X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২
ইজরায়েলের গল্প

করোনাভাইরাস

মূল : মিখাল রেইকেনবাক, অনুবাদ : ফজল হাসান
১০ এপ্রিল ২০২০, ০৭:০০আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২০, ০৭:০০

মিখাল রেইকেনবাক ইজরায়েলের লেখক, গাড়ি দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে বর্তমানে জেরুজালেমে বসবাস করছেন। তিনি ইতোমধ্যে চল্লিশটি ছোটগল্প রচনা করেছেন, যেগুলো বিভিন্ন অনলাইন ম্যাগাজিন এবং সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। করোনাভাইরাস

কম্বোডিয়ায় ছুটি কাটিয়ে আমরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলাম। মেঘের ভেতর দিয়ে প্লেন উড়ে যাচ্ছিল। হংকং বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য প্লেন যখন নিচের দিকে নামছিল, তখন আমি ছিপি লাগিয়ে কানের ফুটো বন্ধ করি। প্লেনের চাকা রানওয়েতে স্পর্শ করার সময় প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভব করি। একসময় প্লেন স্থির হয়ে থেমে যায়। আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি। এক ঝটকা শীতল বাতাস এসে আমার চোখেমুখে ঝাপটা দেয়। আমি বাতাসে ডিজেলের উৎকট গন্ধ পাই। আমরা টার্মিনাল ভবনে প্রবেশ করি—ভবনটি কাঁচ ও কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মেঝেতে হালকা রুপালি রঙের টাইলস। একপাশের দেওয়ালে ঝুলানো প্লাজমা-স্ক্রিনে বিমানের আগমন ও বহির্গমনের সময়-সূচি। আমাদের চারপাশে অগণিত মানুষেরা বিরক্তকর মাস্ক পরে আছে। একজন বিমানবালা এসে আমাদেরও মাস্ক পরিয়ে দেয় এবং টার্মিনাল ভবনের এক দিকে ফাঁকা জায়গায় ভেড়ার পালের মতো নিয়ে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আমাদেরও জড়ো করে। উৎকণ্ঠায় আমার পাকস্থলী মোচড় দিয়ে ওঠে। মাস্ক পরা সহযাত্রীদের সঙ্গে সেই জনাকীর্ণ স্থানে বাধ্য হয়ে সারাদিন অপেক্ষা করার চিন্তাটা আসলে সুখকর নয়।

ইজরায়েলে ফিরে আসার পরে আমি একধরনের খারাপ ফ্লুতে ভীষণভাবে কাবু হই। আমার শরীরে ব্যথা এবং সঙ্গে জ্বর ওঠে। আমি কাশি, হাঁচি দেই এবং গলার ভেতর কফ জমে আছে। আমাকে কি তাহলে নতুন জীবানু, করোনাভাইরাস নাকি অন্য কোনো সাধারণ জীবানু আক্রমণ করেছে? চটজলদি আমি একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রে যাই এবং সেখানে গিয়ে রিসেপশনে বসা মহিলাকে বিশদভাবে বলি যে, করোনাভাইরাসের জন্য আমাকে পরীক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। ভীষণ ভয় পেয়ে মহিলা তৎক্ষণাৎ দৌঁড়ে ভেতরে পালিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে মাস্ক পরা একজন পুরুষ নার্স আবির্ভূত হয় এবং সে আমার থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আপনাকে হাসপাতালে যেতে হবে এবং অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে।’ বলেই সে টেলিফোন করে। আমি ঔষধের দোকান থেকে এক বাক্স মাস্ক কিনি এবং গাড়ি চালিয়ে স্থানীয় হাসপাতালে যাই। হাসপাতালের প্রবেশ পথে মুষ্টিযোদ্ধাদের মতো গাট্টা মার্কা দু’জন রক্ষী দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বাহুতে ট্যাটু রয়েছে।

‘আপনি মাস্ক পরেছেন কেন?’ রক্ষীদের মধ্যে একজন প্রশ্ন করে। আমি যখন তাকে ব্যাখ্যা করে বললাম, তখন সে বললো, ‘হাসাপাতালের ভেতরে যাবেন না। এখানে অপেক্ষা করেন।’

ভয়ার্ত খোরগোশের মতো রক্ষী দু’জন হাওয়া হয়ে যায়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সহকারীকে নিয়ে একজন মহিলা ডাক্তার আসে। উভয়ই মাস্ক পরেছে। চিকিৎসা কাজের জন্য ডাক্তারকে খুবই কমবয়সী মনে হলো। তার অগোছালো মাথার চুল অনেকটা ঘোড়ার লেজের মতো পেছনের দিকে ঝুলে আছে। আমি যখন আসার কারণ বর্ণনা করি, তখন তিনি পেশাগত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান।

‘আপনি হাসপাতালকে যাতে দূষিত না করেন, সেই জন্য অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে বাইরে পার্কিংয়ের জায়গায় চলুন,’ মহিলা বললেন।

পার্কিংয়ের জায়গায় গিয়ে মহিলা আমাকে আদেশ করে, ‘স্যুয়েটার উপরে তুলুন।’

আতঙ্কিত নার্স আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। তার ভ্রু পরিপাটি। ডাক্তার আমার বুক পরীক্ষা করে। তারপর নার্স এসে আমার দেহ থেকে রক্ত এবং মুখের লালা সংগ্রহ করে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে একধরনের অসাড়তা অনুভব করি। ঠান্ডা বৃষ্টি আমার চোখে-মুখে এবং উদাম শরীরের উপরের অংশে ছিটিয়ে পড়তে শুরু করে। তারপর পানির ফোঁটা শরীর বেয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। আমার দেহে শৈত্য প্রবাহ বয়ে যায় এবং আমি কাঁপতে শুরু করি। শীঘ্রই আমার কঠিন পরীক্ষা শেষ হয়। ডাক্তার আমাকে বললো, ‘অবশ্যই আপনি বাড়ি যাবেন এবং পরবর্তী দু’সপ্তাহ সেখানেই থাকবেন।’

কয়েকদিন পর আমার স্ত্রীরও ফ্লুর মতো লক্ষণ দেখা যায়। যেহেতু আমি চাইনি সে একাকি হাসপাতালে যাক, তাই আমিও তার সঙ্গে যাই। সেখানে আবারও আমাদের একই আচরণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে আমরা যেন প্লেগে আক্রান্ত রোগী।

বাড়ি ফিরে এসে আমি টেলিভিশনের সামনে বিছানায় শুয়ে দিন গুজরান করি। ভেজা সিমেন্টের মতো সময় খুব ধীর গতিতে যেতে থাকে। দু’সপ্তাহ স্বেচ্ছা নির্বাসনের পরে আমরা দু’জনই অনেকটা সুস্থ বোধ করি এবং যে যার কাজে ফিরে যাই। আমাদের দেখে সহকর্মীরা অস্বস্থি বোধ করে এবং তারা আমাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলে।

কয়েক মাস পরে আমি ঘটনার মজার দিকটা দেখেছি। আমরা যেখানেই যেতাম, আমাদের দেখে মানুষজন দৌঁড়ে পালিয়ে যেত। তখন সেটা আমাদের কাছে ভয়ঙ্কর মনে হয়েছে। যেহেতু এখন করোনাভাইরাস মহামারী হয়ে দেখা দিয়েছে, তাই ইজরায়েলের জাতীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও বেশি কার্যকর হয়েছে। তারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সম্ভাব্য করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মুখের লালা এবং রক্ত পরীক্ষা করার জন্য প্রতিরক্ষামূলক পোশাকপরা স্বাস্থ্য সেবক/সেবিকাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। এই সময়ে বিশ্ব অপেক্ষায় আছে কখন টিকা আবিস্কৃত হবে।

গল্পসূত্র : ‘করোনাভাইরাস’ গল্পটি মিখাল রেইকেনবাকের ইংরেজিতে একই শিরোনামের গল্পের অনুবাদ। গল্পটি স্পিলওয়ার্ল্ডস্ প্রেস কর্তৃক ‘হ্যোয়্যার ওয়ার্ডস্ ম্যাট্যার’-এ প্রকাশিত হয়েছে ১৭ মার্চ ২০২০ সালে।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অসহায় মা-মেয়ের সরকারি চাল খেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা
অসহায় মা-মেয়ের সরকারি চাল খেয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা
নীরবে কাঁদেন আবু সাঈদের বাবা-মা, দেখতে চান ছেলে হত্যার বিচার
নীরবে কাঁদেন আবু সাঈদের বাবা-মা, দেখতে চান ছেলে হত্যার বিচার
ফিরে দেখা: ২ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ২ জুলাই ২০২৪
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
সর্বাধিক পঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
যশোরে নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দা ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনের মৃত্যু
যশোরে নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দা ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনের মৃত্যু
এনবিআরের আরও ৫ শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
এনবিআরের আরও ৫ শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক