X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ‘আমার দেখা নয়াচীন’

ড. আখতার হোসেন
১৭ মার্চ ২০২০, ০৬:০০আপডেট : ১৭ মার্চ ২০২০, ০৬:০০

প্রসঙ্গ ‘আমার দেখা নয়াচীন’

বাংলা একাডেমি মুজিব শতবর্ষের প্রাক্কালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চীন ভ্রমণের উপর ভিত্তি করে ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। চীন-ভ্রমণ কাহিনীটি কারাগারের অন্তরালে ১৯৫৪ সনে লিখেছিলেন, কিন্তু গ্রন্থটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা প্রকাশের পর প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থের ভূমিকায় বঙ্গবন্ধু-কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে আলোচনা করেছেন, তারপর কোনো আলোচনা করার অবকাশ থাকে না। অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা এদেশের আপামর পাঠককে আলোড়িত করেছে তেমনি বিশ্বের বহুদেশে অনূদিত হয়ে বিশ্ববাসীকেও উপহার দিয়েছে এক অমূল্য সম্পদ। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ আরও একটি নতুন সংযোজন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও বাগ্মিতা সকলের কাছেই বিশেষভাবে পরিচিত। এই বিষয়ে তিনি সকল বিতর্কের উর্ধ্বে। এ মহান পুরুষের তিনটি গ্রন্থ প্রকাশের ভেতর তার লেখনি-শক্তির অসাধারণ পরিচয় উন্মোচিত হয়। রাজনীতিবিদ ও লেখকের সম্মিলনে এক মহান ব্যক্তিত্বে বঙ্গবন্ধুর আত্মপ্রকাশ বাঙালি জাতি তথা সারা বিশ্ববাসীর কাছে বিস্ময়কর।

ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকে ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৪৮ সনের ১১ই মার্চ থেকে ১৯৫২ সনের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময় গ্রেফতার ও মুক্তি লাভের পর ১৯৫২ সনের অক্টোবরে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে চীন ভ্রমণের সুযোগ পান। মাত্র ১২ দিনের স্বল্পস্থায়ী ভ্রমণের ভেতর তার লেখা চীন ভ্রমণের বর্ণনায় উপস্থাপিত হয় এক অসাধারণ চিত্র, যা আমাদের সাহিত্য ও রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য সম্পদ। শান্তি সম্মেলন আর ভ্রমণের উদ্দেশ্যে গেলেও তার ভ্রমণে ছিলো চীনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা। বঙ্গবন্ধু নয়াচীনকে যে দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং উপস্থাপন করেছেন তাতে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু নৃবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে গভীরভাবে অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণ করেছেন। অর্থাৎ অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং সে তথ্যকে পুনঃযাচাই বা সত্যানুসন্ধানের ভেতর উপস্থাপন করেন। বিপ্লবোত্তর চীনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সম্পর্কে যে তথ্য দোভাষীর মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিলেন, সে সমস্ত তথ্যকে শুধু পর্যবেক্ষণই করেননি, স্বচক্ষে যাচাই-বাছাইও করেছেন। যাচাই-বাছাইয়ের সূত্রও বর্ণনা করেছেন। একজন গবেষক সমাজ রাষ্ট্রকে জানতে যে পদ্ধতি অবলম্বন করে, বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের লিখিত গ্রন্থের উপস্থাপনায় সে পদ্ধতির অনুসরণ বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তথ্য সংগ্রহ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, একই সঙ্গে ভিন্ন সংস্কৃতিকে দেখার নিরপেক্ষ অবস্থানেরও পরিচয় পাওয়া যায় এ গ্রন্থে। সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান নারী পুরুষের অবস্থান ও পারস্পরিক সম্পর্ক বিপ্লবোত্তর চীনে সমানাধিকার কীভাবে কার্যকর হয়েছে তাও প্রত্যক্ষ করেন। আবার অবাধ মেলামেশায় যুব সমাজের নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা কমিয়ে আনবে বলে চীন সরকারের বিশ্বাসকে ভালো-মন্দের বিচার না করে ওদের ভবিষ্যতের ওপর ছেড়ে দেন। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সমাজবিজ্ঞানীর মতো সংস্কৃতির ভিন্নতা অধ্যয়নে নিরপেক্ষ মত প্রকাশ করেছেন। অবাধ মেলামেশায় অবিবাহিত যুগলের সন্তান রাষ্ট্র কর্তৃক লালন পালনকে মানবিক বিবেচনায় দেখলেও নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে অনুধাবন করতে চেয়েছেন ছেলেমেয়েদের অবাধ বিচরণ। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার এখানে মতামত দেওয়া উচিত হবে না’ (পৃ: ১০৯)। উচিত অনুচিত সম্পর্কে কোনো মত না দিয়ে ভবিষ্যতে কী হবে তা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ফলাফলের জন্য অপেক্ষায় থাকতে বলেন। গ্রন্থটির মূল বক্তব্য একশত ঊনিশ পৃষ্ঠায় লিখিত হলেও দক্ষ লেখনির ভেতর পদ্ধতিগত অধ্যয়ন, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক চিত্রনে সহজ-সাবলীল ভাষায় ঠাসা বুননে উপস্থাপিত চীনা রাষ্ট্রের একটি এথনোগ্রাফি।

নয়াচীন ও পূর্ববর্তী চীনের তুলনামূলক আলোচনা একই সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক আদর্শ এবং সর্বশেষে নিজের উপলব্ধি সহজভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যে বক্তব্য দিয়ে গ্রন্থটির উপসংহার টেনেছেন, ‘আমার মতে, ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা নাহলে মানুষের জীবনবোধ পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়’(পৃ: ১১৯)। এ কথার ভেতর প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর মূল রাজনৈতিক আদর্শ; মানুষের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে বাক স্বাধীনতা একই সূত্রে গাঁথা। এ আদর্শ বাস্তবায়নে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু নিজে কখনো কম্যুনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না, তার দলের নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীও কম্যুনিস্ট বিরোধী আর মওলানা ভাসানী ইসলামের একজন ধর্মপ্রাণ খাদেম। তারপরও মেহনতি  মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে মুসলিম লীগ সরকারের কাছ থেকে ‘কম্যুনিস্ট’ বলে তিরস্কৃত হয়েছেন। অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য। চীন ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে যে পথে এগিয়ে যাচ্ছে তা বঙ্গবন্ধুর গভীর পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, একদিন চীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশে রূপান্তরিত হবে। অন্যদিকে রাশিয়ার কম্যুনিস্ট নীতির নতুন পথ অবলম্বন করে ভুল পথে চালিত হয়ে আবার সংশোধন করে (পৃ: ১১৬)। দুই দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার ভিন্নতার ভবিষ্যত বুঝতে পেরেছিলেন মাত্র ৩২ বৎসরের তরুণ তৎকালীন শেখ মুজিব। তার ফলাফল কী হয়েছে বর্তমান প্রজন্ম দেখতে পাচ্ছে, অথচ বঙ্গবন্ধু আজ থেকে ৬৮ বৎসর পূর্বেই তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এখানে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় সামগ্রিক রাষ্ট্র-নির্মাণ চিন্তার প্রতিফলনের উৎসরণ পাওয়া যায়।

এ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত গুণাবলী প্রকাশ পায়, দেশের সম্মান রক্ষা, বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও নিজের ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা, বয়ঃজ্যোষ্ঠদের প্রতি সম্মানবোধ, কারো ব্যক্তিগত গুণ প্রকাশের সাহস এবং নির্ভয়ে সত্য কথা বলার সৎ সাহস, শিশুর প্রতি শুধু গভীর ভালোবাসাই নয়, শিশুসুলভ মন, সৌন্দর্য ও সৌজন্যবোধ, যা বঙ্গবন্ধুকে শুধু মহান নেতা নয়, একজন মহা মানবে পরিণত করেছিলো। নিজস্ব রাজনৈতিক আর্দশের বৃত্তে নারীর স্বাধীনতা, নারী-পুরুষের সমান অধিকার, উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষক, শ্রমিকের ন্যায্য পাওনার কথা বলেছেন। আবার ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেছেন। মাত্র ১২ দিনের সফরে একটি রাষ্ট্রের তথা সমাজের খুঁটিনাটি বিষয় তাঁর দৃষ্টির আড়াল হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা-ব্যবস্থা, একই সঙ্গে কারিগরি, কৃষি-শিক্ষার প্রতি আগ্রহের প্রকাশ দেখা যায় এ গ্রন্থে। এমনকি জনগণের নেতা নয়াচীনের প্রতিষ্ঠাতা মাওসেতুং-এর কঠোর নিরাপত্তায় বসবাসও তার দৃষ্টির আড়াল হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এ গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণার অপেক্ষা রাখে। যদিও এ গ্রন্থের আলোচনা স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তারপরেও কিছু বিষয় আলোচনার প্রেক্ষিতে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হলো।

সম্মেলনে যাত্রার প্রাক্কালে পাকিস্তান প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের পূর্বেই সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো রাজনৈতিক নির্যাতনের কথা বাইরে প্রকাশ করা হবে না। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের দেশের মুসলিম লীগের শাসনের কথা যদি বলি তবে দুনিয়া হাসবে। কারণ মুসলিম লীগের গণতন্ত্রের যে রূপ তা কোনো সভ্য সমাজে না বললেই ভালো হয়। তাতে পাকিস্তানের ইজ্জত যাবে’ (পৃ: ৩৪)। এখানেই বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও আত্মসম্মানবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধুর মনের গহিনে ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তার এ বোধের প্রেক্ষপটে রয়েছে রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎ বসুর চিন্তার প্রভাব। তিনি মনে করতেন বৃহৎ বাংলা হলে সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু দিল্লী গিয়ে বিফল মর্মবেদনায় বৃহৎ বাংলার খণ্ডিতাংশ পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে মেনে নিয়ে পাকিস্তানে ফিরে আসলেও অন্তরে ছিল বাঙালির মুক্তি (অন্নদাশঙ্কর রায়, কাঁদো, প্রিয় দেশ, উদ্ধৃত আবুল হাসান চৌধুরী, ২০২০ মার্চ, কালি ও কলম, পৃ: ১২৪)। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি চেতনার দৃঢ় প্রত্যয় স্পষ্ট হয় ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা’ স্বীকৃতির দাবীর ভাষা আন্দোলনের ভেতর। শুধু সচেতনতাই নয়, তার অন্তরে বিশ্বাস ছিল, যথার্থ বাঙালি হওয়ার চর্চা বা অনুশীলন। বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘ভাইস চ্যান্সেলর চীনা ভাষায় বলছেন দোভাষী ইংরেজিতে অনুবাদ করছিলেন। দোভাষী যখন দু-এক জায়গায় ভালোভাবে বুঝতে পারছে না, সেখানে ভাইস চ্যান্সেলর নিজেই অনুবাদ করে দিচ্ছেন। ভদ্রলোক ভালো ইংরেজি জেনেও ইংরেজি বলে না। জাতীয় ভাষায় কথা বলেন। আমরা বাঙালি হয়ে ইংরেজি আর উর্দু বলার জন্য পাগল হয়ে যাই। বলতে না পারলে এদিক সেদিক করে বলি’ (পৃ: ৬৮)। বঙ্গবন্ধু চীনা শান্তি সম্মেলনে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতাই প্রমাণ করে কী অসাধারণ বাঙালি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাংলা ছাড়াও উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ বক্তা ছিলেন তার প্রমাণতো ডেভিড ফ্রস্টের মতো বিখ্যাত সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায়। অনর্গল উর্দু ভাষায় বক্তৃতা দেয়ার দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায় তৎকালীন পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কথপোকথনে। কিন্তু অন্তরে ছিলো বাংলার প্রতি গভীর ভালোবাসা।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল সহজ ও ন্যায় পথে। কোনোপ্রকার ছলচাতুরী বা কূটকৌশলের রাজনীতিকে প্রশ্রয় বা আশ্রয় দেননি। তার সত্যবাদীতার এবং অন্যের গুণকে প্রশংসা করার দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় এ গ্রন্থে। বঙ্গবন্ধু মুসলিম এবং মুসলিম হওয়ার জন্য গর্ব অনুভব করতেন (পৃ: ১১২)। কিন্তু ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, ধর্ম ব্যবসা বা ধর্মীয় কুসংস্কারকে অপছন্দ করতেন। ধর্মকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে পৃথক করে ব্যক্তিগত জীবনযাপন বা আচরণের মধ্যে দেখতে চেয়েছেন। ধর্মকে ব্যবহার করে শোষণ, অত্যাচার এমনকি নারী নির্যাতন তার অপছন্দনীয় ছিল। নয়াচীন সফরে এসে দেখেন ৪ বৎসরের মধ্যেই চীন ধর্মীয় কুসংস্কার মুক্ত হয়ে গেছে। পাকিস্তান কবে এ ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত হবে? বঙ্গবন্ধু এ প্রসঙ্গে জিন্নাহ’র ভূমিকাকে প্রশংসার চোখে দেখে বলেন, ‘মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বেঁচে থাকলে অন্ততপক্ষে এ কাজটা করতে পারতেন’ (পৃ: ১১৪)। এ উক্তির ভেতর বঙ্গবন্ধুর ঔদার্য ও সৎ সাহসের পরিচয় পাওয়া যায়। যে জিন্নাহ বাংলা ভাষার ঘোর বিরোধী এবং বাঙালির শত্রু ছিলেন, তারপরও তিনি এখানে জিন্নাহর ভূমিকাকেই শুধু প্রশংসা করেননি, তার ওপর ভরসাও করেছিলেন। এমন বিরল চরিত্রের বৈশিষ্ট্য শুধু বঙ্গবন্ধুর মধ্যেই পাওয়া যায়।

বঙ্গবন্ধুর বন্ধু-সুলভ মনোভাব আর আসরের মধ্যমণি হয়ে থাকার গল্প ছোট-বেলা ও রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। ছোটদের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর বয়ঃজ্যোষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, দলনেতা মানকী শরীফের পীরসাহেব সবসময় চাইতেন বঙ্গবন্ধু যেন তার পাশে বসেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার নির্দিষ্ট আসনে বসতেন। বঙ্গবন্ধু পীরসাহেবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতেন তার বয়স, পদমর্যাদা সব মিলিয়ে তার পাশে বসা উচিত হবে না (পৃ: ৬৮)। শুধু পীরসাহেবই নয়, তার দলের নেতা সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, মানিক মিয়া, এ কে ফজলুল হক সবাইকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। যদিও অনেকের সঙ্গে ঠাট্টার সম্পর্ক ছিলো কিন্তু সীমা লংঘিত হয়নি কখনো।

বঙ্গবন্ধুর যেমন শ্রদ্ধাবোধ ছিল বয়ঃজ্যোষ্ঠদের প্রতি আবার সত্য কথা বলতেও দ্বিধা করতেন না। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজের কথা বলছেন, ‘আমি একটু মুখপোড়া মানুষ, মনে যা আসে এবং তা সত্য হলে মুখের ওপর বলেছি’ (পৃ: ১০৬)। এটাই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আসল চরিত্র। সকল প্রকার অনাচার, ঘুষ, দুর্নীতি, নারীর অবমাননা, ধর্মকে নিজেদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, সে সম্পর্কে বঙ্গন্ধুর অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। এ সমস্ত অনাচার থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। দরিদ্র কৃষক শ্রমিকের মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন, সে চেতনার বাস্তবায়ন চীন কীভাবে করেছে, তা সরেজমিনে বা মাঠ পর্যায়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এখানে ধারণা করা যেতে পারে যে, এ অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধুর জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে।

বঙ্গবন্ধুর ভেতর আরেকটি শিশুমন লুকায়িত থাকতো, সেই বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায় চীন ভ্রমণের কাহিনিতে। বঙ্গবন্ধু সবসময় শিশুদের সান্নিধ্যে হারিয়ে যেতেন শিশু স্বর্গে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা জানাতে শিশু-কিশোররা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাতো। একবার বিদ্যালয় থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে সবাই যখন বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছেন, তখন দেখা গেলো বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে আছে শিশু-কিশোররা। বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ‘ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কারণ আমি ওদের সাথে একটু ঠাট্টা করেছিলাম, মুখ ভেঙচিয়া দিয়েছিলাম। ওরা মনে করলো পেয়েছি মনের মতো লোক, তাই আমাকে জড়িয়ে ধরলো’ (পৃ: ৬৮)। বঙ্গবন্ধু ওদের সঙ্গে খেলা করে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহারেও ছিল শিশুর মতো আবেগ আর ভালোবাসায় ভরপুর। বঙ্গবন্ধুর শিশুপ্রেমের নিদর্শনকে সরকার তার জন্মদিনকে শিশু দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সৌন্দর্যবোধ ও সৌজন্যবোধ ছিল অপরিসীম। বিভিন্ন স্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার বলেছেন তিনি লেখক নন, তাই সেসব দৃশ্যের বর্ণনা দিতে পারছেন না। ‘কারণ আমি লেখক নই, আমি অনুভব করতে পারি মাত্র, লেখার মতো ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেন নাই’ (পৃ: ৬৬)। বঙ্গবন্ধু নিজের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করেছেন অবলীলায়। শ্রমিকদের অবস্থা দেখার জন্য হঠাৎ এক নবদম্পতির ঘরে উপস্থিত হন। যখন জানতে পারেন তাদের মাত্র বিয়ে হয়েছে, তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উপস্থিত অন্য সদস্যদের কাছে জিজ্ঞেস করেন দেওয়ার মতো কিছু উপহার আছে নাকি? কারো কাছে দেবার মতো কিছুই ছিলো না। বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘আমি ভাবছিলাম, হঠাৎ আমার হাতের দিকে খেয়াল পড়লো, দেখি আমার একটি আংটি আছে। আমি খুলে সেই শ্রমিকের স্ত্রীকে উপহার দিলাম’ (পৃ: ৭২)। বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতার ভেতর তার সৌজন্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। তার এ মহানুভবতার প্রকাশ স্কুল জীবনেই দেখা যায়। উল্লেখ্য, স্কুল জীবনের এক গরীব সহপাঠীকে নিজের গায়ের চাদর দিয়ে এ মহানুভবতার পরিচয় দেন। আপাতদৃষ্টিতে ছোট-খাটো উপহার প্রদানের দৃষ্টান্ত হলেও এরই ভেতর বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের মহিমাও প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধুর সহজ-সরল চরিত্রের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় ন্যাশনাল গার্ডের মহিলাদের প্যারেড দেখে যখন তিনি বলে উঠেন, ‘মহিলা ন্যাশনাল গার্ড এলো, যেভাবে প্যারেড করছে মনে হচ্ছে যেন পুরুষের বাবা আর কি!’ (পৃ: ৫৫)।  

চেয়ারম্যান মাওসেতুং-এর কঠোর নিরাপত্তার জীবনযাপন বঙ্গবন্ধু মেনে নিতে পারেননি । বঙ্গবন্ধুর প্রশ্ন, ‘আপনাদের নেতাকে সকলেই ভালোবাসেন তবে তিনি ওভাবে গার্ডের ভিতর বাস করেন কেন’ (পৃ: ১০২)। প্রশ্নোত্তরে জানানো হয় শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্রের কথা ও নেতাকে হত্যার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। সৎ লোকের শত্রুও বেশি। এ কথা বঙ্গবন্ধু মেনে নিলেও তার বিশ্বাস ছিল জনগণের প্রকৃত ভালোবাসাই বড় প্রাপ্তি। বঙ্গবন্ধু কোনো হত্যাকাণ্ডে বিশ্বাস করতেন না। হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কোনো কল্যাণ আসে না। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশের কোন নাগরিক তাকে হত্যা করতে পারে তা ছিলো তার কল্পনার অতীত। বন্ধু রাষ্ট্রসহ দেশের সকল সংস্থার সতর্কবাণীও বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসকে টলাতে পারেনি। তার এ বিশ্বাস নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থটি সবার আগে লিখিত হলেও সবশেষে প্রকাশনার ভেতর ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব, সর্বোপরি তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় একে একে উঠে এসেছে, যা বাংলাদেশসহ বিশ্বের নিকট এক মহামূল্যের সম্পদ। আজ থেকে ৬৮ বছর আগে লিখিত এ সম্পদকে অত্যন্ত সুচারুভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ গ্রন্থের মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে জানার অবারিত দ্বার উন্মোচন হলো। প্রসঙ্গক্রমে একটি বক্তব্য এ গ্রন্থ পাঠে প্রতীয়মান হয়, বঙ্গবন্ধু উৎপাদন ব্যবস্থাকে সামাজিক যৌথ অংশীদারিত্বের ভেতর দেখতে চেয়েছিলেন। তার চিন্তা-চেতনার সুফল চিনে প্রত্যক্ষ করেন। কিন্ত স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে উৎপাদন ব্যবস্থায় যৌথ অংশীদারিত্বের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানা বা জাতীয়করণের ব্যবস্থাপনা কী প্রেক্ষাপটে সূচিত হয়েছিলো তার অনুসন্ধানে ভবিষ্যতে আরো গবেষণার অবকাশ রাখে।  

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অবৈধ অটোরিকশা-ইজিবাইককে লাইসেন্সের আওতায় আনার দাবি
অবৈধ অটোরিকশা-ইজিবাইককে লাইসেন্সের আওতায় আনার দাবি
বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে ৫টি চুক্তি এবং ৫টি সমঝোতা স্মারক সই
বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে ৫টি চুক্তি এবং ৫টি সমঝোতা স্মারক সই
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পার্সেলে তরুণদের কাছে আসছে কোটি টাকার মাদক
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পার্সেলে তরুণদের কাছে আসছে কোটি টাকার মাদক
গাজার হাসপাতালে গণকবর, আতঙ্কিত জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান
গাজার হাসপাতালে গণকবর, আতঙ্কিত জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান
সর্বাধিক পঠিত
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা