কান্না
শরীর ছড়াতে ছড়াতে গাছেরাও মা হয়ে যায়
মায়েরা ক্রমাগত ঝুরি নামাতে নামাতে একদিন প্রকৃতি হয়ে গেলে
ধূপ জ্বালিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে নিই সেই মাহেন্দ্রক্ষণে।
আজীবন ব্যথাতুর শেকড়ের কাছে মাটির প্রদীপ, নিজস্ব পুতুল রেখেছি
নামে নামে রেখে দিয়েছি কৃষিক্ষেত্র, ফন্দিফিকির করে
গণ্ডি এঁকেছি ঘরে ও বাইরে,
কুটিরজাত রূপালি শিশির দুহাতে মেখে তোমাকে স্পর্শ করিনি আগে
আদি-অন্ত দাঁড়িয়ে যাওয়া ওই প্রকৃত মূল নিখোঁজ হলে
পোড়া মাটির বাদামি খোলস ছেড়ে এসে দাঁড়ায় বিষাদগ্রস্ত শোক,
একজোড়া চোখ, গোল চাঁদের মতো কপালের টিপ
পিঠ জুড়ে কালো মেঘের মতো চুল।
কোথাও বেজে ওঠে শঙ্খধ্বনি
যেন এই সন্ধ্যায় দুহাতে শাঁখ তুলে নিয়েছে, মা আমার
এই বৃষ্টি মায়াময়, উন্মাদ মাদলের দ্রিমি দ্রিমি
মরালের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে,
মরমর করে ভাঙছে মাটির দেয়াল, ফেলে রাখা খোলস
বৃষ্টির ভেতর গুঁড়ো গুঁড়ো স্নেহ এসে জলে ভেজা
শীতল দেহ ঢেকে দিচ্ছে।
চারদিকে ক্রমশ আরো আরো ঘন হয়ে আসছে
এই মহাবৃক্ষের ঝুরি।
মাতৃস্নেহের মায়াপথে দাঁড়িয়ে
এক আবহমান প্রদীপ ছড়িয়ে দেয় আলো ও তাপ।
ছায়াছবি
পাতা ঝরার শব্দের ভেতর একটা ভিন্ন গন্ধও থাকে,
পান্তা ভাতে কাঁচা লঙ্কা ডলে নিলে যেমন হয়।
শব্দ বা গন্ধ দেখা যায় না, কিন্তু পাতাদের ঝরে পড়া দেখি
চোখ ও চোখের গভীরে ঝরতে থাকে
সেইসব নানা রঙের পাতা।
লক্ষ করে দেখেছি এরা কেউ সবুজ নয়,
যেমন আঁকা কুঞ্জবিহারীর ছবি।
বাবুই পাখির বাসার চারদিকে ঝুলন্ত ও সবুজ পাতা,
এ তো ঘরেরই মায়া।
অথচ, স্মৃতিতে যে পাতাগুলো ঝরছে
তাদের কোনো রঙ নাই। শুধু শব্দ এবং গন্ধ
মৃত পাতাদের ক্ষত নিয়ে আভূমি বিস্তৃত বৃক্ষনাথ,
অন্ধকার ঘন হয়ে এলে স্ফুলিঙ্গে অরণ্যও দাউ দাউ জ্বলে ওঠে
দহন শেষে ভেজা পাতা আর ভস্ম পড়ে থাকে।
সর্বাঙ্গে পোড়া ক্ষত, তীব্র আঁশগন্ধ,
পাতাদের কালো দীর্ঘশ্বাসে পুড়তে থাকে
রণরক্ত প্রতিহিংসা
পাথরের নক্ষত্রসভায় সবুজ আলো ঘন হয়ে বসে
আভূমি বিস্তৃত ছায়া ও মৃত পাতার অখণ্ড ছায়া ও ছবি
ঘুম
গেট বন্ধ, হলদে ফুলের গাছটার আড়ালে নামহীন পাথুরে ফলক
কোনো শব্দ হবে না এখানে, যারা আছেন ভেতরে থাকুন
পাখির মায়েরা এখন ঘুমোচ্ছে,
যাদের হাত পা এখনো পুষ্ট হয়নি তারাও ঘুমোচ্ছে।
এই গেট খুলবে না আজ, তুমি একা পায়ে হেঁটে এসো।
ডান দিকের ওই দরজাটায় টোকা দিলে, নীল আলো জ্বলবে
তীব্র কোনো শব্দ হবে না, গড়িয়ে পরবেন না কোথাও
এক বিন্দু মায়া। দুএকটা কান্না মাখানো বাতাবিলেবু
রেখে যেতে পারো, চারদিকে কেমন ঘুমঘুম ধোঁয়া।
এসময় কেবল তুমিই পারো, হে নীল গাউন
নিজস্ব ডানা মেলে উড়ে যাও শয্যার পাশে,
ঘুম আজ আমাদের প্রত্যেকের চোখে।
দরজার ওপাশে অরণ্য, অন্যদিকে ডানা খুলে দিলে
শীতল ও মৃত এক অধর্ম বেড়াল
জলকোলাহল
তুমি, থমকে যাওয়া জল। তোমাকে ঘিরে আছে
স্থবির ও নির্মম পাথর। ছিটকে গেছে শরীরের গন্ধক
বুকের বরফে জমে যাওয়া মাছেদের চোখ
একদিন সেখানেও জল ছিলো, লবণাক্ত অশ্রু।
জল থমকে গেলেই কান্নার বোবা শব্দ—
স্রোতজাত হাওয়ায় মৃদু সেই রক্তের দাগ
নিহত মুঠোর মাটির মতো, গুল্ম ও বৃক্ষের মতো
নীরব বুকের ভেতরেও কেঁপে কেঁপে ওঠে।
স্তব্ধ পাথরের হিম থেকে খসে পড়া চোখ
স্মৃতিহীন ঘাতকের উল্লাস জড়িয়ে নিয়েছে।
পাথরের মধ্যে সেই গণহত্যা ও মৃতদের ইচ্ছের দাগ,
হিম দেহে জেগে থাকে রক্তগন্ধের জলকোলাহল।
উষ্ণ রোদ্দুরের ছবি
যে পথ ধরেছ, তার ধুলোমাখা ঘাম ও গুপ্ত ফুল
মিশে আছে তোমাদের খুশিতে, বিষাদে।
রাত ভেঙে, চাঁদ ভেঙে আলো এলো শহরের শেষে।
তবুও, যাওয়ার ইচ্ছেটা মৃণালতন্তুর মতো গায়ে জল নিয়ে
ঐ ঐ ঐ—আসছে ...
মিছিলের অন্তহীন হেঁটে যাওয়া স্লোগান লাল জোয়ারের মতো
স্তব্ধতার ঝুঁটি নেড়ে, দমকা ঝড়ের মতো,
এই নাও স্বপ্ন পাখি, আমাদেরই উৎপন্ন জলে ও স্থলে
লক্ষ্য করে দেখ, পরস্পরের প্রবল আকর্ষণ
তারা হেঁটে আসছে, খুলে ফেলে ভ্রান্তির বাঘছাল
খুলে ফেলে আত্মবন্দি কৃতদাস জীবন
এই পথের অন্ত নেই,
তাদের শেষ নেই, আমাদের শেষ নেই
আছে শুধু মৃত্যুর রক্তিম কাঁটা,
ধুলোতে ধুলোতে দুঃখের তিমিরে
ইতিহাস পড়ে থাকে, পরে থাকে অনন্ত শিরস্ত্রাণ
বিরতিহীন মিছিলের আনন্দসংগীত, জোয়ারের মতো, শিশিরের মতো
জ্বলে জ্বলে উঠে অনন্ত নক্ষত্রের শুভ হাসি,
তুলে রাখো রৌদ্রসম আঙ্গুলের দাগ
আলো কুড়োনোর বেলা শেষে এঁকে দিও
জোৎস্নাঙ্কিত জল-গণতান্ত্রিক উষ্ণ রোদ্দুরের ছবি
মুঠো
কুয়াশায়, প্রভাতী ধোঁয়ায় ভরে আছে মুঠো,
তিতির তুমি,
আমাদের এই নষ্ট পরিক্রমা রেখে যাব
ওই মুঠোর বাইরের জলকণাগুলোর ভেতর।
অতীন্দ্রিয় তুমি,
কুয়াসার জল ছুয়ে দেখো ভেতরে পরিক্রমার রোদ
তুমি তিতির,
তৃষ্ণার ডাকে জলের কাছে যাও
ডানার ওমে বাতাস থাকে, লেগে থাকে মেঘতামস রোদ।
ভ্রমরসন্ন্যাস তুমি,
চুম্বনের গায়ে দেখ ঝংধরা ধাতু, দেখ আদি ধাতুর লাল
খঞ্জর রেখে কুয়াশার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ
আমি এখন ধাতব খঞ্জর নিয়ে ঘুরে বেড়াতে চাই,
মুক্ত খঞ্জরের ভেতর বেজে উঠবে প্রভাতী রাগ
মুঠোর বাইরে তখন একে একে খুলছে খঞ্জরের খাপ
নিষেধ অবজ্ঞার ধাতু, দেহ ভরে গেছে মুঠোর জল
ভেজা মাটির দেশ
যে লালাভ নক্ষত্রের মাটি এই দেহ
সেই প্রণম্য গর্ভাশয় ফুঁড়ে আমি, চামড়া মাংসের এক বেহিসাবী চাঁদ
কামোজ্জ্বল জ্যোৎস্না আমাকে যতটা জানে,
সবুজাভ জলে ভেজা মেয়েরাও ততটাই জানে
হেমন্তের কুচি কুচি শিশিরেরা গাছের শেকড়ের পাশে ওত পেতে আছে।
ভিজে যাওয়া আড়ালে স্বচ্ছজল, জলে মাখামাখি আমার পদ্মনাভি স্বেদ
কুয়াশায় দুহাত ছড়িয়ে ভিজছো তুমি
ছুঁয়ে দিচ্ছি অঙ্কুর ও পল্লবিত মুকুল
আদিম কুয়োর পলি ও রাজকীয় নখের চিহ্ন
কেঁপে কেঁপে উঠছে, ঘামছে
গর্ভাশয়ের আহুতিতেই জন্মান্ধ চাঁদ লিখে রাখে ফসলের গান,
এ দেশে পাতায় পাতায় আঁকা থাকে হত্যারঞ্জক মুখ।
এই যে স্বেদ, রক্ত, তোমার শরীরে ডুবে যাওয়া এই যে চাঁদের মাটি
কান্নার কথাগুল্ম থেকেই জন্ম নিলো ভেজা মাটির দেশ, তুমি জানো না।
ফণা
আমার শরীরে একটা ছোবলের দাগ রয়ে গেছে,
দুই বিন্দুর মতো সেই কালো ও গভীর দাগ
যদিও আমি কখনো ফণা তোলা সাপের কাছে যাইনি, আশৈশব
সাপের চেড়া জিহ্বা লকলক করতে দেখেছি আমার দেহের চারদিকে
সাপুড়ের বীণের মোহনি সুরে আমার চৌদ্দপুরুষ ন্যুব্জ ও অজ্ঞান
সেই বীণের সুরেই গর্ভবতী হয়েছেন আমাদের মা ঠাকুরমা,
কিন্তু চৌদ্দপুরুষ হু-হুতাশ করে যে
একটা ফণাতোলা সাপ এই প্রজন্মে আমাদের ঘরে জন্মালো না,
শুধুই হেলে ও ঢ্যাঁড়া।
গরম ভাতের গন্ধ ডাক দিলে
সাপের চামড়ার মতো দাগটানা দেহ নিয়ে একটা মেয়ে
ঘুর ঘুর করতো আমাদের উনুনের চারদিকে।
কলার ভেলায় তাকে ভাসিয়ে দেবে বলে একদিন
সমস্ত কলাগাছ কেটে ফেলা হলো।
ভেলা ভেসে গেলো তিস্তার জলে
ওই জ্যোৎস্নায় একটা ডুমুর পাতায় ঢাকা সাপের ছানা
আকাশের দিকে মুখ করে তার শিশু ফণা মেলে ধরল।
সেই থেকে ফণাহীন থাকার ব্যাথা আরো প্রবল হয়ে
কুয়াশার মতো, দৃশ্যমানতা কমিয়ে আনল।
সেই সময়ই আমার দেহের এই ছোবলের দাগগুলো ফুটে উঠল।
হিমায়িত মানুষেরা এভাবেই নিজেদের দেহের দাগগুলো জলে ধুয়ে ফেলছিল
আমার গায়ের দাগ তেমনি বর্ষায় পোয়াতি নদী জলে
ধুয়ে ফেলার জন্য গা ধুইছি আর জল শুকিয়ে ক্রমশ শীত,
ঠান্ডায় জমে যেতে যেতে আমি দেখি কোথাও সাপেরা ফেনা মেলছে আর
আমাদের গ্রাম-গঞ্জ ডুমুর পাতায় ঢেকে যাচ্ছে । হু হু করে কেঁদে উঠছ তুমি
আমরা দেহে চিহ্ন থেকে আজ অক্ষর বানিয়ে গান লিখি, মধু খাই
ডিঙি
দুহাতে লবণ দ্রবণ, ভাটির দিকে ভেসে ভেসে যায়
অন্ধের মাংসডিঙি, একমাত্র বৈঠা হাতে
জল কেটে কেটে আরো গভীরে, ভেসে ভেসে যায়।
লোনা বাতাস, লোনা ঘাম
বায়ুস্রোত তীব্রতর হলে ডিঙি ক্লান্ত হয়
রৌদ্র ক্ষরানোর পর নিদ্রা আসে, মাংস ডিঙার
চারদিকে ফেনিল সাগর, উজানের শ্রম তখন নিছকই গল্পকথা।
ডানায় আলো নিয়ে দিগন্তে চলে যায় সমুদ্রপাখি
অন্ধ নাবিক ও তার ক্লান্তির বৈঠা,
মাংস ডিঙি নিয়ে ভেসে যায় সন্ধ্যার স্বর্ণ উল্লাসে
দুহাতে লবণ দ্রবণ, প্রবাল দ্বীপে নোঙ্গর ফেলে নাও।
সমাধি
প্রাচীন সমাধি ফলকের মাটি মৃত স্মৃতি আঁকড়ে থাকে,
পাথরের গায়ে খোদিত সেই লিপিচিহ্ন থেকে ধুলো ঝরে পড়ে।
মৃত মানুষদের হাড় মাংস জঠরে নিয়ে মাটি জেগে থাকে
অনন্তকাল সেই মাটির উপরে জমতে থাকে শীতল ও সংবেদনশূন্য ফলক,
আমি ঝরাপাতা সরিয়ে সরিয়ে ফলকের গায়ে দেখি মানুষের মুখ ও তিলক।
কলহহীন নারী ও পুরুষের সাংসারিক সুখ ও দুঃখ
মাটি ধরে রাখে। সামধির পেছনে প্রতিদিন ঘনিয়ে আসে
অদ্ভুত এক বিকালবেলা। গভীর ও নির্লিপ্ত
পুরুষের নগ্নতা থেকেই অন্ধকার। নারীর নগ্নতা থেকেই প্রভাত।
সমাধি ফলকের কোনো দিন বা রাত থাকে না, শুধু মাটির স্নেহ থাকে।