে সবই দলীয় গোপন সংবিধানে লেখা আছে। আখলাস ওগুলো আপনাদেরকে পার্ট বাই পার্ট বুঝিয়ে দিবে। আপনাদের এখানে ডাকা হয়েছে জাস্ট একসঙ্গে বসে একটু মদমাস্তি করার জন্য। আমার বয়স হয়েছে এখন আর বিশেষ খাইতে পারি না। ওই একটি জিনিস বাদে।’ গোফের নীচে আবারও মুচকি হাসলেন জেনারেল। ওই একটি জিনিস বলতেই দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির মনে পড়ে গেল, ‘এই যা, জেনারেল সাহেব তো বিকালেই সোনাভানের কথা বলেছিলেন। এখনো তো তাকে আনা হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে সে স্থান পরিত্যাগ করল। এই কাজের উপর তার দলীয় পদটা একটু উপরে ওঠার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হবে। টেবিলের উপর ঠোকাঠুকির আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। ওদিকে জেনারেল লাগোয়া বারান্দায় অপেক্ষা করছে ওই একটি জিনিসের জন্য। ফুরফুরে বাতাস তার অল্প চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। তিনি বারবার চেষ্টা করছেন কপালের টাকটাকে ঢাকতে কিন্তু পারছেন না। শরীরটাও মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে অন্যরকম বাতাসে। নিজেকে সামাল দিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন তিনি। খাটের উপর গা’টা একটু এলিয়ে পা টানটান করে হেলান দিলেন খাটের পিঠে। খুব বেশিক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হল না। খটখট শব্দ শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে গেলেন দরজার কাছে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সেই আদিম গন্ধ তার সমস্ত গা ভিজিয়ে দিল। কিছুটা লাজুক সুরে তিনি বললেন, ‘ওহ্, শেষ পর্যন্ত তুমি এলে তাহলে !’ লজ্জায় মুখটা নিচু করে আছে সোনাভান। বুক ফুলিয়ে নিজের অবস্থান কত শক্ত এমনটি বুঝিয়ে বড় নেতা হবার স্বপ্নে বিভোর পাতি নেতা বিদায় নিল। জেনারেল বসতে আহ্বান জানালেন সোনাভানকে। সারা ঘরময় আদিম মাটি-মাটি গন্ধের সঙ্গে যোগ হয়েছে এবার বাবলা ফুলের গন্ধ। সোনাভান পায়জামায় গুঁজে আনা একগুচ্ছ বাবলা ফুল উপহার দিলো জেনারেলকে। ফুল দেখে জেনারেলের আনন্দ আর ফুরায় না। মুখের উপর টগবগ করে ফুটতে থাকে আনন্দ জোয়ারের পানি। এ যেন অন্যরকম গ্রহণ। জেনারেলের মাথার মধ্যে ধা ধা করে ঘুরতে থাকে কামনার বাতাস। পূর্বে কখনো তিনি এভাবে গ্রহীত হননি। তিনি পুরো মাতাল, (যদিও তিনি একপেগের বেশি খাননি আজ) আনন্দে বিভোর। হুইস্কির গন্ধে নয়, তিনি আজ ডুববেন শরীরের গন্ধে। দরজা বন্ধ হবার পর মুখ খোলে সোনাভান, ‘আচ্ছা সবাই বলে আপনার নাকি নলের দোষ!’ জেনারেল ষোড়শী সোনাভানের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, ‘সেটা আবার কী? একটু বুঝিয়ে বলো?’ সোনাভান বলে, ‘মানে আপনি নাকি লুচ্চো?’ কথাটি জেনারেলের কানকে আগুনের হলকা হয়ে পুড়িয়ে ফেলে। কোনোরকম নিজেকে সামাল দেন তিনি। বাস্তবে যায়-ই হোন তিনি তো আর এসব কথা মুখে শুনে অভ্যস্ত নন। রাগে গরগর করতে থাকলেন তিনি। মুখে বললেন, ‘ওসব শুয়োরের বাচ্চাদের কথা বাদ দাও। তোমার কেমন লাগছে আমাকে?’ ঠোঁটের কোণে হাসি ছড়িয়ে বাম গালে টোল বসিয়ে সোনাভান বলে, ‘আমার কাছে তো বোম্বের হিরোদের মতন লাগছে আপনাকে?’ থানা শহরে এতো সুন্দর এক মেয়ের মুখে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা দেখে জেনারেল আরও মুগ্ধ হলেন। উচ্ছ্বাসে বললেন, ‘তো দূরে কেনো? কাছে আসো, আরও কাছে।’ একটু আড়ষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে কাছে যেতে থাকে সোনাভান। ওদিকে জেনারেল সুখের আবেশ মাখবে, এমন ভাব করে চোখ দুটো বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন ধবধবে রঙিন চাদর বিছানো খাটের উপর। পরণে সাদা পায়জামা। সোনাভান বুকে হাত রাখল জেনারেলের। এরপর আস্তে আস্তে বুক থেকে পেট, পেট থেকে নাভিমূলের কাছে পায়জামার দড়িতে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কুঁকড়ে গেলেন জেনারেল। তারপর আবার পা’টা সটান করলেন। দেহে তার অন্যরকম পুলক এখন। কামনা জড়ানো কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘জানো সোনাভান, আজকাল মানুষ ভালোবাসতেই ভুলে গেছে।’ এমন আবেগময় কথায় সোনাভানের কেমন জানি লাগে। কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হয় সে। জেনারেল বললেন, ‘কই আসো?’ এবার সোনাভান সরাসরি মাথা রাখল জেনারেলের বুকের উপর। আবেশে জেনারেল আবারও চোখ বন্ধ করলেন। সোনাভান পায়জামার গিঁট থেকে বের করল পলিথিনে প্যাঁচানো বাবলা গাছ থেকে পাড়া ফুল ও বিষপিঁপড়া রাখা প্যাকেট। ফুলটা আলাদা করে জেনারেলের ইতোমধ্যে খালি হওয়া বুকটাতে রেখে বুলাতে লাগল। প্রথমে একটু সুড়সুড়ি লাগলেও পরে বেশ আরামবোধ হয় জেনারেলের। গভীর আরামে জেনারেল তখন চূড়ান্ত মহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়। একবার চোখদুটি খুলে আবার বন্ধ করলেন। চোখ খুলে নয়, তিনি ভাবলেন চোখ বন্ধ করেই অনুভব করবেন চূড়ান্ত মুহূর্তের প্রথম অংশগুলোর অনুভূতি। সোনাভান সুকৌশলে প্যাকেটের মুখ খুলে বিষপিঁপড়া চালান করে দিলো জেনারেলের পায়জামার ভেতরে। জেনারেল প্রথম ভাবলেন, সেই জংলি হলুদ রঙের ফুল। কিন্তু অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তার ভুল ভাঙল। চিৎকার করে উঠে তিনি বলতে লাগলেন, ‘কে কোথায় আছো, আমাকে বাঁচাও, এ ডাইনী আমাকে মেরে ফেলল।’ যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল দৌড়ে এলো রুমে। সবাই একসঙ্গে হুড়মুড় করে ঢোকার কারণে খুব সহজে এক ফাঁক গলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় সোনাভান। সবাই তখন জেনারেলকে নিয়ে ব্যস্ত। সোনাভানকে পাকড়াও করতে হবে একথা ভুলে যায় সবাই। নিজের গোপনাঙ্গ মুঠোর ভেতর ধরে আছেন জেনারেল সাহেব। এদিক ওদিক খুঁজে কে একজন আবিষ্কার করল বড় এক কালো রঙের বিষপিঁপড়া। উপস্থিত নেতাগণ বুঝতে পারলো কাজটা দুষ্টু সোনাভানের। কিন্তু তাকে কিছু বলার আগে জেনারেলকে শান্ত করতে হবে। ডাক্তারের কাছে গেলে ব্যাপারটি জানাজানি হলে লজ্জার শেষ রবে না, সেই ভেবে সবাইকে নিষেধ করল জেনারেলের ধরমপুত্র আখলাস। ওদিকে পাজামা ফুঁড়ে গোপনাঙ্গটি ফুলে বের হচ্ছে। একে একে কথা বলে আপাতত এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, জেলে পাড়া থেকে মুচি ডেকে এনে বাঁশের এক খাঁচা বানানো হবে। তারপর ফুলে ওঠা জেনারেলের বিশেষ অঙ্গ যাতে বেশি নড়াচড়া করতে না পারে সেই লক্ষ্যে খাঁচার মধ্যে পুরে রাখা হবে এটি। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুচি এসে হাজির। ফিতে দিয়ে মেপে নিল পরিমল মুচি। সেই মোতাবেক আধাঘণ্টার মধ্যে দ্রুত বানিয়ে ফেলল খাঁচা। এখন এটার মধ্যেই ঢুকানো হবে জেনারেলের বিশেষ অঙ্গ। খাঁচা হাতে পরিমল এগিয়ে গেল জেনারেলের দিকে। একজন মুচি জেনারেলের বিশেষ অঙ্গে খাঁচা পরাবে! ব্যাপারটি চোখে লাগে ধরমপুত্র আখলাসের। সে সঙ্গে সঙ্গে খাঁচাটা পরিমলের হাত থেকে এক প্রকারের কেড়ে নিয়ে নিজেই পরাতে উদ্ধত হল। কিন্তু বিধিবাম! খাঁচা তো ছোট হয়ে গেছে। আখলাস গালাগালি করে বলল, ‘কী ধোন বানাইছিস ?’ ভয়ে ভয়ে পরিমল বলে, ‘ মাপ তো ঠিকই নিইলাম, ছারের ওটা আগের থেকে বড় হয়ি গিলি আমি কী করবো ?’ আখলাস চিৎকার করে বলে, ‘আবার বানা।’
ভয়ে ভয়ে আবার বানাতে বসে পরিমল। আধা ঘণ্টা পর তৈরি হল নতুন খাঁচা। সেটিরও একি দশা। ছোট হয়ে গেল। এভাবে সারারাত একবার বানায়, আরেকবার ভাঙে। চলতে থাকে ভোর পর্যন্ত। অবশেষে ভোর রাতে জেনারেলের বিশেষ অঙ্গ আর না বেড়ে বরং কিছুটা চুপসে যায়। এইবার পরিমল মুক্তি পায়। খাঁচাটা খাপে খাপে লেগে যায়।


লুঙ্গি পরে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন জেনারেল। এখনি হেলিকপ্টার আসবে তাকে নিতে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। বাড়িতে করাতে হবে গোপন ট্রিটমেন্ট। প্রয়োজনে তিনি হাসপাতালকে বাড়িতে নিয়ে আসবেন, তবুও হাসপাতালে যাবেন না। ব্যাপারটি খুবই গোপনীয়। ইজি চেয়ারে বসে হালকা দুলতে দুলতে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। তাড়াহুড়া করে উঠতে গিয়ে গোপনাঙ্গে চাপ লাগলো। উহু করে উঠলেন। এতে তিনি দমলেন না তেমন। আখলাস উদ্দিনের বাড়ির বিরাট ছাদ। সেখানেই ল্যান্ড করল জেনারেলের ব্যক্তিগত ছোট হেলিকপ্টারটি। বাড়ির আশেপাশে জনগণ দাঁড়িয়ে আছে জেনারেলকে শেষ দেখা দেখতে।
কিন্তু তারা কোনোক্রমেই বুঝতে পারবে না আজ জেনারেল তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়াবেন না। কোনোরকম দু’ঠাং ফাঁক করে কোমরটা একটু নিচু করে হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে যাবেন তিনি। অতঃপর হেলিকপ্টারে উঠেই তাড়াতাড়ি স্টার্ট দিতে বলবেন। এরপর সিটে বসে দ্বিতীয় নির্বাচনী প্রচারণা করতে এখানে আসতে হবে, এটি ভেবে উত্তেজনা বশত কড়াৎ করে টান পড়বে তার বিশেষ অঙ্গে। অন্যদিকে সোনামুখী গ্রামের ছেলেমেয়েরা হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে সবাই যখন আকাশের দিকে তাকাবে, ঠিক তখন আলোচ্য গল্পের আদিম গন্ধের ষোড়শী-একরোখা-রাগি-গালে টোলপড়া বালিকা সোনাভান একদলা কাঠের কয়লা নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে হেলিকপ্টারের দিকে একবার তাকিয়েই মাটিতে ফেলবে একদলা কয়লা মিশ্রিত থুতু।


 

তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প ডাক্তারের কাঁচের অফিসের বাইরে থেকে লাবণ্যকে দেখছেন তার মা আয়েশা আফরোজ। পরীকে হারিয়ে লাবণ্য এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। প্রতিরাতে না ঘুমিয়ে বসে থাকে; পরীর জন্য কেনা ড্রেসগুলো ভাঁজ খুলে আবার ভাঁজ করে, ঘুমের মাঝে হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠে

 

স্বপ্নমৃত্যু
ইসলাম আমিনুল

এক.
অর্ক আজ অনেক খুশি। হাসপাতালের কাছেই নাকি একটি পরিচয়হীন শিশু পাওয়া গিয়েছে। এক কলিগ অফিসে আসার পথে দেখেছেন। খবর পেয়েই লাবণ্যকে কিছু না জানিয়ে সাত পাঁচ না ভেবে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিল অর্ক। লাবণ্য নিশ্চয় খুশিই হবে। এই আজকের জ্যামও অন্যদিনের চেয়ে বেশি। যদি তার পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়। অন্য কেউ যদি নিতে চায় শিশুটিকে! আজ লাল বাতিটাও যেন পারমানেন্ট হয়ে গেছে। কতক্ষণ ধরে যে সিগন্যালে বসে আছে! ঘড়িতে সময় দেখল অর্ক। লাবণ্যের ডাক্তারের সাথে একটু আগে কথা হয়েছে। এখন লাবণ্যের এপয়েন্টমেন্ট। মা লাবণ্যকে নিয়ে গেছেন। অর্ক এখানে আসাতে লাবণ্যের সঙ্গে যেতে পারেনি। লাবণ্যের জন্য খারাপ লাগছে। আবার ওকে এমন একটা সারপ্রাইজ দিতে পারবে ভাবতেই ভালো লাগছে। যাক, অবশেষে সবুজ বাতির দেখা মিললো। অর্কের গাড়ি চলতে শুরু করলো।

দুই.
লাবণ্য বসে আসে মনোবিজ্ঞানী ডাঃ আসাদুজ্জামানের সামনে।
- মিসেস লাবণ্য, কেমন আছেন আপনি?
- জ্বি ভাল। আমাকে শুধু শুধু অর্ক আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলল। আমার পরীটা মনে হয় বাসায় কাঁদছে।
- পরী? আপনার মেয়ে?
- জ্বি, তিন মাস বয়স।
- কোথায় রেখে এসেছেন?
- বাসায় মা’র কাছে।
- কিন্তু আপনার মা তো আপনার সঙ্গে এসেছেন।
- তাহলে অর্ক আছে পরীর সঙ্গে অবশ্যই।
- মিস্টার অর্ক তো একটু আগে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। উনি অফিসে।
- তাহলে কি পরী বাসায় একা? আমার এক্ষুণি যেতে হবে।
- মিসেস লাবণ্য, প্লিজ ডোন্ট Worry. বাসায় কেউ নেই। আপনার পরী জন্মের তিনদিন পর মারা গিয়েছে। She is dead.
- না, পরী তো বাসায়, ওর বয়স তিন মাস। আপনি আমার সঙ্গে বাসায় চলুন।
- মিসেস লাবণ্য, পরী আপনার কল্পনা। আপনার সন্তান আমাদের সঙ্গে আর নেই। এটা আপনার মেনে নিতে হবে।

তিন.
ডাক্তারের কাঁচের অফিসের বাইরে থেকে লাবণ্যকে দেখছেন তার মা আয়েশা আফরোজ। পরীকে হারিয়ে লাবণ্য এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। প্রতিরাতে না ঘুমিয়ে বসে থাকে; পরীর জন্য কেনা ড্রেসগুলো ভাঁজ খুলে আবার ভাঁজ করে, ঘুমের মাঝে হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠে। মেয়ের কষ্ট তার আর সহ্য হচ্ছে না। গত সাতটা মাস কত স্বপ্ন দেখে কাটিয়েছে লাবণ্য! পরী জন্ম হওয়ার পর ডাক্তার বললেন প্রিমোচিউর বেবি, অনেক কম্প্লিকেশন। তিনদিন সময় দিল পরী, তারপর সব স্বপ্ন সঙ্গে নিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে।

চার.
স্থানীয় থানায় খবর দেয়া হয়েছে। হাসপাতালের পাশেই যে পরিচয়বিহীন শিশুটি পাওয়া গিয়েছিল সে মারা গেছে। অনেকক্ষণ ধরেই হয়ত শিশুটি সেখানে ছিল, কেউ খেয়াল করেনি। একজন অফিসার ব্যস্তভঙ্গিতে সকল ফরমালিটিস পূরণ করেছেন। সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এক ভদ্রলোক পরিচয়বিহীন এই শিশুটি, যাকে তার পরিবার ফেলে চলে গেছে তার পাশে বসে অঝোর ধারায় কাঁদছে।


 

তরুণ প্রজন্মের ৮টি গল্প আজ পারুলের কোন নাম নেই; কেউ তাকে সনাক্ত করতেও আসেনি। মমিন কিছুক্ষণ জানালার ফাঁকা দিয়ে একটা মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটিকে মৃত্যুর সময়ে তার পরিচয়টুকুও দেয়ার সাহস মমিনের নেই। যেই শরীরকে নরম স্পর্শ দিতো যে হাতে; ওই হাতেই কাটতে হচ্ছে পারুলের শরীর

 

সেই জোয়ারের লজ্জা নেই
মেহেদী শামীম

মমিনের মাথার মধ্যে মাগুর মাছের পুকুর। থৈ থৈ করছে চিন্তার ঝাঁক, সাঁতরে বেড়াচ্ছে গোটা মগজজুড়ে। সিগারেটের ভেতর থেকে তামাকের পাতাগুলো শূন্য করার কাজে ব্যস্ত তার হাত। কিছুক্ষণেই সমস্ত সিগারেট শূন্য। তামাক আর গাঁজার মিহি পাতাগুলো ঠেসে ঠেসে সিগারেট ভর্তি করা ইতোমধ্যেই শেষ। মমিন বিশেষ দিনে বেনসন সিগারেটের মধ্যে গাঁজা ঢুকিয়ে খায়। একটু বেশি মজার পাওয়ার জন্য।
গাঁজার ইস্টিক তৈরি হয়ে গেছে। দেশলায়ের আগুনে চিরচির করে পুড়ছে সিগারেট। ভাঙা জানলা দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক গাঁজার গন্ধ। স্বাভাবিক জীবন-ভাবনা থেকে সে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। ঘরের মধ্যের অন্ধকার চারপাশের দেয়াল ভেঙে ছুটে গেছে চায়ের দোকান পর্যন্ত। চায়ের দোকানও আবছা আবছা লাগছে। সবকিছুর মধ্যেই কেমন হালক রঙের কায়া হয়ে উঠছে। ভাত পঁচা পানি অর্থাৎ বাংলা মদের গন্ধ ঘরের বাতাসের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে গেছে। মশার ভন ভন সুরেলা সংগীতে আর বিরক্ত হচ্ছে না মমিন। শুধু মমিন কেন সমস্ত পৃথিবীই তখন অস্বাভাবিক।
এই ঘরটা যতই ঝাড়– দেয়া হোক না কেন ময়লা হয়েই থাকে। ময়লার সাথে এই ঘরের একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। দেয়াল খসে খসে বালুর সাথে চুন রঙ মাখামাখি অবস্থায় লটকে পড়ে ফ্লোর জুড়ে। একটা অলৌকিক গন্ধে ভূতুরে হয়ে উঠছে ঘরের নিজস্বতা। এই ঘর গিলে খেয়েছে অজস্র সূর্যের তাপ।

হিপোক্যাম্পাস শব্দটির সাথে পরিচয় অনেক আগেই ডাক্তার জহিরের। তিনি এখন দায়িত্বরত অটোপসি ডাক্তার। কিন্তু সে কিছু সময় হিপোক্যাম্পাস নিয়ে চিন্তা করবে। মানুষের মষ্কিকে হিপোক্যাম্পাস অংশে স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা থাকে এবং এই অংশ মানুষকে সৃজনশীল চিন্তা করতে সাহায্য করে। আর এই দুটি ক্ষমতা সক্রিয় এবং শক্তিশালী করতে হলে হিপোক্যাম্পাসে নিউরোনের জন্ম হতে হয়। যখন কেউ যৌন সঙ্গম করে তার হিপোক্যাম্পাসে প্রচুর নিউরোনের জন্ম নেয়। জহিরের মাথায় একটি প্রশ্নের গোল বারবারই গোল-পোস্টের কাছে এসেই ফিরে যাচ্ছে মাঠের মাঝখানে। সেই প্রশ্নটা কিছুটা এরকম একজন প্রতিতা প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বার যৌন সঙ্গম করে তবে ওদের মধ্যে স্মৃতি ধারণ করার ক্ষমতা অথবা সৃজনশীল চিন্তার উৎকর্ষতা তো উচ্চ পর্যায়ের হওয়া উচিত। কিন্তু জহিরের হাতে তেমন সময় নেই ওইখানেই তার চিন্তায় ফুলস্টপ দিয়ে রাখলো। তবে পাঠকের সুযোগ আছে এই বিষয়ে বিশদ চিন্তা করার।

হাসপাতালের ফ্লোর জুড়ে শয্যায়িত এক ডজন মৃত শরীর। আঘাতে জর্জরিত আরও মৃতের সংখ্যার অপেক্ষায় বসে আছে বেলকুনির এক পাশে মমিন অন্য পাশে জহির। মমিন ও জহির যখন ময়নাতদন্ত করে ওই সময়ে তারা দুজন দুজনের দিকে খুব বেশি তাকায় না। ‘ময়নাতদন্ত’ শব্দটি নিয়ে অনেক গুজব রটিয়েছে মমিন কখনো বলেছে, এক গ্রামে ময়না নামে একটা সুন্দরী মেয়ে ছিলো। তাকে তার স্বামী যৌতুকের জন্য মেরে গলায় ফাঁস দিয়ে রেখেছিলো। তার মৃত্যুর কারণ খোঁজার জন্য ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার নাম দিলো ‘ময়নাতদন্ত’। আবার কখনো মমিন বলেছে, ময়না পাখি খুব কালো অন্ধকারে তাদের দেখা যায় না। আর কোন মৃত্যুর পরে প্রথমেই বোঝা যায় না কিভাবে মৃত্যু হলো। তাকে খুঁজে বের করতে হয়। যেমন ময়নাপাখিকে অন্ধকারে খুঁজে বের করতে, তেমনই খুনের রহস্য বের করার জন্য যে তদন্ত করা হয় তাকে ময়না তদন্ত বলে।
এই কাজে যখন দুজনে আসে খুব নীবিড়ভাবে দায়িত্ব পালন করে যায়। তাঁরা দুজনেই দুটি আলাদা প্রক্রিয়ায় নিজেদের অস্বাভাবিক করে। তারপরেই কাজে নেমে পড়ে। আজ আরও কিছু সহকর্মীর দরকার হবে। মৃতের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে দিয়ে।
মমিন এবং ডাক্তার জহির পরিপূর্ণ অস্বাভাবিক। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা প্রখর সবকিছুই তারা নখ দর্পণে নিয়ে ফেলে অল্প সময়ের মধ্যেই। অস্বাভাবিকতাই তাদের বিচক্ষণতার পথে হাটতে শেখায়। মমিন ও জহিরের মধ্যে এক ধরনের সম্মিলন রয়েছে তারা দুজনই পারস্পারিক ইশারার ভাষায় দক্ষ।
এই শহর আজ সকাল থেকেই অন্ধকারে ডুব মেরেছে। চোখে আচ্ছন্ন দেখছে শহরের সমস্ত মানুষ। সূর্য বোধহয় আলো সঞ্চয়ে ব্যস্ত হয়েছে। ডাক্তার জহির ঘুম থেকে উঠে সকালের শেষের দিকে। মমিনের আবার একটু তাড়াতাড়ি উঠতে হয়। তার স্ত্রী আবার টাঁটকা-তাজা বাজার ছাড়া রান্না ঘরে যায় না। আজ সকালেই ডাঁটা শাঁক কিনেছে মমিন, তাজা ডাঁটা শাঁক। ঠিক যেমন তাজা তার সামনে একটি লাশ। লাশের চরিত্রে আছেন একজন তরুণী। তার কোন পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। মমিন খুব ভালো করেই জানে এই হত্যার ঘটনা। কেন মারা হয়েছে এই তরুণীকে অথবা সবাইকে। তাও তাকে এই লাশ কেঁটে-ছিঁড়ে ডাক্তারকে প্রতিবেদন লিখতে সহযোগিতা করতে হবে। হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করার জন্য। মমিন প্রতিদিন হত্যার রহস্য খোঁজে মানুষের মৃত শরীরের মধ্যে। তল্লাশী করে বেড়ায় সমস্ত শরীর কোথাও কোন আঁচর অথবা আঘাতের দাগ দেখলেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে ওইখানে। কাজগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে বলেই মুখ না দেখে-ই কাঁটা শুরু করলো মমিন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চোখ ছুটোছুটি করতে করতে মমিনের চোখ আটকালো মেয়েটির বুকে শক্ত দাঁতের কামড়ে ক্ষত হওয়া চিহ্নে। পরিচিত হয়ে উঠলো মেয়েটি মমিনের কাছে। গতরাতেই সে এই মেয়েটির সাথে শুয়েছে। গতরাতে কেন প্রতি সপ্তাহে প্রায় তিন-চারবার মেয়েটির সঙ্গী হয় মমিন। কিন্তু মমিন তো পরিপূর্ণ অস্বাভাবিক। সে আবেগে আপ্লুত হয় না। হওয়ার সুযোগও নেই। তবে তাকে পুলিশের খপ্পরে পড়তে হবে। কিন্তু মানুষের চোখের পানির নিয়ন্ত্রণ বেশির ভাগ সময়েই মানুষের কাছে থাকে না। হু হু করে মমিনের বুঁকের মধ্যে কান্নার দমকা হওয়া দাপাদাপি করছে। দম আটকে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছে না। বুকের এই ক্ষত মমিন ইচ্ছা করে দেয়নি। পারুল তাকে বাধ্য করেছে এই ক্ষত করে দিতে। মমিনের সঙ্গ পারুলকে নৈসর্গিক আনন্দ দিতো। গতরাতেই মমিনকে অনুরোধ করে বলে তুমি আমার বুকে একটা কামড় দিয়ে ক্ষত করে দাও। সে দিতে চায়নি। মমিনের কষ্ট হচ্ছিলো পারুলের শরীরে ক্ষত করতে। পারুলের বুক ছিলো বাজারে পনিরের গোল স্তুপের মতো। ওইখানে আঘাত না, ঠোঁটের ছোঁয়া-ই দিতে চায় মমিন। কিন্তু পারুলের প্রবলচাপে মমিন বাধ্য হয়েছে ক্ষত করতে।
আজ পারুলের কোন নাম নেই; কেউ তাকে সনাক্ত করতেও আসেনি। মমিন কিছুক্ষণ জানালার ফাঁকা দিয়ে একটা মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটিকে মৃত্যুর সময়ে তার পরিচয়টুকুও দেয়ার সাহস মমিনের নেই। যেই শরীরকে নরম স্পর্শ দিতো যে হাতে; ওই হাতেই কাটতে হচ্ছে পারুলের শরীর। পারুলের নাভির দিকে যখন মমিনের খসখসে দাঁড়ির খোচা লাগতো তখন পারুল আচমকা দাপাদাপি শুরু করে দিতো। কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠতো। ঝাঁপটে জড়িয়ে ধরতো মমিনকে। কিন্তু সেই নাভি ভেতর আর বিদ্যুৎ নেই। জ্বলে ওঠা আগুন নেই। সমস্ত শরীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শেষ। মমিন এবার পারুলের শরীরে মিহি সেলাই করছে। ধবধবে ফর্শা চামড়াগুলো টেনে টেনে জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে একটা আস্ত পারুল তৈরি করছে। পারুলের শরীর যেন নকশী কাঁথা তাকে একটা গঠন দেয়ার জন্য মমিন চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই আস্ত হয়ে উঠছে না। মানুষের শরীর সেলাইয়ে সে দক্ষ কারিগর কিন্তু যে শরীর সে সেলাই করছে এই শরীরের অঙ্কের যোগফল অতি জটিল।

কিছুদিন আগের থেকেই সবাই টের পেয়ে গিয়েছিলো শহরে একটা গণ্ডগোল লাগবে। ভাঙচুর হবে। উচ্ছেদ করা হবে একটা পাড়া। যেখানে চাহিদা পূরণ করা হয় শহরের বিবাহিত, অবিবাহিত প্রায় সমস্ত পুরুষদের। কিন্তু সেখানেই আর একটি চাহিদার জন্ম নিয়েছে। একটি চাহিদার সাথে আরও একটি চাহিদার যুদ্ধ চলছে। অর্থনীতি বলে সম্পদ সীমিত; এই সীমিত সম্পদের মধ্যেই যোগান-চাহিদার যুদ্ধ হয়। যে টিকে থাকে সেই বেঁচে থাকে। সমাজসেবী হারুন মাতবর, জলিল মাহমুদরা পাড়াটি সংরক্ষণের জন্য চার দেয়ালের ভেতরে বসেই উদ্যোগ তৈরি করছে, উদ্যোগ ভাঙছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলছে না কিছুই। শহরের এই উদ্যোগের বৃষ্টিপাত হলে কাদাময় হয়ে উঠবে সমাজসেবীরা। তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ দেয়ালেবন্দি।
অন্যদিকে কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষের উদ্যোগ মাইকের আওয়াজ হয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এই উদ্যোগের বিরোধীতা করে না কেউই অপবাদের ভয়ে। মমিন মাঝে মাঝেই চায়ের দোকানে চেষ্টা করে বিরোধীতা করার। বলার চেষ্টা করে, না এটা ঠিক না; মানবাধিকার বলে তো কিছু থাকলো না। চায়ের দোকানের কেউ কেউ চুপ হয়ে যায়। কেউ কেউ মমিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মমিন খুব দ্রুত চায়ের দোকান ত্যাগ করে বিষয়টি হালকা থাকতে থাকতেই।
আবার আর একটা চায়ের দোকানে বসে। আলোচনায় উঠানোর চেষ্টা করে আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা কি সত্যিই ধর্মপ্রান মানুষ। একবার একটু ঘেঁটে দেখেন তো। নাকি অন্য কোন মতলব আছে। চায়ের দোকানের মানুষগুলো ঘিরে ধরে মমিনকে। মমিনের কণ্ঠের স্বর আর শোনা যায় না। দশ-বিশটা কণ্ঠ তাকে দাবিয়ে দেয়। চায়ের দোকান থেকে চারপাশে ছুটে আসে মোটা আওয়াজ, ‘যেই মতলবই থাকুক শহরটা পাপমুক্ত হবে’। কিন্তু মমিন এই লোকগুলোর মধ্যেই অনেক পাপীকে খুব ভালো করেই চিনে। সাইকেলের প্যাডেলে দ্রুত পা চালিয়ে মমিন বাসায় ফিরে তাজা তরকারি নিয়ে। কিন্তু মমিনের ঘরের মধ্যে আজ আরো একটি চায়ের দোকান উদ্বোধন হয়েছে। এই চায়ের দোকানে সব সময় চিনির পরিমাণ বেশি দেয় চায়ে। চা তখন সরবতে পরিণত হয়। মমিন যখন পারুলের সাথে দেখা করতে যেতো তখন পারুলের ঘরের পাশে চায়ের দোকানে এমন সরবত ধরনের চা বিক্রি করতো। ওই চায়ের ক্রেতাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলো ডাইলের নেশাখোর। কিন্তু তার ঘরের চায়ের দোকানে কেউ ডাইল খায় না। তবে কেন এমন সরবতের মতো চা হয় ঘরে এই প্রশ্নের উত্তর মমিন আজকে পাবে না। এমনকি ভবিষ্যতে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। তাছাড়াও মমিনের প্রশ্ন করার অধিকার নেই। তাকে শুধু উত্তর দিতে হয় প্রশ্নের। মমিনের বউ লাইজুর মুখোমুখি মমিন। মমিন যখন লাইজুরে সামনে দাঁড়ায় তখন মমিনের মধ্যে ঢাকা শহরের হর্নগুলো বাজতে থাকে প্যা.. পু.. প্যাঙ..।

ঘরের মধ্যে উচ্চ স্বরে স্টার জলসায় চলছে ভালোবাসা ডট কম। টিনের চিকন ফুটা দিয়ে আলোর একটা তীর এসে গেঁথেছে মমিনের পানজাবিতে। লাইজুর শরীর থেকে পেঁয়াজের তীক্ষ্ণ ধাচ্ এসে নাক দখল নিয়েছে মমিনের। একদল হাঁস এসে সমবেত হয়েছে জানালায়। মাঝে মাঝে মমিনের মনে হয় সে একটা লঞ্চে বসবাস করে। তার ঘরের তিনপাশেই পানি। হাঁস, টাঁকি মাছ, সিং মাছ, পুঁটি মাছ এসে উঁকি-ঝুঁকি মারে জানালায়। মাঝে মাঝে বড়শি দিয়ে ঘরে বসেই মাছ শিকার করে মমিনের ছোট ছেলে সবুজ। কিন্তু সেই মাছ ঘরে রান্না করতে নারাজ লাইজু। সে বলে এই মাছ নাকি গুহা পানির মাছ। এই মাছগুলো খাদ্য তালিকায় প্রথমেই নাকি আছে মানুষের গু। আর গুহা পানির মাছ তার কড়াইতে সে রাঁধবে না। লাইজু সুস্বাস্থ্যবান একজন মহিলা। তার সমানে মমিন ছোট-খাটো পুরুষ। লাইজুর পড়নের মেক্সির কাপড় দিয়ে তিনটা বালিশের কাভার বানানো সম্ভব। কিন্তু মমিনের শার্টের কাপড়ে একটা বালিশের কাভারও হবে না। লাইজু একদিন তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়েছে এই নিয়ে। সে চিৎকার করে বলে তোমার জামা কাপড় এত্তো ছোট্ট ছোট্ট তা দিয়ে কিচ্ছু হয় না। তুমি কোন কামেই আসো না সংসারের। মমিন খাটের উপরে বসে ঘাড় উঁচু করে লাইজুর দিকে তাকিয়ে আছে। মাছির ভন ভন সুরে বিরক্ত লাইজু।

ইঙ্গিত-ভঙ্গিতে লাইজু তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে তুমি কি সব বলে বেড়াও বাজারে। তোমার সমস্যা কোথায় ?
তোমার উদ্দেশ্য কি ?
তুমি কি ওই পাপের মধ্যে যাও?
মমিন এই প্রশ্নগুলো শুনে আবার পারুলকে নিয়ে চিন্তা করে। পারুল কত সোজা-সাপটা কথা বলে। কোন কিছুই ইঙ্গিত দিয়ে বোঝায় না। যা বলে, কিলিয়ার-কাট কথা। আর লাইজু আমার দলিল করা স্ত্রী সে আমার সামনে খোলাসা করে কোন কথা বলতে পারে না। খালি লজ্জা পায়। জগৎটা আসলেই উল্টা। মমিনের কানের মধ্যে একটা মাঝারি ধরনের আওয়াজ হয়। মমিন টের পায় লাইজু খুন্তি দিয়ে টেবিলে আঘাত করেছে। তারপরেও মমিন কোন উত্তর দেয়নি লাইজুকে, অনেক সাহস সঞ্চয় করে লাইজুর দিকে তাকে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়-
আচ্ছা, তুমি চায়ে এতো চিনি দাও কেন?

মমিনের অনেকগুলো রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হতো। লাইজু পাশে শুয়ে থাকলেও লাইজুকে স্পর্শ করার অধিকার মমিনকে দেয়া হয় না। মমিন যেদিন বেতন পেতো ওইদিনই মমিনের স্বর্গীয় রাত। সমস্ত ঘর মমিনের কাছে মধুময় হয়ে উঠতো। মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকেই মমিন একা হয়ে যেতো। তখনিই মমিন পারুলকে খুঁজে পায়। পারুলই মমিনকে উদ্ধার করে। মমিন অনেক রাতেই গ্রাম থেকে আসা কাজের মেয়েটার ঘরে ঢুকে পড়তো। কিন্তু কিছু করতে পারতো না ফিরে আসতো। কারণ প্রতিদিন সকালের সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের পাশাপাশি তার একটি নিজস্ব সংবাদ মাধ্যম আছে, সেখানে কিছু খবর প্রকাশিত হয়। সেই খবরগুলো সে নিজেই পড়ে। তার এই সংবাদ মাধ্যম তাকে ভীষণ ভয়-ভীতি দেখায়। ওই সংবাদপত্রই মমিনকে সামগ্রিক অপকাজ থেকে দূরে রাখে। তবে সে পারুলের কাছে যাওয়াকে কখনোই অপকাজ হিসেবে দেখেনি। এই বিষয় তার সংবাদপত্রও আপত্তিকর কোন খবর প্রকাশ করেনি। কেন করেনি এমন চিন্তা মমিন করেছিলো। কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তে ইহা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর মমিন একটা বিশেষ গুনের অধিকারী সে কখনো একটা বিষয় নিয়ে বেশি সময় নষ্ট করে না।

ডাক্তার জহিরের উপরে অনেক দায়িত্ব। মৃতদের সমস্ত প্রতিবেদন উচ্ছেদকারীদের পক্ষে রাখতে হবে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ। প্রতিবেদনগুলো বিনিময়ে তার একটা আবদারও আছে। সে এই শহর ছেড়ে নিজের শহরে ফিরতে চায়। একটা বদলি সুপারিশ দরকার। সপ্তাহে একটা দিনের জন্যও সে যেতে পারে না বাড়িতে। তাকেও কোন পারুলের ঘরে হানা দিতে হতো রাতের অন্ধকারে। জহির খুব ব্যস্ত আজ। কিন্তু মমিন ক্লান্ত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় লাশের পরে আর তেমন শক্তি পাচ্ছে না। আজ তাকে জহির কয়েকবার দমকও দিয়েছে। শুয়ে থাকা প্রায় অনেকগুলো লাশকেই জহির খুব ভালো করে চেনে। জহির বহুগমন পুরুষ। কিন্তু লায়লাকে দেখে জহির কিছুটা ভীতস্ত হয়েছে। লায়লার গলায় একটা তিল আছে। হুবুহুব এমনি একটা তিল ছিলো সুমনার গলায়। জহিরের প্রথম প্রেম। তাই সুমনার স্মৃতিচারণ করতে লায়লার কাছে বেশ কয়েকবার যায় জহির। লায়লা অন্যকোন মেকাপ নিতো না। গাঢ় করে কাজল দিতো চোখে। জহিরের আবার মেকাপে অভক্তি রয়েছে। আজও দিয়েছিলো চোখে কাজল। সমস্ত শরীর মৃত হলেও লায়লার চোখ দুটো ছিলো জীবন্ত। ওই চোখ দেখেই জহির ভয় পায়। বেশ ভয় পায়। মমিনের হাত যখন লায়লার শরীর জুড়ে ভ্রমণ করছিলো তখন কয়েকবার মমিনকে দমক দেয় জহির। হঠাৎ হঠাৎ থামতে বলে। মমিন জহিরের চোখের দিকে তাকায়নি একবারও। তাদের কাজের নিয়মে এমনটা নেই। কাজের সময়ে তারা নিজেদের দিকে কখনোই তাকায় না।
রাত বাড়তেই থাকে। ইতোমধ্যে অনেকবার তাদের লাশকাঁটা ঘর থেকে বাইরে যেতে হয়েছে। মিটিং করতে হয়েছে নেতাদের সাথে। আবার ফিরতে হয়েছে কাজে। বাতাসে শঁ শঁ অন্ধকার ভেসে বেড়াচ্ছে হাসপাতালের এলাকা জুড়ে। কোন হ্যালোজিন অথবা এনার্জি লাইটের আলো এই অন্ধকারকে ভেদ করতে পারেনি। জহির, মমিন এবং তাদের সহকর্মীরা নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
তাদের প্রত্যেকেরই দুপুর থেকে প্রস্তুতি ছিলো যে, রাতে অনেকগুলো ময়নাতদন্ত করতে হবে তাদের। হামলা-পালটা হামলা, ইট, হাত বোমা, লাঠির মারামারি। সারাদিন জুড়েই চলছিলো। ঘণ্টা খানেক মারামারি। কিছুক্ষণের জন্য বিরতি। আবার মারামারি শুরু। এমন দফায় দফায় মারামারি চলছিলো সারাদিনজুড়ে। টিভি সাংবাদিকরা ওই দিন তিন-চারবার ফুটেজ পাঠানোর সুযোগ পেয়েছিলো টিভি অফিসে। কারো কারো মাসের বিল বেড়ে গিয়েছিলো দুই-তিনগুন এক ঘটনাতেই। মমিন ঘুম থেকে উঠেছে দুপুর করে। এমন ঘটনা তেমন হয় না। ইদানিং সে দুপুরেই ঘুম থেকে ওঠে। ঘুম থেকে উঠেই স্টার জলসার পর্দায় ‘বেহুলা’ ৬শ তম পর্ব চলছিলো। এই উপলক্ষ্যে তারা একটি বিশেষ পর্ব তৈরি করেছে। সবাই রান্না বন্ধ করে সিরিয়ালটি দেখছে। রাতে দেখতে পারেনি বিদ্যুৎ ছিলো না। তাই দুপুরে পুন:প্রচার দেখছে। বিজ্ঞাপনের সময়ে এক ফাঁকে ২৪ ঘন্টার সংবাদ দেখানো টিভিতে ঘুরতে ঘুরতে যাওয়ার সাথে সাথেই নিজের চেনা পথ ঘাট দেখে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ে মমিন। তখন নিহতের সংখ্যা ২ জন। ঘরের মানুষগুলোর যৌথ প্রতিবাদে রিমোট ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় মমিন। মুখে পানি দিয়ে শার্ট গায়ে জড়াতেই তার সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় লাইজু। লাইজুকে সরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা মমিনের ছিলো না। এই ঘরে মানুষের মৃত্যুর থেকে বেহুলা সিরিয়ালটির ক্ষমতাই বেশি। কি এক অদ্ভুদ টিভির বাঁধনে বেঁধেছে মন।

মোয়াজ্জেম আযান দিতে ঘুম থেকে ওঠার আগেই মমিন ও জহিরের দায়িত্ব শেষ। তারা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরছে। দুজনের চেহারা দুজনে দেখতে গিয়েই তারা দুজনেই বিপদে পরে যায়। নিজেদের কাছে ধরা পরে যায় নিজেরা। একটা লম্বা গোসল শেষে দুজনের বাসায় ঘুমের দরজায় টোকা মারে। শরীরে নিয়মে তাদের ঘুমিয়ে পড়তে হয়। দীর্ঘ মানসিক খাটুনি এবং শারীরিক খাটুনির পরে তারা আর জেগে থাকতে পারেনি। ঘুমাতে তাদের হয়েছে। মমিনের ঘরে এখন নাক ডাকার সুরে রাত হয়ে উঠছে দিনের আলোয়।
জহির শারমিনকে ফোন করেছে। প্রতিদিনই তাদের নিয়ম করে কথা হয়। এতো সকালে যদিও কথা হয় না। বিয়ের পর তারা বেশির রাতই ফোনে কথা বলে বলে নীশি যাপন করেছে। সকালের দিকে তারা ঘুমায়। কিন্তু আজ জহির একটা সুসংবাদ দিয়ে ঘুমাতে যাবে তাই শারমিনকে ফোন করেছে। তার বদলির সুপারিশ খুব তাড়াতাড়ি হচ্ছে। এই সংবাদে একজনের ঘুম ভেঙেছে আর একজন সংবাদ দিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।

সকালের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মানুষ কর্তৃক প্রতিতালয় উচ্ছেদের সময়ে ১৪ জন নিহত, শতাধিক আহত এবং ৫ শতাধিক প্রতিতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়েছে। কিন্তু মমিনের একটি নিজস্ব সংবাদ মাধ্যম রয়েছে। পাঠক তো জানেই। সেখানে প্রতিদিন শহরের নিহতদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেই সংবাদে বানান ভুল হয়। বাক্য গঠনে ভুল হয়। ভাষা শৈলীতে ভুল হয়। কিছু সাহসিক সত্য প্রকাশিত হয়। কিন্তু কেউ পড়তে পারে না সেই সংবাদ। গোপনে গোপনে প্রকাশিত হয় গোপনে গোপনে বিলি হয় মমিনের ঘন কালো চুলের গহীনে। রাতে গাঁজার টানে এবং বাংলা মদের ঘোলাটে জলে ঘোলাটে হয়ে যায় গতকালগুলো। আবার নতুন আলোয় মমিন সকালে বাজার থেকে টাটকা বাজার করে। স্যান্ডির দোকানে চা খায়। চারপাশের লোকজনের কথা-বার্তা শোনে। কিন্তু নিজে কিছুই বলে না।

মমিনের আজকের নিজস্ব সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে কতিপয় জমি দালালের পরিকল্পনায় প্রতিতালয় উচ্ছেদ, ১৪ জন নিহত এবং জমি দখল করে একটি বহুতল শপিং মল এবং একটি লিল্লা বোর্ডিং এতিমখানার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন। এই সংবাদ প্রকাশিত হলেও মমিন নিজেও এই সংবাদ পড়তে পারেনি। কারণ আজ সারাদিন মমিন ঘুমিয়ে থাকবে। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে মমিনের আরেকটি রাত চলে আসবে। সেই রাতে আরো কিছু লাশ আসবে মমিন তাদের ময়না তদন্ত করার আগে আবার গাঁজার ইস্টিকে দেশলায়ের আগুন দিয়ে জোড়ে জোড়ে টান মারবে। বাংলা মদের ঘোলাটে জলে গতকালগুলো ঘোলাটে করে ফেলবে। মমিনের সামনে শুধুই আগামীকাল থাকবে কোন গতকাল থাকবে না।
মমিনের পাশে যে ডাক্তার থাকবে সে হয়তো জহির নয় মিহির। তারাও কাজের সময়ে দুজনে দুজনের দিকে তাকবে না। কিন্তু পরিবর্তন হলো মিহিরের কোন লায়লা থাকবে না শহরে অথবা তার প্রথম প্রেমিকাকে হারানো দুঃখও থাকবে না অথবা দুটোই থাকতে পারে।

পুনশ্চ:

কিছুদিনের জন্য এই শহরে কিছু দামি দামি গাড়ির দৌঁড়া-দৌড়ি লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা তদন্ত করছে। মমিন যেমন মানুষের শরীর তদন্ত করে হত্যার রহস্য উদ্ধার করে তারা তেমন ঘটনা তদন্ত করে হত্যার রহস্য এবং পেছনের ঘটনা উদ্ধার করে বিবৃতি দেয় টেলিভিশনে। মমিনের তদন্ত করতে গাঁজা-বাংলা মদ লাগে। আরও লাগে একটি ভূতের গল্প-কাহিনি সম্মিলিত ঘর। কিন্তু এদের তদন্তে কি লাগে পাঠক জানার চেষ্টা করলে জানতে পারেন।
বিশেষ এ্যাসাইনমেন্টে এই ঘটনার বিশেষ স্টোরি লিখতে একজন মাঝারি বয়স্ক লোকের সাথে একজন তরুণী এমন কয়েকটি টিম এসেছে শহরে। তারা লেকের পাড়ে চা খেয়েছে। হোটেল রুমে ফ্যানের বাতাস খেয়েছে। হাফ রিম প্রতিবেদন লিখেছে।

লিল্লা বোর্ডিং এতিমখানা মাদ্রাসার কাজ দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে। কয়েকবার এখানে মিটিং হয়েছে। এই তহবিলের জন্য টাকা সংগ্রহ চলছে।
বিদেশি কিছু গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থা পরপর কয়েকবার বিবৃতি দিয়েছে। যতদিন ইস্যুটি গরম গরম ছিলো ততদিন স্ব-উদ্যোগে অনেকে অনেক কিছুই বলেছে। আরও কিছু আন্তর্জাতিক ঘটনার ভিড়ে হুট করে ঘটনাটি হারিয়ে গেছে।
এরিই মধ্যে বহুতলা শপিংমলের তিনতলার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। বড় বড় সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে সেখানে রঙিন অক্ষরে লিখেছে ব্যাংক, বীমা অফিস ভাড়া দেওয়া হবে।

এতিমখানা মার্দাসার মিটিং চলছে-ই। কিছুদিন পর পরই মিটিং ডাকা হয়। তহবিল সংগ্রহের জন্য কমিটি করা হয়। কিন্তু কোন ইটের দেখা পায় না এতিম খানাটি।

হঠাৎ করেই একদিন মমিনকে বহুতলা শপিং মলের সামনের লম্বা সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখা গেছে। তিনি বসে বসে মনযোগ দিয়ে একটি মেয়ের সাথে একজন কলেজ পড়ুয়া ছেলের ঘনিষ্ট অবস্থায় গল্প-গুজুবরত দেখছেন এবং মুচকি মুচকি হাসছেন। মেয়েটি-ছেলেটি কিছুক্ষণ গল্প-স্বল্প করেই শপিং মল ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এসেছে। মমিনও বেড়িয়েছে তাদের পিছন পিছন। তারা রিক্সায় উঠছে তাদের অনুসরণ করে মমিনও রিক্সায় উঠছে। রিক্সা গলির ভিতর দিয়ে ছুটছে ছুটতে একটি বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে ছেলে-মেয়ে দুজনই উপরে চলে গিয়ে একটি ফ্লাটে ঢুকলো। মমিন অঙ্ক কষে কষে রসহ্য উদ্ধার করেছে এই ফ্লাটে শুধু ওই মেয়েটি নয় আরো অনেক মেয়ে থাকে। যেই মেয়েটির পিছন পিছন মমিন এসেছে সেই মেয়েটির নাম শায়লা। পারুলের সাথে একই ঘরে থাকতো শায়লা। মিষ্টি করে কথা বলতো। মমিনকে দাদা দাদা বলে ডাকতো।

জহির কোন এক রাতে তার নিজের বউয়ের সাথে; না তার বউ না; তার স্ত্রীর সাথে (জহিরের আবার বউ শব্দটা খুব পাতলা ধরনের শব্দ বলে মনে করে তাই তিনি বউ কে স্ত্রী বলতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন) গভীর রাতে সহবাসে ব্যস্ত। সহবাসের এক পর্যায় সে নিরীক্ষা করতে থাকে হিপোক্যাম্পাস বিষয়টি কি সত্যিই কাজ করে। তার কি বুদ্ধি ও সৃজনশীল দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জহির বেশিক্ষণ চিন্তা করার সুযোগ পায় না তার স্ত্রীর দমকে সে মনযোগ দেয় তাদের নিবিড় চাষে। আজ তারা ফসলের জন্য বীজ বুনবে।

 

অলঙ্করণ : আল নোমান

.........................................................................

ঈদ সংখ্যার সূচিপত্র দেখতে ক্লিক করুন :

বাংলা ট্রিবিউন ঈদ সংখ্যা ২০১৬

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহি চায় ঢাকা
ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহি চায় ঢাকা
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
সব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিবি হারুনসব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী