ফের্নান্দু পেসোয়া পর্তুগিজ ভাষার অন্যতম প্রধান কবি। লিখেছেন সত্তরেরও বেশি নামে। তবে তিনি এই নামগুলোকে ‘ছদ্মনাম’ না বলে ‘হেটেরোনিম’ বলেছেন। হেটেরোনিম সেসব নামকে বলা হয় যা প্রকৃতপক্ষে ছদ্মনাম নয় বরং এমন একটি সত্তার অস্তিত্বকে প্রকাশ করে যাদের জাগতিক কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও কল্পনার পৃথিবীতে তাদের অস্তিত্ব এবং নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে। 'আলবার্তো কাইয়েরো' ফের্নান্দু পেসোয়ার উল্লেখযোগ্য ৪টি হেটেরোনিমের একটি। কাইয়েরো নিজের চোখে যা দেখে বা অনুভব করে তা সেভাবেই ব্যাখ্যা করে। কল্পনায় কিছু তৈরি করে না। পৃথিবীর কোনোকিছু নিয়ে সে প্রশ্ন না তুলে বরং মেনে নেয়। কাইয়েরোর এই কবিতাগুলো পর্তুগিজ থেকে ইংরেজিতে রিচার্ড জেনিথের অনুবাদে প্রকাশিত পেসোয়ার ‘এ লিটল লার্জার দ্যান দ্য এনটায়ার ইউনিভার্স : সিলেক্টেড পোয়েমস’-এর ‘আনকালেক্টেড পোয়েমস’ থেকে নেওয়া হয়েছে।
***
যখন বসন্ত আসে
আমি মরেও যাই যদি
ফুলগুলো আগের মতো ফুল হয়েই ফোটে
গাছগুলোও গত বসন্তের চেয়ে নয় কম সবুজ—
দুনিয়া যেন আমাকে সহজেই গেলো পাশ কাটিয়ে।
আমার মৃত্যুতে মরে না কারো হাতিঘোড়া
এই ভেবে আমি উল্লাসিত, আনন্দে আপ্লুত।
আমি যদি জানতাম, কালই মরে যাবো
এবং পরশু আসবে বসন্ত
আমি শান্তিতে মরতে পারতাম—বসন্ত এখনো আরো দূরে, পরশু!
সময় মতো যদি হয়ও, অন্য সময়ে কেনো আসবে?
সবকিছু যা যা আছে এবং নিখাঁদ তাই আমার পছন্দ
আমি তা অমনই ভালোবাসি
যদি আমি ভালো নাও বাসি তা তার মতোই থাকবে
তাই আমি যদি মরি, শান্তিতেই মরব
কারণ সবকিছুই আছে ঠিকঠাক।
চাইলে আমার কফিনের পাশে লাতিন ভাষায় প্রার্থনা করতে পারো
গান গেয়ে চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচতেও পারো
আমার কোনো ভালোমন্দ নেই—বা তার সুযোগও নেই
কেবল সময় বলে দেবে কখন কী হবে।
৭ নভেম্বর ১৯১৫
***
আমি মরে গেলে
কেউ আমার জীবনী লিখবে—যা জটিল কিছু নয়
যা মাত্র দুটি দিনের—আমার জন্ম ও মৃত্যু
আর এই দু’দিনের মধ্যে সকল দিনই আমার
আমাকে বোঝা খুব সহজ—
কিছু না ভেবেই আমি সবকিছু ভালোবাসি
আমি কখনো সন্তুষ্টির আশায় বসে নেই
কখনোই আমি অন্ধ ছিলাম না
শোনা কখনোই
দেখার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
আমি বুঝি বস্তু চিরকালই বাস্তব
এবং তারা পরস্পর থেকে আলাদা।
আমি চোখ দিয়ে সেটা বুঝেছি, মন দিয়ে তা কখনোই নয়
মন দিয়ে বুঝতে গেলে খুঁজতে হবে তাদের মতো।
একদিন শিশুর মতো হঠাৎ আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম
আর চোখ বন্ধ করেই ডুবেছিলাম ঘুমে।
আর এর বাইরে আমি ছিলাম প্রকৃতির একজন কবি।
৮ নভেম্বর ১৯১৫
***
আমি জানি না, কীভাবে একজন ভাবতে পারে—‘সূর্যাস্ত মানেই মন খারাপ করা’
কারণ এটা সূর্যাস্ত, সূর্যোদয় তো নয়।
কিন্তু এটা তো একটা সূর্যাস্ত, এটা কীভাবে কখনো সূর্যোদয় হতে পারে?
৮ নভেম্বর ১৯১৫
***
আমার কোনো তাড়া নেই। কীসের তাড়া?
সূর্য কিংবা চাঁদ, কারো তাড়া নেই—তারা আছে যথাযথ।
তাড়াতাড়ি করা মানে তো নিজের ছায়াকে
অতিক্রম করে লাফ দেওয়া।
না, আমার কোনো তাড়া নেই।
যদি আমি প্রসারিত করি আমার দু’হাত—
আমি শুধু পৌঁছে যাবো আমার হাত
যেখানে সাধারণত ঠিকঠাক পৌঁছায়, তার এক ইঞ্চিও বেশি নয়।
যেখানেই চাই আমি আঙুলগুলোকে ছোঁয়াতে পারি না,
আমি যেখানে থাকি সেখানে শুধু বসে পড়তে পারি—
হাস্যকর শুধু চিরকালের সত্যের মতো।
কিন্তু প্রকৃত হাস্যকর ব্যাপার তো তাই
যা ভাবি আমাদের মতো করে।
এবং আমরা সবসময়ই তার বাইরে
কারণ আমরা রয়েছি এখানেই।
২০ জুন ১৯১৯
***
তুমি বললে, আমি সাধারণের থেকে বেশি,
একটি পাথর কিংবা গাছের থেকেও।
তুমি বললে, আমার অনুভূতি আছে,
চিন্তা করি এবং জানিও যে
আমি ভাবি এবং অনুভব করি।
পাথরেরা কি কবিতা লেখে?
গাছেরা কি পৃথিবী নিয়ে ভাবে?
হ্যাঁ, সেটা আলাদা ব্যাপার,
কিন্তু সেরকম আলাদা নয়, যা তুমি ভাবছ
কারণ সচেতনতা আমাকে বস্তুর তত্ত্বে ভাবতে
বাধ্য করে না
এটা শুধু সচেতন হতেই বাধ্য করে।
আমি একটি গাছ কিংবা পাথর থেকে বেশি বা বিশেষ কিছু কিনা, আমি জানি না।
আমি আলাদা। আমি জানি না এর থেকে আমি বেশি না কম।
সচেতন হওয়া রঙিন হওয়ার থেকেও কি বেশি কিছু?
হতেও পারে, আবার নাও
আমি শুধু বিভেদ বুঝি।
কেউই প্রমাণ করতে পারবে না, এটা ভিন্নতার থেকেও বেশি কিছু।
আমি জানি, পাথরেরা বাস্তব, গাছেরা অস্তিমান
আমি জানি, কারণ তাদের অস্তিত্ব আছে।
আমি জানি, কারণ অনুভূতি আমাকে টের পাওয়ায়
আমি জানি, আমিও বাস্তব
কারণ আমার ইন্দ্রিয় আমাকে টের পাওয়ায়।
যদিও তারা পাথর কিংবা গাছের থেকে আমাকে বেশি স্পষ্ট করে তোলে,
তবু আমি এতোটুকুই জানি।
হ্যাঁ, আমি কবিতা লিখি—পাথরেরা যা পারে না
হ্যাঁ, আমি ভাবি—গাছেরা যা পারে না, পৃথিবী সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।
কিন্তু পাথরেরা তো আর কবি নয়, তারা কেবলই পাথর,
গাছেরা শুধুই গাছ, তারা ভাবুক নয়।
আমি মনে করি এই ব্যাপারগুলো তাদের থেকে আমাকে বিশেষ করেছে
অথবা নিকৃষ্ট
কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারি না
কেবলই ‘পাথরেরা পাথর, গাছেরা গাছ’ ছাড়া।
এবং আমাকে বলতে পারি এতটুকুই, এটা আমি।
এর চেয়ে বেশি কিছু নয়, এর থেকে বেশি কী বলা যায়?
৫ জুন ১৯২২