X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
গোসলের পুকুরসমূহ

স্বপ্নের বিভিন্ন উল্লেখ ও বর্ণনায় ভিন্নমাত্রার উপন্যাস

উম্মে ফারহানা
১৬ আগস্ট ২০২০, ১৩:১৮আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২০, ১৩:২১

স্বপ্নের বিভিন্ন উল্লেখ ও বর্ণনায় ভিন্নমাত্রার উপন্যাস উপন্যাস মানেই তা কলেবরে বড় হবে এমন কোনো কথা নেই। আখ্যানের উপন্যাসত্ব নির্ভর করে তার দৈর্ঘ্যের ওপর নয়, বরং ব্যাপ্তি আর গভীরতার ওপর। সে হিসেবে মেহেদী উল্লাহ’র প্রথম উপন্যাস গোসলের পুকুরসমূহ উপন্যাসের দলভূক্ত হয়ে গেছে সহজেই, তবে হতে পারতো আরও একটু বড়। ইচ্ছাকৃতভাবেই একে নির্মেদ রাখাটা হয়তো লেখকের সাবধানতা, পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি না ঘটাবার জন্য হিসেবি সাবধানতা, কিংবা হতে পারে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আর সব ঝুঁকির মতন অযথা ব্যাখ্যা ও বিবরণ হয়তো এড়িয়ে গেছেন নির্লিপ্তভাবেই।

অন্য কোন কোন দিককে ‘ঝুঁকি’ বলছি তা একটু বিশদে বলি। প্রথমত, গোসলের পুকুরসমূহ কোনো ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত উপন্যাস নয়। ঘটনার কোনটি আগে কোনটি পরে তা অনেক সময় হয়তো গুলিয়ে যেতে পারে। যদিও ধারাবাহিক বর্ণনার রীতি মোটেই আবশ্যিক নয়, একালের সাহিত্যিকেরা এটি অনুসরণ করেন না দুনিয়ার প্রায় কোথাওই। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বর্ণনার ক্ষেত্রে লেখকেরা ঐতিহ্যের অনুসারী, অত রকম পরীক্ষা নীরিক্ষায় যান না তাঁরা সাধারণত। ফলে, পাঠকেরও অভ্যাস হয়ে গেছে গতানুগতিক ধারায় লেখা উপন্যাস পড়ার। সে হিসেবে গোসলের পুকুরসমূহ অনেকটা ভিন্ন বলে পাঠকের দিক থেকে সাময়িক অসুবিধা বোধ হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে লেখা অধ্যায়গুলোকে আলাদা গল্প বলে মনে হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখানেও লেখক ঝুঁকি নিয়েছেন কোনো অধ্যায়ের নম্বর না দিয়ে। যেহেতু চরিত্রগুলো বিভিন্ন জায়গার আর বিভিন্ন রকমের, তাই এক অধ্যায়ের পর পরবর্তী অধ্যায়ে গিয়ে সংশ্লিষ্টতা বুঝতে খানিক বেগ পেতে হতে পারে। অবশ্য সচেতন পাঠকের জন্য এটি বড় সমস্যা নয়। দুই একটি অধ্যায়ে এই সংশ্লিষ্টতা বেশ স্পষ্ট। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘রেণুবালার ব্যস্তগলার দিনগুলিতে’র ঠিক পরেই ‘উড়ির চরের আয়নাবুড়ি ও মঞ্জুরির ড্রেসিংটেবিল’ অধ্যায়ের কথা।

চরিত্রের সংখ্যা অনেক বেশি এই উপন্যাসে। দুই একটি চরিত্রের ওপর আলাদাভাবে জোর দিয়ে তাঁদের মূল চরিত্র আর বাকিদের ছোট চরিত্র হিসেবে চিত্রায়িত করা হয় সাধারণত। এখানে তা করা হয়নি বলে পাঠশেষে পাঠকের স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী প্রধান কয়েকটি চরিত্র চিহ্নিত করতে না পারা পাঠককে চ্যলেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে। প্রথম অধ্যায়ের ন্যরেটর অবশ্যই মূল চরিত্র, কিন্তু অন্যান্য অনেকগুলো চরিত্রই গুরুত্বের বিচারে অপ্রধান, কিন্তু একইরকম আকর্ষণীয়, এবং তারা সংখ্যায় অনেক। সেই চরিত্রগুলোকে আরও বিশদে দেখাবার দায় না থাকলেও সুযোগ ছিল। লেখক ইচ্ছা করেই সেই সুযোগ নেননি দেখে খানিক বিস্ময় জাগে বৈকি।

ভাষার ব্যবহারে লেখক খানিকটা স্বেচ্ছাচারী। কোথাও প্রমিত, কোথাও আঞ্চলিক, কোথাও কলোকিয়াল, যা ঠিক কোনো অঞ্চলের না হয়ে একটি সার্বীকৃত কথ্যরূপে দাঁড়িয়েছে—বাংলাদেশে প্রচলিত যে রকম। প্রবন্ধের মতন গম্ভীর ভাষা যেমন আছে, তেমন আছে লঘু সংলাপ। ইংরেজি শব্দ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি, সম্ভবত বর্ণনাটাকে অর্গানিক রাখার জন্যই।

গোসলের পুকুরসমূহ’র ফ্ল্যাপে লেখা আছে পুকুর আর সময় এখানে সমার্থক। প্রচ্ছদের যে সাজেশন তাতেও সেটুকু আঁচ পাওয়া যায়। তবে সময়কে তুলে আনতে গিয়ে লেখক আরও একটি উপাদানের ব্যবহার করেছেন এই গ্রন্থে, সেই উপাদান হল স্বপ্ন। স্বপ্নে মানুষের স্থানকালের বোধ ভিন্ন হয়, বাস্তবে সময়ের যে প্রবাহ স্বপ্নে তা থাকে না। স্বপ্নের বিভিন্ন প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ উল্লেখ এবং বর্ণনা এই উপন্যাসকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবের যে ঘটনা সেগুলোকেও অবাস্তব বলে মনে হয়, বিশ্বাস হতে চায় না। মঞ্জুরির বিয়ের আগের দিন হোরাজের সঙ্গে কলাবাগানে যাওয়ার পরিকল্পনা এমনই এক বাস্তব ঘটনা যা শহরে বসে লেখকের কল্পনা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া সহজ হলেও প্রত্যন্ত গ্রামের জীবনের সঙ্গে যাদের যোগ আছে তাঁরা হয়তো উপলব্ধি করতে পারবেন এর বিশ্বাসযোগ্যতা। তেমনিভাবে আলমাসের দীর্ঘ বক্তৃতা মনে হতে পারে অবিশ্বাস্য, কেননা যে রকম সামাজিক অবস্থান আর প্রেক্ষাপটে তার অবস্থান, তাতে অমন দার্শনিকতা কিছুটা ব্যতিক্রমী তো বটেই।

গোসলের পুকুরসমূহ মনোযোগী পাঠ দাবী করে—এমন কথা বললে মনে হবে একে ‘সুখপাঠ্য নয়’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। বরং উল্টো, পড়তে পড়তে আটকে যাওয়ার উপায় নেই, নোয়াখালির আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার যেমন সাবলীল একটু পড়েই ফেইসবুকের মেসেঞ্জারে ইংরেজি হরফে বাংলা লেখাও ততটাই বোধগম্য আর সহজ। কিন্তু পড়া শেষে পাঠককে একটুখানি পিছন ফিরে দেখতে হবে, এতগুলো পুকুরে এতবার ডুব দিয়ে উঠে যাবার আগে হিসেব কষতে হবে ঠিক কোথায় কতগুলো ডুব দেওয়া হলো। একে এক হিসেবে এই উপন্যাসের সীমাবদ্ধতাও বলা যায়। আখ্যান পাঠের প্রত্যাশিত আরাম অনেক পাঠক না-ও পেতে পারেন। তবে আখ্যানের রচয়িতার দায় নেই পাঠকের প্রত্যাশা অনুযায়ী লেখার। সেইজন্যই মনে হয়েছে মেহেদী উল্লাহ তার আখ্যানে ঝুঁকি নিতে ভালোবাসেন। পাঠককে গুনে গুনে ডুব দিতে বাধ্য করলেও নিজে ডুবে ভেসে বেড়ান নিজের ইচ্ছেমতো।

গোসলের পুকুরসমূহ/ প্রকাশকাল : ২০১৮/ প্রকাশক : ঐতিহ্য/ প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিয়ের ১০ মাস পর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ স্বামীর বিরুদ্ধে
বিয়ের ১০ মাস পর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ স্বামীর বিরুদ্ধে
সিলেটে স্কুল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিগার-মারুফাদের একবেলা
সিলেটে স্কুল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিগার-মারুফাদের একবেলা
মেক্সিকোতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত অন্তত ১৮
মেক্সিকোতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত অন্তত ১৮
বরিশালে গরমে শ্রেণিকক্ষে ৫ শিক্ষার্থী অসুস্থ
বরিশালে গরমে শ্রেণিকক্ষে ৫ শিক্ষার্থী অসুস্থ
সর্বাধিক পঠিত
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ