X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১
যখন যেখানে যাই

টেরাকোটা সিপাহীদের সান্নিধ্যে

মঈনুস সুলতান
২৮ জুন ২০১৬, ১৩:৩৩আপডেট : ৩০ জুন ২০১৬, ১৭:৪৯

টেরাকোটা সিপাহীদের সান্নিধ্যে সমাধি সৌধকে পাহারা দেবার জন্য সম্রাট এখানে সমাহিত করেন পোড়ামাটির লাইফ-সাইজ কমবেশি ৮,০০০ জন সৈনিককে। তাদের আশপাশে প্রস্তুত হয়ে আছে ৫২০ টি অশ্ব, সেনানায়ক ও অভিজাতদের জন্য ১৩০টি রথ এবং ১৫০ জন বিশেষ রকমের সাজে সজ্জিত অশ্বারোহী সৈনিক

ওয়াশিংটন ডিসি’র পাতালরেল থেকে বেরিয়ে ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক মিউজিয়ামের দিকে যাওয়ার পথে যেমন কথা ছিল ঠিক তেমনি চিনচিনের জননী লু কুইফিনের সাথে দেখা হয়। একটু অবাক হই- তার সাথে আজ থুরথুরে বুড়ো এক ব্যক্তিকে দেখে। লু তাকে স্কলার উ চি ইয়াং বলে পরিচয় দিয়ে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে হলেনকে। তার সাথে অনেক বছর পর চাক্ষুষ দেখা হলো কিনা, তাই সে আমার দিকে সামাজিক চুম্বনের জন্য গণ্ডদেশ বাড়িয়ে দেয়। আমি আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে মুখের দিকে তাকিয়ে তার খুশি হয়ে ওঠার বিষয়টি বুঝতে পারি। হাসলে তার গালে একাধিক টোল পড়ে, এবং সে ক্রমাগত মৃদু মৃদু হাসছে বলে বালুতটে ঢেউ ভাঙার মতো টোলগুলো ভেঙে চুরে ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা মুখাবয়বে। ঠিক বুঝতে পারি না- তার সাথে উ চি উয়াং বলে বুড়ো মানুষটি কে এবং তিনি কি বিষয়ের স্কলার? মহোদয় ইংরেজি তেমন বলেন বলে মনে হয় না। আমি তাকে খোদ চীনা জবানে ‘নিহাও’ বা ‘হ্যালো’ বললে তিনিও হাসেন। মুখ-গহ্বরে তার দাঁত বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই, অবশ্য সৌজন্য সূচক হাসিতে একপাটি দাঁতের আবশ্যকতা আছে বলেও মনে হয় না।


আমি ও হলেন- আমাদের মেয়ে কাজরিকে নিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে বাস করতাম, সে বছর দশেক আগে লু কুইফিনের সাথে পরিচয়। চীনা এ তরুণী তার ছোট্ট মেয়ে চিনচিনকে নিয়ে কেলিফোর্নিয়ার কোন এক শহর থেকে ম্যাসাচুসেটসে এসে খুব ঝামেলায় পড়েছিল। সে গুছিয়ে ইংরেজি বলতে পারতো না, চাকুরী বাকুরীরও কোন সুসার হয়নি, তার উপর দিন গুজরানের জন্য আর্থিক সামর্থও তার ছিল না। বাজার খরচের বাবদে তাকে হলেন কিছু ধার দিয়েছিলো, তারপর সাওদাপাতির জন্য তাকে লিফট দিয়ে গ্রসারী স্টোরেও নিয়ে যেত। আমরা তাকে কাজ চালানোর জন্য ইংরেজি শিখার ক্লাশে নিয়ে গেলে চিনচিনকে সে কোথায় রেখে যাবে তা নিয়ে মহামুসিবতে পড়ে। চিনচিন যেহেতু কাজরিই সমবয়সী সে কারণে আমি তাকে আমাদের বাসায় ঘণ্টা দুয়েক খেলাধূলা করতে বললে লু কুইফিন বোধ করি কৃতজ্ঞতায় নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখের অভিব্যক্তিতে চীনা নিসর্গ চিত্রের পর্বতমালায় লেগে থাকা মেঘের মতো ভেসে যায় বিষাদ মাখা অনিশ্চয়তা। বোধ করি, মেয়েটি নীরবে ভাবছিলো আমরা যে উপকার করছি- সে এতোই গরিব, তার সঙ্গতি এতোই কম, সে কি কোনদিন তার প্রতিদান দিতে পারবে? হলেন তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো- আমাদের তো তোমার মতোই ছোট্ট একটি মেয়ে আছে, অসুবিধা কি? খেলুক না তারা এক সাথে? তার কাঁধে সস্নেহে হাত রাখতেই চিনচিনের মা ভোরে ঝাঁকিয়ে দেয়া শিশিরে সিক্ত শিউলির ঝাড়ের মতোই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলো।
লু কুইফিন আজকাল ওয়াশিংটন ডিসিতে থাকে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়- বোধ করি সে কোথাও ছোটখাটো চাকরি বাকরি পেয়েছে, তার হাল হকিকতের খানিক উন্নতি হয়েছে, এবং ইংরেজি ভাষা এতদিনে আয়ত্ত্বে এসেছে খানিকটা। স্পষ্টত আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে চায়, তাই সে টিকিট কেটে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রে সফররত চীনের টেরাকোটা সিপাহীদের প্রদর্শনীতে। ম্যাসাচুসেটসে যখন লু কুইফিনের তীব্র অনটন, চেষ্টা চরিত্র করেও হলেন তার জন্য আদনা কোন কাজ জোটাতে পারছে না, তখন সে কিছুদিন সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমাদের বাসায় বেবি সিটার কাম মেইড ইত্যাদি কাজ করে। সে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করতে করতে বা বাসন বর্তন ডিস-ওয়াসারে ঢুকাতে ঢুকাতে বিড়বিড় করে দেদারছে জপতো দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার উপযোগী ইংরেজি শব্দ। বিকালবেলা আধভাঙা ইংরেজি সব শব্দ জোড়া দিয়ে তার সাথে আমাদের আলাপচারিতাও হতো বিস্তর। সে অবগত যে- আমি ও হলেন কাজরিকে নিয়ে বার তিনেক চীন দেশে গিয়েছি। আমার খুব ইচ্ছা ছিলো উত্তর-পূর্ব চীনের শানক্সি প্রদেশের শিয়ানে গিয়ে সম্রাটের সমাধির সংলগ্ন ভুতল থেকে বের করে আনা টেরাকোটা সিপাহীদের চাক্ষুষ করবো। হলেন শিয়ানের পরিবর্তে ইউনানের দিকে যেতে চাইলে এ নিয়ে তার সাথে আমার মতভেদও হয়। টেরাকোটা সিপাহীদের দেখতে না পাওয়ার খেদ যে আজো আমার আছে, এ বিষয়ে চিনচিনের জননী ওয়াকিবহাল।
ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক মিউজিওমে প্রদর্শনীর দুয়ার এখনো খুলেনি। বাইরে কনকনে হাওয়ার সাথে অল্প-সল্প তুষারপাত হচ্ছে, তাই আমরা কাচের ছত্রি দেয়া সেন্ট্রাল হিটিংয়ে উষ্ণ লাউঞ্জে ঢুকে পড়ি। লু কুইফিন হ্যাংগারে ওভারকোট খুলে আমাদের ১৯৭৪ সালে আবিষ্কৃত টেরাকোটা সিপাহীদের কথা বলতে শুরু করে। সে ধ্রুপদী ধাচের চীনা-সিল্কের রঙিন পট্টবস্ত্র পরে আছে বলে ধূসর অভারকোট খুলে ফেলাতে তাকে কাকুনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা প্রজাপতির মতো দেখায়। সে সুচারু একটি হাতপাখা মৃদু নাড়তে নাড়তে বলে- চীনের প্রথম সম্রাট কিন সি হোয়াংডি সমাহিত হয়েছিলেন খ্রীস্টপূর্ব ২১০ অব্দে মাউন্ট লি’তে। স্থানটি তিনি বেছে নিয়েছিলেন- ওখানে নিসর্গের সুলক্ষণ স্বরূপ দুটি স্বর্ণ ও সবুজ জেড পাথরের খনির জন্য। এখনো এ পাহাড়ে পর্সিমেনের বর্ণাঢ্য প্রসূন ফুটে। ডালিমের লোহিত পুষ্পে ঝেপে আসে হাজার বিজার মৌমাছি। এ নিসর্গের বেলে রঙের বিস্তারে আজো আছে অনেকগুলো কেইভ; গুহামুখের শূন্যতায় সূর্যালোক পড়ে তাদের দেখায় কাপড়ের ল্যান্ডস্কেপে করা সূচিকর্মের মতো। কথা বলতে বলতে লু কুইফিন কবি যশপ্রর্থি যে রকম লিটল ম্যাগাজিনে তাদের মুদ্রিত কবিতাটি দেখায় সে রকম আমার হাতে তুলে দেয় টেরাকোটা সিপাহী সম্পর্কিত তথ্যময় একটি পুস্তিকা। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসের কথা। প্রচণ্ড খরা চলছে, চারদিকে পানীয় জলের খুব কাহাত। এক দল কৃষক পাতকূয়া খুঁড়তে গেলে তাদের শাবল খুন্তির মুখে উঠে আসে পোড়ামাটির মনুষ্য ফিগারের টুকরা টাকরা। এ ঘটনা থেকে এখানে সন্ধান পাওয়া যায় হাল জামানার সবচেয়ে বড় আর্কিওলজ্যিক্যাল ডিসকভারির। পুরাতাত্ত্বিকরা সম্রাট কিন সি হোয়াংডির সমাধি সৌধের মূল চত্তর আজো খুঁড়েননি। তাদের আশঙ্কা সমাধিতে কাগজের দলিলপত্র, সিল্কের প্রতীক বা নক্সাদি দু’হাজার বছর পর সহসা বাতাসের স্পর্শ পেয়ে ঝুরঝুরিয়ে একেবারেই উবে যাবে। তবে তার সমাধির সংলগ্ন ভূতলে প্রোথিত সেনানিবাসটিকে তারা খুঁড়ে নিয়ে এসেছেন দিনের আলোয়। সমাধি সৌধকে পাহারা দেবার জন্য সম্রাট এখানে সমাহিত করেন পোড়ামাটির লাইফ-সাইজ কমবেশি ৮,০০০ জন সৈনিককে। তাদের আশপাশে প্রস্তুত হয়ে আছে ৫২০ টি অশ্ব, সেনানায়ক ও অভিজাতদের জন্য ১৩০টি রথ এবং ১৫০ জন বিশেষ রকমের সাজে সজ্জিত অশ্বারোহী সৈনিক।
আমি তথ্য-পুস্তিকাটি খুঁটিয়ে দেখছি, স্কলার উ চি ইয়াং মহোদয় কিছু চীনা ক্যালিওগ্রাফির স্ক্রল নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। মনে হয় তিনি বুঝি আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন। এদিকে লু কুইফিন হলেনকে সাথে নিয়ে লাউঞ্জের এক কোণে ফেইস পেইনটিংয়ের বুথে গেছে। তাই অনুবাদ করার কেউ না থাকাতে উ চি ইয়াং মহোদয়ের সাথে আমার আলাপ কিছু জমে না। আমি খানিক দূর থেকে দেখি হলেন লু কুইফিনের গণ্ডদেশে ফেইস পেইন্টের চিত্র লাগাতে লাগাতে তার কাঁধে হাত রেখে খুব ঘনিষ্ট কিছু মেয়েলি আলাপ সেরে নিচ্ছে। ম্যাসাচুসেটসে বসবাসের সময় আমি হলেণের মারফতে লু কুইফিনের জীবনের কিছু কথা জেনেছিলাম। তার গণ্ডদেশ, গ্রীবা ও বাহুতে সুঁচ ফুটিয়ে চীনা হরফের আকৃতির কিছু লেখাজোখা বা প্রতীক আছে। এক সময় সে হরেক রকমের প্রসাধনী দিয়ে তা ঢাকতে চেয়েছিলো। হলেন তখন তাকে লিসেনিং প্রজেক্ট বলে নারীদের ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলার একটি আসরে নিয়ে যায়। লিসেনিং প্রজেক্টে কোন নারীর সমস্যার কোন সমাধান দেয়া হয় না। তবে তারা যদি তাদের বুকে জমে থাকা কথা কাউকে বলে হাল্কা হতে চায়, তবে সেখানে তাদের ঘটনা শোনার জন্য সহমর্মী কোন শ্রোতা নারীকে জোগাড় করে দেয়া হয়। তার সাথে দুঃখি কোন মহিলা গোপন কথাবার্তা শেয়ার করতে পারেন। ওখানে হলেন শুনতে পায় যে- চীনে তার স্বামী তাকে আফিম জাতীয় কিছু খাইয়ে আচ্ছন্ন করে তার শরীরের বিবিধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আকুপাংচারের মতো তপ্ত সুঁচ দিয়ে অনেক হরফ, প্রতীক ও নক্সা আঁকে। এতে তার দেহের কোন কোন স্থানে মারাত্মক রকমের ইনফেকশন ও প্রদাহের সৃষ্টি হয়। লু কুইফিনের ইংরেজি ভাষায় প্রকাশের ক্ষমতা তখনো ভালো করে তৈরি হয়নি, সুতরাং হলেন কাহিনিটি জানলেও ঠিক বুঝতে পারেনি- তার স্বামী কেন এ আচরণ করেছিলো? এ নিয়ে আমরা বার কয়েক কথাবার্তাও বলেছি- কোন কোন স্বামী তাদের স্ত্রীদের দৈহিক অত্যাচার করে স্যাডিস্টসুলভ আনন্দ পেয়ে থাকে, আবার কেউ যৌতূক আদায়ের লক্ষ্যে তাদের পরিণিতাদের আঘাত করে। হলেন কোথা থেকে তথ্য জোগাড় করে যে- চীনে নাকি স্ত্রীদের বশ করার জন্য সুঁচ ফুটানোর প্র্যাকটিস হাজার বছর ধরে প্রচলিত আছে। শুধু বশীকরণ নয়, ওখানকার কোন এক সম্রাট নাকি তার উপপত্নিদের সনাক্তকরণের জন্য তাদের দেহে সুঁচ ফুটিয়ে রাজকীয় মোহর এঁকে দিতেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা কখনো সখনো ভেবেছি বটে, কিন্তু রহস্যের তিমির ঠিক ভেদ করতে পারিনি।
ফেইস পেইন্ট করা শেষ হয়েছে। হলেন লু কুইফিনকে নিয়ে ফিরে আসে। টেরাকোটা সিপাহীদের ব্যবহৃত ডাল, বর্ম ও শিরোস্ত্রাণের নক্সায় ঢেকে গেছে তার গণ্ড, গ্রীবা ও বাহুতে বহুদিন আগে সুঁচ ফুটিয়ে করা হরফের আকৃতি। ফেইস পেইন্টের বর্ণের আভায় তাকে খানিক উচ্ছলও দেখায়। অতীতে তাকে আমি সব সময় জীবনযাপনের সমস্যার ভারে ভারাক্রান্ত দেখেছি, ছোট্ট চিনচিনের লালন পালন নিয়ে, এবং অল্প কিছু টাকা উপার্জনের উদ্যোমে সে সব সময় মিজারেবল হয়ে থাকতো। তার চোখ মুখের আজকের এ প্রফুল্লতাকে খানিক ব্যতিক্রম দেখায়। আমার সাথে কথা বলতে না পেরে স্কলার উ চি ইয়াং থম ধরে বসেছিলেন, লু কাছে আসতেই পাখির বাচ্চা যে রকম নীড়ে ফেরা মায়ের কাছে আদার চায়, এ রকম ফোকলা মুখে চুঙচাঙ ধ্বনিতে যেন তিনি কলকাকলি করে উঠেন। লু মনযোগ দিয়ে তার বক্তব্য শুনে আমাদের জন্য তা তর্জমা করে। ভূতলে সমাধির বিশাল পরিকল্পনা করে সম্রাট পাহাড়ের পাদদেশে পাহারা দেবার জন্য বসিয়ে ছিলেন বিশটি পরিবারকে। এ পরিবারগুলো কালে কালে সম্প্রসারিত হয়ে পরিণত হয়েছে কুড়ি’টি পূর্ণাঙ্গ গ্রামে। তাদেরই এক উত্তর পুরুষ পাত কুয়া খুঁড়তে গিয়ে ১৯৭৪ সালে আবিষ্কার করেন টেরাকোটা সিপাহীদের ভূগর্ভস্থ ক্যাসোল।
প্রদর্শনীর দুয়ার খুলে দিলে আমরা পাঁচমেশালী দর্শকদের ভীড়ে সামিল হয়ে ঢুকে পড়ি বেজায় বৃহৎ হলকক্ষে। না, চীন থেকে তাবৎ টেরাকোটা ফৌজদের হাওয়াই জাহাজে চড়িয়ে ওয়াশিংটনে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। কেবলমাত্র কয়েকজন সৈনিক আকাশযাত্রা করে এসেছন, তাদের পেছনে সারি দিয়ে রাখা রেপলিকা বা নকল মূর্তিরাজি । ছবি ও আলো দিয়ে ত্রিডাইমেনশ্যানাল ভঙ্গিতে এমন আবহ তৈরি করা হয়েছে যে, মনে হয়- দু’হাজার বছর ধরে তারা দাঁড়িয়ে আছে যুদ্ধংদেহী হালতে।
প্রদর্শনী দেখতে দেখতে আমরা সরে এসে আরেক গুচ্ছ পোড়ামাটির ফৌজদের মোকাবেলা করি। নয়জন টেরাকোটা সৈনিক এখানে রীতিমতো ব্যূহ রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন অশ্বারূঢ় শিরস্ত্রাণ পরা ফৌজদার, বর্ম পরা পদাতিক ও হাঁটু গেড়ে বসা তীরন্দাজ। তাদের চোখ মুখের দিকে তাকালে মনে হয়- লড়াইয়ের ফর্মেশনে যে কোন মুহূর্তে তারা সাজসাজ রবে ঝাঁপিয়ে পড়বে রণাঙ্গনে। এখানে এসেই স্কলার উ চি ইয়াং আমাকে কিছু বলতে গিয়ে খক খক করে কাশতে শুরু করেন। তার কাশি কিছুতেই থামছে না। লু কুইফিন তাকে সামলাতে গিয়ে খানিক বিপন্ন বোধ করে। আমরা একটি বেঞ্চের সন্ধানে একটু দূরে চলে আসি। বেঞ্চে বসে তার কাশি থামে বটে, তবে তিনি হাঁপাতে শুরু করেন দারুণভাবে।
এদিকে দেয়াল ও ছাঁদজুড়ে বিশাল সব নিসর্গ-চিত্র সাঁটা। এসব চিত্রের বহুবিধ ডাইমেনশন ও আলো সম্পাতের জন্য মনে হয় আমরা দাঁড়িয়ে আছি মাউন্ট লি’র পাদদেশে। না, মিউজিয়াম চীন সম্রাট্রের পোড়ামাটিতে নির্মিত তাবৎ দরবার তুলে নিয়ে আসতে পারেনি। তবে প্রজেক্টার দিয়ে তার যে ছবি ফেলেছে তাতে মনে হয়- আমরা দাঁড়িয়ে আছি চীনা ম্যান্ডারিন বা অভিজাত সব পরিষদবর্গের পাশাপাশি। সামনে ধূপধুনা হতে পুরোহিত, পণ্ডিতরা ক্যালিওগ্রাফিতে লিখছেন অনুশাসন। দূরে পোষা সোয়ান বা রাজহাঁস, দীর্ঘ গ্রীবা সারস, তারের বাদ্য বাজিয়ে গান করছেন কেউ কেউ; আর সার্কাসের এক্রোব্যাটরা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে- বুঝিবা জাহাপনার হুকুমের ইন্তেজার করছে। ব্রোঞ্জে তৈরি দশফুটের মতো চার ঘোড়ায় টানা রাজকীয় রথটিও অপেক্ষা করছে উপত্যকার পাদদেশে।
লু কুইফিন স্কলার মহোদয়কে কফ সিরাপ খাইয়ে তাকে হাঁপানি প্রশমনের জন্য নেবুলাইজারের শট দিচ্ছে। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন আসে- কে এই বৃদ্ধ? তার সাথে চিনচিনের জননীর সম্পর্ক বা কি? তিনি কি তার আত্মীয় স্বজনদের কোন একজন, যিনি সম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসি হয়েছেন? আত্মীয় স্বজন প্রসঙ্গ লু কুইফিন লিসেনিং প্রজেক্টে কয়েকবার আলাপ করেছে। হলেনের মারফত তা থেকে যা জানা গেছে তা হল- চিনচিনের জন্ম নিয়ে আত্মীয়দের সাথে তার তীব্র বিরোধ হয়। টেস্টে গর্ভে মেয়ে শিশুর ভ্রুণের তথ্য পাওয়া গেলে তার স্বামী তাকে গর্ভপাত করাতে বলে; এবং তাতে রাজি না হলে সে সন্তানের পিতা হিসাবে রেজিস্ট্রি করবে না বলেও হুমকি দেয়। চীনা সমাজে পিতার নাম রেজিস্ট্রি করার প্রশাসনিক প্রয়োজন আছে। তা না হলে সন্তান ভবিষ্যতে স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না, এমন কি চাকুরী বাকুরী পাওয়াও তার জন্য দুষ্কর হবে। লু কুইফিন এবরশনের জন্য সরকারী ক্লিনিকে যায়। প্রক্রিয়া শুরুর আগে কি কারণে তার মনে তীব্র পরিবর্তন আসে, সে খুঁজে পায় পরিস্থিতিকে বদলে ফেলার সাহস। কর্তব্যরত নার্সকে তার বিয়ের আংটি উৎকোচ দিলে- সে তাকে বাথরুমের দুয়ার দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। তারপর লু কুইফিন পালিয়ে বেড়ায় শহর থেকে শহরে। এবরশন ক্লিনিক থেকে পালানো ক্রিমিন্যাল অপরাধের সামিল। এজন্য তার মা-বাবা ও স্বামীর তরফের আত্মীয় স্বজনদের সবাইকে দিতে হয় বড় অংকের জরিমানা, এবং তার স্বামী ও শ্বশুরের চার মাসের জেলও হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- তার বৃদ্ধ কোন আত্মীয় স্বজন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসি হলে তারা কি স্বেচ্ছায় তার সাথে যোগাযোগ রাখবে?
চার ঘোড়ার ব্রোঞ্জের রাজকীয় রথ আমি ও হলেন আরেকটি পোড়ামাটির অভিজাতের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে লু কুইফিনের আমাদের সাথে এসে যোগ দেয়ার জন্য অপেক্ষা করি। অশ্বের পাশে দাঁড়ানো এ পারিষদের মুখের অভিব্যক্তি অনন্য। হয়তো এ মানুষটি দু’হাজার বছর আগে সম্রাটের দরবারে কর্মরত ছিলেন। তার পত্নী বা উপপত্নীদের তিনি কি সুঁচ ফুটিয়ে বশ করে রাখতেন? আরো বিবিধ সব মূর্তিরাজির অভিব্যক্তির দিকে তাকিয়ে মনে হয়- চীনের কারিগররা সে যুগের জীবিত সব মানুষদের মডেল করে তৈরি করেছেন এসব মৃন্ময় ভাস্কর্য। প্রতিটি মূর্তির পোষাক পরিচ্ছদ ভিন্ন, এমন কি তাদের শিরোভূষণের স্টাইলও আলাদা। স্কলার মহোদয় আবার খুক খুক করে কাশতে শুরু করলে চিনচিনের জননী তার জন্য পানি আনতে ছোটে। আমরা বৃদ্ধের কাছে এসে দাঁড়াই। আমাদের মাঝে কথাবার্তা কিছু হয় না। তবে নীরবে আমি ভাবতে থাকি- লু কুইফিনের জীবন সম্পর্কে আমরা কতোটা জানি? লিসেনিং প্রজেক্টে হলেন ছিল তার দরদী শ্রোতাদের একজন। ওখানে প্রশ্ন করার কোন নিয়ম নেই। সুতরাং, সে স্বেচ্ছায় যা বলেছে হলেণ শুধু তাই জেনেছে। এসব কাহিনি ছাড়াও তার জীবনের আরো অনেক ঘটনা আছে যা আমরা কিন্তু অবগত নই। সে হয়তো কোনদিন তা আমাদের বলবে না। হলেন যা জেনেছে সে অভিজ্ঞতাকে ডুবো পাহাড়ের শিখরের মতো মনে হয়- পাহাড়ের বহুলাংশ তো পানির নিচে ডুবে আছে, আমরা কি কখনো সে রকমের ডুবুরি হতে পারবো?
লু কুইফিন পানি নিয়ে ফিরে এসে তা বৃদ্ধকে খেতে দিয়ে হলেণের কাঁধ ছুঁয়ে ফিসফিসিয়ে বোধ করি কোন মেয়েলি কথা বলতে চলে যায় উপত্যকার চিত্রের আবডালে- যেখানে সিলভারের বর্ণাঢ্যতায় তৈরি করা হয়েছে যুগল নদীর অনুসঙ্গ। চীনা এ সম্রাটের প্রাসাদ থেকে ইয়োলো রিভার ও ইয়াংসি নদীর দূরত্ব ছিলো অনেক। তাই তিনি উপত্যকায় পারদ দিয়ে তৈরি করেছিলেন নদী যুগলের কৃত্রিম রূপরেখা। তাদের তীরে দাঁড়িয়ে চিনচিনের জননী এখন তাকিয়ে আছে হলেনের দিকে। তার চোখে মুখে ফিরে এসেছে নিসর্গচিত্রে ভেসে যাওয়া মেঘের মতো বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তার মিশ্র অভিব্যক্তি। সে কি কোন সংকটে আছে? অনেক বছর পর আমি তাকে আবার কাছ থেকে অবলোকন করছি। কিন্তু আমি চাক্ষুষ এ পর্যবেক্ষণের গভীরে যে বেদনা- তা ঠিক নিরিখ করতে পারি না।
স্কলার উ চি ইয়াংকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। তিনি কথাবার্তার সুযোগ পাচ্ছেন না বলে স্ক্রল মেলে ধরে চুঙ-নাঙ-ইং-তাং জাতীয় কিছু শব্দ করে আমার দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে রীতিমতো জব্দ হয়ে বসে থাকেন। লু কুইফিন বিষয়টি খেয়াল করে হলেনকে হাত ধরে টেনে ফিরে আসে আমাদের কাছে। স্কলারকে একটু রাগতে দেখায়। তার মুখ থেকে নানাবিধ শব্দের তুবড়ি ফুটে। চিনচিনের জননী ধ্যর্য ধরে তা তর্জমা করে। স্কলার লি সি নামের সে জামানার যশস্বী চীনা পণ্ডিত ও ভিসনারী স্টেইটসম্যান বা স্বপ্নিক এক রাষ্ট্র তত্ত্ববিধের কথা বলেন। পণ্ডিত লি সি হাজার বছর আগে এ সম্রাটের শাসনামলের যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন, তা থেকে জানা যায়- রাজকুমার হিসাবে এ সম্রাটের আদি নাম ছিল ইং জেং। তিনি ১৩ বৎসর বয়সে অনুগ্রহ করে সিংহাসনে আরোহণ করে কিন সি হোয়াংডি বা প্রথম সম্রাটের হিসাবে উপাধি ধারণ করেন। স্কলার আবার কাশতে শুরু করলে লু কুইফিন তাকে পানি খাওয়ায়। তার দেয়া তথ্য অবশ্যই জরুরী, তা না জানলে চীন সম্রাটের কেন তাবৎ সেনানিবাসকে পোড়ামাটিতে গড়ে তা তার কবরের পাহারার দায়িত্ব দিয়ে সমাহিত করলেন তা বুঝবো কিভাবে? সুতরাং চীনা কায়দায় তাকে কুর্নিশ করে বলি ‘সিয়ে সিয়ে নি’ বা ধন্যবাদ। স্কলার পানি খেয়ে জান তর করে চোখ পাঁকিয়ে বলেন, পশ্চাত্যের হিসটোরিয়ানরা চীন সম্রাটের শুধু যুদ্ধংদেহী হিসাবে জানে, তিনি যে তামাম চীনকে একসূত্রে গেঁথে ছিলেন, প্রচলন করেছিলেন মাপঝোকের, এবং তার আমলে উদ্ভাবিত লিপি আজ অব্দি মানুষ লেখাপড়ার কাজে ব্যবহার করছে, এগুলো কি জানার প্রয়োজন নেই? এসব জানা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে সওয়াল হচ্ছে- তিনি তো রাজ্য জয় করেছিলেন বিস্তর, বিজীতদের সাথে তার স্বভাব সলুক কেমন ছিল? ফোকলা মুখে কেবল মাত্র মাড়ি দেখিয়ে স্কলার হেসে জবাব দেন, তিনি আশপাশের তাবৎ রাজ্য জয় করে রাজন্যবর্গকে নিয়ে এসেছিলেন তার রাজধানীতে। তারা যদিও রাজবন্দী ছিলেন- তিনি তাদের অরিজিন্যাল প্রাসাদসমূহের রেপলিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন বসবাসের জন্য। হলেণ এবার জানতে চায়- এ সম্রাটের উপপত্নীদের সংখ্যা কত, এবং তিনি বশীকরণ ও সনাক্তকরণের জন্য তাদের দেহে সুঁচ ফুটানো প্র্যাকটিস করতেন কিনা? লু কুইফিন হলেনের প্রশ্ন অনুবাদ না করে কিছুক্ষণ বোবা দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। আর স্কলার মহোদয় চঙ-জঙ করে আরো কিছু যেন বলেন।
কথা বলতে বলতে স্কলারের হাঁপানির টান আবার বাড়লে চিনচিনের জননী তাকে নেবুলাইজারের শট দেয়। প্রদর্শনীতে ঘুরে বেড়ানোর সীমিত সময় শেষ হয়ে আসলে আমরা কাচের গুমটি দেয় লাউঞ্জে বেরিয়ে আসি। বিদায় নেয়ার সময় আমি জানতে চাই- হাউ ইজ চিনচিন? আমার প্রশ্নের জবাবে চোখে এক ধরনের বিভ্রান্তি নিয়ে লু কুইফিন নীরবে তাকিয়ে থাকে। হলেন বলে উঠে- চিনচিন নিশ্চয়ই এখন চমৎকার এক কিশোরী হয়ে উঠেছে? লু কুইফিনের কাছ থেকে কোন জবাব আসে না। তাই হলেন আবার তাকে বলে, সে কি তোমাকে খুব ট্রাবোল দিচ্ছে? টিনএজার মেয়েরা তো এরকম করেই থাকে। আমাদের কাজরিও তো এ রকমের আচরণ করছে। আজকাল সেও তো কোন কথাবার্তা শুনতে চায় না। অতঃপর হলেন গুডবাই বলতে তার কাঁধে চাপ দিলে ঝাঁকিয়ে দেয়া শিশিরময় শিউলির মতো ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে হলেনকে জড়িয়ে ধরে লু কুইফিন।

.............................................................

ঈদ সংখ্যার সূচিপত্র দেখতে ক্লিক করুন :

বাংলা ট্রিবিউন ঈদ সংখ্যা ২০১৬

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
পশ্চিম তীরে ২৫ ফিলিস্তিনি আটক ইসরায়েলের
পশ্চিম তীরে ২৫ ফিলিস্তিনি আটক ইসরায়েলের
২৪ ঘণ্টায়ও নেভেনি সুন্দরবনের আগুন, হেলিকপ্টার থেকে ছিটানো হচ্ছে পানি
২৪ ঘণ্টায়ও নেভেনি সুন্দরবনের আগুন, হেলিকপ্টার থেকে ছিটানো হচ্ছে পানি
 ‘আমি আগের চেয়ে ভালো আছি’
 ‘আমি আগের চেয়ে ভালো আছি’
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
শোইগুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে পুতিনের?
শোইগুর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে পুতিনের?