X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

পাতুম্মা সম্প্রতি মারা গেছেন

প্রশান্ত মৃধা
২৭ জুন ২০১৬, ১৯:১৭আপডেট : ৩০ জুন ২০১৬, ১৭:৫১

ভৈকম মুহম্মদ বশীর ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের ভেলোরের সিএমসি হাসপাতালে এমআরআইর জন্যে সংরক্ষিত রুমে যাওয়ার আগে ভদ্রলোকের সঙ্গে সিরিয়াল সংক্রান্ত আলাপ হয়েছে। এর একটুবাদেই সংরক্ষিত রুমে যাওয়ার ডাক পড়ল। তিনি ওই সংরক্ষিত রুমে একা, আমি মাকে নিয়ে। মায়ের পোশাক আর হাত ও কানের গহনা নিয়ে ডাক্তারদের নির্দেশনা মানতে হবে। মাকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে ইতিমধ্যে হাসপাতালের গাউন পরে তৈরি লোকটির পাশে গিয়ে বসে এবার জানতে চাইলাম, ‘আপনি কি বিহার থেকে?’
বললেন, ‘না, কেরালা থেকে।’
‘আপনাদের অঞ্চলের ভাষা বা আপনার মাতৃভাষা...’ এইটুকু বলতেই তিনি জানালেন, ‘মলয়ালম।’
‘মলয়ালম!’ আমি একটু বিস্ময়ের সঙ্গে তার মুখের দিকে তাকালাম। এর একটা কারণ আছে। তেলেগু বলা মানুষ দেখছি, এখানে তামিল তো এই প্রদেশের সকলেই বলে, অন্তত বাঙালিদের চেয়ে তাদের মাতৃভাষা একটু বেশিই বলে ভালো ইংরেজি জানা সত্ত্বেও। আগে যেমন শুনেছি হিন্দি তারা প্রায় বলতে চায়ই না, আজকাল প্রয়োজনে কিছুটা বলে। কিন্তু এই অঞ্চলে এসে এর পাশের প্রদেশের মলয়ালম আর কন্নড় ভাষায় কথা বলা মানুষ প্রায় দেখিনি। এমন না যে, মলায়লম বা কন্নড় ভাষায় কথা বললে আমি বুঝতাম, কিন্তু তার কাছ থেকে জেনে নিতে পারতাম, তিনি যে ভাষাটি বলছেন, সেটি তামিল বা তেলেগু নয়, তাহলে কী?
ভদ্রলোক হয়তো আমার ব্যক্তিগত বিস্ময়টুকু বুঝলেন। বললেন, ‘আমার মাতৃভাষা মলয়ালম।’
আমি তাকে বিহারের এলিট কংগ্রেসের প্রতিনিধি ভেবেছিলাম। তার পাশে বসা ভদ্রমহিলা সুরুচিপূর্ণ সালোয়ার কামিজ পরা, পরস্পর নিচু গলায় কথা বলছিলেন, তাতে বুঝতে পারছিলাম না তাদের ভাষা অথবা তারা কোন অঞ্চলের মানুষ।
তাঁর মাতৃভাষা জেনে বললাম, ‘মলয়ালম! এই ভাষার একজনকে আমি চিনি, খুব বড়ো লেখক, নাম ভৈকম মুহম্মদ বশীর!’
এবার ভদ্রলোক চমকে আমার দিকে তাকালেন। তাকানোর কারণ বুঝলাম। নিচু গলায় উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ, বশীর, প্রত্যেক মলয়ালম-ভাষী তাঁকে চেনে।’
বললাম, পাতুম্মার ছাগল, বাল্যসখী, নানার হাতি বশীরের এই বইগুলোর বাংলা নাম, সঙ্গে প্রতিটির আনুমানিক ইংরেজি শিরোনামও বললাম।
ভদ্রলোক প্রত্যেকটির মলয়ালম জানালেন। অর্থাৎ মূল নাম।
আমি ভাবলাম, সাহিত্যের লোক নাকি। জাত ভাই? নাকি মলয়ালম ভাষার অথবা সাহিত্যের অধ্যাপক? তাই জানতে চাইলাম, কী করেন তিনি?
বললেন, ইঞ্জিনিয়ার। কুয়েতে পোস্টিং। এখন ত্রিবেন্দুপুরমে (কেরালার রাজধানী) সেটেলড। এবারই শেষবারের মতন যাবেন কুয়েত, অবসরের আর বেশি বাকি নেই।
এরপর নিজে থেকে জানালেন, ‘ছাগলকে মলয়ালমে বলে আড় (সম্ভবত)। বশীর আমাদের ওখানে সবাই পড়ে। ওই রাজ্যে একশ ভাগ শিক্ষিত, অনেক আগে থেকেই। আপনি কি জানেন, ওই পাতুম্মার ছাগলের পাতুম্মা সম্প্রতি মারা গেছেন।’
আমি চোখে বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকাই। ভাবি, পাতুম্মা কে? ও তো গল্প, একখানা বড়ো গল্প। তিনি জানালেন, পাতুম্মাই ছিলেন বশীরের স্ত্রী। ওই গল্পটা সত্য ঘটনা।
জানতে চাইলাম, ‘তাদের কি বাল্য প্রেম?’
‘হ্যাঁ। সেই বাল্যসখীকে নিয়েই এই গল্প লিখেছিলেন বশীর। দারুন ভালোবাসতেন বউকে।’
আমি তখন তাকে আর একটি গল্পের কথা বলি। গল্পটার নাম, ‘পুবন পঝম’। পুবান কলা। স্বামী ঝড়ের রাত্রে নদী পার হয়ে কমলা আনতে গেছে। পায়নি। পেয়েছে কলা, পুবের কলা। তাই নিয়ে এসেছে। কিন্তু বউ তা খাবে না। লোকটি বলছে, এটাই কমলা। আমি কষ্ট করে এনেছি, এটাকেই কমলা ভেবে খেতে হবে। লোকটির হাতে লাঠি।
ভদ্রলোক হাসলেন, ‘এটাও বশীর আর তার স্ত্রী পাতুম্মাকে নিয়ে।’
‘তাই!’
‘এমনিতে বশীর খুব রগচটা মানুষ ছিলেন। কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন টিশতেন না। তাকে কংগ্রেসিরা বলত কমিউনিস্ট, কমিউনিস্টরা বলত কংগ্রেস।’
বললাম, ‘কিছু কিছু জানি।’
‘আসলে প্রতিভাবান মানেই পাগল।’
বসলাম, ‘খুব বড়ো গল্প লেখক। তাঁকে আর সাদাত হাসান মান্টোকে তুলনা করা চলে গল্প লেখক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।’
বললেন, ‘হ্যাঁ। তবে সবমিলে তোমাদের টেগোর গ্রেট।’
‘ঠিকই। কিন্তু বাংলা ভাষায় অনেক জন বড়ো লেখক।’
‘আমি জানি।’ তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন।
এ সময় এমআরআই-এর মূল রুমে মায়ের ডাক পড়ল। আমি তাকে সেদিকে নিয়ে যেতে উঠলাম। তারপর বাইরে বেরিয়ে এসে ভদ্রলোকের স্ত্রীর দিকে দেখি, তিনি মুখ ভার করে বসে আছেন।
আমাকে দেখে জানতে চাইলেন, ‘ভিতরে নিয়েছে?’
‘মাকে নিয়েছে, উনি ওয়েটিঙে।’
তখন ভদ্রমহিলা আমার মুখের দিকে তাকালে দেখলাম, তাঁর চোখ দুটো একটু যেন ভেজা।
কিছুটা কৌতূহল হওয়ায় জানতে চাইলাম, ‘আপনার স্বামীর সঙ্গে আলাপ হল, আপনারা কুয়েতে থাকেন, কিন্তু চিকিৎসার জন্যে এখানে এসেছেন।’
‘গতবার দেশে আসার পরে ওর হাতটায় হঠাৎ ব্যথা। তখন এখানে দেখিয়ে ভালো ফল পেয়েছে। ছোটো ছেলেটা কাছেই ব্যাঙ্গালুরুরতে থাকে, ইঞ্জিনিয়ার। ও আছে আমাদের সঙ্গে। বিকালে চলে আসবে।’
আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। তাকে বা তার স্বামীকে দেখে বয়েস অনুমান করতে পারিনি। যেন তা বুঝে তিনি আরও যোগ করলেন, ‘আমাদের বড়ো ছেলে বিয়ে করেছে, সেও ইঞ্জিনিয়ার। মেয়েটি ডাক্তার, শ্বশুরবাড়ি।’
ভদ্রমহিলা এ নিয়ে আরও বলতে চাইছিলেন হয়তো। তার আগে আমি জানতে চাইলাম, ‘ওর নামটা জানা হয়নি। এতক্ষণ কথা হল ভিতরে বসে।’
বললেন, ‘ওঁর নাম মাইকেল। আমার নাম মিনি। ওঁর হাতটায় কেন যে এমন হল। এমন তো হওয়ার কথা নয়। সুস্থ মানুষ। এখন ভালো হলে হয়।’ তিনি বুকে ক্রুশ আঁকলেন। তাঁর চোখ আবার জলে টলমল হয়ে উঠেছে।
তাঁর দিকে তাকিয়ে আমার তখন মনে হচ্ছিল, তাঁদেরও নিশ্চিত বাল্য প্রেম। মিনি মাইকেলের বাল্যসখী। তাই মাইকেল পাতুম্মার কথা ওইভাবে বললেন। মিনির চোখের জলের দিকে তাকিয়ে ভাবি, ভিতরে বসে এক বশীর বাইরে সজল চোখে তাঁর পাতুম্মার!

....................................................................

ঈদ সংখ্যার সূচিপত্র দেখতে ক্লিক করুন :

বাংলা ট্রিবিউন ঈদ সংখ্যা ২০১৬

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করলে হামাস ক্ষমতায় থেকে যাবে: নেতানিয়াহু
গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করলে হামাস ক্ষমতায় থেকে যাবে: নেতানিয়াহু
ব্যাংক চলাকালীন এনবিআরকে অভিযান চালাতে হবে: হাইকোর্ট
ব্যাংক চলাকালীন এনবিআরকে অভিযান চালাতে হবে: হাইকোর্ট
যেভাবে অ্যালোভেরা ব্যবহার করলে চুল মোলায়েম হবে
যেভাবে অ্যালোভেরা ব্যবহার করলে চুল মোলায়েম হবে
জিএসটির ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
জিএসটির ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
শোইগুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে পুতিনের?
শোইগুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে পুতিনের?