X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কবিতায় আড়াল আমার পছন্দ : হাসনাত শোয়েব

.
০৯ আগস্ট ২০১৭, ১০:০৫আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০১৭, ১০:২২

কবিতায় আড়াল আমার পছন্দ : হাসনাত শোয়েব হাসনাত শোয়েবের জন্ম চট্টগ্রামে, ১৯৮৮ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর। পেশা : সাংবাদিকতা। কবিতার বই : সূর্যাস্তগামী মাছ (২০১৫), ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার (২০১৭)। সম্পাদিত কাগজ : ডাকঘর, ডাক।

 দ্বিতীয় দশকের কয়েকজন কবির কাব্য-ভাবনা ও লেখালেখি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন সাহিত্যের এই আয়োজন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একই সময়ের কবি রাসেল রায়হান।


প্রশ্ন : আপনার দুটি বইয়ের কবিতাতেই পরাবাস্তবের ঝোঁক প্রবল, এবং এটা এসেছে খুব সাবলীলভাবে। পরাবাস্তবতার বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

উত্তর : আমি আসলে এভাবেই ভাবতে পছন্দ করি। এগুলো খুব অটোমেটিক রাইটিং। আমি কবিতা এডিট করি না পারতপক্ষে। মাঝে মাঝে রিপিট হলে করতে হয়। পরাবাস্তব লিখব এই ভেবে কবিতা লিখতে বসি না। পরাবাস্তবতা আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল না। আমি কেবল কবিতাই লিখতে চেয়েছি। সেখানে টুলস হিসেবে পরাবাস্তবতা এসেছে।

প্রশ্ন : এই বইগুলো কতটা ব্যক্তি আপনাকে রিপ্রেজেন্ট করছে?

উত্তর : কখনো প্রত্যক্ষ আবার কখনো পরোক্ষভাবে আমার কবিতা আমাকে রিপ্রেজেন্ট করে। তবে আমার কবিতা আমার থেকে বিচ্ছিন্ন কখনোই নয়।

প্রশ্ন : আপনার শেষ বইটায় (ব্রায়ান অ্যাডামস ও মারমেইড বিষ্যুদবার) আমি একটা বিশেষত্ব দেখতে পাই,যদিও আমিই ট্যাগ লাগালাম পরাবাস্তবতার, কিন্তু সেই পরাবাস্তবতার আড়ালে জীবনের নোংরা বাস্তবতা, সুন্দর বাস্তবতা প্রকটভাবেই সামনে আসছে। কিন্তু যদি বাস্তবতাকেই তুলে ধরতে হয়, পরাবাস্তবতার আড়াল ঠিক কেন?

উত্তর : আমার আসলে এভাবেই এক্সপ্রেস করতে ভালো লাগে। কবিতায় আড়াল আমার পছন্দ। সেক্ষেত্রে পরাবাস্তবতা টুলস হিসেবে সহায়ক। আমি কবিতায় সরাসরি কথা বলতে অপছন্দ করি।

প্রশ্ন : এই ‘কথা বলা’য় কিসের দিকে বেশি জোর দেন? নির্মাণে, না বোধে?

উত্তর : নির্মাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চয়। তবে আমার মনে হয় পাঠক সম্ভবত শেষ পর্যন্ত নির্মাণ নয় কবিতাটা পড়তে চায়। সেক্ষেত্রে বোধ আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কবিতা লেখার সময় এসবের কিছুই মাথায় থাকে না।

প্রশ্ন :  কবিতার নির্মাণ বুঝলাম। নিজের জগত নির্মাণ কতটা জরুরি? জরুরি হলে আপনার ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতিটা ঠিক কেমন?

উত্তর : নিজের জগত নির্মাণ ছাড়া কোনো শিল্পই ঠিক শিল্প না। আপনি সাহিত্য, চিত্রকলা, সিনেমা- যাই করেন না কেন, সেটা যদি আপনার নিজের না হয়, তবে তা আমি দেখব কিংবা পড়ব কেন? আরেকটা জীবনানন্দ কিংবা সত্যজিৎ আমার দরকার নাই। আপনি কবি যদু হলে আমি যদুর কবিতাই পড়তে চাইব কিংবা আপনি ফিল্মমেকার মধু হলে আমি মধুর সিনেমাটাই দেখতে চাইব। আর আমি নিজের জগৎ নির্মাণ করতে পেরেছি কি না সেটা আমার চেয়ে অন্যরা ভালো বলতে পারবে। তবে আমি সবসময় আমার লেখাটাই লিখতে চাই, আমার মতো করে। হয়তো পারি না, কিন্তু একদিন পারব এটা ভেবেই বারবার লিখতে বসি।

প্রশ্ন : অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের সাথে কবিতার পার্থক্যটা ঠিক কোথায়?

উত্তর : কবিতা সাধারণত একটু আড়ালের জিনিস। অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতো কবিতা পারফর্মিং না। তাই এর গণ্ডিও সীমাবদ্ধ। এখানে সেলিব্রেটি হওয়াও খুব কঠিন। কবিতা এমন আর্ট যার শোষণ ক্ষমতা অন্য যেকোনো আর্ট-ফর্মের চেয়ে অনেক বেশি।

প্রশ্ন : এই আর্ট-ফর্মের সঙ্গে জীবনাচরণ, রাজনীতির দ্বন্দ্ব আছে কিনা?

উত্তর : কবিতার সাথে কোনকিছুর দ্বন্দ্ব আছে এমন মনে করি না। সবকিছুর সাথে কবিতা চলতে পারে। কালাশনিকভ যদি কবি হতে পারেন, তবে যে কেউ কবি হতে পারেন।

প্রশ্ন : এমন একটা ধারণা চালু আছে যে, কবিকে হতে হবে মহামানব ধরনের? এই ধারণার ভিত্তি কী হতে পারে?

উত্তর : এই ধারণার ভিত্তি জীবনানন্দ। তাকে আদর্শ মেনেই কবিকে মহামানব বানানোর প্রজেক্ট আমাদের এখানে চলছে। মানে, নির্লিপ্ত-নির্লোভ এবং সর্বোপরি ট্রামের নিচে পড়ে না মরলে আপনি কবিই হবেন না এখানে। আমার কাছে কবি আরেকজন সাধারণ মানুষের মতোই। মোটেই মহামানব-টানব না।

প্রশ্ন : অন্য প্রসঙ্গে আসি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নবীন কবিদের জ্যেষ্ঠরা সাপোর্ট করেন না বলে শোনা যায়। সত্যিকারের কবিরা সেই সাপোর্টটা চায়ও না হয়তো একসময়। কিন্তু জ্যেষ্ঠদের অসহযোগিতার কারণটা ঠিক কী?

উত্তর : কবিতায় কেউ কাউকে সাপোর্ট করতে পারেন না। বৈষয়িক লাভ কিংবা পুরস্কার-টুরস্কার আলাদা বিষয়। কিন্তু যদি আপনার কবিতা না হয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও আপনাকে রক্ষা করতে পারবেন না। আর হ্যাঁ, জ্যেষ্ঠদের অনেকের মধ্যেই হারানোর ভয় আছে এটাও সত্য।

প্রশ্ন :  এরপরেও দেখা যায় 'লাইনে আসার জন্য' জুনিয়র কবিরা সিনিয়র কবিদের পেছনে ঘোরে, সাহিত্য সম্পাদকের পেছনে ঘোরে...

উত্তর : এগুলো হয় না- এমনটা আমি বলব না। অনেককেই মুরিদ হতে দেখেছি এবং দেখছি। কিন্তু আপনার কবিতাই যদি না হয়, তবে এসব করেও কতদূর কী করবেন! যার হয় তার জাত এমনিতেই হয়। যার হয় না গুরু ধরে কিংবা গরু মেজবানি দিয়েও হয় না।

প্রশ্ন : আর গ্রুপিংয়ের যে অভিযোগ প্রায়ই ওঠে...

উত্তর : ওই যে বললাম, কোনোকিছু করেই কবি টিকে থাকতে পারে না, যদি কবিতা না থাকে। সাময়িক কিছু সুবিধা নিশ্চয়ই পেতে পারে। এর বেশি কিছু না।

প্রশ্ন :  কিন্তু গ্রুপিংয়ের সাথে আমরা আসলে আড্ডাকে গুলিয়ে ফেলছি কিনা? হয়তো স্রেফ শেয়ারিং, ভালো লাগা- এসবকে প্রাধান্য দিয়ে আড্ডায় বসা। সেটাকেও অনেক সময় আমরা গ্রুপিং নাম দিয়ে দিই।

উত্তর : এটা ব্যক্তির বিষয়। সে যেভাবে ভাবে আরকি। ট্যাগ সাধারণত অন্যরা লাগায়। হয়তো আপনি ভালোলাগা থেকেই আড্ডা দিচ্ছেন কেউ সেটাকে গ্রুপিং ট্যাগ দিলো। একই ঘটনা তার ক্ষেত্রেও হতে পারে।

প্রশ্ন : আর একটু আগে যে ‘পুরস্কার-টুরস্কার’-এর কথা বললেন। এর প্রভাবই আসলে কতটা?

উত্তর : পুরস্কারে কিছু টাকা আসে, আর কিছু মানুষের কাছে পরিচিতি পাওয়া যায়। এর বেশি কিছু না।

প্রশ্ন : একদিকে লিটলম্যাগ ম্রিয়মাণ, অন্যদিকে দৈনিকগুলোর উত্থান, এই দুইয়ের সুবাদে সাহিত্য একটি কর্পোরেট শ্রেণির কাছে বাঁধা পড়ছে কিনা?

উত্তর : আমার তো মনে হয় লিটলম্যাগের সাথে দৈনিকের পতন হয়েছে। এখন কবিতা প্রকাশের জন্য কিংবা নাম ছাপানোর জন্য কারো দ্বারস্থ হতে হয় না। আমি চাইলে নিজেই কবিতা পৌঁছে দিতে পারি পাঠককে। ভার্চুয়াল দুনিয়া এই সুযোগটা আমাকে দিয়েছে। তাই দৈনিকের সাহিত্য পাতার দাপট এখন আগের মতো নাই।

প্রশ্ন : বিভিন্ন দৈনিকে, অনলাইন পোর্টালগুলোতে সাহিত্য বিভাগ থাকে এখনো। এই বিভাগটি তাহলে সাহিত্যের কতটুকু উপকার করতে পারছে এখন?

উত্তর : এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। খুব দ্রুত অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছানো যায়। এটাকে আমি এখনো ইতিবাচকভাবেই দেখি।

প্রশ্ন : আর ছোটকাগজগুলো? এক সময় তাদের একটা ভূমিকা ছিল। বর্তমানেও বেশ কিছু ছোটকাগজ বের হচ্ছে। তারা কী ভূমিকা রাখছে?

উত্তর : ভার্চুয়াল মিডিয়ার দৌড়ে ছোটকাগজ প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। কিছু থাকলেও, সেসবের কোনো ভূমিকা আমি দেখছি না।

প্রশ্ন : আরেকটা বিষয়, কবিতার পাঠক কম- এরকম একটা অভিযোগ আছে। এর কি কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে করেন?

উত্তর : বিক্রি দিয়েই সম্ভবত পাঠক কমার কিংবা বাড়ার বিষয়টা নির্ধারণ করা হয়। তবে আমার মনে হয় না পাঠক কমছে। পাঠক বরং বাড়ছে। আগের চেয়ে বর্তমানে বই বিক্রির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে ভার্চুয়াল পাঠকও বেড়েছে। তাই পাঠক নেই এই কথা আমার বিশ্বাস হয় না। তাই নতুন করে উত্তরণের দরকার নেই। উত্তরণ হচ্ছে।

প্রশ্ন : কবিতায় শ্লীলতা-অশ্লীলতার একটা তর্ক আছে। এর সীমা ঠিক কতটুকু? কতটা শ্লীলতা অতিক্রম করে গেলে সেটাকে অশ্লীল বলা যেতে পারে? আদৌ বলা যেতে পারে কি না?

উত্তর : আমি কোনো কিছুই অশ্লীল মনে করি না। সুতরাং মানা না মানার প্রশ্নই আসে না। যার যা ইচ্ছা ব্যবহার করবে। এই যেমন, বিনয় মজুমদার সম্পর্কে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, বিনয় গু নিয়ে উৎকৃষ্ট কবিতা লিখতে পারবেন। এটাই আসল বিষয়। আপনি কিভাবে কী ব্যবহার করছেন সেটাই মূল বিষয়। তবে হ্যাঁ, স্ট্যান্ট হিসেবে কোনো শব্দ কবিতায় দেখলে সেই কবিতা আমি ব্যক্তিগতভাবে কম পছন্দ করব।

প্রশ্ন : আরেকটা প্রশ্ন করতেই হচ্ছে। যদি স্ট্যান্ট হিসেবে শব্দ না এসে ছন্দ আসে?

উত্তর : ছন্দ কবিতার একটা টুলস মাত্র, কবিতা না। যার ইচ্ছা ছন্দে লিখবেন, যার ইচ্ছা লিখবেন না। এটা নিয়ে আমি অত ভাবি না। বতর্মান কবিদের মধ্যে ছন্দবিমুখতা বেশ আছে, অন্যদিকে ছন্দ ছন্দ করে শহীদ হওয়া এমন লোকও কম না।

প্রশ্ন : এবার তাহলে শেষ করি। বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতা নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। সেই বৃত্তে (প্রতিদ্বন্দ্বিতা অর্থে ঠিক না, বাংলা সাহিত্যের অংশ হিসেবে) আপনার লেখা ফেলে যদি দেখতে বলা হয়, কতটা তৃপ্ত?

উত্তর : নিজের লেখা নিয়ে পুরোপুরি তৃপ্তি কখনোই আসে না। আমারও না। আর তুলনা করতে আমি রাজি না।

ধন্যবাদ, শোয়েব।

আপনাকেও।


অলঙ্করণ : নরোত্তমা

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কেনাকাটার একাল-সেকাল
অনলাইন শপিংকেনাকাটার একাল-সেকাল
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ‘ইন্ডিয়া-আউট’ ক্যাম্পেইন: বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ফলাফল
বিএনপির ‘ইন্ডিয়া-আউট’ ক্যাম্পেইন: বাস্তবতা ও সম্ভাব্য ফলাফল
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের