X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সত্য প্রকাশের দায়

আনিসুর রহমান
১৫ নভেম্বর ২০২২, ১৬:৪৪আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২২, ১৬:৪৪

আজ পনেরোই নভেম্বর আন্তর্জাতিক কারাবন্দী লেখক দিবস। ১৯৮১ সালে লেখকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন কারাবন্দী লেখকদের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করতে এবং দুনিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্রের সরকারগুলোকে মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার হিসেবে মতপ্রকাশের পক্ষে দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য এই দিবসের প্রবর্তন করে। 

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই দিবসের তাৎপর্যকে থোড়াই কেয়ার করে দেশে দেশে নির্যাতিত বিপদগ্রস্ত কারাবন্দী লেখকের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

২০১৯ সালে দুনিয়া জুড়ে কারাবন্দী লেখকের সংখ্যা ছিল ২৩৮ জন, ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৭৩ জন, আর ২০২১ সালে ২৭৭ জন। 

এরকম প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে সুইডেনের প্রাচীন নগরী উপসালায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো পেন-এর ৮৮তম সম্মেলন। এই সম্মেলনে প্রায় একশো দেশের তিনশোর কাছাকাছি কবি, লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক, প্রকাশক, সাংবাদিক এবং সংগঠক অংশ নিয়েছিলেন।

এই সম্মেলনের তাৎপর্যের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক সংস্থা 'দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সংবরণ, নীরবতা এবং লেখকদের কারাবরণ' বিষয়ে একটি একক বক্তৃতার আয়োজন করে।

২৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে প্রদত্ত আমার বক্তৃতা থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ এই লেখায় তুলে ধরছি: তার আগে বাংলাদেশ থেকে আরো যারা পেন-এর সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন তাদের কথা উল্লেখ করতে চাই। তারা হলেন কবি শামীম রেজা, কথাসাহিত্যিক সালমা বাণী, গল্পকার মুহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং কবি মসউদ মান্নান।

বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল মূল সম্মেলনে নানা কর্মসূচিতে অংশ নেবার পাশাপাশি সম্মেলনকে ঘিরে এর সমান্তরালে আয়োজিত আরো কয়েকটি সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল জর্জিয়ান কবি জুরাব আর্টভেলিয়াসভিলির স্মরণে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ধ্বনিকাব্য উৎসব।

প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সত্যপ্রকাশ আদতে কী? সত্যপ্রকাশে এতো বাধাই বা কেন? মানুষ সত্যপ্রকাশ থেকে বিরত থাকে কেন? সত্যপ্রকাশের কারণে মানুষ কারাবরণই বা করবে কেন?

এই পর্যায়ে বলে নিতে চাই আদতে লেখালেখি কী বা লেখক হবার শর্ত কী? লেখালেখির মানেই হচ্ছে সত্যপ্রকাশ, আপনার মনের প্রকাশ, আপনার নিজের গল্প বলা। লেখালেখি মানে দেখা, দেখানো নয়, শেখানোও নয়। লেখালেখি মানে সময়ের কাছে প্রেমপত্র। আপনার মনের কথা আপনাকেই বলতে হবে।  আপনার দেখা সত্য আপনাকেই প্রকাশ করতে হবে। অন্য কেউ এসে আপনার দেখা সত্য প্রকাশ করে দেবে না। আপনার গল্প আপনাকে বলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ তার সময়ের গল্প, তার নিজের গল্প বলে গেছেন, বলে গেছেন অন্যান্য লেখকেরা। আপনার গল্প আপনাকেই বলে যেতে হবে। আপনার গল্প আপনি অবলা রেখে মরে গেলে সেই গল্প অবলাই থেকে যাবে। লেখক হিসেবে আপনার প্রথম লেখা থেকে জীবনের শেষ লেখা পর্যন্ত মূলত একটাই লেখা। আপনার সামগ্রিক লেখালেখি মূলত আপনার জীবনের একটা একক ভ্রমণকাহিনী।

এখন কথা হলো লেখক হবার শর্ত কী? লেখক হবার শর্ত একটাই কখনো পঠন ছাড়া যাবে না, লেখালেখিও বন্ধ  করা যাবে না।  বিরামহীন পড়ে যাওয়া, বিরামহীন লিখে যাওয়াই লেখক হবার উপায়।  লেখক হবার যাত্রা এক নিরন্তর পথচলা।  

এখন প্রশ্ন হলো আমি যা দেখি আমি কি তা প্রকাশ করতে পারি? আমার কি সেই স্বাধীনতা আছে? আমি যা দেখতে চাই তা কি লেখায় তুলে ধরতে পারি? এই প্রশ্নগুলো দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বেলায় দারুণভাবে প্রযোজ্য। এই দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্যাধিতুল্য ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার কবল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। এই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো কারা যারা এই অঞ্চলে আমার আপনার দেশ দখলে নিয়ে তাদের মর্জির শাসন আর শোষণ আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলো। তারা তো কেউ অন্য গ্রহ থেকে আসেনি। তারা আজকে গণতান্ত্রিক বিশ্বের দাবিদার ব্রিটিশ, ফরাসি, স্প্যানিশ, জাপানিজ, মার্কিন, পর্তুগিজ, দিনেমার এবং ডাচসহ বিবিধ সাম্রাজ্যবাদী পক্ষ।

উপনিবেশ শেষ হয়ে গেছে বলে ঔপনিবেশিক আমল নিয়ে ভাবনা বা প্রশ্ন তোলার সময় কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। এই পর্যায়ে দিনেমার দার্শনিক সৌরেন কিয়ের্কেগার্ডের একটি পর্যবেক্ষণ উল্লেখ করতে চাই।  তিনি বলেছেন, আমাদের যা আছে তার ঠিক ব্যবহার করছি না। আমাদের যা নাই তার জন্য লড়াই করছি। আমাদের আছে অবারিত চিন্তার স্বাধীনতা। কিন্তু আমরা আমাদের ভাবনাশক্তি বা চিন্তাশক্তির যথার্থ ব্যবহার করছি না। অন্যদিকে আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই, আমরা এটির জন্য লড়াই করে যাচ্ছি।

এখন প্রশ্ন হলো আমি কে? আমার চারপাশ, আমার অতীত, আমার ইতিহাস, আমার গায়ের রঙ, আমার ভাষা, আমার সময়, আমার সংস্কৃতি আমার দেশ এসব নিয়েই আমি, আমার আপনার 'আমিত্বের' অস্তিত্ব।  এসব যারা ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলো, ভুলিয়ে দিয়ে বছরের পর বছর আপনাকে আমাকে আমাদের পূর্বপ্রজন্মের মানুষদের উপর শাসনব্যবস্থা বা কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ডাকাতিতন্ত্র কায়েম করেছিল, আজ তারা কি ভিন্ন গ্রহে চলে গেছে? তারা আপনার আমার দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তাই বলে কি ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার বিলুপ্তি হয়ে গেছে?

ঔপনিবেশিক বন্দোবস্ত বহাল তবিয়তেই আছে কেবল পাল্টেছে মোড়ক আর মোড়কের উপর লেবেল। এই মাজেজায় কাজ করে কর্পোরেট বেনিয়া আর অস্ত্র ও যুদ্ধ-রাজনীতির মালমসলা। বেশি দূরে যেতে হবে না। কোনো রাখঢাক না রেখেই বলে দিতে চাই বার্মার ব্যাপারে বা রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিষয়ে রাশিয়া, চীন এমন কি ভারত বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে বার্মার সামরিক জান্তার পক্ষেই অবস্থান কেন নেয়? ছোট ও দুর্বল রাষ্ট্রের উপর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর লোভ ও স্বার্থের প্রকল্প ও অস্ত্র কেনাবেচার যাচিত অযাচিত আবদার চাপিয়ে দেবার মাঝে ঔপনিবেশিক স্বার্থ আর তা পূরণের খায়েশ ছাড়া আর কী থাকতে পারে? একইভাবে দেশীয় বেনিয়া গোষ্ঠী শ্রম শোষণ ভেজাল বাণিজ্য আর দুই নম্বরি করে টাকার পাহাড় করে যখন বিদেশে সম্পদ আর অর্থ পাচার করে তা কি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী মাজেজা থেকে আলাদা করার উপায় বিশেষ কিছু থাকে? এসব কার্যকরণ যোগসূত্রের সঙ্গে যোগ হয় ধর্মীয় উম্মাদনা। ভারতে যেমন হয়েছে হিন্দুত্ববাদীদের উত্তেজনা, বার্মায় রয়েছে বৌদ্ধত্ববাদীদের তোড়জোড় আর বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে রয়েছে ইসলাম নিয়ে নানা রকম রাজনীতি ও ব্যবসা।

কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নয় দুনিয়ার কোনো দেশেই একজন লেখকের মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা নাই। তবে মতপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে একজন লেখকের দায়িত্বের কথাও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। এসব অঞ্চলের কাউকে কাউকে সাম্রাজ্যবাদী গণমাধ্যমের বা বড় বড় দেশের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হতেও দেখা যায়।

এবার লেখকদের সংগঠন পেন প্রসঙ্গ নিয়ে আরও একটি বিষয় অবতারণা করতে চাই।  পেন-এর যাত্রা হয়েছিল বিলেতে ১৯২১ সালে। এর ঠিক পরের বছর এই ভূবঙ্গে বা ভূভারতবর্ষে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর রচিত ব্রিটিশবিরোধী 'বিদ্রোহী' কবিতার জন্য কারান্তরীণ করা হয়েছিল। এই ঘটনা নিয়ে পেন-এর ভূমিকা কী ছিল? আমার কেবল কৌতূহল। কৌতহল আরও আছে জুলিয়ান আসাঞ্জকে নিয়ে বিলেত ওয়াশিংটনসহ খোদ ইউরোপের ভূমিকা কি বাহবা পাবার মতো?  

সত্য প্রকাশ মানে আগুনে হাত দেয়া। একজন লেখকের হাত দৃশ্যে অদৃশ্যে আগুনে পুড়বেই। আমরা দেখি বা না দেখি। লেখালেখিতে অন্তর্দহন না থাকলে কিসের লেখালেখি? আর এরকম বাস্তবতায় লেখককে তার সত্য প্রকাশের মূল্য যেমন উপলদ্ধি করতে হয় তেমনি সত্যপ্রকাশের মূল্যও দিতে হয়। 

তবে লেখক নামধারী সুবিধাবাদী কিছু চতুরপ্রজ মানুষ ঠিক এর উল্টোটা করে ইনিয়ে বিনিয়ে নানারকম শখ ও সুবিধার ধান্দায় থাকেন। এদের কাছে সত্যপ্রকাশ সুদূর পরাহত। আদতে এদেরকে ধর্তব্যের বাইরে রেখে লেখালেখিতে সত্যপ্রকাশের তাৎপর্য বিবেচনায় নিতে হবে। এই সত্য দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যেমন, তেমনি বাংলাদেশ এবং দুনিয়ার অন্যপ্রান্তের জন্যও প্রযোজ্য।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
আজও উদঘাটন হয়নি ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা বাবু হত্যার রহস্য
হৃদয় বিদারক সেই ঘটনার ১১ বছরআজও উদঘাটন হয়নি ৩০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা বাবু হত্যার রহস্য
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক