X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১
উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র

এক বৃদ্ধ ও বিষণ্ন বেশ্যার প্রেম

বিধান রিবেরু
২৮ জুন ২০১৬, ১৭:০৮আপডেট : ৩০ জুন ২০১৬, ১৭:৪৪

চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

বাংলা করলে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাসিকাটির নাম দাঁড়ায় ‘আমার বিষণ্ন বেশ্যাদের স্মৃতি’। এই নাম শুনেই পাঠক আন্দাজ করতে পারবেন কী এর বিষয়বস্তু। তবে সেই আন্দাজ কিন্তু পুরোপুরি ঠিক নাও হতে পারে। কারণ মার্কেস মূলত একটি বিষয়ই বলার চেষ্টা করেছেন গোটা বইতে- সেটা হল জীবনে শেষ বলে কিছু নেই, বার্ধক্য একটা কথার কথামাত্র, শরীর বুড়ো হতে পারে কিন্তু মন নয়। এই উপন্যাসিকা থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র, একই নাম ‘মেমোরিয়া দে মিস পুতাস ত্রিসতেস’, সেটিও এই লেখার আলোচ্য বিষয়। এটি একটি তুলনামূলক লেখা হলেও মার্কেসের ভাবনাটি আমরা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করব সংক্ষেপে।

এক.

নব্বই বছর পূর্তিতে একজন বৃদ্ধ ভাবছেন তিনি জন্মদিনে নিজেকে উপহার দেবেন কুমারী-কিশোরীর সাথে এক বন্য প্রেমের রাত। সেই রাত প্রকৃতই বন্য হয়েছিল কি না, সে হিসাবে আমরা ঢুকছি একটু পরই। এর আগে ভেবে দেখুন এই ধরনের একটি বাক্য দিয়ে এক বৃদ্ধ সাংবাদিক ও লেখকের কাহিনি শুরু করেছেন মার্কেস। কেন? কারণ আগেই বলেছি, শরীরের বার্ধক্য নয়, মনের তারুণ্যকেই মহিমান্বিত করতে চেয়েছেন কলম্বিয়ার নোবেলজয়ী লেখক মার্কেস। এজন্য কাহিনির ভেতর একটি বৃদ্ধ বিড়ালকেও আমদানি করেন তিনি। পরে এই বিড়ালটিও বার্ধক্যের ধকল সামলে বেঁচে থাকে, যেমনটা বেঁচে থাকেন কাহিনির বৃদ্ধটি। বার্ধক্যের বিপরীতে তারুণ্যের কথা বলতে গিয়ে মার্কেস উড়িয়ে দিয়েছেন গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসকে। মার্কেস বলছেন, ‘জীবন আসলে হেরাক্লিটাসের চির পরিবর্তনশীল নদীর মতই বহমান নয়, বরং আরেকবার ঘুরে আসার এবং পরবর্তী নব্বই বছর ধরে উত্তপ্ত কড়াইতে আরেক পিঠ দগ্ধ হওয়ার এই একটাই সুযোগ।’ আমি অনুবাদটি নিয়েছি অরুন্ধতী ভট্টাচার্যের কাছ থেকে। তিনি সরাসরি স্প্যানিশ থেকে বাংলায় তর্জমা করেছেন উপন্যাসিকাটি। যাহোক, পাঠক হেরাক্লিটাসের বহুল ব্যবহৃত পরিবর্তনশীল বাস্তবতা ও নদী বিষয়ক উক্তিটি নিশ্চয় জানেন।
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে থাকে না বা সবকিছুই প্রবহমান অর্থে হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, আপনি একই নদীতে দ্বিতীয়বার পা ডোবাতে পারবেন না। ৫৩৫-৪৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এই দার্শনিক আরো মনে করতেন, স্থায়ী বাস্তবতা বলে কিছু নেই, যা আছে সেটি হল পরিবর্তনের বাস্তবতা, স্থায়ী বলে যেটা আপনার মনে হয়, সেটা ইন্দ্রিয়ের ভ্রম মাত্র। আড়াই হাজার বছর পর মার্কেস একটি উপন্যাসিকা লিখছেন, যার পটভূমি মেক্সিকো, ১৯৬০ সালের দশক, এবং সেটি বেরুচ্ছে ২০০৪ সালে, সেখানে হেরাক্লিটাসের বক্তব্যকে পাল্টে মার্কেস বলছেন, যা গত হয়েছে বলে ভাবছেন সেটা আসলে আবার ফিরে পাওয়া সম্ভব। যেমন কাহিনির ৯০ বছর বয়সী বৃদ্ধ পেয়েছেন, না কিশোরীর দেহ নয়, কৈশোরের প্রেম! কিশোরীটি খণ্ডকালীন যৌনকর্মী। এমনিতে একটি পোশাক কারখানায় বোতাম লাগানোর কাজ করে মেয়েটি। স্তম্ভ লেখক বৃদ্ধ এই কিশোরীর নাম দেন দেলগাদিনা। আসল নাম জানার চেষ্টা করেও যেহেতু ব্যর্থ হন বৃদ্ধ, তাই ওরকম কাল্পনিক নাম দেয়া।
মার্কেস ও বইয়ের প্রচ্ছদ হেরাক্লিটাসের দর্শনকে উল্টে দেয়ার প্রয়াস বৃদ্ধ পান যখন তিনি দেলগাদিনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। এবং দেলগাদিনাকে কয়েকদিন দেখতে না পেয়ে বিরহে দিন কাটাচ্ছেন। এমন প্রেম ও বিরহ তার নব্বই বছরের জীবনে আর আসেনি। এর আগে তার জীবনে যেসব নারী এসেছেন তাদের মধ্যে ছিলেন জন্মদাত্রী মা, বেশ্যা, কাজের মহিলা এবং তাকে জোর করে বিয়ে করা এক নারী। তো নিজে প্রেমে পড়েছেন এমন নজির নেই বৃদ্ধের জীবনে, একমাত্র এই দেলগাদিনা ছাড়া। বেশ্যালয়ের নিয়মিত খদ্দের হিসেবে দুইবার শ্রেষ্ঠ খদ্দরের পুরস্কার পেয়েছেন যে লোক, যে লোক যৌবনকালে বেশ্যালয়ে আশ্রিত সকলের দায়িত্বই নিয়েই নিতে প্রস্তুত ছিলেন সেই লোকের সংসার হবে না সেটাই অনুমেয়। তাই পৈতৃক বাড়িটাতে, যে বাড়িটি আবার ঔপনিবেশিক আমলের, সেখানে দিনপাত করেছেন প্রায় একাই। মার্কেস কিন্তু বার্ধক্যের বিষয়টি ঔপনিবেশিক বাড়িটার উপরও আরোপ করতে চেয়েছেন। তো এই বাড়িতে শুধু একজন কাজের মহিলা দামিয়ানা মাঝে মাঝে বিকল্প যৌনতা উপহার দিয়েছে বৃদ্ধকে। তাই আক্ষেপ নিয়ে দামিয়ানাকে বলতে শোনা যায়, বাইশ বছর পেরুনোর পরও তার কুমারীত্ব ঘোচেনি। দামিয়ানার এসব কথা চিরকেলে তরুণ বৃদ্ধের বিরক্ত লাগে। নব্বইয়ের ঘরে দাঁড়িয়ে দামিয়ানার এই বিরহ আলাপ তার ভালো লাগে না, কারণ তখন তিনি পুরোপুরি যুবা প্রেমিক। জীবনে প্রথমবারের মত প্রেমের সুবাতাস পাচ্ছেন বৃদ্ধ, যা বয়ে এনেছে দেলগাদিনা।
বৃদ্ধ সাংবাদিক যেদিন প্রথম দেলগাদিনাকে দেখে তখন থেকেই একটা ভিন্ন আকর্ষণ কাজ করতে শুরু করে। এরপর তার সঙ্গে কয়েক রাত কাটান তিনি, নগ্ন হয়ে, কোন রকম স্পর্শ ছাড়াই, তারপরও কেমন এক ঘোর কাজ করতে থাকে তার মধ্যে। সে ঘোর এমনই ঘোর যে স্থানীয় পত্রিকায় লেখা প্রতি রোববারের কলামগুলো হয়ে উঠতে থাকে ব্যক্তিগত প্রেমপত্র। তাও আবার হাতে লেখা প্রেমপত্র। পত্রিকার সম্পাদককে অনেকটা বাধ্য করেই এই বন্দোবস্ত করা হয়। যে দয়িতার জন্য এতটা করছেন বৃদ্ধ, সেই দয়িতাই কিন্তু দিনের আলোতে অচেনা। কারণ দিনের আলোতে কখনোই দেলগাদিনাকে দেখেননি তিনি। এমনকি রাতের অন্ধকারেও চড়া মেকাপ নিয়ে বিছানায় আসতো সেই কিশোরী। কাজেই এক ভিন্নলোকের বাসিন্দা হয়েই দেলগাদিনা ধরা দেয় বৃদ্ধের কাছে। এমনভাবে ধরা দেয় যেখানে প্রেমই আছে শুধু, কাম নেই। তাই এক জায়গায় বৃদ্ধ বলছেন, বেঁচেছি, কৃতদাসের জীবন থেকে রক্ষা পেয়েছি। তিনি ইঙ্গিত করছেন যৌনতা তাড়িত জীবনের কথা। যে মুক্তির কথা বৃদ্ধ বলছেন, সেটা কি আসলেই মুক্তি? মুক্তি তো মেলেনি তাঁর, মুক্তি যে মেলেনি সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ঈদিপাস কূটের মাধ্যমেই।
দেলগাদিনাকে একজোড়া পান্নার দুল উপহার দেন বৃদ্ধ, সেগুলো তাঁর মায়ের। কিন্তু দেলগাদিনা পরার পর বৃদ্ধ দেখলো সেগুলো শোভা পাচ্ছে না কিশোরীর কানে। তাই নতুন আরেক জোড়া এনে দেন তিনি। মায়ের কানের দুলে কেন বৃদ্ধ তার প্রেমিকাকে দেখতে চাইবেন, যদি কূট ক্রিয়াশীল না থাকে? আরেক রাতের কথা বলি। সেদিনও বৃদ্ধ শুয়েছিলেন দেলগাদিনার সাথে। অন্ধকারে হঠাৎ এক স্পর্শ পেয়ে তিনি মনে করেন এটা তাঁর মায়ের ছোঁয়া। এক প্রশান্তি খেলে যায় বৃদ্ধের মনে। অন্য এক ভোরে দেলগাদিনার স্পর্শের মধ্যে বৃদ্ধ খুঁজে পান মায়ের সেই ছোঁয়া, নিজেই বলছেন, ‘তাই আনন্দ আমাকে আবৃত করল।’ যদিও পরে বৃদ্ধ আবিষ্কার করেন সেই স্পর্শ মায়েরও না, দেলগাদিনারও না, সেই স্পর্শ ছিল বেশ্যালয়ের মালকিন রোসা কাবারকাসের। কেন রোসা বৃদ্ধকে ওভাবে ভোরের আগে ডেকে উঠিয়েছিল সেই কাহিনি ভিন্ন। কিন্তু স্পর্শের মিল খুঁজে পাওয়ার কারণেই আমরা ঈদিপাস কূটের কথা বলেছি। এবং এই কূটের কারণেই বৃদ্ধ দৈহিকভাবে মিলিত হতে পারে না দেলগাদিনার সাথে- এটা আমার পর্যবেক্ষণ।
দুই.
সাহিত্যের মতো চলচ্চিত্রটিও শুরু হয় জন্মদিনে একটি বুনো রাত উপহার দেয়ার কথা বলে। এরপর ফ্ল্যাশব্যাক ব্যবহার করে একবার কৈশোর, তো আরেকবার যৌবনে আসা যাওয়া করে বৃদ্ধের কাহিনি। ছবিতেই বৃদ্ধের একটি নাম আমরা পাই- এল সাবিও (El Sabio)। চলচ্চিত্রে দিনের আলোতে দেলগাদিনার আনাগোনা দেখানো হলেও সাহিত্যে সেটা নেই। হেনিং কার্লসেনের পরিচালনায় যে মেয়েটিকে দেলগাদিনার (পাওলো মেদিনা এসপিনোজা) চরিত্রে দেখা যায় তার বয়স মার্কেসের দেলগাদিনার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ এমন এক সময়ে ছবিটি শুট করা হয় যখন যৌনকর্মে অপ্রাপ্তবয়স্কদের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে গেছে মেক্সিকোতে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই চৌদ্দ বছরের কিশোরী নয়, কুড়ি বছরের তরুণীকেই বাছাই করতে হয়েছিল চরিত্রটির জন্য। এগুলো ছবির পেছনের কথা। সামনের কথা হল দেলগাদিনাকে আমরা চলচ্চিত্রে সাবিওর পেছন পেছন দ্বিচক্রযান নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখি। যা মার্কেসের ছিল অনুপস্থিত। সাহিত্যের অনেক কিছুই বেকেচুরে গেছে চলচ্চিত্রে। সেটা মাধ্যম পরিবর্তনের জন্য হবেই। কিন্তু সাবিও চরিত্রে অভিনয় করা এমিলিও এচেভারিয়াকে মার্কেসের চরিত্র বলে মনে হয়নি, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। মনে হয়েছে এই শতকের কোন কামুক বৃদ্ধ।
মার্কেসের চরিত্রটির মধ্যে যেমন একটা দর্শন দর্শন গন্ধ ছিল, সেটা পরিচালক কার্লসেনের চরিত্রে অনুপস্থিত। নামের ব্যাপারটিই ধরুন। মার্কেস এই বৃদ্ধের কোন নাম না দিয়ে সকল বুড়িয়ে যাওয়া অনুভূতির সাথে তাকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যখনই তার নামকরণ হয় তখনই ব্যাপারটি বিশেষে বা পার্টিকুলারে পরিণত হয়, সেটি আর সামান্য বা ইউনিভার্সাল থাকে না। বিশেষে পরিণত হয় বলতে বুঝাচ্ছি বৃদ্ধ মানুষে পরিণত হয়। ধারণা আকারে সেটা আর বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সম্পর্কিত থাকে না। আপনি চাইলে বলতে পারেন নামকরণের ফলে ইন্ডিভিজুয়াল বা ইতরে পরিণত হয় ব্যাপারটি। সেটা আপনি বলতেই পারেন, তবে আমি যা বলতে চাইছি তা হলো বার্ধক্যকে সামান্যে উঠানোর যে প্রচেষ্টা মার্কেসে আছে, উল্টোটা ঘটেছে চলচ্চিত্রে।
তাই বলছিলাম চলচ্চিত্রে দার্শনিকতার ছোঁয়া আপনি পাবেন না, শুধু এক সংলাপে চিকিৎসক সাবিওর দিকে মন্তব্য ছুড়ে দেন ‘দার্শনিক’ বলে। বিষয়টি হলো যতই মার্কেস সাবিওকে দার্শনিক বানানোর চেষ্টা করুন না কেন, যৌনতা ও ঈদিপাস কূটের চাপে সেই পরিচয় ঢাকা পড়ে যায়। চলচ্চিত্রে পরিচালক যদি ইচ্ছা করে দার্শনিকতা এড়িয়ে গিয়ে থাকেন তাহলে বোধহয় ভালোই হয়েছে। কারণ নব্বই বছর বয়সে এক কিশোরীর প্রেমে পড়ে যে জীবনকে পুনরায় উপভোগের কথা বলছেন সাবিও, সেটা তিনিও জানেন, মার্কেসও জানেন, উপভোগ করা সম্ভব নয়। তাই প্লেটোনিক ভালোবাসা ধরনের কিছু একটা আমদানির চেষ্টা হয়েছে। আবার এই স্বর্গীয় ভালোবাসার ঠেকনা হিসেবে টানা হয়েছে বেচারা হেরাক্লিটাসকে। উনাকে এখানে টেনে এনে কোনো লাভ নেই, কারণ উনি সত্যই বলেছেন। আর এই যে দেলগাদিনার সঙ্গে কামহীন প্রেম- এটা হলো জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তারুণ্য নিয়ে বেঁচে থাকার এক অদম্য ইচ্ছা মাত্র। ভ্রমও বলতে পারেন। এই ভ্রমকে আরো জোরালো করে তোলে কিশোরী দেলগাদিনার সাথে সাক্ষাৎ ও সাক্ষাতের পর ঈদিপাস কূটের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা। এই উসকে ওঠা ভ্রমকে বৃদ্ধ ভাবতে চান তার জীবনের এক কপাল লিখন হিসেবে।
চলচ্চিত্রের কয়েকটি দৃশ্য তাই তো উপন্যাসিকাতে বৃদ্ধ নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক জায়গায় বলছেন, ‘বুঝতে পারলাম যে প্রকৃতগতভাবে আমি শৃঙ্খলাপরায়ণ নই, এটা আমার অবহেলারই ফল। আমি যে উদারতা প্রকাশ করি, তা বস্তুত সঙ্কীর্ণতাকে ঢাকতে; আমি বিবেচক, কারণ সর্বদা আমার দুর্বুদ্ধি ক্রিয়াশীল; নিজের ক্রোধের কাছে পরাজিত হওয়ার ভয়ে আমি সহনশীল আর আমার সময়ানুবর্তিতা কেবলমাত্র অন্যের সময়কে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রচেষ্টা। সংক্ষেপে এইটুকুই বলা যায় যে ভালোবাসাকে কোনওদিনই আমি আত্মার অন্তর্গত বলে ভাবতে শিখিনি, এ আমার কাছে ছিল শুধুই ভাগ্যের লিখন।’
ভুলে গেলে চলবে না, আলোচ্য উপন্যাসিকাটি মার্কেস লিখেছিলেন মারা যাওয়ার মাত্র দশ বছর আগে। তিনি মারা যান ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল, তখন তাঁর বয়স ৮৭ বছর। সেই বিবেচনায় সাবিও ছিল মার্কেসের এক অবতার, মার্কেসেরই বাসনার বহিঃপ্রকাশ। মার্কেসও নব্বইয়ের কোঠা পূরণ করে একশ’ পর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছিলেন। তিনিও আবার যৌবনকে ছুঁতে চেয়েছিলেন শেষ প্রান্তে এসেও। কে না চায়? তাই তিনি বলতে চেয়েছেন এক নদীতে দ্বিতীয়বার পা ডোবানো সম্ভব।
উপন্যাসিকার শেষ প্রান্তে বৃদ্ধের মুখ দিয়ে মার্কেস বলাচ্ছেন, ‘শেষ পর্যন্ত এটাই জীবন, সুস্থ হৃদয়ের যাপন, আনন্দময় ভালোবাসার আধারে মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবী নির্দেশ। সানন্দ উদ্বেগে, শততম জন্মদিনের পর যে কোনও একদিন, সেই মৃত্যুর উদ্দেশ্যে আমার প্রতীক্ষার আয়োজন।’ সাবিও ঠিক কবে মারা যান সেটা পাঠক জানতে পারে না। কিন্তু মার্কেসের মৃত্যু সম্পর্কে পাঠক জানেন। মার্কেসের মৃত্যুর দুই বছর আগেই ছবিটি মুক্তি পায়। মার্কেস নিজেই অনেক ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন, তদারকি করেছেন, এমনকি কর্মশালাও করিয়েছেন চিত্রনাট্যের উপর। কিন্তু এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য মার্কেস বোধহয় দেখার সুযোগ পাননি। সেজন্যই হয় তো এই চলচ্চিত্রটি দেখার সময় ‘ডেজা ভু’ প্রতিক্রিয়া হয়নি। ফরাসি শব্দবন্ধ ‘ডেজা ভু’র অর্থ ‘আগেই দেখেছি’, এর একটি দার্শনিক মাজেজাও আছে, সেদিকে যাব না। শুধু এটুকু বলবো উপন্যাসে আপনি যে চরিত্রকে কল্পনা করেছিলেন সেটি খুঁজে পাবেন না চলচ্চিত্রে। একে তো দেলগাদিনার বয়স বেশি, তার উপর সাবিওর চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন তিনিও খুব একটা একাত্ম হতে পারেননি চরিত্রের সাথে বা পরিচালক তার মধ্যে দার্শনিক ব্যাপারটা ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। যেটা ফুটে উঠেছে সেটা হল হঠাৎ করেই একজন বৃদ্ধ কাম তাড়িত হলেন, বেশ্যালয়ে গিয়ে এক মেয়ের প্রেমে পড়লেন। সেই মেয়েও তার প্রেমে পড়া শুরু করে ধীরে ধীরে। শেষ দৃশ্যে দেলগাদিনার সঙ্গে রাত কাটিয়ে সাবিও বাড়ি ফিরে আসেন ভোরের আগেই। নিয়মিত কলাম লিখতে বসেন তিনি। লেখার টেবিলের ওপর সেই বুড়ো বিড়াল। ভোরের আলো ফুটছে। তখন বেলকনিতে এসে নতুন সূর্যের দিকে তাকিয়ে সাবিও চিৎকার করে বলেন, ‘আমি প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছি, পাগল নয়, উন্মাদ! আমাকে শুনতে পাচ্ছ? আজকের দিনটা অনেক বেশি সুন্দর!’
এভাবেই বৃদ্ধ এক সাংবাদিক ও লেখকের নব্বই থেকে একানব্বই- একটি বছর দেখানো হয় চলচ্চিত্রে। এমনিতে চলচ্চিত্রটির দৃশ্যধারণ ও সম্পাদনা মন্দ নয়, গল্পের ভেতর একটা ধীর লয় আছে, উপন্যাসিকার মতই। আর অভিনয়ের কথা বললে রোসার চরিত্রে জেরালডিন চ্যাপলিন ভালো অভিনয় করেছেন। সাবিও চরিত্রটির বালক বয়সের ছেলেটিও ভালো অভিনয় করেছেন। ৯৩ মিনিটের চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছে তিনটি দেশের সংস্থা- স্পেন, মেক্সিকো ও ডেনমার্ক।

তিন.
শেষ কথা হিসেবে বলতে চাই উপন্যাসিকা বলি বা চলচ্চিত্র, কোথাও কিন্তু নামকরণের স্বার্থকতা আমরা দেখি না। দুই ক্ষেত্রেই দেখি শিরোনামে বলা হচ্ছে একাধিক বিষণ্ন বেশ্যার কথা। কিন্তু আদতে এটি একজন অপেশাদার বেশ্যার সাথে এক সাংবাদিক ও লেখকের অসম প্রেম উপাখ্যান। যে উপাখ্যানের মধ্যে বেশ্যাদের বিষণ্ন জীবনযাপনের স্মৃতি পাবেন খুবই ক্ষীণ আকারে। দেলগাদিনা গরীব, এটা বলা হলেও তার বিষণ্ন হওয়ার আর কোন কারণ বা ইতিহাস উপন্যাসিকাতে নেই, চলচ্চিত্রেও নেই। কাজেই উভয় ক্ষেত্রেই বলতে হয় শিরোনামটি যথাযথ হয়নি, বরং আমার মনে হয় নভেলা ও চলচ্চিত্র দুটিরই শিরোনাম হতে পারতো ‘নব্বইয়ে নট আউট!’

---

দোহাই
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, আমার বিষণ্ন বেশ্যাদের স্মৃতি, স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ অরুন্ধতী ভট্টাচার্য, উর্বী প্রকাশনী, ২০০৮, কলকাতা।
Terrence Raffertynov, Memories of my melancholy whores: client of the year, The New York Times, Nov. 6, 2005.

Alberto Manguel, A sad affair, Guardian, Sept. 15, 2011.

Jonathan Holland, Memories of my melancholic whores, Variety, May 18, 2012.

................................................................

ঈদ সংখ্যার সূচিপত্র দেখতে ক্লিক করুন :

বাংলা ট্রিবিউন ঈদ সংখ্যা ২০১৬

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহি চায় ঢাকা
ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহি চায় ঢাকা
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
সব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিবি হারুনসব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী